#আমার_পূর্ণতা
#রেদশী_ইসলাম
পর্বঃ৩০ (সমাপ্ত)
রাত ১০ টা বেজে ৪৫ মিনিট। ছাঁদের একপাশে গায়ে হলুদের স্টেজ করা হয়েছে। বসার সুবিধার্থে সামনে সারি সারি দিয়ে রাখা হয়েছে সাদা কাপড়ে জড়ানো চেয়ার। কাজিন মহলের প্রায় সবাই-ই আজ উপস্থিত আছে এখানে। কেউ ব্যস্ত আড্ডা দিতে, কেউ ব্যস্ত ছবি তুলতে আর কেউ বা ব্যস্ত হাতে মেহেদী লাগাতে। পাশে ছোট ছোট ছেলে মেয়েরা দৌড়াদৌড়ি করে খেলা করছে। তাদের মায়েরা যদিও শাসিয়ে গেছে কয়েকবার তবুও কথা শোনার বালাই নেই কারোর। বাচ্চারা একসাথে হলে খেলা করবে, মজা করবে এটাই স্বাভাবিক। বিয়ের অনুষ্ঠান হওয়ার দরুন আজ কারোর চোখেই ঘুম নেই। আর আজ কেউ ঘুমাবে বলেও মনে হয় না। সবাই কোনো না কোনো কাজে ব্যস্ত।
তাফসির দুরে দাঁড়িয়ে ফোনে কথা বলছে কারও সাথে। নাহলেও প্রায় ঘন্টা খানিক হবে। প্রাচুর্য বিরক্ত হলো তা দেখে। এতো কিসের কথা যে এতোক্ষণ কথা বলতে হবে। আর কার সাথেই বা এতো কথা বলছে? এখন রিয়ার হাতে মেহেদী দেওয়া হচ্ছে। রিয়ার পরেই প্রাচুর্যের পালা। তাই প্রাচুর্য উঠে দাড়ালো তাফসিরের কাছে যাওয়ার জন্য। তখন পেছন থেকে রিয়া ডেকে বললো—
” এই প্রাচুর্য কোথায় যাচ্ছিস? আমার পরেই তোর পালা তাই এখন কোথাও যাস না। পরে দেরি হয়ে যাবে। ”
” কোথাও যাচ্ছি না আপু। এখানেই আছি। আসছি দু মিনিটে। ”
প্রাচুর্য দাঁড়ালো না। এগিয়ে গেলো তাফসিরের কাছে। এপাশটায় এখনো লাইটিং করা হয় নি তাই অন্ধকারে আচ্ছন্ন। প্রাচুর্য নিরবে যেয়ে দাঁড়ালো তাফসিরের পেছনে। কথা শুনে বুঝলো ব্যবসার বিষয়ে কথা বলছে।
তাফসির কিছুদিন হয়েছে বিজনেসে জয়েন করেছে। যদিও ইশতিয়াক চৌধুরী বলেছিলেন যে বিয়ের ঝামেলা মিটে যাক তারপরে একবারে জয়েন হওয়ার কথা। কিন্তু তাফসির শোনেনি। তার কথা এখন শুধু শুধু বাড়িতে বসে থেকে কি করবো। তার থেকে বিজনেসে জয়েন করলে সময়টাও কেটে যাবে আর কিছু শেখা ও যাবে। তাই যতো তাড়াতাড়ি যোগদান করা যায় ততই ভালো।
পেছনে কারও উপস্থিতি টের পেয়ে তাফসির পেছনে ফিরলো। প্রাচুর্যকে দেখে ফোনের ওপাশে ব্যক্তিকে বললো—
” আচ্ছা মি. আমির আমি আপনাকে পরে ফোন দিচ্ছি ”
তাফসির ফোন রেখে প্রাচুর্যের দিকে তাকিয়ে দু ভ্রু নাচালো। অর্থাৎ জিজ্ঞেস করলো—
” কি হয়েছে? ”
” কিছু হয় নি। দেখছিলাম সেই তখন থেকে কার সাথে কথা বলছেন। ”
তাফসির চোখ ছোট ছোট করে বললো—
” কেনো তুই কি ভেবেছিস যে আমি কারও সাথে প্রেম পিরিতের আলাপ করছি? ”
” এমা না না। তা ভাববো কেনো? আমি তো এমনিই…”
” দোষ ঢাকা লাগবে না আর। তুই এটাই ভেবেছিস। আমি জানি। ”
” আপনি বেশি জানেন? আমি এটা ভাবি নি বলছি তো। ”
” না ভাবলে এমন লুকিয়ে লুকিয়ে আমার কথা শুনতে আসতিস না। ”
” উফফ আপনি সব সময় আমার সাথে…”
প্রাচুর্য কথা শেষ করতে পারলো না তার আগেই পেছন থেকে শাহিন ডাক দিলো তাফসিরকে। তারা দু’জনেই শাহিনের ডাক অনুসারে পেছনে ফিরে তাকালো। শাহিন অপ্রস্তুত ভঙ্গিতে হালকা হেঁসে বললো—
” সরি ভাবি ডিস্টার্ব করার জন্য। আসলে একটা জরুরি কাজে দরকার ওকে। নিয়ে যায়? ”
প্রাচুর্য তড়িঘড়ি করে বললো—
” আরে ভাইয়া ডিস্টার্ব করার কিছু নেই আমরা এমনি কথা বলছিলাম। সমস্যা নেই যান আপনারা। ”
তাফসির শাহিনের দিকে এগিয়ে গিয়ে ভ্রু কুঁচকে জিজ্ঞেস করলো—
” কি কাজ? ওদিকের তো সব শেষ। ”
” ভাই ইশতিয়াক আঙ্কেল বলছিলো কোক শর্ট পরতে পারে। তাই জেনো বড় বাজার থেকে নিয়ে আসি। কালকে সময় পাবো না আর।”
তাফসির হাত ঘড়িতে সময় দেখে চিন্তিত ভঙ্গিতে বললো—
” এতো রাতে দোকান খোলা পাবো তো? ”
” দোকানের ছেলের নাম্বার দিয়েছে আঙ্কেল। বলেছে খোলা না থাকলে ফোন করলেই ও এসে দিয়ে যাবে সমস্যা নেই। ”
” আচ্ছা গাড়ি বের কর। আসছি আমি। ”
শাহিন মাথা নাড়িয়ে নিচে চলে গেলো। তাফসির ফিরে আসলো প্রাচুর্যের কাছে। প্রাচুর্য সেখানেই দাঁড়িয়ে তাদের কথা শুনছিলো। তাফসির এসে প্রাচুর্যের সোয়েটারের টুপি টেনে মাথায় দিয়ে বললো—
” এটা নামাবি না। আর মেহেদী দেওয়া শেষ হলেই ঘরে চলে যাবি। বেশিক্ষণ জেগে থাকার দরকার নেই। আমার আসতে দেরি হতে পারে। বুঝেছিস? ”
প্রাচুর্য উপর নিচ মাথা ঝাঁকাল। তাফসির পুনরায় বললো—
” কথার জেনো নড়চড় না হয়। ”
প্রাচুর্য মনে মনে বিরক্ত হলো তাফসিরের এতো আদেশ নিষেধ শুনে। তবুও মুখে অদৃশ্য স্কচটেপ লাগিয়ে রাখলো। তাফসির প্রাচুর্যের মুখ পর্যবেক্ষণ করলো। মুখে না বললেও বুঝে নিলো অব্যক্ত কথা গুলি। দাড়ালো না সে। উল্টো ঘুরে নিচে যাওয়ার উদ্দেশ্য পা বাড়ালো। তাফসির চলে গেলে প্রাচুর্য ও আর থাকলো না সেখানে এগিয়ে গেলো সবার দিকে।
রিয়ার মেহেদী দেওয়া শেষ। তাই প্রাচুর্যের পালা শুরু হলো। প্রাচুর্য মেহেদী দেওয়া শেষ হতে হতে প্রায় ঘন্টা দুয়েক লাগলো। তখনো তাফসির ফেরেনি। তবে প্রাচুর্য মনে মনে খুব করে চাচ্ছিলো ঘরে যাওয়ার আগে একবার তাফসিরের দেখা পেতে। কিন্তু হলো না তা। অগত্যা প্রাচুর্য হাত ভর্তি মেহেদী নিয়ে ঘরে চলে গেলো। সাথে প্রিয়তি ও আসলো। প্রাচুর্য ঘরে এসে বসতেই হেয়ার ড্রায়ার দিয়ে প্রাচুর্যের হাতের মেহেদী শুকিয়ে দিলো।
.
.
.
পরের দিন দশটার পর প্রাচুর্যের ঘুম ভাঙলো। বাকিরা এখনো গভীর ঘুমে। ওরা কালকে রাতে কেউই ঘুমায় নি। আড্ডা দিয়েছে। ফজরের আজান দিলে তখন এসে ঘুমিয়েছে। কিন্তু বড়দের কাজের কমতি নেই। তারা এখানে সেখানে ছোটাছুটি করছে। প্রাচুর্য হাতমুখ ধুয়ে বাইরে গেলো। পেটে প্রচন্ড ক্ষুধা কিন্তু কাউকে যে বলবে তার ও উপায় নেই কারন সবাই-ই ব্যস্ত। তাই নিজে নিয়েই খেয়ে নিলো। খাওয়া শেষে পুরো বাড়ি টহল দিলো একবার কিন্তু কোথাও তাফসিরের দেখা পেলো না। তাফসিরের ঘরে যে যাবে তারও উপায় নেই কারন সেখানে তাফসির বাদেও তার সাথে শাহিনের ঘুমানোর কথা। তাই ও ঘরে যাওয়ার সাহস আর করলো না প্রাচুর্য। কিন্তু দেখতেও তো ইচ্ছা করছে। কালকে রাতে কখন ফিরেছে কে জানে!!
প্রাচুর্য তাফসিরকে কোথাও না পেয়ে মুখ গোমড়া করে ফেললো। ফিরে গেলো ঘরে। ইতিমধ্যে প্রিয়তি ঘুম থেকে উঠে বসেছে। প্রাচুর্যকে দেখে হেঁসে রসাত্মক স্বরে বললো—
” কি গো বিয়ের কনে মুখ এমন বাংলার পাঁচের মতো করে রেখেছো কেনো? ”
প্রাচুর্য মুখ বেঁকিয়ে বললো—
” পুরো বাড়ি চষে ফেললাম অথচ মহারাজে দেখা পেলাম না। কোথায় গিয়েছে কে জানে ”
” বাব্বাহ তর সইছে না মোটে তাই না? গেছে হয়তো কোনো কাজে। কম তো আর কাজ না একে তো নিজের বিয়ে তার উপর আবার বোনের বিয়ে। মানে বুঝিস তো ডাবল খাটুনি। ”
” হুম বুঝেছি। এখন তাড়াতাড়ি ফ্রেশ হয়ে আয় তো। ক’টা বাজে দেখেছিস? আমি খাবার আনছি তোর জন্য। ”
প্রিয়তি উঠে প্রাচুর্যের দু পাশের গাল টেনে বললো—
” ওকে বেইব। আমি ফ্রেশ হয়ে আসি। ”
—————
রাতে গায়ে হলুদের অনুষ্ঠান শুরু হলো। স্টেজে শুধু রিয়া একা না। পাশে বিরক্তি নিয়ে প্রাচুর্য ও বসে আছে। পারছে না শুধু কেঁদে দিতে। কোথায় ভেবেছিলো বোনের গায়ে হলুদে সে মজা করবে কিন্তু তা আর হলো না উল্টো মেকআপ সেকআপ করে তাকেই জোড় করে বসিয়ে রাখা হয়েছে। ঠান্ডা হলুদের ছোঁয়া মুখে পরতেই গা শিরশির করে উঠছে তার। অথচ রিয়াকে দেখো কি সুন্দর করে বত্রিশ পা-টি বের করে গাল এগিয়ে দিচ্ছে হলুদ নেওয়ার জন্য। প্রাচুর্য রিয়ার কানের কাছে মুখ নিয়ে মিনমিন করে বললো—
” আপু এবার আমি উঠি? ”
রিয়া ফিরে তাকালো। কিছুক্ষণ চিন্তা ভাবনা করে বললো—
” আচ্ছা যা ওঠ। ”
প্রাচুর্য খুশিতে এক লাফ দিয়ে উঠে দাড়ালো। তবে এতোক্ষণ যাবত বসে থাকার কারনে পা ঝিম ধরে গেছে। কিন্তু তবুও এখানে আর থাকা যাবে না। না জানি আবার কে জোড় করে ধরে বসিয়ে দেয়। তখন রিয়ার ব্ল্যাকমেইল করে প্রাচুর্যকে হলুদ লাগাতে বাধ্য করেছিলো। বলেছিলো প্রাচুর্য হলুদ না লাগালে সেও দিবে না। তাফসিরকে ও বলেছিলো হলুদ লাগাতে কিন্তু তাফসির এতো সব ঝামেলায় পরতে চাই না। সে সরাসরি বলেই দিয়েছে যে তার শুধু বউ লাগবে। বউ পেলেই হয়েছে আর কিছু চাই না।
প্রাচুর্য ঘরে এসে হট শাওয়ার নিলো। এতোক্ষন যাবত শাড়ি পরা ছিলো তাই আর শাড়ি পরলো না। হলুদ রঙের কুর্তির সাথে ম্যাচিং করে সারারা পরে নিলো। ঠোঁটে গোলাপি লিপস্টিক ও চোখে কাজল দিয়ে গায়ে শাল জড়িয়ে বাইরে গেলো।
বাড়ির একপাশে চেয়ার গোল করে সাজিয়ে রাখা। সেখানে তাফসির সহ তার সব বন্ধু বান্ধব আড্ডা দিচ্ছে। আজকে প্রফেশনাল ফটোগ্রাফার আনা হয়েছে বলে ফটোগ্রাফির কাজটা করতে হচ্ছে না শাহিনের। তাই রিলাক্স মুডে এখানে বসে আড্ডা দিচ্ছে।
প্রাচুর্য তাফসিরের বন্ধু-বান্ধবকে দেখে সামনে এগোলো না আর। দুরেই দাঁড়িয়ে গেলো। এখান থেকে তাফসিরের পেছনের দিক দেখা যাচ্ছে। হলুদ রঙের পাঞ্জাবি পরেছে সে। তবে শুধু সে একা নয়, সব ছেলেই একই রকমের একই রঙের পাঞ্জাবি পড়া আর মেয়েরা একই রকমের শাড়ি বা ড্রেস। প্রাচুর্য ভাবলো ফিরে যাবে। কিন্তু তার আগেই তাফসিরের বন্ধু শুভর চোখে পরলো প্রাচুর্য। শুভ তাফসিরকে কনুই দিয়ে গুতা দিয়ে বললো—
” ভাই ভাবি দাঁড়িয়ে আছে। যেয়ে কথা বলে আয়। ”
শুভর কথায় তাফসির কথা বলা থামিয়ে পেছনে ফিরলো। উঠে এগিয়ে আসলো প্রাচুর্যের দিকে। প্রাচুর্য বললো—
” এখানে কি করছেন? সবাই তো ছাঁদে। ”
” তো কি করবো? নারীদের মধ্যে গিয়ে তাদের দেখবো? না বাবা আমি পারবো না তা। আমি আমার বউয়ের বাধ্য লয়াল একমাত্র হাসবেন্ড। বউকে ছাড়া অন্য কারোর দিকে তাকায় না। ”
তাফসিরের কথায় প্রাচুর্য হেঁসে ফেললো। একটু কাছে এসে টেনে টেনে বললো—
” শুনুন না….একটা কথা আছে। ”
তাফসির ভ্রু কুঁচকে বললো—
” কি কথা? ”
” আমার না ওয়াফেল খেতে ইচ্ছা করছে। খাওয়াবেন? ”
” এখন? রাতে ভাত খাস নি? ”
” খেয়েছি তো। এতো কথা বাদ। খাওয়াবেন কিনা তাই বলুন! ”
তাফসির নিষেধ করলো না। প্রাচুর্যের এক হাত মুঠোয় পুরে হাঁটতে লাগলো। সাথে বলে গেলো সবাইকে যে তারা বাইরে যাচ্ছে। কেউ জেনো না খোঁজে।
তাফসির প্রাচুর্যকে নিয়ে বাইরে এসে একটা রিকশা ডাকলো। প্রাচুর্যের দিকে তাকিয়ে বললো—
” ওঠ ”
প্রাচুর্য কথা বাড়ালো না। তাড়াতাড়ি উঠে বসলো রিকশায়। মনে মনে খুশিতে নাচতে ইচ্ছা করছে তার। এটাই তাদের প্রথম একসাথে রিকশায় চড়া। প্রাচুর্য উঠে বসতেই তাফসির ও উঠে বসলো পাশে। রিকশার হুড টেনে প্রাচুর্যকে একহাতে শক্ত করে ধরে বসলো। অন্য হাতে শাল ভালোভাবে টেনে জড়িয়ে দিলো গায়ে যাতে করে বাতাসে বেশি ঠান্ডা না লাগে।
.
.
.
.
ছাঁদে নতুন করে বড় স্টেজ করা হয়েছে বিয়ের জন্য। রাতের আধারে চৌধুরী বাড়ির ঝলমলে আলো চোখ ধাঁধিয়ে দিচ্ছে সবার। পথচারীরা রাস্তা দিয়ে যাওয়ার সময় বারবার ফিরে তাকাচ্ছে। লোকজনে গিজগিজ করছে পুরো বাড়ি। চৌধুরী বাড়ির ছেলে মেয়ের বিয়ে বলে কথা। আয়োজনে কোনো কিছুতেই কমতি রাখেন নি তিন ভাই।
তাফসির সাদা রঙের শেরওয়ানি জড়ালো গায়ে। বুকের সামনের বোতাম লাগিয়ে জেল দিয়ে চুল সেট করলো। চকোলেট কালারের ড্রেসিংটেবিলের পাশের ড্রয়ার খুলে পারফিউম লাগালো। তৎক্ষনাৎ ভেতরে ঢুকলো শাহিন। গালে হাত দিয়ে আগাগোড়া পর্যবেক্ষণ করে বললো—
” ভাই কি লাগছে তোকে। তোর বিয়ে তাতে কি হয়েছে মেয়েরা দেখে হুশ হারাবে। ”
তাফসিরের ভেতর কোনো ভাবাবেগ হলো না। ভারী কন্ঠে বললো—
” যা বলতে এসেছিস বল। ”
শাহিন হতাশ নিশ্বাস ফেলে বিছানায় বসলো। এই ছেলের ভেতর রসকষ কিচ্ছু নেই। আফসোসের সুরে বললো—
” ভাই তুই এতো বেরসিক কেনো? তোকে দেখে মনে হয় জীবনে চাচ্চু ডাক শুনতে পারবো না। ইশশ ভাবির জন্য কষ্ট হচ্ছে আমার। এইযে একটু পর যে বাসর ঘর সাজাবে সবাই তারা তো আর জানে না তাদের কষ্ট বৃথা। আচ্ছা তোরে একটা সাজেশন দি শোন, কিছু না করলেও অন্তত হাত দিয়ে ফুল গুলো এলোমেলো করে দিস যাতে কেউ কিছু বুঝতে না পারে। আর আমিও কাউকে কিছু বলবো না নে। ”
শাহিনের আজাইরা কথা শুনে তাফসির বিরক্তি নিয়ে তাকালো। বললো—
” আমার সমস্যা আছে কি না সেটা কি তোর সামনে দেখাবো নাকি যার সামনে দেখানোর দরকার তাকে দেখাবো? তবে তোকে এতো চিন্তা করতে হবে না। চাচ্চু ডাক শোনা থেকে বঞ্চিত করবো না। ”
তাফসিরের কথায় শাহিন নাটকীয় ভঙ্গিতে হাফ ছেড়ে বললো—
” যাক তোর কথা শুনে শান্তি পেলাম। অন্তত শিওর হলার যে তোর মধ্যে কোনো সমস্যা নাই। ”
তাফসির কটমটে দৃষ্টিতে তাকাতেই থতমত খেয়ে গেলো। ভ্যাবলার মতো হেঁসে বললো—
” ওই চাইয়া আছোস ক্যান কি কবি ক। তুই কইলেই তো আমি কমু হ। ”
তাফসির শ্বাস ফেললো। পায়ে নাগড়া জুতা পরে রুম থেকে বের হতে হতে বললো—
” তুই থাক তোর লজিক লেস ফাউল কথা নিয়ে। আমি চললাম। ”
.
.
.
.
অবশেষে অনেক অপেক্ষা প্রতীক্ষার পর দু জোড়া ভালোবাসা পূর্ণতা পেলো। তৃষ্ণার্ত হৃদয় পেলো নিবারনের উপায়। তাফসির পেলো তার হৃদয় হরনকারী নারীকে এবং আরফান পেলো তার কাঙ্ক্ষিত ভালোবাসার মানুষকে।
বর্তমানে প্রাচুর্য বসে আছে তাফসিরের ফুলে ফুলে সজ্জিত বিছানায়। রজনীগন্ধা,গোলাপ এবং জারবেরা ফুলের সুঘ্রাণে ঘর ম-ম করছে। অন্যদিকে রিয়া আজ শশুর বাড়ি যায় নি। বিয়ে আজ হলেও বিদায় হবে কাল। অনেক রাত হয়েছে বিধায় আজ রাতে তারা চৌধুরী বাড়িতেই থাকাবে এমনই সিদ্ধান্ত নিয়েছে ইশতিয়াক চৌধুরী। তাই কোনো বিষয়ে জোরাজোরি ও করেনি কেউ।
প্রায় ঘন্টাখানেক হয়েছে প্রাচুর্য একভাবে একই জায়গায় বসে আছে। অথচ তাফসিরের খোঁজ নেই কোনো। প্রাচুর্য বিছানা ছেড়ে উঠে দাড়ালো। স্লাইডিং ডোর খুলে বারান্দায় যেয়ে দাঁড়াতেই হিম শীতল বাতাসে শরীরের লোম দাঁড়িয়ে গেলো। প্রাচুর্য ঘাড় ঘুরিয়ে পাশের বেলকনিতে তাকালো। বেলকনির দরজা বন্ধ। গাছ গুলো মনে হচ্ছে তার দিকে তাকিয়ে আছে। তাকে মিস করছে। প্রাচুর্যের মায়া হলো। দীর্ঘ কতোগুলো বছর এ ঘরটায় কাঁটালো সে। আর আজ থেকে অন্যের ঘরে থাকতে হবে তার। প্রাচুর্য দীর্ঘশ্বাস ফেলে আকাশের দিক তাকলো। গোল থালার মতো চাঁদ উঁকি দিচ্ছে আকাশে। সেই চাঁদের দিকে তাকিয়ে মনে পরলো তার প্রথম প্রেমে পড়ার কথা, কাউকে ভালোবাসার কথা। আর যেদিন সে জানতে পারলো তাফসিরের মনের কথা। তার এখনো স্পষ্ট মনে আছে সেই কথা।
এইতো সেদিনের কথা,যেদিন সে তাফসিরের রুমে এসেছিলো তাফসিরকে ডাকতে। কিন্তু ঘরের কোথাও তাফসিরকে না পেয়ে ফিরে যাওয়ার জন্য উদ্যত হতেই তার চোখ পরলো টেবিলের ওপর পরে থাকা কালো রঙের একটি নোটবুকের উপর। উপরে রেড ডেভিল চোখ আঁকা আর নিচে বড় বড় করে লেখা Don’t touch my Diary. Coz it’s personal.
নিষিদ্ধ জিনিসের প্রতি বরাবরই মানুষের কৌতুহল বেশি। প্রাচুর্যের ও তাই হলো। সে কৌতুহল বশত কলম রাখা জায়গাটা মেলে ধরলো। চোখের সামনে ভেসে উঠলো পেঁচানো হাতের লেখা। যেখানে কয়েক প্যারা তাফসিরে অব্যক্ত কথা লেখার শেষে বড় বড় অক্ষরে লেখা ” ভালোবাসি প্রাচুর্য ” সেদিন সে মুহুর্তে থমকে গিয়েছিলো প্রাচুর্য। বিশ্বাস করতে কষ্ট হচ্ছিলো এ চরম সত্যটি। কিন্তু সে বুঝতে পেরেছিলো যে এটাই সত্যি। কারন সে দেখেছে তার প্রতি তাফসিরের কেয়ারিং, অধিকারবোধ। কিন্তু সব জেনে শুনেও সে কিচ্ছুটি বলে নি। স্বাভাবিক ভাবেই থেকেছে। তারপর আসলো সেদিন যেদিন মিসেস ফারাহ এসে এ খবরটি জানালেন। এমনকি তার সব প্লানিং ও বললেন প্রাচুর্যকে। তখন প্রাচুর্য সব শুনে না করেনি কারন ততোদিনে প্রাচুর্য নিজেই তাফসিরের প্রতি দুর্বল হয়ে পরেছিলো। ভালোবাসা কখন কিভাবে হয় বলা যায় না। তবে প্রাচুর্য জিজ্ঞেস করেছিলো মিসেস ফারাহর কাছে যে সে কিভাবে জানলো। মিসেস ফারাহ উত্তর দিয়েছিলেন যে তিনি জিজ্ঞেস করেছিলেন তাফসিরের কাছে একদিন রাতে। তাফসির অস্বীকার করেনি বরং অকপটে স্বীকার করেছিলো তার ভালোবাসার কথা। আর ভালোবাসা স্বীকার করতে ভয় কিসের!!
হঠাৎ পেটে কারও ঠান্ডা শীতল হাতে স্পর্শে কেঁপে উঠলো প্রাচুর্য। সাথে ভঙ্গ হলো এতোক্ষনের চিন্তা ভাবনা। তাফসির প্রাচুর্যের উন্মুক্ত পেট খামচে ধরে গলায় মুখ গুঁজে ধীর কন্ঠে বললে—
” এই ঠান্ডার মধ্যে বাইরে কেনো? তাও আবার গায়ে গরম কিছু নেই। সেধে পরে অসুস্থ হতে চাচ্ছিস? স্বামীর হাতের সেবা পেতে চাচ্ছিস? ”
প্রাচুর্য উত্তর দিলো না। উল্টো তাফসিরের বুকের সাথে হেলান দিয়ে দাঁড়ালো। তাফসির নিজের সাথে আষ্টেপৃষ্টে জড়িয়ে ধরলে প্রাচুর্যকে। প্রাচুর্য একই ভঙ্গিতে চাঁদের দিকে তাকানো অবস্থায় বললো—
” একটা প্রশ্ন জিজ্ঞেস করবো? ”
প্রাচুর্যের কথায় তাফসির প্রাচুর্যের গলা থেকে মুখ উঠালো। সোজা হয়ে বললো—
” কি প্রশ্ন? ”
” আপনি কবে থেকে ভালোবাসেন আমায়? ”
তাফসির অপ্রস্তুত হলো। হালকা কেশে জিজ্ঞেস করলো—
” বলতেই হবে? ”
প্রাচুর্য উপর-নীচ মাথা নাড়ালো। তাফসির নিজেকে সামলে নিয়ে বললো—
” প্রথম দিন থেকেই। অর্থাৎ বাংলাদেশে ফিরে তোকে দেখলাম যেদিন। তাছাড়া এর আগে কখনো তোর দিকে বউ বউ নজরে তাকায়নি। বোন বোন নজরে তাকিয়েছি। কিন্তু সেদিন তোর সদ্য ঘুম থেকে ওঠা ফোলা ফোলা চোখ আর বোকাবোকা চাহনি দেখে কিছু একটা ফিল করেছিলাম। তারপর থেকে যতো দেখেছি ততো ভালোবেসেছি। আর এখন সেটা অসীম হয়েছে। ”
প্রাচুর্য পেছনে ফিরলো তবে হাতের বাঁধন আলগা হলো না তাফসিরের। প্রাচুর্য তাফসিরের চোখের দিকে তাকিয়ে বললো—
” এভাবে আজীবন ভালোবেসেই যাবেন তো? ”
তাফসির নিজের উষ্ণ পুরুষালি ঠোঁট দ্বারা প্রাচুর্যের কৃত্রিম রঙে রাঙানো ঠোঁটদ্বয়ে গভীর পরশ দিলো। কপালের সাথে কপাল ঠেকিয়ে বললো—
” যতোক্ষণ দেহে প্রান থাকবে ততোক্ষণ পর্যন্ত কমবে না ”
প্রাচুর্য ছলছলে চোখে হাসলো। প্রাচুর্যের চোখের দিকে তাকিয়ে তাফসির হুট করে কোলে তুলে নিলো প্রাচুর্যকে। প্রাচুর্য ভয়ে দুহাতে তাফসিরের গলা জড়িয়ে ধরলো। তাফসির প্রাচুর্যকে রুমের ভেতর নিয়ে যেতে যেতে ছাড়া গলায় গান ধরলো। উচ্চারণ করলো গানের ক’টা লাইনঃ
যন্ত্রে বাঁধা মন ছিলো ক্লান্ত অসহায়
অর্থে কেনা সুখ ম্রিয়মাণ দুঃখের ছায়ায়
আর নয় সময় উদ্দেশ্যহীন মিছিলে
তুমি সেই পূর্ণতা আমার অনুভবে
আর নয় আাধার,তুমি স্বপ্নে ডেকে নিলে
ভরে মন অন্তহীন রঙিন এক উৎসবে
প্রাচুর্য প্রশান্তির হাসি হাসলো। অতঃপর প্রাচুর্যের পিঠ ঠেকলো নরম বিছানায়। পূর্ণিমা রাতে রচিত হলো এক নতুন গল্প।
#সমাপ্ত