আমার পূর্ণতা পর্ব-২৯

0
912

#আমার_পূর্ণতা
#রেদশী_ইসলাম
পর্বঃ ২৯

দুপুরে খাওয়া দাওয়া শেষে সবাই এসে বসলেন ড্রয়িং রুমে। তবে ইশতিয়াক চৌধুরী একটু চিন্তিত আছেন। তার কারণ প্রাচুর্যকে এখনো কিছু জানানো হয় নি বিয়ের ব্যাপারে। আসলে তিনি সময় পান নি।
ইশতিয়াক চৌধুরী চোখের ইশারায় স্ত্রীকে ডাকলেন। মিসেস ফারাহ গিয়ে ইশতিয়াকের পাশে দাঁড়িয়ে খানিকটা ফিসফিসিয়ে জিজ্ঞেস করলেন—

” কি হয়েছে ডাকছো কেনো? ”

মিসেস ফারাহর মতো ইশতিয়াক চৌধুরীও ফিসফিস করে জবাব দিলেন—
” বলছি কম বেশি সবাইকেই তো জানানো হলো যে রিয়ার বিয়ের দিন তাফসির আর প্রাচুর্যের বিয়ে হবে। কিন্তু যার বিয়ে তাকে মানে প্রাচুর্যকে তো কিছু বলা হলো না। ”

” কি করবো এখন? ”

” তুমি এক কাজ করো, আমরা যতোক্ষণ এখানে বেয়াইন আর আরফানের সাথে কথা বলছি তুমি ততোক্ষণে প্রাচুর্যের সাথে কথা বলে আসো। দেখো ওর কোনো সমস্যা আছে নাকি। তুমি এসে আমাকে জানালে তবেই ওদের বিয়ের সিদ্ধান্তে যাবো। নাহলে ওরা এখন যেভাবে আছে সেভাবেই থাকবে যতোদিন চাইবে। ”

” ঠিক আছে তুমি পাঁচ মিনিট অপেক্ষা করো। আমি শুনে আসি। ”

মিসেস ফারাহ দাঁড়ালেন না। চললেন অদুরে দাঁড়িয়ে থাকা প্রাচুর্যের দিকে।
প্রাচুর্য তখন কথা বলছিলো আরফানের ছোট বোন অহনার সাথে। মিসেস ফারাহ কাছাকাছি এসে অহনার দিকে তাকিয়ে বললেন—
” অহনা মা দেখে আসো তো তোমার ভাবি কি করছে। ও তো একা একা আছে একটু গল্প ও করে আসো। পরিচয় ও হলে তাতে তাই না? ”

মিসেস ফারাহর কথায় অহনা হেঁসে মাথা দুলিয়ে চলে গেলো রিয়ার রুমের দিকে। অহনা চলে যেতেই প্রাচুর্য মিসেস ফারাহর দিকে ফিরলো। জিজ্ঞেস করলো—
” কি হয়েছে বড় মা? কিছু কি বলবে? ”

মিসেস ফারাহ মাথা ঝাঁকিয়ে প্রাচুর্যের হাত টেনে রুমের দিকে নিয়ে যেতে যেতে বললেন—
” চল কথা আছে। ”

প্রাচুর্য ও কোনো কথা না বলে গেলো মিসেস ফারাহর সাথে। মিসেস ফারাহ প্রাচুর্যের রুমে এসে হাত ছাড়লেন। প্রাচুর্যের মাথায় হাত বুলাতে বুলাতে বললেন—
” শোন না মা। একটা কথা ছিলো। ”

প্রাচুর্য মিষ্টি হেঁসে বললো—
” বলো না বড় মা কি বলবে? ”

” বলছি যে আমরা না একটা সিদ্ধান্ত নিয়েছি। ”

মিসেস ফারাহর কথা শুনে সন্দিহান চোখে তাকালো প্রাচুর্য। ঠোঁট কামড়ে ভাবলো যে কি সিদ্ধান্ত হতে পারে। মিসেস ফারাহ প্রাচুর্যের মুখ পরখ করলেন। তারপর বললেন—
” এতো চিন্তার কিছু নেই। আমরা ভাবছিলাম যে রিয়ার বিয়ের দিন যদি তোদের ও বিয়েটা দিয়ে দেওয়া যায় তাহলে ভালো হয়। কি বলিস?”

মিসেস ফারাহর কথা শুনে প্রাচুর্য আঁতকে উঠে বললো—
” কি বলছো বড় মা? এতো তাড়াতাড়ি? ”

” সমস্যা কি আম্মা? বিয়ে তো হয়েই গেছে তোদের। এখন শুধু অনুষ্ঠানের মাধ্যমে সবাইকে জানানো হবে। ”

” কেউ জানে না ভাবছো বড় মা? আগের দিন পাশের বাসার রুমা আন্টি কি বলছিলো জানো? ”

” কি বলছিলো?”

” বলছিলো যে ‘কিরে প্রাচুর্য শুনলাম তোর নাকি বিয়ে টিয়ে হয়ে গেছে তাও নাকি আবার তোর বিদেশ ফেরত বড় চাচাতো ভাইয়ের সাথে?’ আমি শুনে বললাম ‘ তুমি কি করে জানো আন্টি?’ উনি বললো ‘ সে জানি একভাবে। সত্যি কি না তাই বল। ‘ আমি বললাম ‘ হ্যাঁ সত্যি ‘ উনি বললো ‘ বাহ লুকিয়ে লুকিয়ে বিয়ে করে ফেললি তাও আবার চাচাতো ভাইকে অথচ আমাদের জানালি ও না’ আমি বললাম ‘ লুকিয়ে না আন্টি। উনি দেশে ফিরলে অনুষ্ঠান করে সবাইকে জানানো হবে তাই জানায় নি কাউকে। ‘ আচ্ছা বড় মা উনি কি করে জানলো বলো তো।”

” আমার মনে হয় কাকলি বলেছে। দাড়া ও কালকে আসুক বাড়ি পরিষ্কার করতে তখন দেখবো বাড়ির ভেতরের কথা বাইরে কেনো বলে বেড়াচ্ছে। এখন সেসব বাদ দে তুই বল তোর কোনো সমস্যা আছে নাকি? ”

প্রাচুর্য কাঁদো কাঁদো মুখে বললো—
” কিন্তু বড় মা আমার কতো ইচ্ছা ছিলো আপুর বিয়েতে মজা করবো। কতো কতো ড্রেস কিনবো। বর যাত্রীর গেট ধরবো। ওইদিন যদি আমার ও বিয়ে হয় তাহলে তো আমি কিচ্ছু করতে পারবো না বড় মা। আমার কোনো ইচ্ছা পুরন হবে না। ”

” সেসব আমার উপর ছেড়ে দে। আর তুই তোর মতো আনন্দ করবি। আমরা তো শুধু সেদিন জানাবো সবাইকে তোদের বিয়ের কথা। তোর যা যা ইচ্ছা হয় সব করিস। ”

” আচ্ছা বেশ তাহলে আমার আর কি? তোমরা যা ভালো বুঝো করো। আমার আর কোনো সমস্যা নেই। ”

প্রাচুর্যের কথায় মিসেস ফারাহ হাঁপ ছেড়ে বাঁচলেন। তিনি তো ভয় পেয়ে গিয়েছিলেন। ভেবেছিলেন মেয়েটা বোধহয় রাজি হবে না। কিন্তু না মেয়েটা দু’বারের একবার ও দ্বিমত করলো না। অবশ্য করবে কিভাবে সে নিজেও তো ছেলের প্রেমের হাবুডুবু খাচ্ছে। এ বয়স কি আর তারা পার করে আসেন নি নাকি!
**
আগামী দু সপ্তাহ পর দু পরিবারের সম্মতিতে বিয়ের ডেট ফিক্সড হলো। আরফান দের পরিবারের আত্মীয় স্বজনরা তেমন নেই বললেই চলে তাই বর যাত্রী তে শুধু আরফানের বন্ধু বান্ধবরা-ই আসবে।
আরফান বাড়িতে এসে ফ্রেশ হয়ে ফোন হাতে নিলো। অনেকক্ষণ যাবত রিয়ার সাথে কথা হয় না। তাদের বাড়িতে থাকা কালীন ও মেয়েটা কথা বলে নি তার সাথে। অযুহাত হিসেবে দেখিয়েছে বাড়িতে সবাই আছে। সবার সামনে কথা বলতে লজ্জা লাগে। তাই আরফান ও আর জোর জবরদস্তি করে নি।
আরফান রিয়ার নাম্বারে কল দেওয়ার আগেই দরজায় ঠকঠক শব্দ হলো। আরফান গলার স্বর উঁচু করে জানান দিলো ভেতরে আসার। তখনি ভেতরে প্রবেশ করলেন সিরিনা বেগম। মা’কে দেখে আরফান বিছানা ছেড়ে উঠে দারালো। হাঁসি মুখে জিজ্ঞেস করলো—

” কি ব্যাপার? আম্মাজান আমার ঘরে যে? ”

” ফ্রী আছিস? ”

” হ্যাঁ আছি মা। বলো ”

” তাহলে আমার রুমে আয়। ”

” আচ্ছা যাও আসছি। ”

সিরিনা বেগম কথা না বাড়িয়ে নিজের রুমের দিকে গেলেন। পিছু পিছু আরফান ও গেলো। সিরিনা বেগম আরফানকে খাটের উপর বসতে বললেন। আরফান বসে ভ্রু কুঁচকে সিরিনা বেগমের দিকে তাকিয়ে বললেন—
” কিছু বলবে মা?”

সিরিনা বেগম উত্তর দিলেন না। আলমারি খুলে লকার থেকে কয়েক বান্ডিল টাকা বের করলেন। তা দেখে আরফান অবাক হয়ে বললো—
” টাকা বের করছো কেনো মা? আর এতো টাকা কোথায় পেলে তুমি? ”

সিরিনা বেগম মুচকি হেঁসে আরফানের পাশে এসে বসলেন। আরফানের এক হাত উঁচিয়ে টাকা গুলো হাতে দিতে দিতে বললেন—

” এগুলো তোর বাবার পেনশনের টাকা। রেখে দিয়েছিলাম অহনার বিয়ের জন্যে। কিন্তু এখন টাকা গুলো তুই রাখ। বিয়েতে দরকার পরবে। আর কম খরচ তো হয় না বিয়েতে। এই টাকা গুলো থাকলে তোর খরচ কিছুটা হলেও কমবে। ”

আরফান কন্ঠে বিরোধিতা এনে বললো—
” না মা এই টাকা গুলো লাগবে না আমার। তুমি অহনার জন্য রেখে দেও। ওর বিয়ের জন্য। আর এদিকটা আমি সামলাতে পারবো। সমস্যা নেই। ”

” হ্যাঁ সেই কতো সামলাতে পারবে তা কি আর জানি না আমি? নতুন চাকরি। এখনো ওতো টাকা হয়ে পারে নি যে তুমি একা সামলাতে পারবে সব। ”

” তবুও মা। আমি নিতে পারবো না এই টাকা। রেখে দেও তুমি। ”

” উফফ বেশি বুঝিস না তো। আমি বলেছি তো বিয়েতে লাগবে। আর এখন যেহেতু চাকরি করছিস সেহেতু অহনা কে নিয়ে সমস্যা নেই। ওর বিয়ের জন্য টাকা গুছানো হয়ে যাবে। এতো চিন্তা করিস না। আল্লাহর উপর ভরসা রাখ। যা হবে সব ভালোই হবে। ”

আরফান এগিয়ে এসে মায়ের মুখোমুখি দাঁড়ালো। সিরিনা বেগমের মুখ দু’হাতে আঁজলা ভরে ধরে জিজ্ঞেস করলো—

” মা? এই বিয়েতে তুমি খুশি তো? তোমার পছন্দ অনুযায়ী বিয়ে করতে পারলাম না মা। তুমি আমাকে ক্ষমা করে দিও। আমি রিয়াকে অনেক ভালোবাসি। ”

আরফানের কথায় সিরিনা বেগমের চোখ দিয়ে জল গড়ালো। যাক ছেলেটা যে অন্তত তার পছন্দ অপছন্দের কথা ভাবছে তা-ই অনেক। ক’জনই বা এরকম টা ভাবতে পারে। চোখে অশ্রু থাকলেও সিরিনা বেগম হাঁসি মুখে বললেন—

” আমি খুশি আব্বা। অনেক খুশি। তোর ভালোবাসার উপর আমার বিশ্বাস আছে। আমি জানি তুই এমন কোনো মেয়েকে আনবি না যে তোর বা এই পরিবারের জন্য ক্ষতিকর। তাছাড়াও আমি সবকিছু ভালোই দেখলাম। ”

আরফান সিরিনা বেগমের চোখের পানি মুছিয়ে দিয়ে বললো—
” ওনারা খুব ভালো মানুষ মা। আর রিয়া ও। দেখো ও এমন কোনো কাজ করবে না যাতে তোমার কষ্ট হয়। আর কখনো যদি ওর কোনো কাজে কষ্ট পেয়ে থাকো তাহলে নিজের মেয়ে ভেবো ওকে ক্ষমা করে দিয়ো। সাথে শিখিয়ে পড়িয়ে নিজের মন মতো করে নিয়ো। ”
.
.
.
.
বেলকনিতে সদ্য লাগানো লাল টগর গাছ টা নেড়ে চেড়ে দেখছিলো প্রাচুর্য। এটা আজ বিকালে লাগিয়েছে। গাছ টা তাফসির উপহার দিয়েছে তাকে। কি সুন্দর থোকায় থোকায় ফুল ধরে আছে। গাছটা এনে প্রাচুর্যের বেলকনির সৌন্দর্যে হাজার গুন বেড়ে গিয়েছে। সে দেখেছিলো শেষ বিকেলের রোদ যখন এই গাছটির উপর পরেছিলো তখন কি সুন্দর স্নিগ্ধ আর শান্তি লাগছিলো।

” কি করছিস? ”

পুরুষালী ভারি কন্ঠস্বরে প্রাচুর্য নড়েচড়ে বসলো। পেছনে না ফিরলেও অনায়াসেই বুঝতে পারলো কন্ঠের মালিককে। প্রাচুর্য উচ্ছ্বসিত কন্ঠে বললো—

” ফুল গুলো দেখছিলাম তাফসির ভাই। দেখুন কি সুন্দর দেখাচ্ছে। ”

তাফসির কথা বললো না। এগিয়ে এসে প্রাচুর্যকে চেয়ার থেকে টেনে দাঁড় করালো। প্রাচুর্য শুধু ফ্যালফ্যাল দৃষ্টিতে তাকালো। তাফসির চেয়ারে নিজে বসে টান দিয়ে প্রাচুর্যকে কোলের উপর বসিয়ে কোমড় জড়িয়ে ধরলো। চমকে উঠলো প্রাচুর্য। অলরেডি শরীর কাঁপা-কাঁপি শুরু হয়ে গেছে তার। তা বোধহয় তাফসির ও বুঝতে পারলো। তাই সে আরও শক্ত করে চেঁপে ধরলো নিজের সাথে। কানের পাশ থেকে চুল সরিয়ে দাঁত বসালো গলার পাশে। প্রাচুর্য অস্ফুট স্বরে গুঙিয়ে উঠলো। নখ বসিয়ে দিলো তাফসিরের হাতের পিঠে। তাফসির নিজের কাজ সম্পন্ন করে দাঁত সরিয়ে ফেললো। কন্ঠ খাদে নামিয়ে বললো—

” বল আর ভাই বলবি? যদি আবার বলিস তাহলে ডাবল হবে। ”

প্রাচুর্য উত্তর দিতে পারলো না। তার চোখ এখনো বন্ধ। ভারী নিশ্বাস আছড়ে পরছে। তাফসির কামড় দেওয়া জায়গায় ঠোঁট ছোঁয়ালো। বললো—

” আজকের মতো মাফ করে দিলাম। পরের দিন ভাই শুনলে সেদিন আর কোনো মাফ টাফ হবে না ডাইরেক্ট পদক্ষেপ নেওয়া হবে মনে রাখিস। ”

এর মধ্যে রুম থেকে ফোনের আওয়াজ আসলো। প্রাচুর্য এক সেকেন্ড ও দেরি করলো না তড়িৎ গতিতে উঠে দৌড় লাগালো রুমে। তাফসির মুচকি হেঁসে ঠাঁই বসে থাকলো এক জায়গায়।
প্রাচুর্য রুমে এসে ফোন হাতে নিয়ে দেখলো প্রিয়তির কল। প্রাচুর্য চটপট রিসিভ করে কানে ঠেকিয়ে বিছানার মাঝখানে যেয়ে বসলো।

” কি ব্যাপার প্রাচু রাণী? কি খবর? আমাদের তো ভুলেই গেছেন। ”

প্রিয়তির কথায় প্রাচুর্য হালকা হেঁসে বললো—
” তোকে কি ভুলা যায় দোস্ত? একটু ব্যস্ত ছিলাম শুধু। ”

” হুম হুম তা কি আর আমরা জানি না ভেবেছেন? ”

প্রাচুর্য ভাবলো তার আর তাফসিরের বিয়ের কথা এখনি জানিয়ে দেবে প্রিয়তি কে। আর কতোদিন লুকিয়ে রাখবে। আজ হোক বা কাল সবাই তো জানবেই। তবে প্রাচুর্যের ভয় হলো। যদি প্রিয়তি ভুল বোঝে তাকে? বা যদি কষ্ট পায় তখন কি করবে সে? বেস্ট ফ্রেন্ড বলতে তো এই এক জনই। যাকে নিজের সমস্ত কথা শেয়ার করা যায়। কিন্তু সব শুনে যদি প্রিয়তি আর তার বন্ধুত্ব নষ্ট হয়ে যায় তখন? কি হবে বা না হবে ভাবতে ভাবতে প্রাচুর্য চিন্তায় পরে গেলো। প্রাচুর্য কোনো কথা বলছে না দেখে প্রিয়তি বললো—

” কিরে কথা বলছিস না কেনো? ”

প্রাচুর্য আর ভাবলো না। যা হওয়ার হবে। কিন্তু আর লুকিয়ে রাখা সম্ভব না। প্রাচুর্য হালকা কেশে গলা পরিষ্কার করে বললো—

” দোস্ত কিছু কথা আছে। প্রমিজ কর রাগ করবি না। ”

প্রিয়তি বললো—
” কি কথা বল। ”

প্রাচুর্য মনে একরাশ ভয় নিয়ে বললো—
” আমার আর তাফসির ভাইয়ের বিয়ে হয়ে গিয়েছে হুট করে আর অনুষ্ঠান কিছুদিন পর। প্লিজ দোস্ত রাগ করিস না আসলে…”

প্রাচুর্যের কথা শেষ করতে দিলো না প্রিয়তি। তার আগেই গা ছাড়া ভাব নিয়ে বললো—
” ওহ এই কথা। জানি তো। ভাবলাম অন্য কিছু বলবি। ”

প্রাচুর্য বিস্মিত হলো। সাথে সাথে প্রায় চিল্লিয়েই বললো—
” তুই কিভাবে জানলি? ”

প্রাচুর্যের গলার স্বর পেয়ে তাফসির রুমে আসলো। প্রাচুর্যের পাশে বসে জিজ্ঞেস করলো—
” কি হয়েছে? কোনো সমস্যা? ”

প্রাচুর্যের চোখে মুখে এখনো বিস্মিত ভাব। কিছু বলতে যাবে তার আগেই ফোনের ওপাশ থেকে প্রিয়তি বললো—
” তাফসির ভাই বলেছে। তাও অনেকদিন আগেই। এতোদিন শুধু তোর বলার অপেক্ষা তে ছিলাম। ”

প্রাচুর্য দ্বিতীয় দফায় বিস্মিত হলো। অবাক চোখে ঘাড় ঘুরিয়ে তাফসিরের দিকে চাইলো। তাফসির এতোক্ষণ তার দিকেই তাকিয়ে ছিলো। প্রাচুর্য তাকাতেই ভ্রু নাচিয়ে জিজ্ঞেস করলো কি হয়েছে? প্রাচুর্য বললো—
” আপনি প্রিয়তি কে বলেছেন আমাদের বিয়ের কথা? কবে বললেন? আমাকে কেউই তো কিছু জানান নি। আমি উল্টো চিন্তায় চিন্তায় অস্থির হয়ে যাচ্ছিলাম যে ওকে কিভাবে জানাবো। ”

প্রিয়তি বললো—
” ওহ তোমার রোমিও আছে নাকি? আচ্ছা তাকে সময় দেও এখন। আমি পরে কথা বলবো কেমন? টাটা। ”

প্রিয়তি ফোন কাটতেই তাফসির আয়েশ করে প্রাচুর্যের কোলে মাথা রাখলো। প্রাচুর্যের হাত নিয়ে কপালে রেখে বললো—
” মাথা টিপে দে। ”

প্রাচুর্য হাত দিয়ে মাথা মালিশ করতে করতে অস্থির ভঙ্গিতে বললো—
” বলুন না কবে বললেন ওকে? আর কিভাবে বললেন? ও না আপনার ব্লক লিস্টে ছিলো? ”

তাফসির চোখ খুলে বললো—
” আগের দিন ওর সাথে দেখা হয়েছিলো আমার। ও মনে হয় প্রসেনজিৎ স্যারের কাছে পড়ে। আর স্যারের সাথে দেখা করতে গিয়েছিলাম আমি। তখন ওকে দেখে ডাক দিলাম। ও আমাকে দেখে ভয়ে ভয়ে কাছে এসে বললো—জ্বি ভাইয়া বলুন। কি বলবেন? ”

” তারপর? ”

” ও ভেবেছিলো আমি বোধহয় ওকে বকা দেওয়ার জন্য ডেকেছি। তাই ও ভয়ে ছিলো। তা ওর মুখভঙ্গি দেখেই বোঝা যাচ্ছিলো। কিন্তু ওকে যখন সবকিছু বললাম তখন ও অবাক হয়েছিলো। তবে রাগ করে নি। আর আমার কাছে ক্ষমা ও চেয়েছিলো। এখন সব ঠিকঠাক। ”

” বাহ আপনি দেখছি অনেক ফাস্ট। আমার আগেই সবকিছু সেটিংস করে নিলেন। আমি আরও ভয়ে ছিলাম। ভেবেছিলাম ও হয়তো আমার সাথে আর কোনোদিন কথায় বলবে না। ”

” সবাই তোর মতো বোকা নাকি? যদি আমি ওকে না বলতাম বা না বুঝাতাম তাহলে তুই ঠিকঠাক ভাবে কখনোই বলতে পারতিস না। ও এমনিতে ভালো আছে তবে সে সময় কেনো এমন করেছে তা ওই ভালো জানে। আর একটা জিনিস কি জানিস? আমার প্রতি ওর এট্রাকশন ছিলো। যেটা সময়ের সাথে সাথে চলে ও গেছে। বুঝেছিস? ”

প্রাচুর্য বুঝদার ভঙ্গিতে উপরনিচ মাথা নাড়লো। কারন তাফসির ভুল কিছু বলে নি। সে আসলেই গুছিয়ে কিছু বলতে পারতো না। আর এট্রাকশনের কথা টা তো ও আগেই বুঝেছিলো।
.
.
.
.
আজ সোমবার। বিয়ের আর বেশিদিন নেই। কালকে গায়ে হলুদ। আর তার একদিন পর বিয়ে। অলরেডি ইভেন্ট ম্যানেজমেন্টের লোকরা তাদের কাজ শুরু করে দিয়েছে। বিয়ে বাড়িতেই হবে। তবে আরফান আর রিয়ার রিসিপশনটা সেন্টারে হবে। তাফসিরদের টা ও করতে চেয়েছিলো ইশতিয়াক চৌধুরী। কিন্তু তাফসির কড়াকড়ি ভাবে নিষেধ করে দিয়েছে যে কোনো রিসিপশন হবে না। সে সাদামাটা ভাবেই চাই সবকিছু। বিয়ের অনুষ্ঠান করছে করুক। আর কিছু চাই না তার। এদিক দিয়ে প্রাচুর্যের ও কোনো আগ্রহ দেখা গেলো না। সে শুধু বোনের অনুষ্ঠান গুলোতে আনন্দ করতে চাই। আর আগের বার বিয়েরদিন বুঝেছিলো যে এটা কতো ঝামেলার। ওর তো মুখে হাসি টেনে রাখতে রাখতে মুখই ব্যাথা হয়ে যাচ্ছিলো। তার ওপর আবার ওই ভারী জামাকাপড় নিয়ে অতক্ষণ বসে থাকা। তার পক্ষে আর সম্ভব না। তার থেকে ভালো একদিন হচ্ছে ওই একদিনেই হোক। আর দরকার নেই। এমন কি গায়ে হলুদ ও চাই না সে। বরং বোনের বিয়ে ইন্জয় করুক প্রাচুর্য তাই ই ভালো হবে।
আজ তাদের শপিং শেষ হলো। পুরো এক সপ্তাহ এই শপিংয়ে দৌড়াদৌড়ি করতে করতে সবার নাজেহাল অবস্থা। বাড়িতে অলরেডি আত্মীয়স্বজনে গিজগিজ করছে। কারোরই একটু দম ফেলার সময় পর্যন্ত নেই। তাফসির এবং তার বন্ধুবান্ধব রা ডেকরেশনের দিকটি তদারকি করছে। বাড়ির পেছনের জায়গা টুকু তে খাওয়া দাওয়ার ব্যবস্থা করা হয়েছে। তবে বিয়ে বা গায়ে হলুদের অনুষ্ঠান ছাদে হবে। তাই সেই অনুযায়ী ছাঁদে বড় করে স্টেজ করা হয়েছে। থিম সাদা এবং গোলাপি।
চৌধুরী বাড়ি আলোয় ঝলমল করছে। প্রবেশদ্বারে সাদা পর্দার মতো কাপড়ের ওপর আর্টিফিশিয়াল ফুল এবং হলুদ ঝাড়বাতি দিয়ে ডেকোরেশন করা। আবার নিচে দুপাশে ছোট ছোট সাদা রং করা টুল তার ওপর ছোট নকশা করা মাটির কলসি থেকে গাঁদাফুল বের হচ্ছে এমন ডেকোরেশন। ছাঁদে গায়ে হলুদের জন্য স্টেজ করা হয়েছে শুধু। গায়ে হলুদ শেষ হলে তারপর বিয়ের জন্য পুনরায় স্টেজ করা হবে।
এতোক্ষণ যাবত এসবই ঘুরে ঘুরে দেখছিলো প্রাচুর্য এবং প্রিয়তি। দুর থেকে ব্যস্ত তাফসিরকে নজরে পরছে প্রাচুর্যের। লোকটা কি ব্যস্ত। দুদণ্ড কোথাও দাড়াচ্ছে না। সব দিকেই ঘুরে ঘুরে নজর রাখছে। রাদিয়ার বিয়েতে তো এসব করতে পারলো না তাই রিয়া এবং নিজের বিয়েতে সবদিক নিজের হাতে সামলাচ্ছে। বাড়ির কর্তারা গেছেন বাজার করতে। কাল সকাল সকাল বাবুর্চি চলে আসবেন এমনই কথা হয়েছে। শাহিনকে দেখা যাচ্ছে ক্যামেরা হাতে। সে সবকিছুর ছবি তুলছে। এর মধ্যে তাফসিরের নজরে পরলো প্রাচুর্যকে। সে শাহিনকে এদিকটায় দেখতে বলে এগিয়ে গেলো প্রাচুর্যের কাছে। তাফসির ওদের কাছে এসে প্রিয়তির দিকে তাকিয়ে জিজ্ঞেস করলো—

” কি ব্যাপার প্রিয়তি? কেমন আছো? ”

প্রিয়তি মুখে হাসি টেনে বললো—
” আলহামদুলিল্লাহ ভালো আছি ভাইয়া। আপনি? ”

” আমিও ভালো আছি। ”

প্রিয়তি প্রাচুর্যের হাত ছেড়ে বললো—
” প্রাচুর্য আমি তোর ঘরে আছি। তুই কথা শেষ করে আয়।”

প্রিয়তির যাওয়ার দিক থেকে চোখ সরিয়ে প্রাচুর্য তাফসিরের দিকে তাকালো। তাফসির দু কদম এগিয়ে আসলো প্রাচুর্যের সামনের ছোট চুল কানের পেছনে গুঁজে দিয়ে বললো—

” বাইরে কতো ঠান্ডা দেখেছিস? তার মধ্যে বাইরে ঘুরাঘুরি করছিস কেনো? যদি অসুস্থ হয়ে যাস তখন?”

প্রাচুর্য মাথা নিচু করে জবাব দিলো—
” একটু সাজানো দেখছিলাম। তাছাড়া আপনিও তো আছেন। আপনার ঠান্ডা লাগছে না বুঝি? শুধু একটা শার্ট পরে আছেন। ”

তাফসির নিঃশব্দে হাসলো। বললো—
” আসলেই ঠান্ডা লাগছে না। বরং দেখ ঘামে শার্ট ভিজে গেছে। এখন যদিও একটু একটু ঠান্ডা লাগছে। কিন্তু এতোক্ষণ দৌড়ঝাপের উপর ছিলাম বলে গরম লাগছিলো। ”

” তাহলে গরম কিছু পরে নিন। নাহলে নিজেই অসুস্থ হয়ে যাবেন গরম ঠান্ডা লেগে। আমি কিছু এনে দেবো? ”

তাফসির দুপাশে মাথা ঝাঁকিয়ে বললো—
” না দরকার নেই। একটু পর গরম লাগবে আবার। তুই ভেতরে যা এখন। বাইরে ঘুরাঘুরি করিস না। ”

প্রাচুর্য সম্মতিসূচক মাথা নাড়িয়ে ভেতরে পা বাড়ালো। প্রাচুর্য চলে যেতেই তাপসির পুনরায় নিজের কাজে যোগ দিলো।

#চলবে

একটি উত্তর ত্যাগ

আপনার মন্তব্য লিখুন দয়া করে!
এখানে আপনার নাম লিখুন দয়া করে