আমার পূর্ণতা পর্ব-২৮

0
868

#আমার_পূর্ণতা
#রেদশী_ইসলাম
পর্বঃ ২৮

ইকরাম ইশতিয়াক চৌধুরীর দিকে তাকিয়ে বললেন—
” তাহলে ভাইজান ওদের কবে নাগাদ আসতে বলবো?”

ইশতিয়াক চৌধুরী ইশারায় তাফসিরকে দেখালেন অর্থাৎ তাফসিরের কাছে জিজ্ঞেস করো। ইশতিয়াক চৌধুরীর ইশারা মোতাবেক ইকরাম তাফসিরের দিকে তাকিয়ে বললেন—
” আব্বা বল কবে আসতে বলবো ওদের? ”

” শুক্রবার আসতে বলো।যেহেতু ওইদিন সবাই-ই বাড়ি থাকবে তাই ওদের লাঞ্চের দাওয়াত দাও। বাড়ির সবাইকেই আসতে বলো। আর ওইদিন একবারে ফাইনাল কথা শেষ করবে। তবে আমার মতে বিয়ে টা তাড়াতাড়ি হলে ভালো হয়। ”

” আচ্ছা ওরা সবাই আসুক। একসাথে বসেই সব ঠিক করবো। ওদের সমস্যা আছে নাকি কোনো কিছুতে সেইগুলা ও তো জানতে হবে তাই না? ভাইজান ওইদিন কিন্তু আপনিই সব ঠিক করবেন। মেয়ে তো আমার একার না আপনাদের ও। ”

” বেশ তুমি যা চাও তাই হবে। ”

এ সময় তাফসির উঠে দাড়ালো। পকেটে দু’হাত ভরে সরাসরি ইশতিয়াক চৌধুরীর দিকে তাকালো। ভরাট কন্ঠে বলে উঠলো—
” বাবা আমি আপনাকে কিছু কথা বলতে চাই। আর এখন যেহেতু সবাই-ই এখানে উপস্থিত আছে তাই এখনই বলার প্রয়োজন মনে করছি। ”

ইশতিয়াক চৌধুরী চোখ থেকে চশমা খুলে হাতে নিলেন। পকেট থেকে রুমাল বের করে চশমার গ্লাস মুছতে মুছতে বললেন—
” বলো কি বলতে চাও তুমি। ”

তাফসির ভনিতা ছাড়া সোজাসাপ্টা জবাব দিলো। বললো—
” আমি বিজনেসে জয়েন করতে চাই। আর সেটা খুব তাড়াতাড়ি। ”

এ কথা বলে আর এক মুহুর্ত দাড়ালো না তাফসির। লম্বা লম্বা পা ফেলে সিঁড়ি বেয়ে দোতলায় উঠে গেলো। পেছনে ফেলে গেলো হতবাক দৃষ্টিতে তার দিকে তাকিয়ে থাকা কিছু মানুষকে। ইশতিয়াক চৌধুরী হাত থেকে চশমা ফেলে স্ত্রীর দিকে বিস্ময় নিয়ে তাকালেন। স্ত্রীর হাতে হালকা চাপড়া মেরে বললেন—

” ফারাহ আমি যা শুনেছি তুমিও কি তাই শুনেছো? কি বলে গেলো ও? ও বিজনেসে জয়েন করতে চাইছে? আমি ভুল কিছু শুনি নি তো? ”

মিসেস ফারাহর চোখে খুশিতে পানি জমেছে তবুও ঠোঁটে চওড়া হাসি। উনি ইশতিয়াক চৌধুরীর দিকে তাকিয়ে উপর নীচ মাথা নাড়িয়ে বললেন—

” তুমি ভুল শোনো নি গো। ও ঠিকই বলেছে। আমাদের তাফসির সত্যিই ব্যবসায় জয়েন হওয়ার কথা বলেছে। যাক অবশেষে ছেলে টার সুমতি ফিরলো তবে।
.
.
.
.
ঘুমের মধ্যে প্রাচুর্যের হঠাৎ মনে হলো সে শূন্যে ভাসছে। সাথে সাথে হাতের সামনে যেটা পেলো সেটা ঝাপটে ধরলো ওমনি ঘুম ও ভেঙে গেলো আতঙ্কে। কিন্তু চোখের সামনে তাফসিরের মুখটি দেখতেই অবাক হয়ে গেলো। এখনো বুক ধরফর করছে তার। প্রাচুর্য খানিকটা আতঙ্কিত হয়ে বললো—
” কি করছেন তাফসির ভাই? নামান আমাকে। আল্লাহ পরে যাবো আমি। নামান বলছি। ”

প্রাচুর্যের কথায় কোনো দ্বিরুক্তি করলো না তাফসির। সাথে সাথে নিজের অবস্থান পড়ার টেবিলের চেয়ারে আবিষ্কার করলো প্রাচুর্য। সে মুহুর্তে তাফসিরের গম্ভীর স্বর ভেসে আসলো।

” পড়ালেখা কি সব চাঙ্গে তুলেছিস? এসে ধরে তো একবারও পড়তে দেখলাম না। এতো ঘুম আসে কোথা থেকে তোর? ”

প্রাচুর্য একটা শুকনো ঢোক গিলে বললো—
” অনেক ক্লান্ত লাগছিলো তাফসির ভাই। তাই পড়তে বসি নি। সকালে উঠে পড়তে বসবো ভেবেছিলাম। ”

তাফসির রাগী কন্ঠে বললো—
” এতো তাড়াতাড়ি ফার্মের মুরগী হয়ে গেলি? এখনো তো আরও সময় বাকি আছে। তোকেই এখনো সামলাতে দশ জন লাগে তো কিছুদিন পর যখন আমাদের বাবু আসবে তখন কতো দিকে সামাল দেবো আমি? বাইরে থেকে তো শুধু তুই একা না। আমরা সবাই-ই এসেছি। কোই ওদের তো কিছু হলো না। দিব্বি সবাই হেঁটে চলে ঘুরে বেড়াচ্ছে। এমনকি সামি-সাদনান তোর থেকে ছোট হয়েও দৌড়িয়ে বেড়াচ্ছে আর তুই এখানে পরে পরে ঝিমোচ্ছিস। ”

তাফসিরের কাছ থেকে বকা খেয়ে মাথা নিচু করে ফেললো প্রাচুর্য। চোখে পানি ছলছল করছে। মনে মনে খানিক টা অভিমান জমলো তাফসিরের ওপর। সে নাহয় একটু ঘুমিয়েছেই তা বলে এমন বকা দেওয়ার কি দরকার। সে তো কখনো পড়ালেখায় গাফিলতি করে না। শুধু আজকেই নাহয় একটু পড়তে বসে নি তাতে কি এমন হয়েছে।

তাফসির অন্যপাশের চেয়ার টেনে বসতে বসতে বললো—
” বই বের কর ”

তাফসিরের কথা শুনে মাথা নিচু করে গোপনে চোখের পানি মুছলো প্রাচুর্য। তারপর ঘাড় ঘুড়িয়ে ঘড়ির দিকে তাকাতেই মুখ চুপসে গেলো তার। প্রায় বারোটা বাজে। এতো রাতে এখন কার পড়তে ইচ্ছা করে।

” এদিক ওদিক না তাকিয়ে যা বলেছি তাই কর। ”

” এখন তো অনেক রাত তাফসির ভাই। কালকে পড়লে হয় না? ”

” না হয় না ”

প্রাচুর্য আর কিছু না বলে বই বের করে পড়তে শুরু করলো। একদিক থেকে রাগ হচ্ছে অন্যদিকে অসহায় লাগছে। কিন্তু কি আর করার মুখের ওপর কিছু বলতে তো আর পারবে না। নিজে তো বসে বসে ফোন টিপছে আর প্রাচুর্যকে পড়িয়ে মা র ছে।
.
.
.
আজ সকালে তাফসির একটু দেরি করেই ঘুম থেকে উঠলো। কারন রাতে ঘুমাতে ঘুমাতে অনেক দেরি হয়ে ছিলো। মুলতঃ প্রাচুর্যকে জ্বালানোর জন্যই ওতো রাতে বই নিয়ে বসিয়েছিলো তাফসির। ভেবেছিলো প্রাচুর্য হয়তো ঝগড়া করবে কিন্তু না মেয়েটা তো ভদ্র ভাবেই তার কথা পালন করলো। ব্যাপার টা অতোটা ও খারাপ লাগে নি তার কাছে। সে তো চাই যে প্রাচুর্য তার কথা শুনে চলুক। তার সাথে একটু বেশি সময় থাকুক।
এসব কথা ভাবতে ভাবতে তাফসির ওয়াশরুমে চলে গেলো ফ্রেশ হতে।

ইশতিয়াক চৌধুরী ধীর পায়ে হেটে করিডোরের শেষের রুমটার সামনে এসে দাঁড়ালেন। দীর্ঘশ্বাস ফেলে রুমের দরজায় দু’বার টোকা মারলেন। তাফসির সবে মাত্রই ফ্রেশ হয়ে বের হলো। ভাবলো প্রাচুর্য বা মা এসেছে বোধহয়। কারন এ দু’জন ছাড়া আর কেউই তার রুমে আসে না। কিন্তু তাফসির দরজা খুলে ইশতিয়াক চৌধুরীকে দেখতেই অবাক হয়ে গেলো। এই মানুষটাকে সে একদমই আশা করে নি। তাফসিরকে এমন দাঁড়িয়ে থাকতে দেখে ইশতিয়াক চৌধুরী খুকখুক করে কাশলেন। তাফসিরের দিকে তাকিয়ে বললেন—
” কি ভেতরে যেতে দেবে না? ”

নিজের চমকিত ভাবটা সামলে নিলো তাফসির। দরজার সামনে থেকে সরে গিয়ে ইশতিয়াক চৌধুরীকে ভেতরে ঢোকার জায়গা করে দিলো। ইশতিয়াক চৌধুরী ভেতরে গিয়ে বিছানার উপর বসলেন। চোখ ঘুরিয়ে পুরো রুম টাকে পর্যবেক্ষন করলেন। বিছানার মাথার উপরের দেয়ালে বড় একটি ফটো ফ্রেম। প্রাচুর্যের ছবি। দুহাত ভর্তি মেহেদী নিয়ে মুখে মিষ্টি হাসি। তা দেখে ক্ষীণ হাসলেন ইশতিয়াক চৌধুরী। ছেলেটা যে প্রাচুর্যকে কতো খানিক ভালোবাসে তা আর বুঝতে বাকি নেই তার। মাথা ঘুড়িয়ে সামনে দাঁড়িয়া থাকা তাফসিরের দিকে তাকালেন। আগের মতোই হেঁসে বললেন—

” দাঁড়িয়ে আছো কেন তুমি? এসো এখানে বসো। ”

আদেশ পেয়ে তাফসির ইশতিয়াক চৌধুরীর পাশে বসলো। মিহি কন্ঠে শুধালো—

” আপনি কি কিছু বলবেন বাবা? হঠাৎ আমার রুমে..?”

তাফসিরের মুখের কথা কেড়ে নিয়ে ইশতিয়াক চৌধুরী বললেন—

” কেনো কোনো কিছু বলা ছাড়া কি তোমার রুমে আসতে পারি না? ”

ইশতিয়াক চৌধুরীর এতো ভালো ব্যবহার ঠিক হজম হচ্ছে না তাফসিরের। ঠোঁট কামড়ে চিন্তা ভাবনা করলো সে। কিন্তু না কিছুতেই বুঝতে পারছে না কারন টা।

” তোমার রুমে আসাতে তুমি বোধহয় খুব অবাক হচ্ছো তাই না? এতো অবাক হওয়ার কিছু নেই। তুমি তো আমার ছেলে। তোমার রুমে আসার জন্য নিশ্চয় কোনো কারন লাগবে না? ”

” না আমি ঠিক সেভাবে বোঝাতে বা বলতে চাই নি। ”

” মাঝখানে কেটে গেছে সাত সাতটি বছর। তোমার আর আমার সম্পর্কটা আগের মতো নেই। তুমি আমার সাথে কথা বলতে অস্বস্তি অনুভব করছো। বুঝতে পারছো ঠিক কতোটা দুরত্ব হয়েছে? ”

ইশতিয়াক চৌধুরীর কথায় কোনো প্রতিত্তোর করলো না তাফসির। খানিকক্ষণ পর ইশতিয়াক চৌধুরী নিজেই বলতে শুরু করলেন—

” অনেক গুলো বছর তো হলোই এবার কি আমাদের মাঝের বাবা ছেলের সম্পর্কটা স্বাভাবিক করা যায় না? রাগ, অভিমান, অভিযোগ ভুলে যাওয়া যায় না?”

” আপনার উপর আমার কোনো রাগ, অভিমান বা অভিযোগ নেই বাবা। ”

” তাহলে কথা বলো না কেনো? সব সময় এতো দুরত্ব বজায় রেখে চলো কেনো? এড়িয়ে চলো কেনো? সাত বছর আগে করেছিলাম একটা ভুল। আমি মানছি তোমার কথা শুনে তারপর ডিসিশন নেওয়া উচিৎ ছিলো। আমি কোনো কিছু যাচাই বাছাই না করেই তোমার গায়ে হাত তুলেছিলাম। তোমাকে ব্যাখ্যা করার কোনো সুযোগ দেই নি। কিন্তু তোমার কি এমন করা উচিৎ হয়েছিলো বলো?”

” এখন এসব কথা কেনো তুলছেন বাবা? ”

” তুলছি কারন আমি চাই সবকিছু আবার আগের মতো হয়ে যাক। তোমার আর আমার সম্পর্ক আগের মতো হোক। আমার ও তো কষ্ট হয় বলো? আর কত কাল এমন কথা না বলে থাকবে? তোমাকে আমি অনেক ভালোবাসি। তোমরা দুই ভাইবোন আমার দুই চোখের মনি। তোমাদের দু’জনকে ছাড়াই আমি অচল। ”

এ কথা গুলো বলতে বলতে ইশতিয়াক চৌধুরীর চোখ অশ্রুসিক্ত হয়ে উঠলো। সে একটু এগিয়ে এসে তাফসিরের এক হাত মুঠোয় পুরে বললো—

” তুমি এ বাড়ির সব থেকে বড় সন্তান। তাই সবার থেকে বেশি আদর তুমিই পেয়েছো। তুমি যখন দুনিয়ায় আসলে তখন তোমাকে হাতে নিয়ে আমি খুশিতে কান্না করে দিয়েছিলাম। অফিস থেকে শুরু করে পুরো এলাকায় মিষ্টি দিয়েছিলাম। আর তুমি যখন চলে গেলে আমি কষ্ট পেয়েছিলাম। কিন্তু আমি দেখাতে পারি নি কাউকে আমার কষ্টটা। তুমিও কথা বলতে না আমার সাথে। ভেতরে ভেতরে গুমরে ম র তা ম। আচ্ছা আমাকে কি ক্ষমা করা যায় না? ”

তাফসির ইশতিয়াক চৌধুরীকে জড়িয়ে ধরলো। ঠিক কতো বছর পর তার ঠিক নেই। তবে ইশতিয়াক চৌধুরীর মুখে এমন আবেগপ্রবণ কথা তার সহ্য হচ্ছে না। যাইহোক তার বাবা তো। সে ও কম ভালোবাসে না এই মানুষটা কে। তার অভিমান তো অনেক আগেই ঘুচেছে। শুধু এতোদিন দ্বিধা, সংকোচ ছিলো। তাও আজ শেষ হয়েছে ইশতিয়াক চৌধুরীর কথায়। তাফসির নিজেও চাই বাবার সাথে সম্পর্কটা আগের মতো করতে। সে বললো—

” এমন ভাবে বলবেন না বাবা। ভুল আমার ও ছিলো। ক্ষমা তো আমার চাওয়া উচিৎ আপনাদের এতো কষ্ট দেওয়ার জন্য। পারলে আমাকে মাফ করবেন। ”

ইশতিয়াক চৌধুরীর ঠোঁটে হাসি ফুটলো। মনে হচ্ছে বুকের ওপর থেকে কয়েক কেজি ওজনের ভারি পাথর সরে গেলো। তিনি বৃদ্ধাঙ্গুলি দিয়ে চোখের পানি মুছে তাফসিরের পিঠে হাত রাখলেন। শেষ করলেন মান-অভিমানের সকল পর্ব। এবার থেকে স্বাভাবিক হলো বাবা-ছেলের সম্পর্কটা।
.
.
.
আজ শুক্রবার। আরফানের পরিবারের আসার দিন। সকাল সকাল রিয়া এসে প্রাচুর্যকে উঠিয়ে দিলো। প্রাচুর্যের হাত টেনে নিয়ে গেলো নিজের রুমে। রিয়ার রুমে যেয়ে প্রাচুর্যের চোখ চড়কগাছ। পুরো বিছানা জুড়ে জামা-কাপড়ের স্তুপ। প্রাচুর্য কপালে হাত দিয়ে চিল্লিয়ে বললো—

” এ কি করেছো তুমি আপু? জামা কাপড়ের এ অবস্থা কেনো? ”

রিয়া মুখ কাচুমাচু করে বললো—
” জানিসই তো আজকে ও বাড়ি থেকে আসছে বিয়ের কথা পাকাঁ করতে। আমি চাই আমাকে পার্ফেক্ট লাগুক। তুই একটু আমাকে একটা জামা সিলেক্ট করে দে না বইন। প্লিজ। ”

প্রাচুর্য শ্বাস ফেললো। এগিয়ে এসে জামা কাপড় সরিয়ে সরিয়ে সব দেখলো। একটা লাল রঙের জামা হাতে উঠিয়ে উল্টেপাল্টে দেখে রিয়া কে দিয়ে বললো—

” এটা পরতে পারো। সুন্দর আছে। আর তোমাকে পরলেও মানাবে। ”

” সিওর তুই? ”

” আমি তো সিওর। এখন তোমার পছন্দ না হলে অন্য একটা দেখতে পারো। ”

” না এটাই ঠিক আছে। আমি এটাই পরবো। ”

প্রাচুর্য জামা কাপড় এক পাশে সরিয়ে বসতে বসতে বললো—
” তা ভাইয়া রা আসবে কখন আপু? ”

” এই তো আসলো বলে। তুই তো পরে পরে ঘুমিয়েছিস ওইদিন। কি হয়েছে কিচ্ছু জানিস না। তাফসির ভাইয়া যে অফিসে জয়েন হওয়ার কথা বলেছে এটা তো অন্তত জানিস? নাকি তাও জানিস না? ”

রিয়ার কথায় প্রাচুর্য চোখ বড় বড় করে তাকালো। বিস্ময় নিয়ে উচ্চস্বরে বললো—

” কি বলছো এসব? সত্যি নাকি? ”

” দেখেছিস? আমি ঠিকই ভেবেছিলাম তুই কিছুই জানিস না। আচ্ছা প্রাচু তুই কি এ বাড়িরই সদস্য নাকি? আমার তো সন্দেহ হচ্ছে। ”

” আমার তো এখন তাই মনে হচ্ছে আপু। আমি মনে হয় এ বাড়ির সদস্য না। তাফসির ভাই আগের দিন ঠিকই বলেছিলো। কেমন যেনো দিন দিন ফার্মের মুরগীর মতো হয়ে যাচ্চি। যেখানে কাইত সেখানে রাইত। ”

” তুই জানিস টা কি বলবি আমাকে? ”

” শুধু জানি বড় বাবা আর তাফসির ভাইয়ের সম্পর্কটা ঠিক হয়ে গেছে। তাও বড় মা থেকে শুনেছি। তাছাড়া তাফসির ভাই তো আমাকে কিছুই বলে না। ”

” যাক অন্তত এটুক তো জানিস। আচ্ছা তোর মনে আছে তাফসির ভাই রাদিয়া আপুর বিয়ের সময় যখন দেশে আসছিলো তখন বাবা ওনাকে ডেকেছিলো কথা বলার জন্য? উনি তো গিয়েছিলো। তো ওইদিন নাকি বাবা বলেছিলো ওনাকে অফিসে জয়েন হওয়ার কথা। আর সেটা নাকি বড় বাবা-ই শিখিয়ে দিয়েছিলো। কিন্তু তাফসির ভাই নাকি সরাসরি নাকচ করে দিয়েছিলো। তাহলে হঠাৎ এখন রাজি হলো কেনো এটাই বুঝছি না। ”

” হ্যাঁ তাইতো। পুরো মাড়ি চাপা লোক একটা। কিচ্ছু বলে না। আচ্ছা দেরি হচ্ছে কিন্তু। এবার তুমি তৈরি হয়ে নেও। আমিও গোসল করে আসি। ”

” আচ্ছা যা। ”
.
.
.
রান্না করতে করতে মিসেস ফারাহ হঠাৎ সিদ্ধান্ত নিলেন রিয়ার বিয়ের দিনই যদি একবারে তাফসির প্রাচুর্যের বিয়েটা হয়ে যায় তাহলে কেমন হবে? তিনি আর রান্না ঘরে থাকলেন না। শাহানা আর মুমতাহিনা বেগমকে রান্নার ভাড় দিয়ে হাত ধুয়ে ছুটলেন স্বামীর কাছে। আগে তার স্বামীর সাথে এ বিষয়ে আলাপ করতে হবে তারপর প্রাচুর্যের শাহানা-ইনসাফের সাথে কথা বলবে। যেই বলা সেই কাজ। তিনি ঘরে এসে দেখলেন ইশতিয়াক চৌধুরী টিভিতে নিউজ দেখছে। মিসেস ফারাহকে তাড়াহুড়ো করে আসতে দেখে সোজা হয়ে বসলেন ইনসাফ। চোখ থেকে চশমা খুলে বেড সাইট টেবিলের উপর রেখে বললেন—

” কি গিন্নি এসময় ঘরে যে? তোমাকে আবার এসময় পাওয়া যায় না। কিচেন লাভার কিনা! দিনের বেশিরভাগ সময়ই রান্না ঘরে কাটিয়ে দেও। তা হঠাৎ আজকে? ”

” ফাইজলামি বাদ দেও। আগে আমার কথা শোনো। ”

” জ্বি মহারানী। বলুন। ”

” আমি সিদ্ধান্ত নিয়েছি যে রিয়ার বিয়ের দিন তাফসির আর প্রাচুর্যের বিয়েটাও দিয়ে দেবো। পাঁচ মাস তো হতেই গেলো। আর তাফসির ও যেহেতু চলে এসেছে সেহেতু কথা অনুযায়ী এখন বিয়েটা দেওয়া যায়। তাছাড়াও একসাথে বিয়ে হলে ঝামেলা কম হয়। ”

” টাকা বাঁচাতে চাচ্ছো? ”

” ধ্যাত কিসব বলছো? একমাত্র ছেলের বিয়েতে টাকা বাঁচাতে চাইবো? ভালোর জন্যই বললাম আর তুমি অন্যদিকে নিয়ে যাচ্ছো কথা। ”

” মহিলা মানুষ হলেও মাথায় বুদ্ধি আছে বটে তোমার। যাইহোক এখন তো তাহলে কথা বলতে হয় সবার সাথে।”

” আগে ইনসাফ,শাহানা আর ইকরাম,মুমতাহিনার সাথে কথা বলো। ওরা সবাই রাজি হলে তাফসিরের সাথে কথা বলো। কারন আমি জানি ছেলে কখনো দ্বিমত করবে না। বউ পাগল বলে কথা। তোমাদের গুষ্টিতে তো ছেলেরা আবার বউ পাগল হয়। ”

” ধুর কি যে বলো না। এটাকে বউ পাগল বলে না। বউয়ের প্রতি ভালোবাসা বলে। এখন যাও তো ওদের পাঠিয়ে দেও। একটু পরেই আবার আরফান রা চলে আসবে। তার মধ্যেই কথা শেষ করতে হব ওদের সাথে। ”

মিসেস ফারাহ ঝটপট গিয়ে ডেকে দিলেন সবাইকে। তার কথা অনুযায়ী সবাই হাজির হলো ইশতিয়াক চৌধুরীর রুমে। ইকরাম আর ইনসাফ বসতে বসতে ইশতিয়াক চৌধুরীর দিকে তাকিয় জিজ্ঞেস করলো—

” হঠাৎ জরুরি তলব করলেন যে ভাইজান? কি হয়েছে? ”

” শোনো আমরা মানে আমি আর তাফসিরের মা ভাবছিলাম প্রাচুর্য আর তাফসিরের বিয়ে টা রিয়ার বিয়ের দিন হবে। তোমাদের কারোর কোনো আপত্তি আছে? ”

ইশতিয়াক চৌধুরীর কথায় সবাই বললো—

” না ভাইজান ”

ইনসাফ চৌধুরী বললো—

” আপনি পরিবারের কর্তা ভাইজান। আপনি যা বলবেন সেটাই শেষ কথা। আর আমরা জানি আপনি যেই সিদ্ধান্ত নেবেন নিশ্চয়ই বুঝে শুনে ভালোর জন্যই নেবেন।”

ইনসাফ চৌধুরীর সাথে তাল মেলালো সবাই। ইকরাম চৌধুরী বললো—

” আমারও একই মত ভাইজান। তাতে করে ঝামেলা ও কম হবে। তাফসিরের সাথে কথা বলেছেন এই বিষয়ে? ”

” না এখনো কিছু বলি নি। আগে তোমাদের সাথে কথা বলে সিওর হলাম এবার ওর সাথে কথা বলবো।”

———————

প্রায় ঘন্টা খানিক পর আরফানের পরিবার এসে পৌঁছালো চৌধুরী বাড়ির আঙিনায়। চৌধুরী বাড়ির সদস্যরা সাদরে আপ্যায়ন করলো আরফানের পরিবারকে। যা দেখে চোখ ছলছল করে উঠে উঠলো আরফানের মা সিরিনা বেগমের। এতো সম্ভ্রান্ত পরিবারের থেকে এতোটা সন্মান আশা করেন নি তিনি। যদিও আগের দিন তিনি বুঝেছিলেন যে এনারা ভালো মানুষ তবে আজকের ব্যবহারে তিনি মুগ্ধ। ছেলে যখন সবকিছু তাকে খুলে বললো তখন তিনি ভয়ে ছিলেন। না জানি আবার কোনোদিনও অপমানিত হতে হয় নাকি এটা ভেবে। তাদের টাকা পয়সা কম হলেও আত্মসম্মান প্রবল। কিন্তু ছেলের মুখের দিকে তাকিয়ে কিছু বলতেও পারছিলেন না। তবে যখন চৌধুরী বাড়িতে পা রাখলো তখন তার ধারণা ভুল প্রমানিত হলো। সাথে মেয়ের নম্র ভদ্র আচরণে তিনি বুঝলেন যে তিনি যেই ভয়টা পেয়েছিলেন সেটা অবান্তর। আরফান একে একে সবার সাথে পরিচয় করিয়ে দিলো তার মা’কে। আগের দিন শুধু তার মা এসেছিলো কিন্তু আজকে ছোট বোন অহনা ও সাথে আছে। যার ভাব হয়েছে প্রাচুর্যের সাথে।

যোহরের আজান দিলে বাড়ির সব পুরুষরা গেলেন নামাজ পরতে। আজ বাবা,ছেলে, জামাই সবাই একসাথেই গিয়েছে মসজিদে জুম্মার নামাজ আদায় করতে। বলতে গেলে চৌধুরী বাড়িতে আজ বেশ উৎসব মুখর পরিবেশ।

#চলবে

একটি উত্তর ত্যাগ

আপনার মন্তব্য লিখুন দয়া করে!
এখানে আপনার নাম লিখুন দয়া করে