আমার পূর্ণতা পর্ব-২৬

0
914

#আমার_পূর্ণতা
#রেদশী_ইসলাম
পর্বঃ ২৬

কাউকে মিস করা আর কারও জন্য অপেক্ষা করা সত্যিই কষ্টের। লোকে বলে প্রিয় মানুষের জন্য করা অপেক্ষার মধ্যেও নাকি শান্তি আছে,ভালো লাগে। কিন্তু কোই? প্রাচুর্যের তো শান্তি লাগছে না!! তার তো আরও অস্থির অস্থির লাগছে। মনে হচ্ছে কতো যুগ হয়ে গেছে তাফসিরকে সে দেখে নি। তার ইচ্ছা আকাঙ্খা একটাই তা হলো শুধু মাত্র একটু চোখের সামনে ওই মুখটা একটু দেখা। আর একটু ছুঁয়ে দেওয়া। দেখা তো হয় প্রতিদিনই তবে সেটা ওই যন্ত্রটা তে। তাতে না ছুঁয়ে দেখা যায় আর না মন ভরে দেখা যায়।
এইবার ফিরে আসলে সে আর কিছুতেই যেতে দেবে না ওই পাষাণ মানুষ টাকে। প্রয়োজন পরলে সে জোড় করে আটকে রাখবে তাফসিরকে। এতোদিন শুধু বড় মা অপেক্ষা করতো। এখন বড় মা’য়ের সাথে সে ও যুক্ত হয়েছে। বুঝতে পারছে প্রিয় মানুষ দুরে থাকলে কতোটা কষ্ট হয়।

নদীর পাড়ে বসে এসবই ভাবছিলো প্রাচুর্য। আজ সে কলেজে যায় নি। তবে বাড়ির থেকে কলেজের নাম করেই বের হয়েছে। কারন অন্য কোথাও যাওয়ার কথা বললে মা কখনো একা আসতে দেবে না তাকে। সেই ঘটনার পর একা বের হওয়া তার জন্য পুরোপুরি নিষিদ্ধ। সাথে যদিও প্রিয়তি আসতে চেয়েছিলো কিন্তু সে পুরোপুরি নাকচ করে দিয়েছে। তার একটু একা থাকতে ইচ্ছা করছে। শুধু শুধু মন খারাপ হচ্ছে। আর প্রচুর মুড সুয়িং হচ্ছে।

প্রিয়তি তাদের বিয়ের কথা জানে না এখনো। প্রাচুর্যই জানায়নি। কোন মুখে জানাবে সে? যেখানে প্রিয়তি তাফসিরকে পছন্দ করেছিলো সেখানে প্রাচুর্য নিজে তাফসিরকে বিয়ে করে বসে আছে এটা শুনলে প্রিয়তি কি রিয়াকশন দিবে সে বুঝতে পারছে না। আদৌও সহজ ভাবে মানবে তো? বা বন্ধুত্বটা থাকবে তো? কিন্তু তার-ও বা কি করার? ভালোবাসা কি কখনো জেনে বুঝে সময় করে আসে নাকি? আর যেখানে ও জানতো যে তাফসির ওকে ভালোবাসে সেখানে যদি প্রিয়তির সাথে তাফসিরের কোনো সম্পর্ক করিয়ে দেওয়ার কথা ভাবতো না জানি তার কপালে কি দুঃখ ছিলো। এমনিও তাফসির প্রিয়তিকে পছন্দ করে না তেমন। আর সে জানে প্রিয়তিও তাফসিরকে মন থেকে ভালোবাসতো না। এটা শুধুই এট্রাকশন ছিলো। এসব আকাশ পাতাল ভাবনা ঘুরছে প্রাচুর্যের মাথার ভেতর। এর মধ্যে ক্ষুধা ও লেগেছে তার। সকালে আসার সময় খেয়ে আসে নি আজকে। খানিকটা তাড়াহুড়ো করেই বের হয়েছে।

গাড়ি কলেজের সামনে নামিয়ে দিলেও সে ঢুকে নি কলেজে। লুকিয়ে ছিলো বাউন্ডারির পেছনে। বাড়ির গাড়ি চলে যেতেই বের হতে নিচ্ছিলো তখনই দেখা হলো প্রিয়তির সাথে। কোনো মতে কথা শেষ করে তাড়াতাড়ি রিকশা ধরে এখানে চলে এসেছিলো। এসেছে তাও ঘন্টা তিনেক হয়েছে। তাফসিরের সাথে শেষ কথা হয়েছে চারদিন আগে বিকাল বেলায়। এরপর আর কোনো কথা হয় নি। সে নাকি প্রচুর ব্যস্ত মানুষ। এতোটাই ব্যস্ত যে কথা বলার ও সময় নেই। এসব কথা চিন্তা করে মুখ বাঁকাল প্রাচুর্য। মনে মনে ভাবলো ” ইহহ আসছে আমার প্রাইম মিনিস্টার। কি এমন কাজ যে কাজের জন্য পথ চোখে দেখছে না। থাক সে তার কাজ নিয়ে। তাতে আমার কি? হুহ” বলে উঠে দাড়ালো প্রাচুর্য। আর ক্ষুধায় থাকতে পারছে না সে। এবার বাড়ির পথ ধরে হাটা ধরলো প্রাচুর্য। কিছুদূর আসতেই একটা রিকশা ডেকে উঠে বসলো তাতে।

বাড়ির ভেতরে আসতেই ড্রয়িংরুমে সবাইকে বসা দেখে অবাক হয়ে গেলো। এমনকি ইশতিয়াক, ইকরাম আর ইনসাফও উপস্থিত। সাথে রাদিয়া ও আবির ও। তবে গিন্নিদের দেখা যাচ্ছে না। তারা হয়তো রান্নায় ব্যস্ত। কারন বাড়ি খাবারের ঘ্রানে ম-ম করছে। প্রাচুর্যের দিকে একপলক সবাই তাকিয়ে মুচকি হাসি দিলো। তারপর আবার আলোচনায় মত্ত হয়ে গেলো।
রিয়া প্রাচুর্যকে দেখতেই বললো—

” কি ব্যাপার তুই এই অসময়? আজকেও কি শরীর খারাপ করলো নাকি? এতো তাড়াতাড়ি চলে এলি যে? ”

” আমার কথা বাদ দেও। আগে বলো সবাই এসময় বাড়িতে কেনো? কিছু কি হয়েছে? আমার কিন্তু টেনশন হচ্ছে। ”

রিয়া মুখ টিপে হেঁসে বললো—

” তোমার জন্য সারপ্রাইজ আছে সোনা। যাও যাও নিজের রুমে যাও। সময় হলেই পাবে। ”

” বলো না আপু কি সারপ্রাইজ? আজকে কি তোমার বিয়ে? ”

” ধুর বোকা বিয়ে হলে তো জানতিস ই আর বাড়ি সাজানো দেখতিস। এখন যা ঘরে যা। ফ্রেস হয়ে আয়। ও হ্যাঁ ভালো কথা আর চমক পেয়ে টাশকি খাইয়া পরিস না যেনো আবার। ”

রিয়ার কথা আগাগোড়া কিছুই বুঝলো না প্রাচুর্য। ঠোঁট উল্টে সিঁড়ির দিকে পা বাড়াতে বাড়াতে বললো—

” আপু মা কে বলো আমার জন্য খাবার নিয়ে আসতে। ক্ষিধায় ম রে যাচ্ছি আমি। ”

রিয়া বলে উঠলো —
” আচ্ছা যা তুই। বলে দিচ্ছি আমি। ”

প্রাচুর্য ঘরে এসে কাঁধ থেকে ব্যাগ নামিয়ে টেবিলের উপর রাখলো। বোতল থেকে পানি খেয়ে গলা ভিজালো। ক্রস বেল্ট খুলে বিছানায় ছুড়ে মেরে বেলকনির দিকে তাকালো। সেখানে বাগান বিলাস গাছটি আর নেই। সরিয়ে ফেলেছে অনেক আগেই। জায়গাটা বর্তমানে ফাঁকা পরে আছে। দেখতে ভালো লাগছে না। তাই প্রাচুর্য ভাবতে থাকলো সেখানে কি কি গাছ রাখা যায়। এর মধ্যে দরজার নক ঘোরানোর শব্দ হলো। প্রাচুর্য ভাবলো বোধহয় মিসেস শাহানা খাবার নিয়ে এসেছে। তাই প্রাচুর্য পেছনে না ঘুরে একই অবস্থায় বেলকনির দিকে তাকিয়ে বলতে লাগলো—

” মা এখন একদম জিজ্ঞেস করবে না যে এতো তাড়াতাড়ি কেনো চলে এসেছি। আমার ভালো লাগছিলো না তাই চলে এসেছি। আর পরীক্ষার ও রেজাল্ট দিয়েছে। সব সাবজেক্টই পাশ এসেছে। আর ভালো ও হয়েছে। তবে রেজাল্ট কালকে দিয়েছে আজকে নয়। আমি তোমাদের বলতে ভুলে গিয়েছিলাম। এখন খাবার রেখে তুমি যাও। আমি ফ্রেশ হতে যাচ্ছি। এসে খেয়ে নিবো। ”

” শেষ? ”

এতোক্ষণ একদমে কথা গুলো বলে থামলো প্রাচুর্য। কিন্তু চেনা এমন রাশভারি পুরুষালি কন্ঠে থমকে গেলো সে। চকিতে পেছন ফিরে তাকাতেই বিমূর্ত হয়ে গেলো। সে কি সপ্ন দেখছে? কি সাংঘাতিক! তার কথা সারাদিন ভাবতে ভাবতে এখন দিন দুপুরে ও সপ্ন দেখা শুরু করলো? তার কি হ্যালুসিনেশন হচ্ছে? যদি সত্যি এমন হয় তবে তো ভালো লক্ষ্মণ নয়। প্রাচুর্য ভাবলো এটা হয়তো তার হ্যালুসিনেশন। তাই চোখ ভালো করে ডলে সামনে তাকালো। তা দেখেই তাফসির ঠোঁট কামড়ে হেঁসে দুই ভ্রু নাচালো। যার অর্থ ” কি? এবার বিশ্বাস হলো তো যে আমি আসলেই সামনে? ”
প্রাচুর্যের বুক কেঁপে উঠলো। সাথে কাঁপতে থাকলো হাত পা। অবশেষে সে এলো তবে? প্রাচুর্য হাত দিয়ে মুখ চেপে ধরলো। সাথে সাথে দু চোখ দিয়ে গড়িয়ে পরলো দু ফোঁটা গরম অশ্রু। তা দেখে তাফসির হাত বাড়িয়ে টেনে প্রাচুর্যকে কাছে নিয়ে আসলো। দুহাত দিয়ে আষ্টেপৃষ্ঠে জরিয়ে নিলো নিজের সাথে। আবেশে চোখ বন্ধ করে নিলো দুজনেই। ঠিক কতোদিন পর একজন আরেকজনকে স্পর্শ করলো ঠিক জানা নেই। প্রাচুর্যের বন্ধ চোখ দিয়ে এখনো পানি গড়াচ্ছে। তাফসির মুখ নামিয়ে ঠোঁট ছোঁয়ালো প্রাচুর্যের ডান গালে। প্রাচুর্য সে অবস্থাতেই দ্বিতীয় বারের মতো কেঁপে উঠলো। তাফসির জড়িয়ে ধরা অবস্থাতেই জিজ্ঞেস করলো—

” কি হলো? কাঁদছিস কেনো? চলে এসেছি তো দেখ! ”

প্রাচুর্য নাক টেনে অভিমানী কন্ঠে বললো—

” এতোদিনে তবে আসার সময় হলো আপনার? ”

তাফসির কিছু বললো না। প্রাচুর্যকে একহাতে ধরে রেখে অন্য হাত দিয়ে চোখ মুছিয়ে দিলো। তারপর সরাসরি প্রাচুর্যের চোখের দিকে তাকিয়ে বললো—

” আর কক্ষনও যাবো না তোকে ছেড়ে। এবার থেকে এখানেই থাকবো। তবে আমার জ্বালা সহ্য করতে পারবি তো? অতিষ্ঠ হওয়া চলবে না কিন্তু। ”

প্রাচুর্য অবাক হয়ে বললো—
” মানে? আপনি কি একেবারে চলে এসেছেন? আর কোনোদিনও চলে যাবেন না? ”

তাফসিরে মুচকি হেঁসে বললো—
” না ম্যাডাম। আর কখনো যাবো না। এখন থেকে সবাই এক সাথেই থাকবো। এবার তাড়াতাড়ি ফ্রেশ হয়ে আসুন তো অপেক্ষা করছি নিচে। আমিও কিন্তু এখনো পর্যন্ত কিছুই খায় নি। ”

প্রাচুর্য সম্মতিসূচক মাথা নেড়ে জামা কাপড় নিয়ে ওয়াশরুমে ঢুকে গেলো। আহা আজ কি আনন্দ তার। একটু আগেই মন খারাপে কান্না আসছিলো আর এখনই নাচতে ইচ্ছা করছে। এমন চমক সে আগে কখনো পাই নি। এটা তার জীবনের বেস্ট বেস্ট বেস্ট! এমন চমক পেতেও ভালো লাগে। ইশশ এখন ভাবতেই আনন্দ লাগছে যে এখন থেকে তাফসির এখানেই থাকবে। আবার একটু আগে তাফসিরের দেওয়া চুমুর কথা মনে পরতেই লজ্জা লাগছে।
*
তাফসির নিচে এসে ড্রয়িংরুমের সোফায় বসলো আবিরের পাশে। আবির গল্প থামিয়ে হাসি মুখে তাফসিরের দিক তাকিয়ে বললো—

” কি ভাইয়া এবার প্লান কি তোমার? ”

তাফসির অকপটে উত্তর দিলো—
” বিয়ে ”

তাফসিরের উত্তর শুনে খানিকটা থতমত খেয়ে গেলো আবির। পাশ থেকে রিয়া আর রাদিয়া শব্দ করে হেঁসে উঠলো। আবির পুনরায় তাফসিরের দিক তাকিয়ে বললো—
” কতোবার বিয়ে করতে চাও তুমি? কয়দিন আগে আমার ছোট্ট শ্যালিকাকে বিয়ে করতে পারলে না এখন আবার বিয়ে করবে? নাহ তোমাকে তো সুবিধার মনে হচ্ছে না। ”

পাশ থেকে রাদিয়ে ধমক দিয়ে বললো—
” ধ্যাত ভাইয়া তো প্রাচুর্যকেই বিয়ে করতে চাইছে। আগের বার বিয়ে হয়েছে ঠিকই কিন্তু শোনো নি বাবা কি বলেছিলেন? ”

আবির ডান বাম মাথা নাড়াতেই রিয়া বলতে শুরু করলো—
” বাবা বলেছিলেন তাফসির ভাইয়া দেশে পুরোপুরি আসলেই দু’জনের বড় আয়োজনে বিয়ে হবে। তখন দু’জনে সংসার ও করতে পারবে। আর কোনো বাধা বা নিষেধাজ্ঞা থাকবে না। আর তাই ভাইয়া বলেছে যে বিয়ে করবে। বুঝেছো?”

আবির মাথা নাড়িয়ে বললো—

” হ্যাঁ বুঝেছি ”

” রিয়া আরফানকে বলিস বিকালে মিট আপ করতে। ওর সাথে দেখা করা প্রয়োজন। “__গম্ভীর কন্ঠে বলে উঠলো তাফসির।

” হ্যাঁ ভাইয়া। আরফানও তাই বলছিলো যে তুমি আসলে যাতে ওকে বলি। ও দেখা করতে চাই তোমার সাথে। ”

” ভাইয়া তাইলে আমরা কি দোষ করলাম? আমরা ও তো এখনো রিয়ার হবু বরকে দেখি নি। তাহলে আমাদের ও নিয়ে চলো। আমরাও একেবারে দেখা করে আসি। ”

রাদিয়ার কথায় তাফসির বললো—
” আচ্ছা সমস্যা নেই। পাঁচ টার মধ্যে রেডি হয়ে থাকিস সবাই। ”
**
হাত ঘড়িতে সময় দেখে মুখ থেকে বিরক্তসূচক আওয়াজ করলো তাফসির। আধ ঘন্টার বেশি হয়ে গেলো মেয়েটার কোনো খোজ নেই। গোসল করতে কি কারোর এতো সময় লাগে? এদিকে ক্লান্তিতে চোখ বুঁজে আসছে তার। কিছুদিন যাবত ঠিক ভাবে ঘুম হয়নি। কাজের প্রেসার ও ছিলো প্রচুর। রিজাইন দিতে কম কাঠখড় পোহাতে হয়নি। সে কাজের বেলায় সব সময়ই সৎ এবং নীতি বান ছিলো। অফিসের উচ্চপদস্থ কর্মকর্তাদের সাথে সম্পর্ক ছিলো ও বেশ। তাই কেউই ছাড়তে চাই নি। রিজাইন দেওয়ার জন্য কড়া কারন দেখাতে হয়েছে তার এবং শাহিনের। তা কার্যকর হতেও সময় নিয়েছে বেশ কয়েকদিন। ততোদিনে পরিশ্রম ও হয়েছে ভালো।
তাফসির সোফায় হেলান দেওয়া অবস্থাতেই চোখ বন্ধ করলো। বেশ কিছুক্ষণ কেটে যাওয়ার পর মেয়েলি বডি ওয়াশ ও শ্যাম্পুর তীব্র ঘ্রাণ নাকে এসে বিঁধল। সাথে ভেসে আসলো রিনরিনে কন্ঠস্বর।

” আপনি কি ঘুমিয়ে পরেছেন?”

প্রাচুর্য পাশে বসে তাফসিরের উদ্দেশ্যে বললো। তাফসির জবাব না দিয়ে পিটপিট করে চোখ খুলতেই প্রাচুর্য পুনরায় মিন মিন করে বললো—

” সরি একটু দেরি হয়ে গেলো। আপনাকে অনেকক্ষণ অপেক্ষা করালাম তাই না?”

প্রাচুর্যের সদ্য গোসল করে আসা স্নিগ্ধ মুখের দিকে তাকিয়ে তাফসিরের বিরক্তি মুহুর্তেই ভ্যানিশ হয়ে গেলো। মুখে মিষ্টি হাসি এনে সোফা ছেড়ে উঠতে উঠতে বললো—

” সমস্যা নেই। আয় ”

#চলবে

একটি উত্তর ত্যাগ

আপনার মন্তব্য লিখুন দয়া করে!
এখানে আপনার নাম লিখুন দয়া করে