আমার পূর্ণতা পর্ব-০৭

0
915

#আমার_পূর্ণতা
#রেদশী_ইসলাম
পর্বঃ ৭

চৌধুরী বাড়ির প্রত্যেকটি সদস্য বর্তমানে উপস্থিত আছে ছোট্ট একটি ঘরে। ঘরটা প্রাচুর্যের। মিসের শাহানা, মিসেস ফারাহ অর্থাৎ তাফসিরের মা এবং সামি-সাদনানের মা মুমতাহিনা বেগম ও উপস্থিত আছেন সেখানে। তারা তিনজন প্রাচুর্যকে ঘিরে বসে আছেন। মিসেস শাহানা অনবরত প্রাচুর্যের মাথায় হাত বুলিয়ে দিচ্ছেন আর বার বার আঁচল দিয়ে চোখের পানি মুছচ্ছেন।

ইশতিয়াক চৌধুরী চিন্তিত মুখে পায়চারি করছেন। আর ইনসাফ চৌধুরী মাথা নিচু করে বসে আছে প্রাচুর্যের পড়ার টেবিলের চেয়ারে। তাফসির এখানে উপস্থিত নেই। সে এতক্ষণ এখানে থাকলেও কিছুক্ষণ আগে বের হয়েছে কাউকে ফোন করতে করতে।

বাইরে ভোরের আলো ফুটবে ফুটবে ভাব। আজান দিয়েছে মিনিট পাঁচেক হলো। সে মুহূর্তে ইকরামুল বলে উঠলেন—

” ভাইজান আজান দিয়েছে। চলুন নামাজ পরে আসি সবাই। আর তাছাড়া তাফসির সব জানে যখন তখন সে চুপ করে বসে থাকবে না। কোনো না কোনো ব্যবস্থা করবেই। ইনসাফ চল নামাজ পরে আসি। আর কতক্ষণ এভাবে বসে থাকবি।”

ইকরামুল চৌধুরীর কথা শুনে পায়চারি থামিয়ে দিলেন ইশতিয়াক চৌধুরী। ইকারামের দিকে তাকিয়ে বললেন—

” হ্যাঁ যায় চলো। আমি ওজু করে আসছি। তোমরা ও এসো। ”

ইশতিয়াক চৌধুরী চলে যেতেই মাথা তুলে তাকালেন ইনসাফ চৌধুরী। মেজো ভাইয়ের দিকে তাকিয়ে বললেন—

” আমি বোধহয় দায়িত্ববান বাবা হতে পারলাম না ভাইজান। অফিস, কাজ সামলাতে সামলাতে মেয়েটার দিকে খেয়াল রাখতে পারলাম না ভাইজান। নিজের মেয়েটা কে নিরাপত্তা দিতে পারলাম না। বাবা হিসাবে নিজেকে ব্যর্থ মনে হচ্ছে।”

” কিসব বলছিস ইনু। দেখ যা হয়েছে তা হঠাৎ করেই। মেয়েটা ও তো এতোদিন বলে নি কিছু আমাদের। আর না বললে আমরা বুঝবো কি করে বল। এখন এসব কথা থাক। যা ওঠ। বড় ভাইজান এখনি চলে আসবে।”

” হ্যাঁ চলো।”

ইকরাম ও ইনসাফ চৌধুরী সেখান থেকে চলে যেতেই পুনরায় কেঁদে উঠলেন শাহানা। ওনার কান্না দেখে এগিয়ে আসলেন ফারাহ। শাহানার মাথায় হাত বুলিয়ে বললেন—

” থাক কাঁদিস না ছোট। যা হওয়ার হয়ে গিয়েছে। এখন কান্না করে লাভ নেই কোনো। তার থেকে ভালো চল আমরাও নামাজ আদায় করে নি। ওনারা ও তো গেছেন। মেয়েটা ঘুমিয়েছে যখন ঘুমাক। আমরা কথা বললে ওর ঘুমে আরও ব্যাঘাত ঘটবে। ”

” হ্যাঁ আপা চলো।”
.
.
প্রাচুর্যের ঘর থেকে সবাই বেরিয়ে যেতেই ঘরে প্রবেশ করলো তাফসির। দরজা চাপিয়ে দিয়ে ধীরে সুস্থে গিয়ে বসলো প্রাচুর্যের মাথার পাশে। মেয়েটা এখন গভীর ঘুমে। তাফসির কপালে হাত দিয়ে জ্বর পরীক্ষা করলো। নাহ্ এক ফোঁটাও কমে নি জ্বর। সে আস্তে আস্তে প্রাচুর্যের মাথায় হাত বুলাতে থাকলো আর ভাবতে থাকলো তখনের কথা।

তখন তাফসির যখন কারোর ফুপিয়ে কান্নার আওয়াজ শুনলো তখন বুঝতে পারছিলো না আসলে এতো রাতে কে কান্না করছে। পরে যখন দেখলো প্রাচুর্যের বেলকনির দরজা খোলা তখন সন্দেহ হলো তার। কারন অন্যদিন রাতে সে দরজা বন্ধ করে ঘুমাই তবে আজ খোলা কেনো। তাই সন্দেহবসত তাফসির প্রাচুর্যের রুমের সামনে গেলো। প্রথমে দরজা নক করলো কিন্তু খুললো না প্রাচুর্য। ভেতর থেকে কান্নার আওয়াজ ও স্পষ্ট শোনা যাচ্ছিলো। তখন সন্দেহ গাঢ় হলো তার। তাই সে আবার নিজের বেলকনিতে চলে আসলো। প্রাচুর্যের বেলকনি থেকে তার বেলকনির দুরত্ব বেশি নয় তাই সে অনায়াসেই লাফিয়ে যেতে পারলো। কিন্তু যখন ভেতরে ঢুকলো তখন স্তব্ধ হয়ে গেলো। প্রাচুর্য হাঁটুতে মুখ গুঁজে ফুপিয়ে ফুপিয়ে কাঁদছে। চুল গুলো সব এলোমেলো। তাফসির তাড়াতাড়ি প্রাচুর্যের কাছে গেলো। ব্যস্ত ভঙ্গিতে মুখ উচু করে ধরলো প্রাচুর্যের। আর তখনই তাফসিরের বুকটা ধ্বক করে উঠলো।

জ্বরে গা পুড়ে যাচ্ছে। কান্না করতে করতে মুখ লাল হয়ে গেছে প্রাচুর্যের। চোখ ফুলে উঠেছে যার দরুন তাকাতে পর্যন্ত পারছে না। আর তার মধ্যে গালে পাঁচ আঙুলের দাগ খয়েরী রঙ ধারন করেছে। যা দেখেই আঁতকে উঠলো তাফসির। প্রাচুর্যের মুখ দু’হাতের মধ্যে নিয়ে জিজ্ঞেস করতে থাকলো ” কি হয়েছে ” কিন্তু কান্নার দাপুটে কথা বলতে পারছিলো না সে। অনেক কষ্টে মুখ খুলালো প্রাচুর্যের আর সব শুনে তাফসিরের রাগে কপালের রগ ফুলে উঠলো। তৎক্ষনাৎ যেয়ে ডেকে আনলো সবাইকে। অনেক বকাঝকা ও করলো মেয়ের দিকে খেয়াল না রাখার কারনে। সব শুনে সবাই ও স্তব্ধ হয়ে গেছিলো। মিসেস শাহানা তো দৌড়ে যেয়ে মেয়েকে ঝাপটে ধরলো। মা কে পেয়ে প্রাচুর্যও জড়িয়ে ধরলো। আর কান্না করতে করতে একসময় ঘুমিয়ে পরলো সে।

সে সময়ের কথা মনে পরতেই হাতের মুঠো শক্ত হয়ে উঠলো তাফসিরের। প্রাচুর্যের এ অবস্থা যে করেছে তাকে ছারবে না সে। এখন শুধু সকাল হওয়ার অপেক্ষা। যদিও সকাল হতে আর বাকি নেই বেশি। এইতো মাত্র আর কিছুক্ষণ।

——————————

যখন সকাল হলো তখন তাফসিরকে খুঁজে পাওয়া গেলো না কোথাও। রোজকার দিনের মতো সকালের নাস্তা করে অফিসে চলে গেলেন সবাই। ইনসাফ চৌধুরী যাওয়ার আগে মেয়ের ঘর থেকে ঘুরে গেছেন একবার। এ অবস্থায় মেয়েকে একা রেখে মোটেও অফিসে যেতে ইচ্ছে করছিলো না তার। কিন্তু আজ ইম্পর্ট্যান্ট মিটিং আছে বলে যেতে হলো।

শাহানা বেগম খাবার নিয়ে রুমে এলেন প্রাচুর্যের। মেয়েকে ঘুৃম থেকে তুলে জ্বর চেক করলেন। এখন যদিও বেশি জ্বর নেই তবে হালকা হালকা আছে। প্রাচুর্যকে উঠিয়ে ফ্রেশ করে নাস্তা করিয়ে ওষুধ খাইয়ে দিলেন। তারপর চুল আঁচড়িয়ে মাথায় তেল দিয়ে লম্বা বিনুনি করে দিলেন। পুরোটা সময় চুপ করে মাথা নুইয়ে ছিলো প্রাচুর্য। তার মুখ থেকে একটা কথাও বের হয় নি। যা দেখে মন ভার হলো শাহানার।
তার মেয়েটা বোকা। ছেলেটা যে এতো ডিস্টার্ব করছে তা যদি শুরুতে বলতো তাহলে জল এতো দুর গড়াতো না আজ। তখনই ব্যবস্থা নেওয়া যেতো কোনো। এর মধ্যেই দরজা খোলার আওয়াজে সেদিকে ফিরে তাকালেন মিসেস শাহানা।

তাফসির এসেছে। প্রাচুর্য এক পলক সেদিকে তাকিয়েই আবার মাথা নুইয়ে ফেললো। তাফসির গিয়ে সোজা বসলো শাহানার পাশে। মিসেস শাহানা তাফসিরের দিকে তাকিয়ে চিন্তিত মুখে বললেন—

” আব্বা ব্যবস্থা করেছিস কোনো? ছেলে টা কে? কোথায় থাকে খোঁজ নিয়েছিস?

তাফসির কিছু না বলে শুধু ইশারায় মাথা নাড়ালো। তারপর বলতে শুরু করলো—

” ছেলেটার নাম তানভির হাসান। প্রাচুর্যদের সাথে একই ক্লাসে পরতো। প্রাচুর্য যখন স্কুলে ছিলো তখন থেকেই ওর পেছনে ঘুরতো। তখন ওতো টাও ডিস্টার্ব করে নি যদিও। কিন্তু দিন যতো যেতে থাকলো ততো বেশি বিরক্ত করা শুরু করলো প্রাচুর্যকে।”

তাফসিরের কথায় শাহানা বললেন—

” আর কিছু জানতে পেরেছিস? এমনি এমনিই ছেড়ে দিলি? কিছু বলিস নি ওকে?”

তাফসির একবার প্রাচুর্যের দিক তাকালো তারপর শাহানা বেগমের দিকে তাকিয়ে ইশারায় বাইরে আসতে বলে সে বাইরে চলে গেলো। সাথে সাথে চলে গেলেন শাহানা ও। প্রাচুর্য এখন শুয়ে আছে চোখ বন্ধ করে। তার এসব বিষয়ে মন নেই।
.
.
শাহানা বেগম বাইরে আসতেই দেখলেন তাফসির দাড়িয়ে আছে করিডরের শেষ প্রান্তে। শাহানা বেগম এগিয়ে গেলেন তাফসিরের দিকে। তাফসিরের কাঁধে হাত দিয়ে বললেন—

” এইবার বল আব্বা।”

” ছেলেটার বয়স উনিশ বা বিশ হবে হয়তো। প্রাচুর্যদের সাথে পড়লেও এসএসসি তে ফেল করে থেকে গেলো আবার সেই টেনে। এইটুকু বয়সেই সে বিভিন্ন নেশাদ্রব্য সেবন করে। এমন কোনো মাদক নেই যা সে গ্রহণ করে নি। ওদের এলাকায় মাঝেমধ্যে রাস্তা ঘাটে পরে থাকতে দেখা যায় ওকে। সাথে আছে মেয়ে জনিত সমস্যা। শুধু প্রাচুর্য না, এমন অনেক মেয়ে আছে যাদের রাস্তাঘাটে ব্যাড সাউন্ড করে। বাবা নেই। মারা গেছে অনেক বছর আগেই। মা মানুষ করছে তবে মায়ের কোনো কথায় শোনে না। নেশার টাকা না পেলে মায়ের গায়ে হাত তুলতে দু’বার ও ভাবে না। প্রাচুর্যের পেছনে পরে ছিলো কারন প্রাচুর্যের সুন্দর চেহারা। আর চৌধুরী বাড়ির মেয়ের সাথে একবার রিলেশন হয়ে গেলে তখন বিভিন্ন উছিলায় প্রাচুর্য থেকে টাকা নিতো। তখন ওর নেশার টাকা ও হয়ে যেতো সাথে পাওয়ার ও। কিন্তু কাল প্রাচুর্য ওসব কথা বলায় রাগে এসব করেছে সাথে এতোদিনের রাগ টাও ঝেরেছে।”

” তুই কিছু বলিস নি আব্বা? এমনি এমনিই ছেড়ে দিলি?”

শাহানার কথায় মুচকি হাসলো তাফসির। সাথে বাম হাত উঁচু করলো যেখানে আপাতত ব্যান্ডেজে আবৃত।

চলবে

একটি উত্তর ত্যাগ

আপনার মন্তব্য লিখুন দয়া করে!
এখানে আপনার নাম লিখুন দয়া করে