#আমার_পূর্ণতা
#রেদশী_ইসলাম
পর্বঃ ৩
আশ্চর্য হওয়ার ভান করে বললেন ” তোরা কি পুরো বসুন্ধরা উঠিয়ে নিয়ে এলি নাকি? বাপ চাচারা যা আয় করছে সব দেখি তোরা শপিং এর পেছনে লাগিয়ে দিচ্ছিস। ”
ওনার কথা শুনে মেজাজ গরম হলেও কিছু না বলে চুপ করে থাকলাম। কারন আমি কিছু বললেই তো দোষ। দেখা গেলো আবারও বেয়াদব উপাধি পেয়ে গেলাম।
কিন্তু রিয়া আপু চুপ করে থাকলো না। মিন মিন করে বললো ” তেমন কিছুই না ভাইয়া। আসলে কালকে আপুর রিসিপশনে সবাই একই রকমের শাড়ি পড়বো তো তাই।”
উত্তরে তাফসির ভাই কিছু না বলে ধুপ করে বসে পরলো আমার পাশে। আমি সরে বসতে গিয়ে খেয়াল করলাম এপাশে সোফার হাতল ছাড়া আর কিছু নেই। উনি একবার আমার দিকে তাকিয়ে পরমুহূর্তে চোখ ঘুরিয়ে ফোনের দিকে তাকালো। আমি আড়চোখে একবার ফোনের দিকে তাকিয়ে চোখ সরিয়ে নিতেই আবার তাকালাম। হঠাৎ মস্তিষ্কে হানা দিলো একটু আগে আড় চোখে দেখা আবছা সেই তিনটি শব্দ। আমি কি সত্যি দেখলাম? তাফসির ভাইকে কে জানি আই লাভ ইউ বললো না? তার মানে তাফসির ভাই প্রেম করছেন?
ফোনের স্কিনের দিকে তাকিয়ে আছি সেটা হয়তো খেয়াল করেছেন উনি। সাথে সাথে ফোনের পাওয়ার বাটন অফ করে পকেটে ঢুকালো ফোন। ভ্রু কুঁচকে আমার দিকে তাকিয়ে বললেন,,
” অন্যের ফোনে উঁকিঝুকি দেওয়া যে ব্যাড ম্যানার্স এটা জানিস না তুই?”
বুঝলাম ধরা পরে গেছি। তবুও সাফাই গাইতে বললাম ” আমি কোথায় আপনার ফোনে উঁকিঝুঁকি দিলাম তাফসির ভাই? আমি তো ওই পাশের হাতলে থাকা তেলাপোকা টা কে দেখছিলাম। দেখুন দেখুন এখনো যাচ্ছে না।”
আমার কথা শুনে পাশের হাতলের দিকে তাকালেন উনি। সত্যি তেলাপোকা দেখে আর কিছু বললেন না। উঠে চলে গেলেন ওনার রুমের দিকে।
বুঝলাম কথায় হয়তো কাজ হয়েছে। মনে মনে তেলাপোকা টা কে ধন্যবাদ জানালাম। কারন সে এসে সময় মতো না বসলে আজকে মান সন্মান সব যেতো শুধু মাত্র তাফসির ভাইয়ের ফোনের দিকে তাকানোর জন্য।
এর মধ্যে মা এসে তাড়া লাগালেন। আমাদের এখনো বসে থাকতে দেখে রাগী গলায় বললেন,,
” তোরা এখনো উঠিস নি? তোদের নিয়ে কি করবো বল তো। একটু পরেই তোদের বাপ-চাচারা নিচে নামবে খেতে আর তোরা এখনো বসে আছিস? আজকে কি নতুন জানছিস যে সবাই একসাথে খেতে বসে এ বাড়িতে? নিয়ম কানুন সব ভুলে গেলি? ”
মায়ের কথা শুনে আমি বললাম ” যাচ্ছি মা। ফ্রেশ হয়েই চলে আসছি। বেশিক্ষণ লাগবে না। ”
——————
তখন সকাল ১০ টা বেজে ৩০ মিনিট। শাড়ি পরে হালকা সাজগোজ করে যখন আয়নার সামনে নিজেকে ঘুড়িয়ে ঘুড়িয়ে দেখছি সেই মুহুর্তে দরজায় নক করলো কেউ। নিজেকে আর একবার ভালো করে দেখে নিয়ে ধীর পায়ে গিয়ে দরজা খুলতেই আমাকে ধাক্কা দিয়ে ভেতরে ঢুকলো সামি। পরতে পরতেও নিজেকে সামলে নিলাম। ওর কাজে সাথে সাথে মেজাজ গরম হয়ে গেলো আমার। ধমক দিয়ে বললাম,,
” এভাবে কেউ ধাক্কা দেয়? কমনসেন্স নেই? যদি পরে যেতাম? আর তুই আমার রুমে কেনো ঢুকেছিস? যা বের হ।”
আমার কথা শুনে সামি ভাবলেশহীন ভাবে উত্তর দিলো ” তোমার রুমে আমি এমনেও থাকতে আসি নি। ইহ্ যেদিকেই তাকাই শুধু পিংক আর পিংক। আমার মতো একজন ব্যক্তিত্বসম্পন্ন মানুষ এমন মেয়েলি ঘরে থাকবে ভাবলে কি করে? আমি তো শুধু তোমাকে ডাকতে এসেছি। কারন সবাই একটু পরেই বের হবেন। বড় বাবা তাড়াতাড়ি যেতে বলেছে সবাইকে। ”
ওর কথা শুনে অবাক হওয়ার ভান করে বললাম ” তুই ব্যক্তিত্বসম্পন্ন মানুষ? এমন মিথ্যা কথাটা বললো কে তোকে? তোকে ব্যক্তিত্বসম্পন্ন মানুষ বললে তো আসল ব্যক্তিত্বসম্পন্ন মানুষদের অপমান করা হবে।”
” কি হচ্ছে এ ঘরে? ”
আমাদের ঝগড়ার মধ্যেই তৃতীয় ব্যক্তির কথা শুনে দুজনেই ঘুরে তাকালাম দরজার দিক। তাফসির ভাই দরজার সামনে দাঁড়িয়ে আছেন। ওনার কথা শুনে সামি দ্রুত বললো ” দেখো না ভাইয়া প্রাচু আপু বকা দিচ্ছে আমাকে”
সামির কথা শুনে আমার দিক থেকে চোখ সরালেন উনি। সামির দিকে তাকিয়ে বললেন ” আচ্ছা তুই যা। আসছে ও।”
সামি আর কিছু না বলে চুপচাপ মাথা নিচু করে চলে গেলো।
সামি ঘর থেকে বের হতেই ধীর পায়ে এগিয়ে এসে আমার মুখোমুখি দাঁড়ালেন তাফসির ভাই। ওনাকে আসতে দেখে আরেকটু গুটিয়ে দাঁড়ালাম আমি। এমনিতেই শাড়ি পরলে প্রচুর লজ্জা পাই আমি তার মধ্যে আবার ওনার সামনে।
উনি একবার আমার পা থেকে মাথা পর্যন্ত চোখ বুলিয়ে আমার মুখের দিকে তাকালেন। মনে মনে প্রস্তুতি নিলাম ওনার মুখ থেকে কোনো আজাইরা কথা শোনার। কারন উনি তো ভালো কথা বলতে পারেন না কখনো। কিন্তু উনি আমাকে অবাক করে দিয়ে ড্রেসিং টেবিলের উপর থেকে টিপের পাতা থেকে কালো একটি টিপ নিয়ে পড়িয়ে দিলেন কপালে। আমি অবাক চোখে ওনার দিকে তাকাতেই উনি জোর পায়ে রুম থেকে বেরিয়ে গেলেন।
—————————
রাদিয়া আপুর শশুর বাড়িতে অনুষ্ঠান শেষ হতেই রউনা দিলাম আমরা। সাথে রাদিয়া আপু আর তার সদ্য বিবাহ করা স্বামী মহাশয় ও আছেন বটে। আমাদের গাড়িতে আছে শুধু কাজিন গ্রুপ ও আবির ভাইয়া অর্থাৎ আপুর হাসবেন্ড। যদিও সব কাজিনের এক গাড়িতে জায়গা হয় নি। অন্য গাড়িতেও আছেন তারা। ওনারা তাফসির ভাইয়ের নানা বাড়ির দিকের কাজিন। আমাদের গাড়িতে তাফসির ভাই ড্রাইভ করছেন। আর আমরা গাড়ির ভেতরে ও আড্ডা দিচ্ছি। আবির ভাইয়া খুব হাসিখুশি মানুষ। আমাদের আড্ডার মধ্যেই আবির ভাইয়া তাফসির ভাইকে বলে উঠলেন একটা চায়ের দোকানের পাশে গাড়ি থামাতে। চা খাবো সবাই। আবির ভাইয়ার কথা মতো তাফসির ভাই কিছুক্ষণ পর গাড়ি থামালেন একটা টং দোকানের সামনে। তারপর আমরা সবাই একে একে নেমে দাড়ালাম গাড়ি থেকে। আবির ভাইয়া চায়ের অর্ডার দিয়ে এসে দাড়ালেন আপুর পাশে। একে অপরে কি সুন্দর গল্প করছেন।
ওনাদের থেকে চোখ সরিয়ে একে একে সবাইকে দেখলাম। তিশা আপু, সাইমা আপু, আদিত ভাইয়া অর্থাৎ তিশা আপুর বড় ভাই এবং সামি-সাদনান সবাই দোকানের ভেতরের বেঞ্চে বসে গল্প করছে আর তাফসির ভাই গাড়ির সামনে হেলান দিয়ে দাড়িয়ে দাড়িয়ে ফোন টিপছেন।
এর মধ্যেই চা দিয়ে গেলে দোকানের কর্মরত ছোট ছেলেটা। আমি চা খেতে খেতে আকাশের দিকে তাকালাম। গোল থালার মতো পূর্ণ চাঁদ উঠেছে আজ। ফেসবুক পোস্টে দেখেছিলাম আজ নাকি ব্লু-মুন দেখতে পাওয়া যাবে। এটাই তবে সেই ব্লু-মুন। যার আলো তে আশপাশ হয়ে উঠেছে সোনালী রং। চাঁদের থেকে চোখ সরিয়ে তাফসির ভাইয়ের দিকে তাকাতেই দেখলাম চটপট চোখ সরিয়ে অন্য দিকে তাকালেন উনি। তবে কি এতোক্ষণ যাবত উনি আমার দিকেই তাকিয়ে ছিলেন?
.
.
.
.
সকাল ৭ টা নাগাদ এলার্মের শব্দে ঘুম ভাঙলো আমার। আড়মোড়া ভেঙে উঠে বসলাম আমি। আজ থেকে আবার সেই রুটিন মাফিক জীবন শুরু। এতোদিন বিয়ে উপলক্ষে শান্তিতে ছিলাম। আজকে থেকে আবার সেই কলেজ, কোচিং, পড়ালেখা শুরু। সকাল ৮ টা ৩০ থেকে কলেজ তাই তাড়াতাড়ি করে ফ্রেস হতে চলে গেলাম। বাড়ি থেকে কলেজে যেতে আধ ঘন্টা সময় লাগে।
একবারে রেডি হয়ে নিচে আসতেই দেখলাম খাওয়া শুরু করে দিয়েছে সবাই। তাফসির ভাই অনুপস্থিত। হয়তো এখনো ঘুমাচ্ছেন। আমি তাড়াতাড়ি খেয়ে বেরিয়ে গেলাম কলেজের উদ্দেশ্যে।
_____
কলেজে পৌঁছে সবার আগে দেখা হলো প্রিয়তির সাথে। যে সম্পর্কে আমার বেস্ট ফ্রেন্ড। আমাকে দেখতেই এগিয়ে আসলো আমার দিকে। ব্যাস আর কি লাগে? শুরু হলো আমাদের গল্প। যে গল্প কোচিং শেষ না হওয়া পর্যন্ত ননস্টপ চলবে।
কলেজ ছুটি হলো ২.৩০ মিনিটে। ক্লান্তিতে শরীর চলছিলো না তারপরও কোচিং শেষে একবারে বাড়িতে ফিরতে হবে নাহলে মা মেরে হাড্ডি গুড়ো গুড়ো করে ফেলবেন।
কিন্তু কোচিং শুরু হতে এখনো ৪৫ মিনিট বাকি তাই চলে গেলাম কলেজের পাশের একটা কফি শপে। কফি শপটা নতুন করেছে। ভিতরে জায়গা ছোট হলেও ডেকোরেশন অসম্ভব সুন্দর। প্রায় প্রতিদিন ই কলেজ শেষে আসা হয় এখানে। শুধু আমি আর প্রিয়তি না। আমাদের সাথে আরও চার-পাচঁটা ফ্রেন্ড যুক্ত হয়। এ সময় টুকু তে আড্ডা দি সবাই। বেশ ভালোই সময় কাটে তাতে।
আড্ডা দিতে দিতে হঠাৎ ফোন বের করলো তানজিম। তা দেখে অবাক হয়ে গেলাম সবাই। কারন কলেজে ফোন ব্যবহার করা নিষিদ্ধ। প্রিয়তি তানজিমের উদ্দেশ্যে বললো,,
” তানজিম ফোন এনেছিস তুই? কিন্তু কিভাবে? ধরা খাইস নি? ”
প্রিয়তির কথা শুনে তানজিম বললো ” আমাকে কি তোদের মতো বোকা পেয়েছিস নাকি যে ধরা খাবো? আমি ফোন লুকানোর নিনজা টেকনিক জানি। ধরা খেলেও ফোন খুজে বের করতে পারবে না স্যার-ম্যাম রা।”
” কিন্তু এটাকে তো রুলস ব্রেক বলে। কি দরকার শুধু শুধু ফোন আনার?” ____বলে উঠলাম আমি।
আমার কথায় তানজিম বললো ” রাখ তোর রুলস ব্রেক। কলেজ,কোচিং শেষ হতে হতে সেই বিকেল। এতোক্ষণ অনলাইনে না ঢুকে পারা যায় নাকি?”
এর মধ্যে পাশ থেকে অপ্সরা বল উঠলো ” আচ্ছা থাম তোরা। তানজিম ফোন দে। ছবি তুলি সবাই। ইনস্টাগ্রামে আপলোড দিবো ”
.
.
.
.
সন্ধ্যা পার হয়ে রাত নামলো যখন তখন প্রাচুর্য পড়ার টেবিলে বসে। এতোক্ষণ পড়ার কারনে প্রচুর মাথা ব্যাথা করছিলো। তাই মা কে কফি দিতে বলবে মনে মনে ঠিক করলো। কিন্তু যেই ওমনি উঠে দাড়ালো তখনি দরজার খট করে খুলে ভেতরে প্রবেশ করলো তাফসির। তাফসির কে দেখতেই প্রাচুর্য বিহ্বল চোখে তাকালো। বুঝে উঠতে পারলো না এ সময় তার ঘরে তাফসির ভাইয়ের কাজ টা কি। তাই কিছু না বলে চেয়ে থাকলো সেদিকে।
তাফসির ভাই কিছু না বলে টেবিলের সামনে থেকে চেয়ার নিয়ে বসে পরলো পায়ের ওপর পা তুলে। যা দেখেই ভ্রু কুঁচকে এলো আমার। তৎক্ষনাৎ তাফসির ভাই ফোন ঘেটে কিছু একটা বের করলেন। ফোন তুলে আমার মুখের সামনে ধরতেই হতভম্ব হয়ে গেলাম।
চলবে