#আমার_তুমি[২]
#পর্ব_৪০[অন্তিম পর্ব]
#জান্নাত_সুলতানা
-“এই তুই তুরাগ এর সাথে কেনো আজ পুকুর পাড়ে গিয়েছিলি?”
ছোট সায়রা মিশানের প্রশ্নে মনে হয় ভীষণ খুশি হলো।তৎক্ষনাৎ হাতের পুতুল বিছানায় ফেলে দিয়ে বসা ছেড়ে ওঠে এগিয়ে এলো।আর খুশিতে গদগদ হয়ে জবাব দিলো,
-“তুলাগ ভাই আমাতে এতটা চতলেত দিয়েতে।তাই গিয়েতি।”
মিশান বিরক্তিতে ভ্রু কুঁচকে নিলো। ক্লাস টুতে পড়ুয়া মেয়ে এখন ঠিকঠাক শব্দের উচ্চারণ করতে পারে না।ভূপৃষ্ঠ হওয়ার পর সাথে সাথে কাঁদে নি।টুইন বেবি ছিল তো।সেক্ষেত্রে প্রহর কাঁদলেও।সায়রা কাঁদে নি।চব্বিশ ঘন্টা অবজারভেশনে রাখতে হয়েছে। আর সেই থেকে সায়রা দ্রুত রিকোভার করে নি।আস্তে আস্তে সব হয়েছে যেমন বসা,কোনো জিনিস নিজের হাতে নিচ থেকে তুলতে পারা।কথা বলা হাঁটা চলা।সবাই অনেক টা সময় লেগেছে। তবে সেসব নিয়ে বেশি ভাবে না মিশান।কপালে বা হাতের তর্জনী আঙ্গুল ঘষে বিড়বিড় করে বলে উঠলো,
-“লোভী একটা।
ঠিক বাপের মতো।”
সায়রা গোল গোল চোখে তাকিয়ে থাকে মিশানের অধরপানে।ঠিক শুনতে পায় নি কি বলছে মিশান।কিছু জিগ্যেস করবে তার আগেই মিশান বলে উঠলো,
-“আমি তোকে রোজ স্কুল থেকে ফিরার সময় একটা করে চকলেট দেই।তবুও কেনো তুই তুরাগ এর থেকে চকলেট নিস?”
-“তুমি তো এততা দাও।আরেত তা তুলাগ ভাইয়া দেয়।দুতা হয়।”
সায়রা জবাবে এবার মিশান চটে গেলো।সায়রার চুলের ঝুঁটি টেনে ধরলো।সায়রা আকস্মিক আক্রমণে হকচকালো।কি হচ্ছে বুঝতে পেরে ফুঁপিয়ে ওঠে। মিশানের খেয়াল এলো।রাগের মাথায় একটু বেশি বাড়াবাড়ি করে ফেলছে।তাই ঝুঁটি ছেড়ে দিতে দিতে ধমকের স্বরে বলল,
-“এই চোপ।
একদম কোনো সাউন্ড করবি না।”
সায়রা চোখ ডলে।পিটপিট করে মিশানের দিকে তাকিয়ে থাকে।মিশান নিজের মাথার পেছনে এক হাত রেখে আরেক হাত কোমড়ে রেখে আবারও বিড়বিড় করে বলতে লাগলো,
-“তোর বাপের পয়সার অভাব যে তুই মানুষের থেকে চকলেট নিস!বেয়াদব কোথাকার।”
পরপরই সায়রা’র দিকে তীক্ষ্ণ দৃষ্টিতে তাকালো।সায়রা সঙ্গে সঙ্গে মাথা নিচু করে নিলো।মিশান বুঝতে পারে সায়রা ওকে ভয় পেয়েছে। অবশ্যই পাওয়ারই কথা যা ব্যবহার করেছে।না করে বা কি করত?যখন শুনেছে সায়রা তুরাগ এর সাথে স্কুল থেকে ফিরার সময় পুকুর পাড়ে গিয়েছে তখনই রাগ হয়।তবে তখন কিছু করতে পারে নি। তার অবশ্য কারণ রয়েছে। আজ মিশানের চৌদ্দ তম জন্মদিন। আর সেই উপলক্ষে ছোট খাটো একটা অনুষ্ঠান এর আয়োজন করছে সওদাগর বাড়ির সবাই। গরিব অসহায় মানুষদের খাবার আর মসজিদে ইমাম কে দিয়ে দো’আ পড়িয়েছে।সেই সাথে তাদের গ্রামের বড়ো মাদ্রাসা টায় সব শিক্ষার্থীদের খাবার দিয়েছে। সেইজন্য মিশান সারা দিন বাবার আর দাদার সাথে ছিল।আর বিকেলে বাড়ি ফিরে প্রহর এর কাছে এই খবর পাওয়া মাত্র মিশান রেগে আছে।এখন সন্ধ্যা। সবাই নিচে বসে আড্ডা দিচ্ছে। আর এই সুযোগে মিশান খোঁজ নিয়ে জানতে পেরেছ সায়রা উপরে আছে।
তাই তো তৎক্ষনাৎ চুপিচুপি উপরে রুমে চলে এসছে।
আজ কিছু বলতে না পারলে আর সুযোগ পাবে না।কারণ মিশান কাল হোস্টেল চলে যাবে।আর সায়রা মির্জা বাড়ি।দেখা যদিও স্কুলে হবে। কিন্তু বেশি কিছু তখন বলার সময় হয় না।
মিশান সায়রার একটা পুতুল হাতে নিলো।সায়রার কাছে এগিয়ে এসে সেটার চুল গুলো এলোমেলো করতে করতে বলল,
-“এখন থেকে আমি তোকে রোজ দুই টা চকলেট দেব।
কিন্তু তার জন্য শর্ত মানতে হবে তোকে।রাজি?”
সায়রা চোখ চিকচিক করতে গিয়েও করে না।কি শর্ত দিবে মিশান ভাই?মানুষ টা বেশি সুবিধার নয়। তাই আগে থেকে সব ক্লিয়ার করে নিতে হবে। শর্ত মানার মতো হলে তবেই রাজি হবে।ভ্রু কুঁচকে কোমড় দুই হাত রেখে জানালো,
-“বলো।
বেতি ততিন হলে পারবো না।”
মিশান অদ্ভুত হাসলো।পুতুল টা বিছানায় ছুঁড়ে ফেলে দিয়ে সায়রার ঠিক সামনে এসে দাঁড়ালো।
কণ্ঠে গম্ভীরতা এনে শুধালো,
-“আজ থেকে তুরাগ এর থেকে দূরে থাকবি।শুধু তুলার বস্তা নয়।সব ছেলের থেকে দূরে থাকবি। আর আমি যা বলবো তাই শুনতে হবে। নয়তো ছোট মনি কে বলে দেবো তুই ছেলেদের সাথে পুকুর পাড়ে যাস।”
সায়রা কিছু ভাবে। তুরাগ মাঝেমধ্যে চকলেট দেয়।প্রতিদিন দেয় না।কারণ রোজ তুরাগের সাথে ওর দেখা হয় না।ওদের সকালে ক্লাস হয় আর তুরাগের বারো টা থেকে। মাঝেমধ্যে ভাগ্যক্রমে দেখা হয়।তারমধ্যে আজ হয়েছিল।সব দিক ভেবে সায়রা বলল,
-“আত্তা।”
মিশান নিজের জিন্সের হাঁটু সমান প্যান্ট এর পকেট হাতরে একটা চকলেট বের করে। সায়রার হাত টেনে ধরে সেটা সায়রার হাতে দিতে দিতে হুশিয়ারি কণ্ঠে জানালো,
-“ভুলেও আমার সাথে চালাকি করতেই যাবি না।এই আশরিফ সওদাগর মিশান ভালোর ভালো তো খারাপের সরদার।”
কথা শেষ করে মিশান লম্বা লম্বা কদম ফেলে রুম ত্যাগ করে। সায়রা চকলেট পেয়ে সে কি খুশি। মিশান এর কথা এক কান দিয়ে ঢুকিয়ে আরেক কান দিয়ে বের করে দিয়েছে এতো ভারী কথার বিশ্লেষণ বোঝার সময় বা ব্রেইন কোনো টাই ওর হয় নি।
——-
সময় কত দ্রুতই চলে যায়।সময়ে সাথে সাথে আমরা কত কিছু হারিয়ে ফেলি আবার নতুন কিছু আসে জীবনে।তেমন সাদনানের আর প্রিয়তার ঘর আলো করে প্রহর সায়রা এসছে দেখতে দেখতে কেমন ছয় বছর চলে গেলো। কিন্তু প্রিয়তার যেনো চোখের সামনে এখনো ভাসে এই তো সেদিন না এই মানুষ টার সাথে কতরকম করে বিয়ে হলো।অথচ সেগুলো এখন সৃতি।
সবাই কত পরিবর্তন এসছে নিজেদের মাঝে কিন্তু ভালোবাসায় যেনো কোনো কমতি হয় মন্ত্রী সাদনানের।এখনো আগের মতোই ভালোবাসে, কেয়ার করে। এই তো একটু আগেও ফোন করে নিজের ছেলেমেয়েদের বাহানা করে বউয়ের সাথে পাক্কা এক ঘন্টা কথা বলেছে। অথচ মানুষ টা কিছু সময়ের জন্য বাহিরে গিয়েছে বলতে মূলত রিধি আর ওয়াজিদ কে এয়ারপোর্টে থেকে রিসিভ করতে গিয়েছে হয়তো ফিরেও আসবে কিছু সময় ব্যবধানে।
এখন সন্ধ্যা সবাই এক সাথে হলেই কেক্ কাটা হবে।প্রিয়তা ভাবলো কেক্ কাটা শেষ হলে আর প্রহর সায়রা কিছুই খাবে না।তাই খাবার নিয়ে ছেলে মেয়ে কে খুঁজতে লাগলো।রান্না ঘর হতে বেরিয়ে সিঁড়ির কাছে আসতেই দেখা মিললো ছেলে তার একদম নিচের সিঁড়িতে মনমরা হয়ে বসে আছে। প্রিয়তা কিছু ভেবে চট করে জিগ্যেস করলো,
-“প্রহর বোন কোথায়?”
প্রহর গম্ভীর হয়ে দাঁড়ালো মায়ের সামনে। বোন আজ তুরাগ এর সাথে পুকুর পাড়ে গিয়েছিল। সেই থেকে প্রহর আর বোনের সাথে কথা বলে নি। আর না খেলার জন্য ডেকেছে।তাই কোনো কথা সে বললো না। প্রিয়তা সন্দিহান চোখে ছেলের দিকে তাকালো। বোনের সাথে বেশ গলায়গলায় ভাব প্রহরের।টুইন হলেও দু’জন সম্পূর্ণ ভিন্ন দেখতে। আচার-আচরণ সব।প্রিয়তা জানে প্রহর রেগে থাকলে বোনের সাথে কথা বলে না।তাই নিজেই প্রহর কে আবার জিগ্যেস করলো,
-“ঝগড়া করেছে বোন?”
-“নাহ।”
প্রিয়তা আর কিছু জিগ্যেস করলো না। করেও লাভ নেই। প্রহর কখনো বলবে না কি হয়েছে। তাই প্রিয়তা কথা বাড়ায় না। খাবার প্লেট ডান হাতে নিয়ে ছেলের হাত বা হাতে আঁকড়ে ধরে উপরে আরভীর রুমের উদ্দেশ্য হাঁটা ধরে।মিশান, আরভী,তুরাগ,সায়রা, ছোট সোহান কে বিছানায় বসি চারদিক থেকে ঘিরে বসে আছে।
সোহান সারা আর রাহান এর ছেলে।দেড় বছর হয়েছে। দেখতে মাশাআল্লাহ মায়ের মতোই গুলোমুলো কিউট দেখতে হয়েছে।
সোহান কে দেখে প্রহর নিজে গিয়ে লাফিয়ে বসলো বিছানায়। প্রিয়তা নিজেও এগিয়ে গিয়ে পাশে দাঁড়ানো সার্ভেন্ট কে উদ্দেশ্য করে বলল,
-“খালা আপনি ওদের সবার খাবার এখানে পাঠিয়ে দিন।আমি খাইয়ে দেবো।”
প্রিয়তা প্লেট রেখে হাত ধুয়ে সোহান কে কোলে তুলে কিছু সময় আদর করলো।বাচ্চাদের সাথে টুকটাক কথা বলতে বলতে দু’জন কাজের মহিলা এসে হাজির হলো।এখানে সবচেয়ে ছোট সদস্য আরভী আর সোহান প্রিয়তা ওদের খাবার আলাদা রেখে আর বাকি সবার খাবার নিজে হাতে খেতে দিলো।
——
রাত আটটা নাগাদ সাদনান এলো ওয়াজিদ রিধি কে নিয়ে। পুরো সওদাগর বাড়ি মানুষের হৈ-হুল্লোড় পরো গেলো।কেউ বাদ যায়নি আজ সবাই সওদাগর বাড়িতে রয়েছে।
সাদনান লিভিং রুম ছেড়ে আগে কক্ষে চলে গেলো। সেই সাথে বউ কে ইশারা করে রুমে আসার জন্য বলে এলো।রিধি ওয়াজিদ কে সবাই ফ্রেশ হয়ে নিতে বললো।আর বাকিরা কেক্ কাটার প্রস্তুতি নিতে লাগলো।
প্রিয়তা রুমে প্রবেশ করা মাত্র সাদনান ওয়াশ রুম হতে বেরিয়ে এলো।উদোম গায়ে অল্পস্বল্প পানির ছিটেফোঁটা মুখের আশেপাশে কিছু চুলও ভেজা। হাতে টাওয়াল প্রিয়তা রুমে আসতেই টাওয়াল সাদনান বউয়ের উপর ছুঁড়ে ফেলে।
প্রিয়তা কিছু টা হকচকিয়ে টাওয়াল হাতে এগিয়ে এলো।সাদনান ঝট করে বউয়ের কোমড়ে দুই হাত চেপে ধরে শুন্যে তুলে নিলো।
প্রিয়তা টাওয়াল দিয়ে সাদনানের মুখের পানি সহ বুকে থাকা অল্পস্বল্প পানি গুলো মুছিয়ে দিতে দিতে বলল,
-“আপনার এই স্বভাব কোনো দিন যাবে না?”
-“আমার তুমি আছো।”
সাদনান মৃদু হেঁসে বলে উঠলো।
প্রিয়তা ছাড়া পেয়ে ব্যালকনিতে গিয়ে টাওয়াল মেলে দিয়ে রুমে এলো।সাদনান ততক্ষণে গায়ে পাঞ্জাবি পড়ে আয়নার সামনে দাঁড়িয়ে। প্রিয়তা নিজেও শাড়ী পড়ে রয়েছে।সাদা আর গাঢ় রানী গোলাপি সুতোর কাজ করা।সাদনান কে সাদা পাঞ্জাবি গায়ে দারুণ লাগছে।অবশ্য সব সময় সুদর্শন লাগে কিন্তু প্রিয়তা পাশে দাঁড়াতেই আজ পরিপূর্ণ মনে হলো নিজে কে।
সাদনান বউয়ের দিকে একপলক আয়নায় তাকিয়ে চোখ ফিরিয়ে সরাসরি তাকালো বউয়ের মুখপানে।
কিছু সময় মুগ্ধ দৃষ্টিতে তাকিয়ে রইলো। পরপরই ঝুঁকে বউয়ের কপালে ভালোবাসার পরশ দিলো।
নিজের বা হাতের মুঠোয় প্রিয়তার ডান হাত শক্ত করে আঙ্গুলের ভাঁজে পেঁচিয়ে ধরে রুম হতে বেরিয়ে এলো।
লিভিং রুম তখন মানুষ গিজগিজ করছে।
চারদিকে শুধু মানুষ।ছোট সায়রা সোফায় গুটিশুটি মেরে বসে আছে। তার পাশেই সব বাচ্চারা রয়েছে। একটু পর কেক্ কাটা হবে। মিশানও রেডি হয়ে চলে এসছে।
সবাই আসতেই শফিক সওদাগর তাগাদা দিলো।
মিশান কে ঘিরে সব বাচ্চারা কেক্ কাটলো।
কেক্ কাটার শেষ রাহান এলো কোথা থেকে দৌড়ে। হাতে একটা ক্যামেরা।
একজন সিকিউরিটির হাতে ক্যামেরা দিয়ে সবাই কে এক সাথে দাঁড়াতে তাগাদা দিতে লাগলো।সোফায় শফিক সওদাগর এর কোলে আরভী জাফর মির্জার কোলে নিজের পুঁতি প্রহর। আজম মির্জার কোলে সোহান।পাশে মফিজুর মির্জা মিশান কে আগলে নিয়ে দাঁড়িয়ে ওনার এক পাশে সুফিয়া বেগম অন্য পাশে তুরাগ কে কোলে নিয়ে কালাম খান। ওনার পাশে ওয়াসিফ দেওয়ান নিজের নাতনি রুহি কে কোলে নিয়ে দাঁড়ালো।
আয়না রাহাত সালেহা বেগম ইনিয়া কে সামনে নিয়ে রোজিনা বেগম তারা সবাই পুরুষদের পেছনে দাঁড়ালো। আর এক পাশে তিন্নি কবির এক সাথে দাঁড়ালো।মাইশা আয়ান মিশান কে সামনে রেখে এক সাথে, সারা রাহান ওদের পাশেই রিধি ওয়াজিদ আর তারপর প্রিয়তা সাদনান । সাদনান এক হাতে বউয়ের কোমড় জড়িয়ে ধরে একদম নিজের সাথে চেপে রাখলো।প্রিয়তা অবশ্য বারকয়েক ছাড়ানোর চেষ্টা করলো। তবে লাভের লাভ কিছু হলো না।মানুষ টার স্বভাব কোনো দিন বদলাবে না। রাহান সবার ঠিকঠাক দাঁড়ানো শেষ সিকিউরিটি কে ইশারায় ফটো ক্লিক করতে বললো।সিকিউরিটি মুচকি হেঁসে সবাই কে এক ফ্রেমে বন্দি করে নিলো।সাদনান ঠিক সেই সময় বউয়ের দিকে তাকিয়ে ফিসফিস করে বলে উঠলো,
-“আমার তুমি আমার স্বভাব। এই স্বভাব আমি কোনো দিন বদলাতে চাই না।”
~সমাপ্ত~
আমার তুমি সিজন-০১ পড়তে লেখাটির উপর ক্লিক করুন