#আমার_তুমি[২]
#পর্ব_২৪
#জান্নাত_সুলতানা
প্রিয়তা ড্যাব ড্যাব করে সাদনানের দিকে তাকিয়ে আছে।সাদনান ড্রেসিং টেবিলের সামনে দাঁড়িয়ে রেডি হচ্ছে। রোজকার শুভ্র পাঞ্জাবি ছেড়ে আজ কালো একটা পাঞ্জাবি পড়েছে।হাতে দামী একটা ঘড়ি চিকচিক করছে। চাপদাড়ি ভর্তি গাল টানটান ভ্রু জোড়া ছোট ছোট চোখ সরু নাক।অল্প সিগারেটে পোড়া অধর।মাথায় ঘনকালো চুল।উফ।এতো কেনো কিউট মানুষ টা?প্রিয়তার বুকের ভেতর জ্বালা ধরে। মনে মনে হিংসে হয়।এখন এই সুদর্শন পুরুষ বিয়ের অনুষ্ঠানে গেলেই তো সব মেয়ে হা করে তাকিয়ে থাকবে।প্রিয়তা কি করে সহ্য করবে সেসব?মনঃক্ষুণ্ন হয়।বুক ভারী হয়ে আসে।কষ্ট লাগে।চোখ চিকচিক করে। অধর কাপে।তবে নিজে কে সামলে নেয়।মন খারাপ করে তাকিয়ে থাকে নিজের ব্যক্তিগত পুরুষের সুন্দর অবয়বের দিকে।লম্বাটে বলিষ্ঠ সুপুরুষ টা নিজে কে সম্পূর্ণ পরিপাটি করে।কিন্তু পাঞ্জাবির বোতাম খোলা।যার ফলস্বরূপ বুকের ঘনকালো কিছু লোম উঁকিঝুঁকি মারছে। প্রিয়তার কয়েক সেকেন্ড এর জন্য শ্বাস-প্রশ্বাস অস্বাভাবিক হয়।ফের নিজে কে সামলে নেয়।সাদনান চুল নিজের হাতের সাহায্যে ঠিক করে এগিয়ে আসে।বউয়ের ঠিক বরাবর দাঁড়িয়ে বউয়ের মতিগতি বোঝার চেষ্টা করে। সফলও হয়।বউ তারই দিকে তাকিয়ে। মেয়েটার হুঁশ কি আছে?
সাদনান বউ কে এভাবে তাকিয়ে থাকতে দেখে মনে মনে হাসলো।তবে মুখ গম্ভীর আর থমথমে কণ্ঠে বলে উঠলো,
-“আমাকে দেখা শেষ?”
প্রিয়তা নড়েচড়ে বসলো।অসভ্য লোক।এভাবে কেউ জিগ্যেস করে?
সবাই কে নিজের মতো নির্লজ্জ ভাবে?
-“আমি মোটেও আপনাকে দেখছিলাম না।”
প্রিয়তা আমতা আমতা করে জানায়।সাদনান ভ্রু কুঁচকায়।চোখ বন্ধ করে শ্বাস টানে।দুই হাত এগিয়ে প্রিয়তার বাহু খাবলে ধরে। প্রিয়তা চমকায়।দুই হাতে সাদনানের বুকে ঠেকিয়ে নিজে কে সামলে নেয়।ধীরগতিতে নিজের হাত এগিয়ে আস্তে ধীরে সাদনানের পাঞ্জাবির বোতাম লাগিয়ে দেয়।প্রিয়তা নিজেও রেডি হয়ে গিয়েছে অনেক আগে। তাই অনুমতি চেয়ে জিগ্যেস করলো,
-“এবার যাই?”
সাদনান ছেড়ে দেয় বউ কে।ড্রেসিং টেবিলের উপর রাখা বেলি ফুলের মালা টা হাতে তুলে নেয়।বউয়ের পেছনে দাঁড়িয়ে সেটা চুলে খোঁপায় পড়িয়ে শাড়ির আঁচল তুলে ঘোমটা টেনে দিয়ে দুই হাতে গালে রাখে।প্রিয়তা চোখ বন্ধ করে রাখে।সাদনান বউয়ের ললাটে ওষ্ঠ ছুঁয়ে দিয়ে মোলায়েম কণ্ঠে বলল,
-“জান বাহিরের দিকে একদম যাবা না।ভাবির সাথে সাথে থাকবে।কিছু প্রয়োজন হলে মা, ছোট মা কে জানাবে।শরীর খারাপ লাগলে রুমে চলে আসবা।”
সাদনানের কথায় প্রিয়তা চোখ ছোট্ট ছোট্ট করে বলে উঠলো,
-“আগে যাই!
তাছাড়া আমি বাচ্চা না।আমার ভীষণ ক্ষুধা পাচ্ছে।
যাই?”
-“যাও।
আর হ্যাঁ, আমি ডাকার সাথে সাথে আমার সামনে দেখতে চাই।”
কথা শেষ হওয়ার সঙ্গে সঙ্গে প্রিয়তা মাথা নেড়ে সায় জানিয়ে রুম হতে বেরিয়ে গেলো।সাদনান তপ্ত শ্বাস ছাড়ে।
অতঃপর পেছন পেছন নিজেও বেরিয়ে আসে।
—-
বিয়ে বাড়ি চারদিকে মানুষ গিজগিজ করছে। বর উপস্থিত হয়েছে এসে আধঘন্টা হবে। আগে বিয়ে পড়ানো হবে তারপর খাওয়াদাওয়া। সাদনান যেখানে বসে আছে সেখানে কিছু সাংবাদিক রয়েছে।মন্ত্রীর ফুপাতো বোনের বিয়ে কেনো তার বাড়ি থেকে হচ্ছে এমন অহরহ প্রশ্ন আর কৌতূহল মানুষজনের মুখে মুখে।তবে এতে কারোর কোনো প্রতিক্রিয়া নেই।সাদনান আয়েশি ভঙ্গিতে বসে আছে সাথে রয়েছে আরো কিছু সুনামধন্য ব্যক্তি। অদূরে দাঁড়িয়ে আছে কিছু মেয়ে। তাদের মধ্যে কিছু মেয়ে সব মধ্যবয়সী লোকের মধ্যে সুদর্শন পুরুষ কে চোখ সাহায্যে আহার করছে। প্রিয়তা দোতলায় দাঁড়িয়ে সেদিকে তাকিয়ে থাকে।সাদনান অবশ্য একবার উপরে দিকে তাকিয়ে শান্ত দৃষ্টি নিক্ষেপ করছে। এতে প্রিয়তা বরাবর কেঁপে উঠলেও এবার কোনো প্রতিক্রিয়া তার মাঝে দেখা যায় নি।
বিয়ে পড়ানো শেষ খাবার খাওয়ার পর কনে বিদায়ের পালা এলো।বিদায় মানে বিষাদ।রিধির বিদায় হতে হতে সন্ধ্যা গড়িয়ে যায়।আস্তে আস্তে কোলাহল পূর্ণ থেকে একদম পানির ন্যায় শান্ত হয়ে পরে পুরো মির্জা বাড়ি।শুধু সিকিউরিটি আর কাজের লোক বাদে আর কোনো বাড়ির সদস্য কে নজরে আসে না।
আম্বিয়া মির্জা বেশ অনেক টাই কেঁদেছেন।যার ফলস্বরূপ ওনি অসুস্থ হয়ে পড়েছেন। সবাই হয়তো ওনার কাছে বসে।
—-
মির্জা বাড়ি যতটা কোলাহলপূর্ণ ছিল তার ঠিক বিপরীতে দেওয়ান ভিলা। কোনো মানুষ নেই।শুধু কাজের লোক আর সিকিউরিটি ছাড়া।রিধি কে একজন কাজের লোক ওয়াজিদ এর রুমে দিয়ে গেলো।ওয়াজিদ রুমে বসে ছিল।কয়েকজন প্রতিবেশী নিচে এতোক্ষণ রিধি কে দেখতে এসছিল।নয়তো ওয়াজিদ সাথে করে বউ কে নিয়ে আসত।মা নেই বোন নেই কোনো নিকটবর্তী আত্মীয় নেই।তাই কোনো ফর্মালিটি করার প্রয়োজন পড়ে না।ওয়াজিদ সোফায় বসে ছিল।রিধি কে রুমে প্রবেশ করতে দেখে পাশে থাকা একটা শপিং ব্যাগ হাতে এগিয়ে এলো।সেটা রিধির হাতে দিয়ে বলে উঠলো,
-“যাও।
ফ্রেশ হয়ে এসো।অনেক টা দখল গিয়েছে এই দু’দিনে।”
রিধির চোখে মুখে ক্লান্তির ছাপ থাকলে মুখে রয়েছে মুষ্টি একটা হাসি।প্রাপ্তি। পূর্ণতার।ভালোবাসার মানুষ টাকে সারাজীবন এর জন্য নিজের হালাল ভাবে পাওয়ার।ওয়াজিদ মুগ্ধ। বরাবরই সেই রিধি কে দেখে মুগ্ধ হয়।তবে তৃষ্ণা মেটে না।ক্লান্তির সমাপ্তি ঘটলেও বুকের ভেতর মরুভূমির ন্যায় খা খা করতে থাকে বুকের তৃষ্ণা এই রমণী কে মরার আগপর্যন্ত হয়তো দেখার তৃষ্ণা মিটবে না।
-“যাও দ্রুত।
অপেক্ষা করছি।”
ওয়াজিদ মৃদু কণ্ঠে জানালো। রিধি মাথা নেড়ে ওয়াশ রুমে চলে গেলো।বিছানা রংবেরঙের ফুল দিয়ে সাজিয়েছে ওয়াজিদ এর কিছু বন্ধ।এরজন্য অবশ্য হারামি বন্ধুমহল মোটা অংকের একটা টাকার অংশ নিয়েছে।
ওয়াজিদ তাকিয়ে রইলো। রিধির ফুলে এলার্জি রয়েছে। যদিও রিধি ফুল অনেক পছন্দ করে। কিন্তু ওয়াজিদ চাইছে না আজ এমন একটা দিনে রিধির কোনো রকম সমস্যার মধ্যে পরে।ঝটপট ফুলের সাথে বিছানার চাদর সহ তুলে বিনে রেখে দিলো।অতঃপর ছাঁদের সাথে বিছানায় লম্বা লম্বা করে টানানো ফুল গুলো খুলে সব বিনে রাখে।রিধি ওয়াশ রুম হতে ফ্রেশ হয়ে এসে ওয়াজিদ কে এসব করতে দেখে বিস্ময় নিয়ে জিগ্যেস করলো,
-“আপনি সব ফুল কেনো তুলে নিয়েছেন?
আল্লাহ!”
-“তোমার এলার্জি আছে।”
ওয়াজিদ এর শান্ত কণ্ঠ। রিধি শাড়ী আর দোপাট্টা হাতে নিয়ে এগিয়ে এলো।বিছানায় ফেলে মুখে হাত দিয়ে আগের ন্যায় কণ্ঠে বলল,
-“আপনি এলার্জির জন্য,,
-“ফুল ছাড়া বাসর হয় না?
না-কি ভালোবাসা কমতি হয়!”
ওয়াজিদের থমথমে কণ্ঠ শোনে রিধি নিজেও থমথমে খেলো।কিছু বলার জন্য মুখ খুলবে তার আগেই ওয়াজিদ বলল,
-“এসো খাবার খেয়ে নেবে।
ঠান্ডা হয়ে যাচ্ছে।”
ওয়াজিদ গিয়ে সোফায় বসে পড়ে। রিধির খাবার এর দিকে তাকিয়ে পরিবারের কথা মনে পড়ে গেলো।বিশেষ করে নিজের ভাইয়ের কথা।মন খারাপ হয়।তবে পেটে ক্ষুধা থাকায় কিছু বলে না।সেই দুপুরে বড় মামি কয়েক লোকমা খাবার খাইয়ে দিয়ে ছিল।তখন রিধি খেতে পারেনি। তাই আর কথা না বাড়িয়ে ওয়াজিদ এর পাশে বসে। ওয়াজিদ খাবার মেখে রিধি কে খাইয়ে দেয়।সাথে নিজেও খেয়ে নেয়।খাওয়া শেষ ঠিক তক্ষুনি ওয়াজিদ এর ফোন বেজে ওঠে। রাহান কল করেছে। ওয়াজিদ ভালোমন্দ জিগ্যেস করে রিধির কাছে দিয়ে দেয়।
রিধি অনেক সময় নিয়ে সবার সাথে কথা বলে ব্যালকনি হতে রুমে এলো।ওয়াজিদ তখন ল্যাপটপ নিয়ে বসে আছে।
রিধি এগিয়ে গিয়ে পাশে বসলো। ওয়াজিদ মৃদু হেঁসে জিজ্ঞেস করলো,
-“কথা শেষ?”
রিধি ঘাড় নাড়ে। ওয়াজিদ আবার বলল,
-“লাইট অফ করে শুয়ে পড়ো।
সারা দিন অনেক দখল গিয়েছে।”
-“ঘুমিয়ে পড়ব?”
রিধি সাথে সাথে বলে উঠলো। ওয়াজিদ ভ্রু কুঁচকে তাকায়।রিধি থমথমে খায়।কথার ভাঁজে বেফাঁস কথা মুখ ফসকে চলে এসছে।বুঝতে পেরে মনে মনে জিহ্বা কাটে।তবে মুখে জোর করে হাসি টেনে আমতা আমতা করে বলল,
-“না মানে সারা দিন অনেক দখল গিয়েছে। যাই ঘুমিয়ে পড়ি।”
-“বাট আফসোস সোনা।
সেটা এখন হচ্ছে না।”
ওয়াজিদ ল্যাপটপ পাশের টেবিলের উপর রেখে রিধি কে টেনে দুই হাত রিধির কোমড় পেঁচিয়ে বলে উঠে।রিধি চমকায়।বিস্ফারিত নয়নে তাকায় ওয়াজিদ এর মুখের দিকে।এক অদ্ভুত নেশা চোখে লেগে আছে। রিধি সঙ্গে সঙ্গে চোখ নামিয়ে নেয়।ওয়াজিদ বা হাতে বেডের সাইডে থাকা সুইচ টিপে লাইট অফ করে রিধির গলায় মুখ গুঁজে দিলো। রিধি কেঁপে উঠল। শক্ত করে ওয়াজিদ এর চুল খামচে ধরতেই ওয়াজিদ নেশাতুর কণ্ঠে বলে উঠলো,
-“এতো ফাস্ট।
ধীরে জান, আমি ফাস্ট হলে তুমি আমাকে সামলাতে পারবে তো!”
#চলবে….
#আমার_তুমি[২]
#পর্ব_২৫
#জান্নাত_সুলতানা
“আমি দ্রুত ফিরে আাসার চেষ্টা করবো।
তুমি ফ্রেশ হয়ে খাবার খেয়ে নিও।”
ছোট একটা বার্তা। রিধির এতোক্ষণ মন খারাপ ছিল।সকালে ঘুম থেকে ওঠেই ওয়াজিদ এর একটা কল আসায় বাড়ি থেকে বেরিয়ে গিয়েছে। দেশে আসার পর একটা হসপিটাল জয়েন করেছে ওয়াজিদ। যদিও সে একেবারেই চলে আসে নি।তবে যতদিন দেশে আছে ততদিনে সেটায় ডিউটি করবে।হসপিটালের মালিক ওয়াজিদ এর এক বন্ধুর বাবা আর সেই ওয়াজিদ কে সময় দেওয়ার জন্য আবদার করেছেন।
রিধি ওয়াজিদ কে ফিরতি কিছু একটা বার্তা পাঠিয়ে ফ্রেশ হতে ওয়াশ রুমের দিকে পা বাড়াল।
——
-“বাবা অসুস্থ।
দু’দিন থাকি?”
অনেক টা সাহস সঞ্চয় করে আবদার টা করে ফেললো প্রিয়তা।ওপাশে নিশ্চুপ সাদনান।প্রিয়তা চাতক পাখির ন্যায় অপেক্ষারত।অনুমতি কি দিবে মন্ত্রী সাহেব?
প্রিয়তার অপেক্ষার অবসান ঘটিয়ে সাদনান গুরুগম্ভীর কণ্ঠে বলল,
-“তুমি এখন যাও।
এব্যাপারে আমি পরে কথা বলছি।”
আহ্ কি রাশভারী কণ্ঠস্বর। এই কথার পিঠে কি বলবে প্রিয়তা? কোনো শব্দচয়ণ যে তার মস্তিষ্ক তৈরী করতে পারছে না। তাই তো নিঃশব্দে ফোন কেটে দিলো। সাদনান ফোনের ওপাশে কোনো সারা শব্দ না পেয়ে ফোন কান হতে সড়িয়ে সামনে আনলো।লাইন কেটে দিয়েছে প্রিয়তা।তপ্ত শ্বাস ছাড়ে সাদনান। আজ দু’দিন হয় শফিক সওদাগর একটু অসুস্থ। মূলত বিয়ে বাড়ি থেকে যাওয়ার পর কিছু টা অসুস্থ বোধ করছিল।আয়না দেখতে গেলেও প্রিয়তা কে সাদনান যেতে দেয় নি।বলেছে সময় করে সে নিয়ে যাবে কিন্তু এখনো আজ দু’দিন পেরিয়ে গেলো সাদনান নিয়ে যেতে পারে নি। এরমধ্যে শফিক সওদাগর নিজের আদরের ছোট মেয়ে কে দেখার জন্য বারংবার বলে যাচ্ছে। প্রিয়তা নিজের বাবা-র জন্য মন খারাপ।আর আজ আম্বিয়া মির্জা নিজেও দেখতে যাবে।তাই সবাই একসাথে চলে যাবে।
এমনটাই সালেহা বেগম সাদনান কে ফোন করে জানিয়েছে।সাদনান সেসব ভাবনা সাইডে রেখে সামনে মিটিংয়ে মনোযোগ দিলো।
—-
সকাল এগারোটা নাগাদ সওদাগর বাড়ি এসে পৌঁছাল মির্জা বাড়ির প্রায় অর্ধেক মানুষ।সব মহিলার এসেছেন। দুপুরে খাওয়া দাওয়া আর সারা দিন থেকে বিকেলে নাস্তা করে সবাই আবার চলে গেলো।সাথে করে আয়নাকে নিয়ে গেছে।প্রিয়তা বিকেল টা বাবা-র ঘরে বসে রইলো।আয়ান বোনের জন্য সন্ধ্যায় বাড়ি ফিরে এলো।সাথে নিয়ে এলে বোনের পছন্দের হরেকরকমের বাহিরের খাবার।প্রিয়তা ভাইয়ের সঙ্গে আর বাবার গা ঘেঁষে বসে।
আজ অনেক দিন ধরে নিজে কে মুক্ত পাখি মনে হলো।সারা দিন কোনো খবরদার করে নি যে কেউ।বাবা-র শরীরের গন্ধ শুঁকে। ভাইয়ের ভালোবাসা আর যত্ন সব সময় আলাদা।
আয়ান বোন কে নিজের হাতে খাইয়ে দিলো।সাথে মাইশা কেও। রাতে আড্ডা দিয়ে খাবার প্রিয়তা শফিক সওদাগর এর রুমে বসে খেলো।রাত সাড়ে ন’টা নাগাদ প্রিয়তা রুমে এলো।ফ্রেশ হয়ে ফোন টা হাতে নিলো।সারাদিন মানুষের ভীড়ে থাকলে কষ্ট একাকিত্ব ঘুচে যায়।কিন্তু রাত?রাত হলেই তো আবার সেই একাকিত্ব।বুকের কষ্ট যে সব উগড়ে বেরিয়ে আসতে চায়।দমবন্ধ লাগে। বুকের ভেতর তীব্র থেকে তীব্র যন্ত্রণা অনুভব হয়।প্রিয়তা কথা গুলো ভাবতে ভাবতে ফোন টা হাতে নিয়ে ফোনের স্কিনে মন্ত্রী সাদনান শাহরিয়ার একটা সফেদা পাঞ্জাবি গায়ে গাড়িতে হেলান দিয়ে দাঁড়িয়ে থাকা একটা ছবি জ্বলজ্বল করছে। প্রিয়তার চোখ হতে অশ্রু গড়িয়ে ঠিক সাদনান এর পিকচার টার উপর পড়লো। প্রিয়তা কাঁপা কাঁপা ডান হাত টা তুলে সাদনানের ছবিটার উপর হতে জলের ফোঁটা টা মুছতে মুছতে বিড়বিড় করে বলে উঠলো,
-“আপনি এতো টা কেনো পাষাণ প্রিয় পুরুষ?
আপনার সাথে থাকা যে দিনদিন বন্দী পাখির ন্যায় হয়ে যাচ্ছে।ভালোবাসার মানুষ টার সাথে থাকা মানে তো স্বাধীনতা।কিন্তু আপনি তো আমার সব স্বাধীনতা বেড়াজালে বন্দী করে দিয়েছেন।”
প্রিয়তার বকবক করার মাঝেই একটা নোটিফিকেশন এলো। প্রিয়তা হোয়াটসঅ্যাপে গিয়ে নোটিফিকেশন ওপেন করতেই নজরে এলো,
“আমি গাড়িতে অপেক্ষা করছি।
আয়ান কে বলে দিচ্ছি। চলে এসো।”
প্রিয়তা চোখ বন্ধ নিলো।পরপরই দ্রুত হাতে কিছু একটা টাইপ করে সেন্ট করে দিয়ে নেট অফ করে বিছানায় শুয়ে পড়লো।মিনিট পাঁচ মিনিট এর মধ্যে শরীরে ঠান্ডা হাতের শীতল স্পর্শ পেতে প্রিয়তা চমকাল।
চোখ বড় বড় করে শোয়া থেকে ওঠে বসতেই প্রথমে দরজার দিকে নজর দিলো।দরজা বন্ধ করে নি সে।কিন্তু দরজা এখন বন্ধ আছে। প্রিয়তা এবার সামনে তাকাল।ড্রিম লাইটের কমলা রঙের আবছা আলোয়ে শুভ্র পাঞ্জাবি পরিহিত বলিষ্ঠ পুরুষ সাদনান শাহরিয়ার কে দেখতে দানবের চেয়ে কম কিছু লাগছে না।প্রিয়তা আস্তে করে একবার ফাঁকা ঢোক গিলে পানি। পরপরই নিজের বাহুতে শক্ত হাতের খাবলা অনুভব করলো।সাদনান কিছু টা টেনে দাঁড় করালো বউকে।
চোয়াল শক্ত করে গম্ভীর কণ্ঠে শুধালো,
-“একটু আগে কি বললে!আর যাবা না তুমি আমার সাথে?”
প্রিয়তা চোখ বন্ধ করে খিঁচে দাঁড়িয়ে রইলো। কোনো জবাব দিলো না। সাদনানের রাগ যেনো এবার তরতর করে বেড়ে গেলো।মেয়ে টার সাহস ইদানীং বেড়েছে।কি বলল ও?একটু আগে! সাদনান কথা টা ভেবেই আরো রাগ বাড়ে।দিকবিদিকশুন্য হয়ে পরে।ভুলে গেলো ভালোবাসার মানুষ টার কষ্টের কথা। এক হাতের প্রিয়তার মুখ চেপে ধরে। প্রিয়তা অবাক হয়।ব্যাথায় চোটে চোখের কোঠায় জল চিকচিক করে।কিছু বলার জন্য খোঁজে পেলো না।বিয়ের একবছর হতে চলে।কখনো এমন ব্যবহার করে নিয়ে সাদনান।তাই ব্যথার চেয়ে বিস্ময় টা বেশি।প্রিয়তার ভাবনার মাঝেই সাদনান হিসহিসিয়ে বলে উঠলো,
-“এই,এই উত্তর কেনো দিচ্ছিস না তুই?
আরেকবার বল!কি যেনো বলছিলি!”
প্রিয়তার দুই হাত সাদনানের হাতের উপর রেখে সরানোর বিফল চেষ্টা করতে করতে কাঁপা কাঁপা অধর জোড়া নেড়ে বলল,
-“আমার লাগছে।”
সাদনানের কি হলো?হুঁশ কি এলো?নিজের কলিজায় আঘাত করে কি সে ব্যথা পায় নি?হয়তো পেয়েছে। তাই তড়িৎ গতিতে বউয়ের চোয়াল ছেড়ে দিলো।শক্ত করে বুকে চেপে ধরতেই প্রিয়তার গলা দিয়ে গোঙানোর শব্দ হলো।চোখের জল সাদনানের পাঞ্জাবি বেদ করে বুকে স্পর্শ করতেই সাদনান বউয়ের মাথায় তালুতে চুলের ভাঁজে নিজের অধর বারকয়েক ছোঁয়াল।মুখে কিছু বলল না।প্রিয়তা ছুটাছুটি করল। তবে বিশেষ কোনো লাভ হলো না।সাদনান শক্ত করে জড়িয়ে ধরে কিছু বলার জন্য মুখ খোলার আগেই প্রিয়তা কান্না করতে করতে বলতে লাগলো,
-“আমার স্বাভাবিক জীবন চাই।বলেছিলাম আমি।আপনি আপনি জানতেন আমি কেমন।সেদিন এতো এতো মানুষের মধ্যে কতটা খারাপ পরিস্থিতির মধ্যে ছিলাম আমি।চারদিকে মানুষ ক্যামেরা,প্রশ্ন। অস্বস্তি হয় এসব আমার। আপনার সাথে কোথাও যাওয়া যায় না।আমি একা যেতে পারি না। সব সময় সাথে মানুষ নিয়ে চলে ফেরা করতে হয়।অসহ্য লাগে আমার এসব।সাধারণ আমি।সাধারণ ভাবে থাকতে কমফোর্টেবল ফিল করি।এতো সবে আমার দমবন্ধ লাগে। আপনার এতো কড়াকড়ি নিয়ম আমার একদম ভালো লাগে না। এদিকে যাবা না,ওটা করবা না,এভাবে থাকবে না,এটা খাবা না,ওটা খাবা না,এটা ধরবে না,ওটা পড়বে না।বিরক্ত লাগে সব কিছু।”
সাদনান যেনো স্তব্ধ। এতো এতো অভিযোগ বউয়ের? সত্যি কি সে ভালোবাসার নাম করে ভালোবাসার মানুষ টার সব স্বাধীনতা ছিনিয়ে নিয়েছে নিজের অজান্তেই!
কতটা বয়স?তারউপর থেকেছে তো সব সময় বাবা আর ভাইয়ের ছায়াতলে। এসবের ছোঁয়া যে কোনো ভাবে ছুঁয়ে যায় নি মেয়ে টাকে।
-“আ’ম সো্ সরি জান।”
কি মধুর কণ্ঠ। কি করে রেগে থাকবো প্রিয়তা?মানুষ টাকে না চাইতেও নিজের থেকে বেশি ভালোবেসে ফেলেছে।
—-
রাত তখন দেড় টা।সাদনান তখনো বউ কে বুকে আগলে বসে আছে। রাগ না-কি অভিমান কোন টা বউয়ের মনে! সাদনান জানে না। তবে বউ এখন কিছু টা স্বাভাবিক হয়েছে বোঝা যাচ্ছে। সাদনান বউয়ের হাতের উলটো পিঠে চুমু খেয়ে জিগ্যেস করলো,
-“ঘুমবে না জান?”
-“হু।
আপনি খাবার খাবেন না?”
প্রিয়তা মিনমিন করে জিগ্যেস করে। তখন হঠাৎ করে কি করে এতো সাহস এসছিল মনে প্রিয়তা জানে না।কত গুলো কথাই না মানুষ টা কে আজ শোনাল।ইশ এখন লজ্জায় মানুষ টার বুকেই মুখ লুকিয়ে বসে আছে। ভাবা যায়!সাদনান বউয়ের মুড যে স্বাভাবিক হয়েছে একদম শিওর হয়ে গেলো।মুখ গম্ভীর কণ্ঠ থমথমে এনে বলল,
-“এখানে এসছি রাত এগারো টায়।
এখন দেড় টা বাজে। তোমার এতো সময় পর আমার খাবার এর কথা মনে পড়লো!বাই দ্য ওয়ে, আমি খাবার খেয়ে এসছি।”
প্রিয়তা মনে মনে নিজে কে ইচ্ছে মতো গালাগাল করলো।সারা দিন মানুষ টা নিশ্চয়ই এক জায়গায় বসে ছিল না।এখানে সেখানে ঘুরাঘুরি করে এতো রাতে এসছে আর ও?এখন নিজের উপর রাগ লাগলো। তবে মুখে বলল,
-“আচ্ছা ফ্রেশ হয়ে আসুন।”
সাদনান তাই করে।গায়ের পাঞ্জাবি খুলে নেয়।উদোম হওয়া মাত্র প্রিয়তার মনে পড়ল।মন্ত্রী মশাই এখন পড়বে টা কি?তড়িঘড়ি করে ঘর ছেড়ে বেরিয়ে গেলো।বাহিরে বারান্দা থেকে গিয়ে আয়ানের একটা ট্রাউজার আর টি-শার্ট নিলো।ভাগ্য ভালো ছিল আজ আয়ান নিজের প্রায় অর্ধেক কাপড় ধুয়ে দিয়েছিল।আর প্রিয়তার ব্যালকনিতে বিকেলে রোদ পড়ে তাই তো বোনের ব্যালকনিতে এনে কাপড় মেলে দিয়ে গিয়েছিল। প্রিয়তা মনে মনে ভাই কে হাজার টা ধন্যবাদ দিতে ভুলে না।রুমে এসে দেখলো সাদনান ফ্রেশ হয়ে চলে এসছে।প্রিয়তার হাতের দিকে তাকিয়ে সাদনান কিছু বলার জন্য মুখ খোলার আগেই প্রিয়তা বলে উঠলো,
-“এগুলো পড়ে নিন।
হবে এতে?”
সাদনান কিছু বলে না।শুধু টি-শার্ট টা নিয়ে পড়ে নিলো।গাড়িতে অবশ্য একসেট ড্রেস সব সময় থাকে।সে কি আর জানতো বউ এমন ঠমক ধরবে তবে নাহয় ড্রেস নিয়ে তারপর আসতো।
প্রিয়তা ট্রাউজার আবার নিয়ে ব্যালকনিতে রেখে আসে।
সাদনান ড্রেসিং টেবিলের সামনে দাঁড়িয়ে নিজের চুল ঠিকঠাক করে। প্রিয়তা বিছানায় বসে পিটপিট করে সেদিকে তাকিয়ে থাকে।
মানুষ টা এই আবছা আলোয়ে কি এতো সাজুগুজু করছে!প্রিয়তার বুঝে আসে না।
সাদনান বিছানায় প্রিয়তার পাশে বসতেই প্রিয়তা একটু নড়েচড়ে বসলো।মূলত সাদনানের গা ঘেঁষে বসলো। সাদনানের পেট মুচড়ে হাসি পায়।
তবে হাসে না।বা হাতে বউয়ের কোমড় টেনে নিজের সাথে চেপে ধরে।আস্কারা পেয়ে বিড়াল ছানার ন্যায় গুটিশুটি মেরে সাদনানের বুকে গাপটি মেরে গেলো প্রিয়তা। সাদনান বউ কে নিজের উপর থেকে বিছানায় শুইয়ে দেয়।দুই হাত প্রিয়তার দু’দিকে রেখে প্রিয়তার পুরো মুখে একবার চোখ বুলিয়ে নিয়ে ধীরে কণ্ঠ বলে উঠলো,
-“মুড কি ঠিক আছে?”
প্রিয়তা নিজের মাথা টা উঁচু করে সাদনানের অধর নিজের অধর আলতো ছুঁয়ে দিয়ে জানাল,
-“বেশি না।
তবে আপনার ছোঁয়া তা সম্পূর্ণ করতে সক্ষম হবে।”
#চলবে….