#আমার_তুমি[২]
#পর্ব_৫
#জান্নাত_সুলতানা
সেই রাতে প্রিয়তা আর সাদনানের সাথে নিজের দৃষ্টি মিলাতে পারে না।
রাতে খাবার শেষ নিজে আগে আগে রুমে এসে গুটিশুটি মেরে বিছানার এক পাশে শুয়ে পড়ে।সাদনান শ্বশুর আর আয়ানের সাথে বেশ সময় নিয়ে আড্ডা দিয়ে রুমে এলো।সাদনান রুমে এসে দরজা আঁটকে দিয়ে বিছানায় শুয়ে রোজকার ন্যায় বউ কে জড়িয়ে ধরে।
প্রিয়তা তখন ঘমুে বিভোর। সাদনান বউয়ের মায়াময় মুখপানে তাকিয়ে থাকে।
আজ থেকে চার বছর আগে এই ছোট্ট গোলগাল মুখটার মায়া পড়ে ছিল সাদনান।
সে দিন রাহাতের জন্য আয়না কে দেখতে এসছিল মির্জা বাড়ির সবাই।সেদিন সাদনান এর অনার্স ফাইনাল ইয়ারে’র লাস্ট এক্সাম ছিল।
পরীক্ষা শেষ সোজা সওদাগর বাড়ি এসছিল।আর বাড়িতে ঢোকাতে সঙ্গে সঙ্গে সদ্য নাইনে ওঠা কিশোরীর শাড়ী পড়া রূপ সাদনান কে সেদিন ছোট প্রিয়তার মায়ায় পড়তে বাধ্য করেছিল।মির্জা বাড়িতে তাদের যাতায়াত আগে থেকে ছিল।আজ্জম মির্জার সাথে শফিক সওদাগর এর সেই ছোট বেলার বন্ধুত্বের খাতিরে দুই পরিবারে বেশ ভালো সম্পর্ক ছিল।আগে এই বাড়িতে আসা হলেও প্রিয়তার দিকে সাদনান কখনো মনে কোনো উদ্দেশ্য নিয়ে ছোট প্রিয়তার দিকে তাকায় নি। তবে সেই দিনের পর থেকে না চাইতেও সাদনান প্রিয়তার দিকে তাকালে নিজের পুরুষালী সত্ত্বা নাড়িয়ে দিতো।নিজের মনের কোথাও একটু এই রমণী তাকে টানত।নিজের সুন্দর সুশ্রী চেহারা আর শরীর এর ঘটন নিজের পার্সোনালিটির জন্য কমবেশি প্রায় অনেক মেয়ে আশেপাশে ঘুরঘুর করত। তবে সাদনান নিজে কখনো তাদের প্রতি কোনো টান ফিল করতা না বলে পাত্তা দেয় নি। গম্ভীর আর নিজের স্বভাবসুলভ আচরণ থমথমে কণ্ঠে কথা বলা পুরুষ টা সত্যি সেই ছোট প্রিয়তার জন্য মনে কিছু ফিল করত।তবে ব্যাপার টা পাত্তা দেয় নি। অবশ্য দেওয়ার কথাও নয়।বয়সের দিক দিয়ে দেখলে তো একদমই নয়।
সারা আর প্রিয়তা দু’জন একই সমানে পড়ত তারউপর স্কুল যাওয়ার পথে সাদনানদের বাড়ি। প্রিয়তা স্কুল যাওয়ার সময় সারা কে নিয়ে যেতো।বাড়ির ভেতর অবশ্য যেতো না।
সাদনান যথাসম্ভব এড়িয়ে চলার চেষ্টা করত তবে বারবারই মেয়ে টা ইচ্ছেকৃত বা দূর্ঘটনাবসত কোনো কোনো ভাবে সাদনান প্রিয়তার সামনে পড়ে যেতো।মাঝেমধ্যে সারা আর প্রিয়তা কে স্কুল পৌঁছে দিত।
এভাবে দেখতে দেখতে আর সাদনান নিজের লুকানো অনুভূতির সাথে যুদ্ধ করতে করতে পিচ্চি টা কখন যে বড় হয়ে গেলো সাদনান বুঝতেই পারে নি।আবার বিয়েও দিয়ে দিচ্ছিল মেয়ের কত কষ্ট করেই না বিয়ে টা আটকাল।বিয়ে ঠিক হয়েছে সাদনান জানত না।জানবে কি করে সে তো তখন জরুরি কাজে বাইরে ছিল।ফিরে এলো বিয়ের আগের দিন রাতে। অবশ্য আয়ান সঙ্গে না থাকলে সম্ভব হত না কিছু। ক’দিন পর এই পিচ্চি ভার্সিটির গন্ডিতে পা রাখবে। ভাবা যায়?
সাদনান কথা গুলো ভাবতে ভাবতে প্রিয়তার কপালে গাঢ় একটা চুমু খেলো।
শক্ত করে জড়িয়ে ধরে নিজের সাথে মুখ টা প্রিয়তার কানের কাছে নিয়ে ফিসফিস করে বলে উঠলো,
-“ভালোবাসি আমার জান।”
———
পরের দিন সকালে সাদনান প্রিয়তা সওদাগর বাড়ি থেকে নাস্তা করে বেরিয়ে আসে।সাদনান সাথে করে প্রিয়তার বইখাতা সব নিয়ে আসে।প্রিয়তা কে কোচিং-এ দিয়ে সাদনান চলে গেলো।
প্রিয়তা অনুভূতিহীন। ক্লাসে যাওয়ার পর সারা ভীষণ খুশি প্রিয়তা কে দেখে।প্রিয়তাও খুশি খুশি মনে ক্লাস করে।
ক্লাস শেষ হলে সারা আর প্রিয়তা দু’জনে বাড়ি চলে এলো।আম্বিয়া মির্জা তখন প্রিয়তার দিকে তীক্ষ্ণ দৃষ্টিতে তাকিয়ে।
প্রিয়তা দেখল তবে মাথা নুইয়ে রুমে চলে এলো।
ফ্রেশ হয়ে নিচে গিয়ে খাবার খেয়ে রুমে এসে লম্বা একটা ঘুম দিলো।
—–
মাইশা আর তিন্নি একই ডিপার্টমেন্টের স্টুডেন্ট। ভার্সিটিতে ভর্তি হওয়ার পর দু’জনের পরিচয় তবে কারোর সাথে কারোর পার্সোনাল বিষয় শেয়ার করার মতো সম্পর্ক এখনে হয় নি।
মাইশা যেদিন জানাল তাদের ডিপার্টমেন্ট এর লেকচারার কবির খাঁন এর সাথে তার এক কাজিনের বিয়ে ঠিক হয়েছে সেদিনের পর আর তিন্নি ভার্সিটিতে আসে নি।মাইশা ব্যাপার টা ঠিক বুঝতে পারে নি। হঠাৎ এভাবে মেয়ে টা হারিয়ে গেলো কেন!
আজ অনেক দিন পর মাইশা তিন্নি কে ক্লাসে দেখতে পেলো।উদাসীন মুখে পেছনের একটা বেঞ্চে গাপটি মেরে বসে আছে।সামনে একটা বই মেলে রাখা।কিন্তু দৃষ্টি তার বইয়ের দিকে নয়।বাইরের দিকে তাকিয়ে আনমনা হয়ে বসে আছে।
মাইশা এগিয়ে গিয়ে পাশে বসলো।তিন্নি সামন্য চমকাল।তবে পরক্ষণেই মাইশা কে দেখে হাসলো।ভালো মন্দ জিজ্ঞেস করলো। মাইশা জবাব দিলো।
প্রশ্ন করলো,
-“এতো দিন আসো নি কেন?”
-“অসুস্থ ছিলাম।”
মাইশা বুঝতে পারে তিন্নি সত্যি বলে নি।একটা মেয়ে হয়ে আরেকটা মেয়ের এমন আচরণের একটাই মানে দাঁড়ায়। মাইশা তিন্নির মুখ থেকে সত্যি বের করতে চাইছে। তাই কথার ফাঁকে ঘুরিয়ে ফিরিয়ে জানাল,
-“তুমি জানো!কবির স্যার ওইদিন বিয়ে করতে আসে নি।
আমার ছোট ভাই সাদনান মির্জার সাথে বিয়ে হয়েছে।”
তিন্নি মাইশার কথা শুনে অবাক হলো।মনের কোথাও একটু আশা দেখা দিলো। মন টা হঠাৎ ভালো হয়ে গেলো।তবে বিস্ময় নিয়ে জিগ্যেস করলো,
-“ভবিষ্যতে এমপি মির্জা সাদনান?
তোমার ভাই?”
-“হ্যাঁ।”
তিন্নির যেনো আজ অবাক হওয়ার দিন।বারবার চমকপ্রদ তথ্য জানতে পরাছে।
ওদের দু’জনের কথার মাঝেই কবির খাঁন ক্লাসে এলো।ক্লাস শুরু হলো।তিন্নি মুগ্ধতা নিয়ে সেদিকে তাকিয়ে রইলো।
হোক না একতরফা ভালোবাসা।অনুভূতি তো সুন্দর। ভাবতে ভালো লাগে স্বপ্ন বুনতে ভালো লাগে।ততক্ষণে সব ভালো যতক্ষণ অপরপ্রান্তে মানুষ টা এসবের কিছুটি তার নিকট অজানা।
——
রাত সাড়ে এগারো টার দিকে সাদনান, রাহান,জাফর মির্জা বাড়ি ফিরল।
তখন মাত্র লিভিং রুমে সুফিয়া বেগম, প্রিয়তা বসে ছিল।সবাই ফ্রেশ হয়ে এলেই তাদের খাবার দেওয়া হলো।খাবার খাওয়ার ফাঁকে জাফর মির্জা জানাল এই সাপ্তাহে মার্কা দেওয়া হবে।তার পরই ভোট প্রচার এর কাজ শুরু হবে। যদিও জয়ে নিয়ে কোনো ভয়ের আশংকা নেই।তবে বিরোধী দলের বর্তমান অবস্থানরত এমপি বেজায় খারাপ লোক।তাই যথাসম্ভব সবাই কে সাবধানে থাকতে হবে।
বাড়ি থেকে একা-একা কেউ না বেরুনো টা শ্রেয়।
সুফিয়া বেগম চিন্তিত বিরস মুখে ছেলের দিকে তাকিয়ে রইলো। সাদনান মায়ের দিকে তাকিয়ে আশ্বাস দিলো।কিছু হবে না। আল্লাহর উপর ভরসা রাখতে বলল।
খাবার শেষ সাদনান আগে আগে রুমে চলে গেলো প্রিয়তা সুফিয়া বেগম এর সাথে সব গুছিয়ে রুমে এলো প্রায় আধঘণ্টা পর জাফর মির্জার কথা শোনার পর থেকে কেমন অন্যমনস্ক হয়ে আছে।
রুমে এসে প্রিয়তা ওয়াশ রুম গেলো।ফিরে এলো মিনিট এর মাথায়।
সাদনান ব্যালকনি থেকে ফোনে কথা বলতে বলতে রুমে এলো।প্রিয়তা তখন ড্রেসিং টেবিলের সামনে দাঁড়িয়ে আনমনা হয়ে চুল আঁচড়াচ্ছে।
সাদনান ফোন কেটে সেটা সোফায় রেখে এগিয়ে এসে প্রিয়তার পেছনে দাঁড়িয়ে নিজের হাতে চিরুনি নিয়ে নিলো।প্রিয়তা হকচকিয়ে ওঠে। ধন্য ফিরতেই বুঝতে পারে সাদনান চুল বিনুনি করছে।
সাদনান প্রিয়তার চুল গুলো বিনুনি করতে করতে জানতে চাইলো,
-“ক্লাস কেমন হলো আজ?”
প্রিয়তা বলল,
-“ভালো।”
প্রিয়তা জবাবে বলল।পরপরই আবার বলল,
-“আমার রাজনীতি একদম পছন্দ নয়,সাদনান ভাই।”
-“জানি তো।”
প্রিয়তা সাদনানের জবাব শুনে অবাক হলো।
-“তাহলে?
স্বাভাবিক জীবন চাই।
সুন্দর সংসার চাই।আতংক আর ভয়ে নিয়ে কিচ্ছু হয় না।”
প্রিয়তার কথায় সাদনান কিছু একটা ফিল করে।মেয়ে টা তাকে নিয়ে ভাবছে। অবশ্য ভাবারই কথা বউ হয়।প্রিয়তা এতোক্ষণ আয়নায় সাদনান এর দিকে তাকিয়ে কথা বলছিল।সাদনান প্রিয়তার চুলে রাবার ব্যান্ড দিয়ে চুল আঁটকে দিলো।তারপর প্রিয়তা কে নিজের দিকে ফিরিয়ে প্রিয়তার দুই গালে হাত রাখে।বউয়ের ললাটে ওষ্ঠ ছুঁয়ে দিয়ে বলল,
-“আই প্রমিজ।আমার দেহে প্রাণ থাকা অব্ধি তোমার কিচ্ছু হতে দেব না।”
-“আমি আমার কথা বলছি না।
আপনার জন্য চিন্তা হয় আমার।”
-“কিচ্ছু হবে না আমার।”
-“আপনি জানতে চেয়েছিলেন না আমি কেন আপনাকে বিয়ে করতে চাই নি!আমার একটা স্বাভাবিক জীবন চাইতাম।সেইজন্য বাবার পছন্দের পাত্র কে বিয়ে করতে রাজি হয়েছিলাম।
অথচ ভাগ্য দেখুন ঠিক আমাকে আপনার সাথে বেঁধে দিলো।
কথায় আছে না আমরা যা ভাবি তা কখনো হয় না আর যা কখনো কল্পনাও করি না সেটাই হয়।”
-“তোমার আফসোস হয়?”
-“নাহ।
কখনো না।আমার ভাগ্য যা আছে সেটাই হয়েছে।”
সাদনান প্রিয়তা কে জড়িয়ে ধরলো।
প্রিয়তা নিজের দুইহাত সাদনান এর পিঠে রাখলো।
সাদনান মৃদু কণ্ঠে বলল,
-“আমার আমি কে তোমার জন্য ভালো রাখব।”
প্রিয়তা দীর্ঘ শ্বাস ছাড়ে। তবে পরক্ষণেই লজ্জায় সাদনান এর থেকে ছাড়া পাওয়ার জন্য ছুটোছুটি করে।সাদনান ছাড়ে না।
শক্ত করে বউ কে জড়িয়ে ধরে বিছানায় শুয়ে পড়ে।
প্রিয়তার কানের কাছে মুখ নিয়ে ফিসফিস করে বলল,
-“স্বাভাবিক হও।
তখন না হয় আমি তোমায় গভীর ভাবে ছুঁয়ে দেব।”
——
-“এতো রাতে তুই এখানে কি করছিস?
ঘুমিস নি কেন?”
সারা হকচকাল।
পেছন ফিরে রাহান কে দেখে অবাক হলো।
তবে নিজে কে সামলে নিয়ে পানির গ্লাস দেখিয়ে বলল,
-“পানি খেতে এসছি।”
-“রাতে ঘুমাস না?”
রাহান থমথমে কণ্ঠে জিগ্যেস করলো।
সারা সহজসরল গলায় বলল,
-“হ্যাঁ।
ঘুমব না কেন?”
-“তাহলে আমাকে এতো জ্বালাস কেন।”
রাহানা বিড়বিড় করে বলল।
সারা শুনতে পায় না।তাই জিগ্যেস করে,
-“কিছু বললেন?”
-“না,হ্যাঁ ভূতের মতো এভাবে রাতে আর ঘুরাঘুরি করবি না।
দেখা গেলো তোকে ভূত মনে করে কেউ ভয়ে জ্ঞান হারাবে।এখন যা রুমে যা।”
-“আমি ভূতের মতো কোথায় ঘুরঘুর করলাম?পানি ছিল না রুমে পানি খেতে এসছি।
আর আপনি এতো রাতে এখানে কি করছেন?”
সারা রাহানের দিকে চোখ কটমট করে তাকায়।
তবে পরক্ষণেই কিছু মনে হওয়ার মতো করে জিগ্যেস করলো।
রাহান চোরা চোখে একবার সারা’র দিকে তাকিয়ে থমথমে কণ্ঠে বলল,
-“ভূতের সাথে সাক্ষাৎ করতে এসছি।”.
#চলবে……