আমায় ডেকো অপরাহ্নে পর্ব-০৩

0
835

#আমায়_ডেকো_অপরাহ্নে
#আকাঙ্ক্ষা_আহনাফ_স্নেহা
#পর্ব_০৩

তিথির বিয়েটা শেষ পর্যন্ত হলো না বিয়ের দিন তিথির বাবার হার্ট অ্যাটাক হলো। ফরহাদ সাহেব এরপর আর কথা এগিয়ে নিয়ে যাননি। তিথিদের বাড়িতে অনেক মানুষের সমাগম কেউ রোগী দেখতে আসছে, আবার কেউ আসছে তিরষ্কার করতে। মেয়ের বিয়ে ভেঙে গিয়েছে। হাসিখুশি তিথির মুখ ফ্যাকাশে হয়ে গিয়েছে,আগের মতো বকবক করে না। আমাকে মাঝে মাঝে শুধু জিজ্ঞেস করে ‘ ফরহাদ সাহেব বিয়ে করেছে তাই না?’

আমি কিছুই বলতে পারি না অপ্রস্তুত হাসি, আমি ভালো করেই জানি ফরহাদ সাহেব বিয়ে করেছেন এবং জাপান চলেও গিয়েছেন। নিউমার্কেটে একদিন দেখা হয়েছিল চোর চোর ভাব নিয়ে অন্য দিকে হাটা ধরেছিল। উনার সুন্দরী বৌ অবাক হয়ে ডেকে যাচ্ছেন ‘ এই কোথায় যাচ্ছ তুমি, আমার হাতে চুড়ি গুলো পড়িয়ে দাও।’ পৃথিবীতে সবাইকে সান্ত্বনা প্রয়োগ করা যায়, একমাত্র নিজেকে ছাড়া। তিথির বাবার অসুখের ভিতরেই খবর এলো বাড়িটা নিলামে উঠবে। তিথিরা বাড়ি ছেড়ে দেওয়ার প্রস্তুতি নিচ্ছে।

দাদাজান এবারের চিঠিতেও আমাকে গ্রামে যাওয়ার অনুনয় করলেন। আমার একগুঁয়ে জীবন আর ভালো লাগছিল না, আমি রোজ বারান্দায় দাঁড়িয়ে থাকি, মাঝরাতে ছাদে উঠে দাঁড়িয়ে আকাশ দেখি। বৃষ্টি হলে ভিজে ভিজে বাহিরে যাই এই বুঝি কেউ এসে নেম প্লেটটা যত্ন করে ছুবে। কিছুই হয় না আমি সয়ে যাই চাপা আর্তনাদ। মাঝে মাঝে মা ভাঙা গলায় প্রশ্ন করেন ‘ তোর কী হয়েছে রে মা?’ আমি জবাব দিতে পারি না। ঘন্টার পর ঘন্টা মায়ের বুকে লেপ্টে থাকি। দিন যাচ্ছে ক্রমশই এভাবে। হুটহাট ঘুম ভেঙ্গে গেলে বালিশে মুখ গুঁজে ফুঁপিয়ে উঠি। কাঁপা কাঁপা হাতে লিখতে বসি ‘ আপনার কী আমার কথা মনে আছে?’ আমি কখনো মাছ খাই না, প্রেমে পড়লে মানুষ ছুতো খুঁজে বেড়ায় ঐ অপরপ্রান্তের মানুষটার সান্নিধ্য পাওয়ার জন্য। আমি বাবার পরিপাটি রুমটাতে গিয়ে বসলাম। ঠোঁট ফুলিয়ে বললাম ‘ বাবা চিতল মাছ খেতে ইচ্ছে করছে!’

বাবা বই পড়ায় ক্ষুণ্ণ হয়েছে তা চাপা পড়ে গেলো তার মোটা ফ্রেমের চশমা পরিহিত চোখের বিষ্ময়ে। ‘ কি বললি?’

‘ইয়ে বাবা, আমার না খুব চিতল মাছ খেতে ইচ্ছে করছে।’ কথাটা বলেই চোরা দৃষ্টিতে বাবাকে পরোখ করছি। ভাবা বই খুলতে খুলতে বললেন ‘ চিতল মাছ পাবো কোথায়? ঢাকা শহরে মাছের বাজারে গিয়ে এসব খুঁজে বের করতে করতে দিন চলে যাবে। তাছাড়া তুই তো মাছ খাস না,কাটা বাছতে পারিস না’

‘ অনুভ্র সাহেবকে বলো না চিতল মাছ নিয়ে আসতে।’
কথাটা বলেই বুঝতে পারলাম কী বলে ফেলেছি,কথাটা ঘুরিয়ে পেঁচিয়ে না বলে সরাসরি বলে দিয়েছি। আমার কোনো দোষ নেই,যা দোষ সব অনুভ্রর। তড়িগড়ি স্থান পরিবর্তন করলাম। বারান্দায় গিয়ে গ্রীলে ধরে আকাশ দেখলাম,আকাশ কৃষ্ণমেঘে মেঘাচ্ছন্ন। মেঘের গর্জন শোনা যাচ্ছে। ইচ্ছে করছিল বই পড়তে সময়টা বই পড়ে কাটাতে। নয়তো আমি দুদিনেই পাগল হয়ে যাবো। মনের অস্থিরতা ক্রমশই বেড়ে যাচ্ছে। সে ডুব দিলো যে আর ফিরলো না, অভিমান করতে ইচ্ছে করছে,অথচ তার সম্পর্কে ভালো করে কিছুই জানি না। বেগুনী রঙের শাড়ি পড়ে, চুল খোঁপা করলাম। শাড়ির কুচি ঠিক করতে মায়ের কাছে গেলাম,

‘ কোথায় যাচ্ছিস ঝড় বৃষ্টির মধ্যে?’

‘ আগে শাড়ির কুচি ঠিক করে দাও মা, তোমার কাপড় পরে সেলাই করো।’

মা আমার কুচি গুলো নিখুঁত ভাবে ঠিক করে দিলো, যত্ন করে কানের লতিতে কাজলের ছোঁয়া লাগিয়ে দিলো। আয়নার দিকে তাকিয়ে হালকা গোলাপি লিপস্টিক দিতে দিতে বললাম ‘ লাইব্রেরীতে যাচ্ছি মা কয়েকটা বই আনবো। তোমার জন্য বই আনতে হবে?’

‘ ঔষধের বক্সে দুইশো টাকা আছে দেখ, নজরুলের দুয়েকটা বই আনিস।’

‘ মা, পুরাতন একটা পঞ্চাশ টাকা আছে।’

‘ হ্যাঁ,তো?’

‘ টাকাটা নিয়ে যাই, এই দেখো ছিঁড়ে যাবে নরম নরম হয়ে আছে।’
_______________________________

নিউমার্কেটে গিয়ে বই আর কেনা হলো না, মায়ের দোয়া নামের এক কাপড়ের দোকানে কাঁদো কাঁদো মুখ নিয়ে একটা যুবক বসে আছে। আমি ডুকতেই উৎসাহ দেখালো না, আমাকে বললো ‘ কি নিবেন আপা?’ লক্ষ্য করলাম ছেলের মুখটাই কাঁদো কাঁদো। দোকানে চোখ বুলাতে গিয়ে দেখলাম সাদা রঙের চমৎকার একটি পাঞ্জাবি। গলার কাছ দিয়ে বাদামি রঙের সুতো আর নেভু ব্লু রঙের মিশ্রনে ভীষণ সুন্দর কাজ করা। ছেলেটা আমার দিকে উত্তরের আশায় তাকিয়ে আছে, আমি পাঞ্জাবিটার দিকে আঙুল দেখিয়ে বললাম ‘ ঐ যে সাদা রঙের পাঞ্জাবিটা নিবো।’

বৃষ্টি পড়ছে অনেক্ষণ অপেক্ষা করার পরেও বৃষ্টি থামেনি। শাড়ির কুচি মুঠোয় নিয়ে এক আঙুলে শপিং ব্যাগ নিয়ে দোকানের বারান্দা দিয়ে হাটছি। বৃষ্টি জড়সড় হয়ে নামলো বাসের ছাউনির নিচে দাড়ালাম, ছাউনিতে কয়েকজন ফকির শুয়ে আছে কাঁথা মুড়ি দিয়ে। বিশ্রী গন্ধ আসছে আশপাশ থেকে। সামনে অনেকগুলো রিক্সা জ্যাম হয়ে আছে রিক্সার টুংটাং শব্দ হচ্ছে। পায়ের কাছে এসে পা ছাড়া এক কুকুর আসলো সে জোরে জোরে ঘেউ ঘেউ করছে। ভয়ে আমি বাহিরে চলে আসলাম। বৃষ্টিতে ভিজে ভিজে এগিয়ে যাচ্ছি এখান থেকে ছোট খালার বাসায় গিয়ে উঠব। একজন রিক্সাওয়ালার অনুনয় শোনা যাচ্ছে ‘ বাপজান, আর দশটা ট্যাকা দেন,পেটে অনেক খিদা’

লোকটার জন্য মায়া লাগছে রিক্সার হুডের ভিতরে কে তা দেখতে পাওয়া যাচ্ছে না। তবে তার হাতে লিচুর ঝুড়ি, পায়ের কাছে দুইটা কাঁঠাল একটা বাজারের ব্যাগে, কাঁঠালের কষ পড়ছে বাহিরে। আমি পা বাড়ানোর আগেই একটা কণ্ঠস্বর শুনে থেমে গেলাম। ‘ ঠিক আছে চাচা, লিচু গুলো ধরেন। মানিব্যাগ বের করি আবার। আপনার বেশি খিদে লাগলে কয়েকটা লিচু খান’

এগিয়ে গেলাম বড় আশা নিয়ে মানুষটাকে দেখতে। গায়ে আকাশী রঙের শার্ট, কালো প্যান্ট। মাথা নুইয়ে কাঁঠাল গুলো গুলো ভালো করে ব্যাগের ভিতর ডুকালো। রিক্সা থেকে নামতেই জনবহুল রাস্তাটায় ঝুম বৃষ্টিতে আমাদের আরো একবার দৃষ্টির সন্ধিক্ষণ হলো। উৎসাহ দেখাতে গিয়ে সাদা বেগুনীর মিশ্রনে চুড়ি পড়া হাতটা নাড়ালাম। মানুষটা বিনয়ী হেসে স্বাভাবিকের চেয়ে জোরে বলে উঠল ‘ আরেহ, চিত্রলেখা!’

#চলবে….?

একটি উত্তর ত্যাগ

আপনার মন্তব্য লিখুন দয়া করে!
এখানে আপনার নাম লিখুন দয়া করে