আপনিময় বিরহ পর্ব-১৯ এবং শেষ পর্ব

0
1717

#আপনিময় বিরহ
#অন্তিম_পর্ব
#বোরহানা_আক্তার_রেশমী
________________

প্রিয়তা অনুভূতি শূণ্য দৃষ্টিতে একবার প্রিয়মের দিকে তো একবার তনিমার দিকে তাকায়। তনিমা অসহায় দৃষ্টিতে তাকিয়ে আছে প্রিয়তার দিকে। প্রিয়ম স্বাভাবিক। প্রিয়তা শান্ত গলায় বললো, ‘তনু তুই যা। আসতেছি!’

তনিমা কিছু বলতে গিয়েও বলে না৷ চুপ করে রুম থেকে চলে যায়৷ প্রিয়তা খানিকটা এগিয়ে আসে প্রিয়মের কাছে। অসহায় কন্ঠে বলে, ‘আপনি কি এখনো চুপ করে থাকবেন? কিছু বলবেন না?’

প্রিয়ম ডোন্ট কেয়ার ভাব নিয়ে বলে, ‘আমি কি বলবো? সাদাফের সাথে বাজি হইছিলো তোরে পটানোর তোরে বিয়ে করার না। সো সাদাফ তোরে বিয়ে করবে কি না আই ডোন্ট কেয়ার!’

প্রিয়তার যেনো শক্ত বাধটা মুহুর্তেই খুলে গেলো। ঝাপিয়ে পড়লো প্রিয়মের ওপর। প্রিয়ম ভারসাম্য রাখতে না পেরে কিছুটা পিছু হেলে যায়। প্রিয়তা শব্দ করে কেঁদে উঠে। প্রিয়ম শক্ত হয়ে দাঁড়িয়ে অন্য দিকে তাকিয়ে থাকে। প্রিয়তা হাউমাউ করে কেঁদে বলে,

‘আপনি আমার সাথে এমন কেন করতেছেন? আপনি তো আমাকে ভালোবাসেন বলেন। আমাকে এভাবে কষ্ট দিবেন না। আমি শিশির ভাইয়ের থেকে যে কষ্টটা পেয়েছি তা আরেকবার পেলে বাঁচতে পারবো না। আপনি বলেন না এতক্ষণ যা বলছেন সব মিথ্যা। বলেন না!’

প্রিয়ম টেনে সরিয়ে দেয় প্রিয়তাকে। প্রিয়তা সোজা হয়ে দাঁড়াতেই বলে, ‘তোর ন্যাকা কান্না অফ কর। যা এখান থেকে। আজাইরা প্যাচাল শোনার টাইম নাই আমার।’

প্রিয়তার কি হলো কে জানে! হুট করেই প্রিয়মের পা জড়িয়ে ধরে। প্রিয়মের বুকটা ধ্বক করে উঠে। প্রিয়তা ভাঙা ভাঙা ভাবে বলে, ‘প্রিয়ম ভাই আমি আপনাকে খুব ভালোবাসি প্লিজ আ…

আর কিছু বলার আগেই পা ঝাড়ি মেরে সরিয়ে নেয় প্রিয়ম। প্রিয়তা বাকরূদ্ধ হয়ে যায়। কান্না অটোমেটিক বন্ধ হয়ে যায়। প্রিয়ম পেছনে ফিরে তাকায়। প্রিয়তা তাচ্ছিল্যের সুরে হেঁসে বলে,

‘যে আপনিময় বিরহ আপনি কাটিয়ে আগলে রেখেছিলেন আজ আবার সেই আপনিময় বিরহ আপনিই আমাকে দিলেন! বিয়েটাকে পর্যন্ত অস্বীকার করলেন! আচ্ছা।’

প্রিয়তা কোনোরকমে উঠে দাঁড়ায়। তারপর কোনো দিকে না তাকিয়ে ছুটে বেড়িয়ে যায় রুম থেকে। প্রিয়তা বের হতেই প্রিয়ম পাশে থাকা গিটারটা ছুঁড়ে মারে ফ্লোরে। কয়েক টুকরো হয়ে ভেঙে গুড়িয়ে যায় সেইটা। হাঁটু মুড়িয়ে বসে শব্দ করে কেঁদে উঠে। কাঁধে কারো হাতের স্পর্শ পেয়ে পেছনে তাকিয়ে দেখে তাহেরা বেগম। প্রিয়ম তাহেরা বেগমকে জড়িয়ে ধরে হাউমাউ করে কেঁদে উঠে। তাহেরা বেগম নির্বাক। প্রিয়মের কান্নাটা হালকা হয়ে আসতেই তিনি জিজ্ঞেস করে,

‘প্রিয়তার সাথে এরকম করলি কেন?’

প্রিয়ম ভীষণ আক্ষেপ নিয়ে ভাঙা ভাঙা ভাবে বলে, ”আমি বলেছিলাম ওকে ভালোবাসায় মুড়িয়ে রাখবো। তা আর হলো না মা। আমি যা করেছি তাতে ওর ভালোই হবে। কেউ না জানুক তুমি তো জানো মা তোমার ছেলে তার টুনটুনি তার প্রিয়কে কতটা ভালোবাসে!’

তাহেরা বেগমের চোখ ভরে আসে। ছেলেটা কেন এমন করলো তা জানা নেই তার। কিন্তু সে ভালো করেই জানে প্রিয়তাকে প্রিয়ম কতটুকু ভালোবাসে!

প্রিয়তা কোনো রকম কান্না আটকে এগিয়ে আসে বাড়ির দিকে। সদর দরজায় দাঁড়াতেই শুনতে পায় তার বিয়ে নিয়ে কথা হচ্ছে। সাদাফের ফ্যামিলি রাজি প্রিয়তাকে বউ বানাতে। কিন্তু পলক সাহেব সিদ্ধান্তহীনতায় ভুগছে। তবুও ভদ্রতার খাতিরে বললেন,

‘দেখুন আপনারা এসেছেন খুব ভালো লাগলো। কিন্তু বিয়েটা এত তাড়াতাড়ি আর তাছাড়া আমার মেয়ের মত না নিয়ে দিতে পারবো না। আর এখন তো প্রিয়তা প্….

কথা শেষ করার আগেই প্রিয়তা ডেকে উঠে পলক সাহেবকে। পলক সাহেব মেয়ের চোখ মুখের দিকে তাকিয়ে আঁতকে উঠে। মেয়ের এই রকম বিধ্বস্ত অবস্থা সে শেষ দেখেছিলো শিশির আর অনিমার বিয়ের পর। উদয় আর তনিমাও চমকায়। তাঁরা বেগম তখন কিচেনে। পলক সাহেবের ভাবনার মাঝেই প্রিয়তা আস্তে করে বলে উঠে,

‘আমি বিয়েতে রাজি আব্বু।’

এটুকু কথায় যেন যথেষ্ট ছিলো পরিবেশকে নিস্তব্ধ করতে। সাদাফ নিজেও হা হয়ে গেছে প্রিয়তার কথায়। কম বেশি সবাই জানে প্রিয়তা, প্রিয়মের কথা। দুজন দুজনকে অনেকটা ভালোবাসে। ভার্সিটির সবাই এই জুটি নিয়ে বেশ কথা বলে। এমন কি হলো যার জন্য প্রিয়তা সাদাফকে বিয়ে করতে রাজি হয়ে গেলো! তাঁরা বেগম নিজেও কিচেন থেকে ট্রে হাতে নিয়ে আসার সময় কথাটা শুনলো। উদয় কিছু বলার জন্য এগিয়ে আসতেই প্রিয়তা আবার বলে উঠলো,

‘আব্বু যত দ্রুত পারো বিয়ের ব্যবস্থা করো।’

বলেই কাউকে কিছু না বলে চলে যায়। পলক সাহেব মেয়ের যাওয়ার দিকে তাকিয়ে থাকে। সাদাফের বাবা বলে উঠে,

‘মেয়ে যখন রাজি তখন তো…

‘আমরা আপনাদের জানাবো।’

কেউ আর কিছু বললো না। পরিবেশ থমথমে হলেও প্রিয়তার পরিবার অতিথি আপ্যায়ন করতে ত্রুটি রাখলেন না। প্রিয়তা রুমে এসে দরজা বন্ধ করে হাউমাউ করে কাঁদতে লাগে। বুকের বাম পাশটা ব্যাথা অনুভব করতেই ফ্লোরে শরীর এলিয়ে দেয়। প্রিয়মের কাছে যখন তাদের বিয়েটার কোনো মূল্য নাই তখন সেও আর দাম দিবে না। সাদাফকে সে বিয়ে করবে।

রাতের বেলায় ছাঁদে দাঁড়িয়ে সিগারেট ফুঁকছিলো প্রিয়ম। সে সময় হাজির হয় উদয়। চোখ মুখ লাল হয়ে গেছে রাগে। এসেই প্রিয়মের কলার টেনে ধরে। প্রিয়ম হাসে। অদ্ভুত সে হাসি। উদয় রেগে বলে,

‘নি’র্লজ্জের মতো হাসছিস কেন তুই? জানিস আজ কি হয়ছে? ধারণা আছে তোর! প্রিয়তা আর সাদাফের বিয়ে ফিক্সড হয়ে গেছে। প্রিয়তা আব্বুকে রাজি করিয়ে ৭ দিনের মধ্যে বিয়ে ফাইনাল করছে।’

প্রিয়ম ফের হাসে। বলে, ‘বাহ ভালো তো। কংগ্রেস দোস্ত। তোর বোনের বিবাহ জীবন সুখের হোক।’

‘মজা করছিস আমার সাথে? প্রিয়তা আর তুই একে অপরকে ভালোবাসা সত্বেও কি এমন হলো যে প্রিয়তা সাদাফকে বিয়ে করতে রাজি হয়ে গেলো!’

প্রিয়ম দীর্ঘশ্বাস নিয়ে বলে, ‘জীবনে প্রথম কোনো ভালো ডিসিশন নিয়েছে তোর বোন।’

উদয় যেনো আরো ক্ষেপে গেলো। রেগে বললো, ‘তুই ভালো করেই জানিস সাদাফ জেদ করে প্রিয়তাকে বিয়ে করতে চাচ্ছে!’

‘হুম জানি। আর এটাও জানি সাদাফকে যতটা খারাপ ভাবছিস ততটা খারাপ না। আজ ‘ও’ বিয়ের প্রপোজাল আনছিলো শুধু আমাকে দেখাবে বলে কারণ ‘ও’ জানতো প্রিয়তা রাজি হবে না। কিন্তু প্রিয়তা রাজি হয়ে গেছে। এটা কিন্তু ভালো হয়ছে। আর সাদাফ আমার সাথে জেদ করে প্রিয়তাকে বিয়ে করলেও কখনোই ওকে কষ্ট দিবে না। ‘ও’ মেয়েদের যথেষ্ট সম্মান করে।’

উদয় আর কিছু বলে না। শুধু চেয়ে থাকে নিজেদের বাড়ির দিকে। তার বোনের জানালার দিকে। প্রিয়তা জানালা থেকে তাকিয়ে আছে আকাশের দিকে। তনিমা আস্তে করে এসে পাশে দাঁড়ায়। প্রিয়তা কারো উপস্থিতি টের পেয়ে নড়েচড়ে দাঁড়ায়। তনিমা প্রিয়তাকে নিজের দিকে করে বলে,

‘কি হয়ছে তোদের? তুই বিয়েতে রাজি কেন হলি?’

প্রিয়তা উত্তর দেয় না। তনিমা ফের বলে, ‘কথা বলছিস না কেন? তুই কি ভুলে গেছিস সাইমা সাদাফ ভাইকে ভালোবাসে!’

টনক নড়ে প্রিয়তার। আচমকা তাকায় তনিমার দিকে। তারপর ধপ করে ফ্লোরে বসে বলে, ‘এটা আমি কি করলাম!’

‘কি করবি এখন?’

‘কিছু আর করার নাই তনু। বিয়ের ডেইট ফাইনাল হয়ে গেছে। সবাই বিয়ের প্রস্তুতি শুরু করেছে। এখন কি করবো!’

তনিমা আর কিছু বলে না। চুপচাপ নিজের রুমে চলে যায়।

______________

দেখতে দেখতেই কেটে যায় কয়েকটাদিন। সাইমা সব কষ্ট চেপে রেখে হাসিমুখে বান্ধবীর বিয়ে ইনজয় করছে। প্রিয়তা একদম রোবট হয়ে গেছে। এই অবস্থায় আর কিছু বলা হয়ে ওঠেনি। আজ প্রিয়তার গায়ে হলুদ ছিলো। সব ঠিকঠাক শেষ হয়ে গেছে। প্রিয়তা একা একা নিজের রুমে বসেছিলো হলুদ শাড়ি পড়ে। এখনো গায়ে কাঁচা হলুদ আছে। প্রিয়ম দরজার বাহির থেকে দুচোখের তৃষ্ণা মিটিয়ে দেখে নেয় প্রিয়তাকে। মনের সাথে যুদ্ধ করে প্রিয়তার রুমের বাহির থেকেই চলে যায় ছাঁদে। সেখানে দাঁড়াতেই নোমান আর সামি আসে। প্রিয়মের পাশে দাঁড়িয়ে বলে,

‘তুই সবটা প্রিয়তাকে বলছিস না কেন? রিমা, নিতু খুব রেগে আছে তোর, প্রিয়তা আর সাদাফের ওপর। ওরা কেউ বিয়েতে আসেনি। উদয় আর তনিমাও কারো সাথে কথা বলছে না। সবাই যেনো একটা করে রোবট। অনুভূতিশূণ্য।’

প্রিয়ম নোমানের দিকে তাকিয়ে বলে, ‘আমার কাছে খুব বেশি সময় নেই নোমান। তোরা এসময় কিছু বলতে যাস না ওদের। বিয়েটা হয়ে গেলে সব ঠিক হয়ে যাবে।’

নোমান জড়িয়ে ধরে প্রিয়মকে। প্রিয়ম কেঁদে উঠে। কয়েক মিনিট কাঁদতেই কাশি উঠে যায় প্রিয়মের। কাশির সাথে মুখ দিয়ে বের হতে থাকে র’ক্ত। রক্তে যেনো মাখামাখি অবস্থা। নোমান আর সামি ভয় পেয়ে যায়। সামি নিচে নামতে নিলে প্রিয়ম আটকায়। মাথা নাড়িয়ে বোঝায় ‘না’। সামি প্রিয়মকে আশ্বস্ত করে বলে,

‘পানি আনতে যাচ্ছি। কিছু বলবো না কাউকে।’

প্রিয়মের হাত ছাড়িয়ে নিচে ছুটে যায় সামি। কয়েক মিনিট বাদেই ছুটে আসে পানি হাতে। বন্ধুর কষ্টে দুজনেরই চোখ ভিজে আসে। প্রিয়ম কিছুটা স্বাভাবিক হতেই সেখানে হাজির হয় শিশির। প্রিয়তার বিয়ের জন্য সে এসেছে। তার প্রথম প্রেম, ভালোবাসার মানুষকে একবার বউ সাজে দেখতে এসেছিলো। কিন্তু এসে দেখে প্রিয়মের সাথে না ওর বন্ধুর সাথে বিয়ে। প্রিয়মকে একা পেয়ে সে কথা বলতে এসেছিলো ছাঁদে। অন্ধকারে এক কোণায় ছিলো বিধায় কেউ দেখতে পায়নি। প্রিয়ম, নোমান, সামির সব কথা শুনতে পায় শিশির। প্রিয়মের কাছে এসে সরাসরি জিজ্ঞেস করে,

‘প্রিয়তাকে ছেড়ে দিচ্ছেন কেন? কি হয়ছে আপনার?’

প্রিয়ম একটুও রাগ দেখায় না শিশিরের ওপর। হেঁসে বলে, ‘ওপরওয়ালার মনে হয় প্রিয়তা সুখটা সয় না বুঝলেন তাই তো প্রথমে আপনাকে কেড়ে নিলো আর আজ আমাকে। ‘

‘হেয়ালি ছেড়ে ভালো ভাবে বলুন। আপনার মুখ থেকে র’ক্ত কেন আসলো?’

প্রিয়ম অনুভূতিশূণ্যের মতো তাকিয়ে বললো, ‘আমার মাথায় র’ক্তক্ষ’রণ হয়। তাই!’

শিশির বাকরুদ্ধ হয়ে যায়। এতো বড় একটা অসুখ অথচ কেউ জানে না! শিশির কিছু বলতে নিলে প্রিয়ম আটকায়। নিজেই বলে, ‘ডক্টর বলেছে আমার হাতে আর কিছুদিন, আর কিছু সময় বা আর কিছু মুহুর্ত আছে। আমি জানি আপনিও প্রিয়তাকে ভালোবাসেন। তাই একটা রিকুয়েষ্ট করবো। রাখবেন প্লিজ?’

শিশিরের গায়ের লোম দাঁড়িয়ে গেছে। রোবটের মতো মাথা নাড়িয়ে বোঝায়, ‘হ্যা’। প্রিয়ম হেঁসে বলে, ‘এখানে যা হলো তার কিছু প্রিয়তাকে বলবেন না৷ ‘ও’ সহ্য করতে পারবে না। বিয়ে হয়ে গেলে ‘ও’ সুখী হবে। দেখে নিয়েন!’

শিশিরের কি হলো কে জানে! হুট করেই জাপ্টে ধরে প্রিয়মকে। প্রিয়মের চোখ ঝাপসা হয়ে আসে। নিজেকে সামলে নেয়।

প্রিয়তাকে বউ সাজিয়ে রুমে রেখে গেছে। বর এসেছে। সবাই সেখানেই। প্রিয়তা বসে আছে নিজের মতো। পাথরও যেনো এর থেকে ভালো। প্রিয়ম হাজির হয় সেসময়। প্রিয়তাকে বউ সাজে দেখে বুকে চিনচিনে ব্যথা অনুভব করে। সকাল থেকেই তার প্রচন্ড মাথা ব্যাথা। তবুও এসেছে প্রিয়তাকে বউ সাজে দেখতে৷ অন্যের হতে। প্রিয়তার সামনে আসতেই প্রিয়তা তার দিকে তাকায়। একরাশ ঘৃণার দৃষ্টি ছুড়ে ফের অন্য দিকে তাকায়। প্রিয়ম অদ্ভুত ভাবে হাসে। প্রিয়তা বসা থেকে উঠে দাঁড়ায়। প্রিয়ম সামনাসামনি দাঁড়িয়ে হেঁসে বলে,

‘তোকে ভীষণ সুন্দর লাগতেছে টুনটুনি।’

‘টুনটুনি’ ডাকটা কানে আসতেই কান্না উপচে আসে প্রিয়তার। প্রিয়ম অনুরোধ ভরা কন্ঠে বলে, ‘শেষ বারের মতো একটা ইচ্ছে পূরণ করবি?’

প্রিয়তা চট করে তাকায় প্রিয়মের দিকে। প্রিয়ম সাদা একটা পাঞ্জাবি পড়ে আছে। প্রিয়ম প্রিয়তার উত্তরের অপেক্ষা না করে নিজেই বলে, ‘একটা বার আমার প্রশস্ত বুকে মাথা রাখবি টুনটুনি?’

প্রিয়তা ভাষা হারিয়ে ফেলে৷ কি বলবে বুঝে উঠে না। প্রিয়মকে কেন যেনো ফিরাতে পারে না। আস্তে করে প্রিয়মের বুকে মাথা রাখে। সাথে সাথে প্রিয়মের চোখ থেকে টুপ করে এক ফোটা জল গড়ায়। কিছুক্ষণ ওভাবে থাকার পর প্রিয়ম প্রিয়তার মাথা উপরে উঠায়। তারপর প্রিয়তার কপালে ঠোঁট ছুঁইয়ে এক সেকেন্ডও দাঁড়ায় না। গটগট করে বেড়িয়ে যায়। প্রিয়তা সেদিকে তাকিয়ে কেঁদে উঠে। তার কান্নার মাঝে সেখানে শিশির আসে৷ চোখের কাজল লেপ্টে গেছে। প্রিয়তা শিশিরের দিকে তাকাতেই শিশশির অসহায় কন্ঠে বলে,

‘বিয়েটা করো না প্রিয়তা।’

প্রিয়তা জিজ্ঞাসু দৃষ্টিতে তাকায়। শিশির ভাবে প্রিয়তা প্রিয়মকে ভালোবাসে। তার জানা উচিত প্রিয়মের বিষয়ে। শেষ সময়ে পাশে থাকা উচিত। তাই মাথা নিচু করে বলে,

‘প্রিয়ম তোমাকে ভালোবাসে। ওর তোমাকে দরকার।’

প্রিয়তাকে সবটা বলে শিশির। প্রিয়তা ধপ করে বসে পড়ে। এতো কিছু হয়ে গেলো আর সে কিছুই জানে না? প্রিয়মের হাতে আর মাত্র কিছুদিন, কিছু সময় বা কিছু মুহুর্ত আছে কথাটা শুনতেই বুকটা ধ্বক করে ওঠে। পাথরের মতো তাকিয়ে থাকে এক দিকে। তখনই সবাই মিলে প্রিয়তাকে নিতে আসে। প্রিয়তা এতোটাই শকড যে গলায় এসে সব কথা আটকে যাচ্ছে। প্রিয়তাকে এনে সাদাফের পাশে বসানো হয়। সামনের লাইনের প্রথম চেয়ারে বসে আছে প্রিয়ম। প্রিয়তা আশ মিটিয়ে দেখে নেয় প্রিয়মকে। বিয়ে শুরু করে কাজি। যখন প্রিয়তাকে কবুল বলতে বলা হয় তখনও সে প্রিয়মের দিকে তাকিয়ে আছে। কয়েকবার প্রিয়তাকে কবুল বলতে বলার পরই ধপ করে একটা শব্দ হয়। সবাই সেদিকে তাকিয়ে দেখে প্রিয়ম নিচে পড়ে আছে। নোমান, শিশির আর সামি ছুটে আসে প্রিয়মের কাছে। শিশির প্রিয়মের পালস চেইক করে হুট করেই শব্দ করে কেঁদে উঠে। তাহেরা বেগম ছুটে আসে ছেলের কাছে। ছেলের গায়ে হাত দিয়ে ঠান্ডা হিম শীতল দেখে ঘাবড়ে যান। সাদাফও উঠে আসে। নোমান কান্নারত অবস্থায় বলে,

‘প্রিয়ম চলে গেছে আন্টি।’

কথাটা বলার সাথে সাথেই পেছনে আরেকটা শব্দ হয়। সেদিকে তাকাতেই দেখে প্রিয়তা পড়ে আছে। সবাই ছুটে যায় প্রিয়তার কাছে। প্রিয়তার শরীর হিম শীতল। একটু আগে যেখানে বিয়ের জন্য আমেজে ভরপুর ছিলো সেখানে এখন কান্নার সুর ভেসে আসছে। তাঁরা বেগম আর তাহেরা বেগমের আহাজারীতে ভরে গেছে পরিবেশ। পাশাপাশি শোয়ানো হয়েছে প্রিয়ম আর প্রিয়তাকে। সাদাফ নোমানকে জিজ্ঞেস করে,

‘প্রিয়মের কি হয়েছিলো? হঠাৎ কিভাবে!’

নোমান তাচ্ছিল্য করে হেঁসে বলে, ‘তুই তো বিয়ের আমেজে মেতে ছিলি। খবর নিয়েছিস প্রিয়ম কেমন আছে? ‘ও’ প্রায় সময় মাথা ব্যাথা মাথা ব্যাথা করতো। আমরা ৩ জন সেদিন একটা সিক্রেট কাজে বাহিরে গেছিলাম। সেদিন প্রিয়ম সেন্সলেস হয়ে গেছিলো। হসপিটালে এডমিট করার পর সব টেস্ট করে জানতে পারি প্রিয়মের মাথায় র’ক্তক্ষ’রণ হয় যার ফলে মাথা ব্যাথা করে। ডক্টর ডিরেক্ট বলে দিয়েছিলো প্রিয়ম আর বাঁচবে কয়েকদিন।’

সাদাফ যেনো বাকরুদ্ধ হয়ে যায়। উপস্থিত সবাই ভাষা হারিয়ে ফেলে। তাদের পরিবারের একজন একা এতো কষ্ট করেছে আর তারা জানতেও পারেনি! সামি এগিয়ে এসে সাদাফকে বলে,

‘তুই যে সামিরার মৃত্যুর জন্য দায়ী করেছিলি প্রিয়মকে। সেই প্রিয়মই তোর সামিরার খু’নীদের নিজে হাতে পুলিশে তুলে দিছে। আর তোর জেদ! প্রিয়তাকে কেড়ে নেওয়ার! দেখ দুজনে ভালোবেসে একসাথে পৃথিবী ছেড়েছে। তুই তোর জেদেও হারলি তোর প্রাণপ্রিয় বন্ধুকেও হারালি!’

সাদাফ নিজের ভারসাম্য হারিয়ে ফেলে। বসে পড়ে ফ্লোরে। এক দৃষ্টিতে তাকিয়ে থাকে লাশ দুইটির দিকে।

পরিশিষ্ট:____________

আজ প্রিয়ম প্রিয়তার ৩ বছরের মৃতুবার্ষিকী। সবাই এসেছে প্রিয়ম আর প্রিয়তার কবরের সামনে। তাঁরা বেগম, পলক সাহেব, তাহেরা বেগম, উদয়, তনিমা,উদয় তনিমার মেয়ে, নোমান, সামি, সাদাফ, সাইমা, রিমা, নিতু, বাদ যায়নি শিশিরও। দুর থেকে অনিমা আর সাফাও দাঁড়িয়ে দেখছে প্রিয়ম প্রিয়তার কবর। ওদের মৃত্যুর পর জানা যায় প্রিয়ম মাথায় র’ক্তক্ষ’রণের জন্য আর প্রিয়তা হার্ট অ্যাটাক করে মারা যায়। প্রিয়তা হার্টের প্রবলেম ছিলো তা সবারই জানা। যখন সে জানতে পারে প্রিয়মের ব্যাপারে তখন থেকেই তার বুকে ব্যাথা শুরু হয়। আর যখন শুনেছে প্রিয়ম মা’রা গেছে তখন তার হার্ট অ্যাটাক হয়। এবং সাথে সাথেই মৃত্যু। ডক্টর আগেই সবাইকে বলেছিলো প্রিয়তা যেনো কোনো প্রকার শক না পায় কিন্তু জীবনের সব থেকে বড় শক সে সেদিনই পেয়েছে। সাদাফ আজও নিজেকে দায়ী করে প্রিয়ম, প্রিয়তার মৃত্যুর জন্য। সাইমা আজও সাদাফের অপেক্ষায় আছে। অনিমা শিশিরের কাছে ফেরেনি। শিশির এখনও অনিমার অপেক্ষায় আছে। অয়নও অপেক্ষায় আছে কবে অনিমা তাকে ভালোবাসবে। প্রিয়তার মৃত্যুর পর বদলে গেছে উদয় তনিমাও। সংসার করছে তবে সেই আমেজটা নেই। মেয়েটা দেখতে প্রিয়তার মতোই হয়েছে। তাঁরা বেগম, পলক সাহেব আর তাহেরা বেগম নিজেদের সন্তান হারিয়ে নিস্তব্ধ হয়ে আছে। এ গল্পে কেউ ভালো নেই। সবার রয়েছে বিরহ। আপনিময় বিরহ। উদয় আর তনিমা আকাশের দিকে তাকায়। আকাশ থেকে যেনো প্রিয়ম, প্রিয়তা পাশাপাশি হাত ধরে খিলখিলিয়ে হাসছে আর বলছে,

‘আমার আপনিময় বিরহ কাটেনি। সে বিরহ নিয়েই পাড়ি জমিয়েছি ভালোবাসার মানুষটার সাথে। ইহজন্মে দুজনে এক হয়নি তাতে কি পরজন্মে তো দুজন একসাথেই রয়েছি।’

সমাপ্ত…

একটি উত্তর ত্যাগ

আপনার মন্তব্য লিখুন দয়া করে!
এখানে আপনার নাম লিখুন দয়া করে