আপনিময় বিরহ পর্ব-১৩+১৪

0
1142

#আপনিময় বিরহ (১৩)
#বোরহানা_আক্তার_রেশমী
___________________

সময় দ্রুত চলে যাচ্ছে। কেটে গেছে বেশ কয়েকদিন। প্রিয়তা আর প্রিয়মের কেয়ারগুলোকে অন্য ভাবে নেয়না। তবে আগের মতোই সিমির এতো কেয়ার প্রিয়মের ওপর তা সহ্য করতে পারে না। সমানেই নবীন বরণ উৎসব। প্রিয়ম, উদয় ভীষণ ব্যস্ত। ভার্সিটির সিনিয়র হওয়ার সুবাদে সব কাজ তাদের ওপর। তনিমা ইচ্ছে করে নোমানের সাথে হেঁসে হেঁসে কথা বলে। উদয় দেখে আর রাগী চোখে তাকায়। তা অবশ্য পাত্তা দেয় না তনিমা। সাইমা যতটা সাদাফের কাছে নিজেকে প্রকাশ করতে চায় সাদাফ ততটাই ইগনোর করে তাকে। ক্লাসে বসে আনমনে জানালা দিয়ে বাহিরে তাকিয়ে ছিলো প্রিয়তা। বাহিরে সব কাজ নিয়ে ছোটাছুটি করছে। প্রিয়মকেও দেখতে পাচ্ছে। হঠাৎ করেই সবাই একদিকে ছুটে যাচ্ছে। হুট করে সবাই একদিকে দৌড়াচ্ছে দেখে প্রিয়তার খানিকটা সন্দেহ হয়। নিজের জায়গা থেকে উঠতে যাবে তখনই তনিমা ছুটে আসে। ব্যস্ত কন্ঠে বলে,

‘প্রিয়ম ভাইয়ের সাথে কারা যেনো ঝামেলা শুরু করেছে। দ্রুত চল।’

প্রিয়তা কয়েক মিনিটের জন্য থমকায়। এই ছেলে আবার কার সাথে ঝামেলা শুরু করলো! প্রিয়তা আর তনিমা দ্রুত ছুট লাগায় ক্যাম্পাসের দিকে। এসে দেখে অনেক ভীড় জমে গেছে কিন্তু কেউ এগোচ্ছে না। প্রিয়তা আর তনিমা কোনো রকমে ঠেলে ঠুলে ভেতরে ঢোকে। অবস্থা বেগতিক দেখে বার বার প্রিয়মকে ডাকতে থাকে৷ এদিকে প্রিয়ম আর ৩ টা ছেলের মধ্যে মারাত্মক রক্তারক্তি হয়ে গেছে। সেই মুহুর্তেই ছুটে আসলেন ভিসি। ভিসিকে দেখেই ঝামেলা থেমে যায়। প্রিয়মের মাথার এক কোণা বেয়ে টপটপ করে রক্ত গড়িয়ে পড়ছে। ভিসি এই অবস্থা দেখে রেগে জিজ্ঞেস করলেন,

‘এটা কি তোমাদের গুন্ডামি করার জায়গা? এটা কলেজ ক্যাম্পাস ভুলে যাও নাকি তোমরা। অনেক হয়েছে তোমাদের গুন্ডামি এবার নিজেদের গার্ডিয়ানকে ভার্সিটিতে আসতে বলো। আর প্রিয়ম তোমাকে তো আমি ভদ্র ছেলে বলে জানতাম তুমি এটা কি করলে?’

প্রিয়ম উত্তর দিলো না৷ ছেলেগুলোকে সে যথেষ্ট মে’রেছে তবুও তার মন ভরেনি। পারলে জানে মে’রে ফেলতো। একবার ঘাড় বাকিয়ে ছেলেগুলোকে আরেকবার প্রিয়তার দিকে তাকালো। প্রিয়তার কাতর মুখ দেখেই হঠাৎ তার সব রাগ উধাও হয়ে গেলো। প্রিয়তার কাতর মুখ দেখে তার কষ্ট হওয়ার কথাা হলেও শান্তি অনুভব করলো। আস্তে আস্তে জায়গা ফাঁকা হতে শুরু করলো। প্রিয়তা একপ্রকার লাফিয়ে আসে প্রিয়মের কাছে। অস্থির গলায় বলে,

‘কত কত রক্ত বের হচ্ছে! কি দরকার ছিলো আপনার ঝামেলা করার? তাড়াতাড়ি এদিকে আসুন।’

প্রিয়মকে কিছু বলতে না দিয়েই প্রিয়তা প্রথমে ওড়নার এক সাইড দিয়ে ফেটে যাওয়া জায়গাটা চেপে ধরে। তারপর টেনে নিয়ে যায় ভার্সিটির সাথে থাকা ফার্মেসিতে। প্রিয়ম পুরোটা সময় নিশ্চুপ হয়ে শুধু প্রিয়তার দিকে তাকিয়ে ছিলো। ব্যান্ডেজ করা শেষে রাগী দৃষ্টিতে তাকিয়ে বলে,

‘কি সমস্যাা আপনার? ঝামেলা করতে গেছেন কেন?’

‘তোর জন্য।’

প্রিয়তা ভ্যাবাচ্যাকা খায়। তার জন্য মানে! প্রশ্নসূচক দৃষ্টিতে তাকাতেই প্রিয়ম হালকা হেঁসে বলে, ‘কিছু না। কিন্তু তুই এতো উতলা হচ্ছিস কেন?’

প্রিয়তা উত্তর না দিয়ে বলে, ‘আজ আর ভার্সিটি থাকতে হবে না। বাড়ি চলুন।’

‘কাজগুলো কি তুই করবি?’

‘কাজ করার জন্য অনেক মানুষ আছে। বাই দ্যা ওয়ে আমার ভাইটা কই? এতোকিছু হয়ে গেলো আর ওর পাত্তা নাই।’

‘ও’ একটু বাহিরে গেছে।’

প্রিয়তা আর কিছু বলে নাা। প্রিয়মের হাত ধরে টেনে নিয়ে আসে গেইট পর্যন্ত। তারপর কল দেয় তনিমাকে। তনিমা রিসিভ করেই গড়গড় করে বলে, ‘কই গেলি তোরা? তোদের খুঁজে আমি হয়রান! প্রিয়ম ভাই ঠিক আছে তো?’

‘তোর আর খুঁজে লাভ নাই বইন। তুই উদয় ভাইয়ের সাথে চলে আসিস। আমি আর প্রিয়ম ভাই বাড়ি যাচ্ছি।’

তনিমার উত্তরের অপেক্ষা না করেই খট করে কল কেটে দেয়। তারপর প্রিয়মকে নিয়ে একটা রিক্সা নেয়। প্রিয়ম ভ্রু কুঁচকে তাকায় প্রিয়তার দিকে। বলে, ‘গাড়ি থাকতে রিক্সা কেন?’

‘শখ হয়ছে তাই। চুপ করে বসে থাকেন। একে তো মাথা ফাটাইয়া দুনিয়া উদ্ধার করতেছে আবার বেশি কথা!’

‘তুই কি আমারে ধমকাচ্ছিস?’

‘ না ধমকাবো কেন? আপনারে তো আমি…

আর কিছু না বলে মুখ ঘুরিয়ে বসে থাকে। প্রিয়ম নিঃশব্দে হাসে। ভালোবাসা তো কেবল শুরু!

এদিকে তনিমা বেচারি আছে বিপদে। উদয় তার ওপর রেগে থাকে বলে বরাবরই সে উদয়ের থেকে দুরে দুরে থাকে। এমনকি বাড়িতেও প্রিয়তা নয়তো তাঁরা বেগমের পিছু পিছু ঘুরে যাতে করে উদয় কিছু বলতে না পারে। কিন্তু এখন? সেই জমের হাতে একা পড়লো! হায় আল্লাহ! আজ তো তার কপালে শনি, রবি, সোম সব আছে। বসে বসে আল্লাহর নাম নিচ্ছে আর নখ কামড়াচ্ছে। সাইমা অনেকক্ষণ এসব পর্যবেক্ষণ করে বললো,

‘একা একা কি বিড়বিড় করতেছিস ভুতের মতো?’

তনিমা একবার তাকায় সাইমার দিকে। তারপর আবার নখ কামড়াতে থাকে। সাইমাও নিজের মতো বসে গালে হাত দিয়ে তাকিয়ে থাকে। তনিমা ভ্রু কুঁচকে তাকায় সাইমার দিকে। বলে, ‘তুই কি দেখিস?’

‘তোর নখ কামড়ানো।’

‘ধুর সর।’

‘কি হয়ছে বলবি তুই?’

‘বইন পড়ছি আজকা জমের হাতে। আজ আমার ইন্না লিল্লাহ নিশ্চিত।’

‘ক্লিয়ার কইরা ক।’

‘আরে ওই যে উদয় উগান্ডা উনি আমাকে কাঁচা চিবা’ইয়া খা’বে আজ। বইনরে বাঁচা আমারে।’

বলতে বলতেই উদয় হাজির। এসে সরাসরি তনিমার সামনের বেঞ্চে ওর দিকে হয়ে বসে। তনিমা ফাঁকা ঢোক গিলে। সাইমা ঠোঁট চেপে হেঁসে বলে, ‘আপনারা কথা বলেন। আমি আসতেছি।’

বলেই দৌড়। তনিমা মনে মনে সাইমার চৌদ্দ গোষ্ঠী উদ্ধার করলো। তারপর দাঁত কেলিয়ে উদয়ের দিকে তাকাতেই উদয় দিলো এক ঝাড়ি। ভয়ে লাফায় উঠে তনিমা। কাঁদো কাঁদো মুখ করে বলে,

‘ধমকাচ্ছো কেন ভাইয়া? আমার ভয় লাগে তো।’

‘তোর ভয়ের খেতায় আগুন। আজ তোর সব সাহস আমি বের করে ছাড়বো।’

বলেই হাত ধরে টানতে টানতে গাড়ির দিকে নিয়ে যেতে লাগলো। তনিমা সমানে বলে যাচ্ছে, ‘ছেড়ে দাও ভাইয়া। আর জীবনে তোমাার কথার অবাধ্য হবো না।’

কে শোনে কার কথা? ধপাস করে গাড়িতে ফেলে উল্টো ঘুরে এসে বসে পড়ে ড্রাইভিং সিটে। তনিমা ভয়ে চুপ হয়ে যায়। মনে মনে আল্লাহর নাম তো সে কখন থেকেই নিচ্ছে। উদয় সোজা গাড়ি চালিয়ে একটা শুনশান লেকের পাশে চলে আসে। অনেক দুরে দুরে এক দুইটাা মানুষ দেখা যাচ্ছে। তনিমা ভয়ে ভয়ে বলে,

‘এমন শুনশান জায়গায় আনছো কেন? মে’রে টেরে ফেলবা নাকি!’

উদয় রাগী চোখে তাকায় তার দিকে। তারপর দাঁতে দাঁত চেপে সামান্য ঝুকে আসে তনিমার দিকে। বলে, ‘নোমানের সাথে কি তোর? এতো কিসের হাসাহাসি তোদের? তুই কোন সাহসে ওর সাথে কথা বলিস?’

তনিমা ভয় পেলেও সাহস করে বলে, ‘তুমিও তো রিনি আপুর সাথে কথা বলো ইনফ্যাক্ট দুজনে রিলেশনশিপেও আছো এতে আ-আমি কি কিছু বলি? না তো। তাহলে তুমি কোন অ-অধিকারে আমার ব্যাপারে নাক গলাও!’

উদয় কটমট করে বলে, ‘অধিকার তাই না! অধিকার!’

বলেই হুট করেই করে বসে এক অনাকাঙ্ক্ষিত কাজ। তনিমা শকড, ফ্রিজড। উদয় রাগ সব ঠোঁটের ওপর ঝাড়ে। কয়েক সেকেন্ড পর ছেড়ে দিয়ে একদম কাছে এগিয়ে আসে। একজন আরেকজনের নিঃশ্বাসের শব্দটাও শুনতে পায়। তনিমা তখনো শকড। এতো দ্রুত সব হয়ে গেছে যে সবটাই তার মাথার উপর দিয়ে গেছে। উদয় ফিসফিস করে বলে,

‘তোর ওপর সবরকম অধিকার শুধু আর শুধু আমার। তুই পুরোটাই আমার।’

তনিমা কথা বলার ভাষা হারিয়ে ফেলে। ফ্যালফ্যাল করে চেয়ে রয় উদয়ের দিকে। উদয় মুচকি হেঁসে দূরত্ব মিটিয়ে নিজের সাথে জড়িয়ে নেয় তনিমাকে। তারপর বলে, ‘রিনি আমার জাস্ট ফ্রেন্ড রে বোকা মেয়ে। সেদিন তোর ওপর আমার ভীষণ রাগ, অভিমান ছিলো তাই রাগের মাথায় ওকে গার্লফ্রেন্ড বলেছিলাাম। তুই তো চাইলেই নিজের অধিকার খাটাইতে পারতি! কেউ না তোর জিনিসের দিকে নজর দিলে তুই তার ১২ টা বাজাস তাহলে তোর সব থেকে গুরুত্বপূর্ণ মানুষটার দিকে নজর দেওয়ার পরও চুপ করে ছিলি কেন? নাকি আমাকে ভালোবাসিস না?’

উত্তরে শক্ত করে জড়িয়ে ধরে তনিমা৷ চোখ থেকে টুপ করে কয়েক ফোটা জল গড়িয়ে পড়ে। তার বিরহ কাটার পালা। সে এখন ভালোবাসার সুখটা অনুভব করবে। উদয় প্রশান্তির হাসি হেঁসে তনিমার কপালে নিজের ওষ্ঠ ছোঁয়ায়।

রাতের বেলায় গা কাপিয়ে জ্বর আসে প্রিয়মের। জ্বরে বিছানা থেকে উঠতে অবদি পারছে না। ভুলভাল বকে যাচ্ছে। তাহেরা বেগম টেনশনে পাগল হওয়ার জোগাড়। একবার এদিকে দৌড়াচ্ছে তো একবার ওদিকে। মাথায় ব্যান্ডেজের কারণে জলপট্টিও দিতে পারছে না। কোনো রকমে হালকা করে কাপড় ভিজিয়ে মুছিয়ে দিচ্ছে। প্রিয়ম একটু ঘুমোতেই তিনি ছুট লাগালেন বোনের কাছে। বাড়ি পাশাপাশি হওয়ায় সময় লাগে না। তাহেরা বেগম যাওয়ার পর পরই পিটপিট করে তাকায় প্রিয়ম। আস্তে করে উঠে ঢুলতে ঢুলতে ব্যালকনির দিকে যায়। ব্যালকনিতে গিয়ে দেখে প্রিয়তা নেই। মুহুর্তেই বাচ্চাদের মতো ঠোঁট উল্টে দেয় সে। ওখানেই হাত পা ছড়িয়ে বসে পড়ে। তাহেরা বেগম তাঁরা বেগম আর প্রিয়তাকে সাথে নিয়ে এসে দেখে প্রিয়ম রুমে নেই। ব্যালকনিতে চেইক করতে গিয়ে দেখে ওখানে বাচ্চাদের মতো ঠোঁট উল্টে হাত পা ছড়িয়ে বসে আছে। প্রিয়তা এই দুশ্চিন্তার সময়ও নিঃশব্দে হেঁসে দেয়। লোকটা মাঝে মাঝে বাচ্চাদের মতো করে। সবাই মিলে প্রিয়মকে ধরে রুমে আনে। প্রিয়ম খেয়াল করেনি প্রিয়তাকে। নিজের মায়ের কোলে মুখ গুজে দিয়ে বলে,

‘আম্মুউউউ আমি ওর কাছে যাবো। দেখো না ‘ও’ নাই। আসতেছে না। পঁচা মেয়ে।’

প্রিয়তা ভ্রু কুঁচকে তাকায়। এতো বড় ছেলে এমন বাচ্চাদের মতো করে কথা বলতেছে! আর কাকে পঁচা বলতেছে! তাহেরা বেগম ছেলেকে শান্ত করতে বলে, ‘আছে বাবা। চলে আসবে। চিন্তা করো না।’

প্রিয়তা জিজ্ঞেস করে, ‘খাালামনি উনি এমন বাচ্চাদের মতো করে কথা বলতেছে কেন?’

তাহেরা বেগম মুচকি হেঁসে বলে, ‘আমার ছেলেটার জ্বর হলে ‘ও’ এমন বাচ্চা হয়ে যায়। কি বলে না বলে নিজেই জানে না।’

প্রিয়তাা হাসে। তাহেরা বেগম আর তাঁরা বেগম অনেকক্ষণ প্রিয়মের কাছে থেকে তারপর প্রিয়তাকে কিছুক্ষণ থাকতে বলে একটু বাইরে যায়। প্রিয়তা আস্তে করে প্রিয়মের পাশে বসে। তারপর ধীরে ধীরে মাথায় হাত বুলিয়ে দিতে লাগলে খপ করে হাত ধরে ফেলে প্রিয়ম। প্রিয়তা চমকে উঠে। প্রিয়ম হাত আঁকড়ে ধরে মুখের দিকে তাকায়। মিষ্টি করে হেঁসে মাথাটা চট করে প্রিয়তার কোলের ওপর দেয়। মুখ গুজে দেয় পেটের কাছে। সব কিছু এতো দ্রুত হয়ে গেছে যে প্রিয়তা শকড। কি করবে বুঝতে পারে না। প্রিয়ম শক্ত করে ধরে আছে। ছাড়াতেও পারছে না। প্রিয়ম ফিসফিস করে বলে,

‘এত্তোগুলা ভালোবাসি প্রিয়। তুই শুধু আমার টুনটুনি আর কারোর না। একদম না।’

চলবে..

#আপনিময়_বিরহ (১৪)
#বোরহানা_আক্তার_রেশমী
________________

আজকে ভার্সিটিতে নবীন বরণ উৎসব। সুন্দর করে সাজানো হয়েছে সবটা। যার যার মতো সবাই ভীষণ ব্যস্ত। প্রিয়ম, উদয় সকাল সকাল চলে এসেছে। সাথে আছে রিমা, নিতু, নোমান আর সামি। সাদাফ থাকলেও খুব একটা গুরুত্ব দিচ্ছে না কোনো কাজেই। সামিরা মারা যাওয়ার পর থেকেই সে বেপরোয়া হয়ে উঠেছে। প্রিয়ম মাঝখানে জ্বরে কাবু থাকলেও দুদিনেই সুস্থ হয়ে গেছে। উদয় আর তনিমার প্রেম, ঝগড়া একসাথে চলতেছে। ভার্সিটির প্রায় সব ছেলেরাই নীল পাঞ্জাবী আর সাদা পাজামা। আর মেয়েরা নীল শাড়ি। প্রিয়তা আর তনিমা এখনো ভার্সিটি আসেনি। তনিমা রেডি হয়ে বসে আছে কিন্তু প্রিয়তার পাত্তা নাই। তাই নিজেই উঠে প্রিয়তার রুমের দিকে যায়৷ গিয়ে দেখে প্রিয়তা শাড়ি হাতে নিয়ে বসে আছে। তনিমা এই অবস্থা দেখে দেয় এক ধমক। প্রিয়তা লাফিয়ে উঠে। তারপর বলে,

‘এক থা’প্পড় দিবো ইডিয়েট মেয়ে। এরকম কেউ করে!’

‘তুই আগে বল তুই শাড়ি না পড়ে শাড়ি হাতে নিয়ে কি করছিস?’

‘শাড়ির মুখ দেখতেছি।’

‘শাড়ির মুখ নাই যে দেখবি। রেডি হোস নাই কেন? বল!’

প্রিয়তা আমতা আমতা করে বলে, ‘ইয়ে মানে আমি না গেলে হয় না রে!’

তনিমা ভ্রু কুঁচকে বলে, ‘প্রিয়ম ভাইয়ের মা’ইর খাওয়ার শখ হয়ছে তোর?’

‘আরে ধুর। আমার যেতে ইচ্ছা করতেছে না।’

তনিমা প্রিয়তার হাত থেকে শাড়ি নিয়ে প্রিয়তাকে তুলতে তুলতে বলে, ‘উঠ তাড়াতাড়ি। দেড়ি হলে খবর আছে আমাদের।’

প্রিয়তা নাক মুখ কুঁচকে বলে, ‘তোর তো জামাই আছে না গেলে তোর পিন্ডি চটকাবে।’

‘আছেই তো। তোরই ভাই।’

বলেই দাঁত বের করে হাসতে থাকে। প্রিয়তা রাগে তনিমাকে রুম থেকে ধাক্কা মেরে বের করে দেয়। বিড়বিড় করে বকা দিতে থাকে উদয় আর তনিমাকে। তারপর সুন্দর করে শাড়ি পড়ে ডাক দেয় তনিমাকে। তনিমার হেল্প নিয়ে পুরোটা কমপ্লিট করে। দুজনেই নীল শাড়ি, নীল চুড়ি, মুখে হালকা সাজ, ম্যাচিং কানের দুল, টিকলি, খোঁপায় কাঠগোলাপের গাজরা, পায়ে নুপুর। ব্যাস দুজনেই রেডি। দুজনে তাঁরা বেগমের থেকে বিদায় নিয়ে একসাথে বেড়িয়ে পড়ে। রিক্সায় উঠতেই কল আসে সাইমার। সেও সেইম ভাবেই সেজেছে। তিন বান্ধবী সেইম টু সেইম।

প্রিয়তা, তনিমা আর সাইমা একসাথে ঢোকে ভার্সিটিতে। প্রিয়ম কাজের জন্য খেয়াল না করলেও রিমা আর নিতু ঠিকই খেয়াল করে। তারা প্রিয়মকে কনুই দিয়ে গুতো দিয়ে বলে, ‘দোস্ত গেইটের দিকে তাঁকা!’

প্রিয়ম বিরক্তির দৃষ্টি নিয়ে একবার ওদের দিকে আরেকবার গেইটের দিকে তাকাতেই ‘থ’। হাতে ফুল ছিলো তা পড়ে গেছে নিচে। ভালোবাসার মানুষকে বরাবরই বেশি সুন্দর লাগে। উদয় প্রিয়মকে হা করে তাকিয়ে থাকতে দেখে নিজেও সেদিকে তাকায়। তাকিয়ে তারও একই অবস্থা। অজান্তেই মুখ থেকে বের হয়ে আসে, ‘মাশাল্লাহ।’

রিমা আর নিতু দুজনের কান্ড দেখে খিলখিল করে হেঁসে উঠে। ধ্যান ভাঙে প্রিয়ম আর উদয়ের। দুজনেই হালকা কেশে নিজেদের সামলায়। ততক্ষণে প্রিয়তারা কাছাকাছি চলে এসেছে। সেদিন জ্বরের ঘোরে প্রিয়ম প্রিয়তার পেটে মুখ গুজে দিয়ে কি সব বিড়বিড় করছিলো ভাবতেই লজ্জায় মাথা নামিয়ে নেয়। তনিমা উদয়কে দেখে লাজুক হাসে। উদয় ঠোঁট কামড়ে হাসে। সাইমা একবার প্রিয়ম আর উদয়ের দিকে তাকাচ্ছে তো একবার প্রিয়তা আর তনিমার দিকে তাকাচ্ছে। এক পর্যায়ে বলে,

‘ওয়েট ওয়েট! কাহিনিটা কি? তোরা প্রিয়ম ভাই আর উদয় ভাইকে দেখে এমন লাজে রাঙা হচ্ছিস কেন?’

প্রিয়ম ফট করে তাকায় প্রিয়তার দিকে। রিমা আর নিতু শব্দ করে হেঁসে বলে, ‘বুঝো না? লাভ কেইস বইনা।’

বলেই আবার হাসতে শুরু করলো। প্রিয়তা লজ্জায় মাটিতে মিশে যাওয়ার মতো অবস্থা। আর তনিমা? তার তো বরাবরই লজ্জা কম। তবুও কিছুটা লজ্জা পায়। তারপর হেঁসে বলে, ‘ওদিকে যায়?’

সবাই সায় দেয়। সব মেয়েরা সেদিকে চলে যায়। বাকি রয় উদয় আর প্রিয়ম। উদয় প্রিয়মকে খোঁচা মেরে বলে, ‘তুই প্রিয়তাকে প্রপোজ কবে করবি?’

প্রিয়ম ভ্রু কুঁচকে তাকিয়ে বলে, ‘তুই পৃথিবীর প্রথম ভাই যে কি না বোনের প্রেম দেখার জন্য উতলা হয়ে গেছিস।’

বলেই চলে যায়। বেচারা উদয় আহম্মকের মতো তাকিয়ে থাকে সেদিকে।

প্রিয়তারা আসতে নিলেই সামনে এসে দাঁড়ায় সাদাফ। সাইমা একদফা ক্রাশ খায়। প্রিয়তা শান্ত দৃষ্টিতে তাকিয়ে বলে, ‘কিছু বলবেন?’

সাদাফ মিষ্টি করে হেঁসে বলে, ‘তোমাদেরকে অনেক কিউট লাগতেছে।’

‘থ্যাঙ্কস।’

সাদাফ যে শুধুমাত্র প্রিয়তার প্রশংসা করেছে তা কেবল রিমা আর নিতুই বুঝলো। সাইমা তো খুশিতে গদগদ। তার প্রিয় মানুষটা সবার মাধ্যমে তারও প্রশংসা করেছে এটা ভেবেই। প্রিয়তা আর কিছু না বলে এড়িয়ে চলে আসে। প্রিয়ম দুর থেকে সবটা দেখে।

নবীন বরন শেষ হয়ে যাওয়ায় সবাই যে যার মতো জায়গা ছেড়ে চলে আসছিলো। তখন হুট করেই প্রিয়ম এসে প্রিয়তার হাত ধরে ক্যাম্পাসের মাঝখানে নিয়ে যায়। প্রিয়তা আকস্মিক ঘটনায় কিছুটা চমকায়। উদয়, তনিমা, সাইমা, রিমা, নিতু, নোমান, সামি, সাদাফ সবাই ওদের পিছু পিছু যায়। প্রিয়ম প্রিয়তাকে দাঁড় করিয়ে দিতেই প্রিয়তা জিজ্ঞাসু দৃষ্টিতে তাকায়৷ প্রিয়ম সবাইকে অবাক করে দিয়ে প্রিয়তার সামনে হাঁটু মুড়ে বসে পড়ে। এক থোকা কাঠগোলাপ এগিয়ে দেয় প্রিয়তার সামনে। প্রিয়তা শকড। ধীরে ধীরে সবাই জড়ো হয় তাদের ঘিরে। প্রিয়ম বলতে শুরু করে,

‘তোকে গুছিয়ে বলার মতো কোনো শব্দ আমার কাছে নাই। বুঝতে শেখার পর থেকেই আমি তোর প্রতি দুর্বল। সেই দুর্বলতা কবে ভালোবাসায় গিয়ে ঠেকেছে আমার জানা নেই। তোদের বাড়ি না গেলেও তোর খোঁজ সবসময় আমি রাখতাম যখন জানতে পারলাম তুই অন্য কাউকে ভালোবাসিস ভীষণ ভাবে ভেঙে পড়েছিলাম। তবুও নিজেকে সামলিয়েছে। আমি অনেক নিজের অনুভূতির সাথে লড়াই করেছি। ভেবেছি তোকে ভুলে যাবো। কিন্তু তোর প্রতি আমার ভালোবাসা ততদিনে আকাশ ছুঁয়েছে। আমি আর পারছি না তোর বিরহ নিয়ে থাকতে। আমি তোর নামের বিরহ না আমি পুরোটাই তোকে চাই। তোর সব আপনিময় বিরহ দুর করে ভীষণ ভাবে ভালোবাসতে চাই। তোর সাথে জীবনের শেষ বসন্তটাও কাটাতে চাই। তোকে আমি আমার করে চাই। আমার হবি টুনটুনি? প্রিয়তা থেকে শুধুই আমার প্রিয় হবি? ভালোবাসবি আমাকে?’

প্রিয়তা বাকরুদ্ধ। প্রিয়ম তাকিয়ে আছে প্রিয়তার দিকে। তনিমা, সাইমাসহ বাদ বাকি অনেক মেয়ে বলতেছে এক্সেপ্ট করে নিতে। কিছু ছেলেরাও বলছে আবার শিষ বাজাচ্ছে। প্রিয়তার চোখের কোণ জলে টইটম্বুর। প্রিয়ম তাকে এতো আগে থেকে ভালোবাসে আর সে কিছুই জানে না। প্রিয়ম যেন ভীষণভাবে আকুল আবেদন জানাচ্ছে তাকে একটু ভালোবাসার। সেই আকুলতা উপেক্ষা করা প্রিয়তার সাধ্য নয়। কাঁপা কাঁপা হাতে ফুল নিয়ে মাথা নাড়িয়ে ধরে আসা গলায় বললো,

‘হুম। ভালোবাসবো আপনাকে।’

এটুকুই যেনো যথেষ্ট ছিলো। সবাই হৈচৈ শুরু করে দিলো। প্রিয়ম প্রিয়তার আনন্দ সবাই যেন ভাগাভাগি করছে। আরো কয়েকজন নিজেদের ভালোবাসা প্রকাশ করলো। প্রিয়তা লজ্জায় মাথা নিচু করে আছে। সাদাফ নির্বাক হয়ে তাকিয়ে আছে প্রিয়ম আর প্রিয়তার দিকে। তনিমা উদয়কে গুতো দিয়ে বলে,

‘ছোট বোনের প্রপোজ করা দেখলে! লজ্জা নাই তোমার?’

উদয় ভাব নিয়ে বলে, ‘লজ্জা কেন থাকবে? আর তাছাড়া প্রেম করার অধিকার কি শুধু আমার একার? আমার বোনেরও আছে। হুহ!’

তনিমা শব্দ করে হেঁসে দেয়। নিজেদের মধ্যে খুনশুটি করতে করতে আলাদা ভাবে বের হয়ে যায়। আজ তারাও একা সময় কাটাবে আর প্রিয়ম প্রিয়তাকেও কাটাতে দিবে। তনিমা আর উদয় রিক্সায় করে নদীর পাড়ে চলে আসে। অনেক কাপল আছে সেখানে। তনিমা আর উদয় একটা বেঞ্চে বসে। উদয়ের কাঁধে মাথা রেখে তনিমা বলে,

‘প্রিয়তার বিরহের দিন এবার শেষ। তাই না বলো!’

উদয় মুচকি হেঁসে বলে, ‘হুম। প্রিয়ম ওকে ভীষণ ভালোবাসে। প্রিয়তাকে ভালোবাসায় মুড়িয়ে রাখবে।’

তনিমা মুচকি হাসে। সে যেমন অনেকদিনের বিরহ কাটিয়ে ভালোবাসা পেয়েছে তেমনই প্রিয়তাও পাবে। প্রিয়তা নিঃসন্দেহে ভাগ্যবতী। সে-ই বা কম কি!

প্রিয়তা আর প্রিয়ম ফুটপাত ধরে হেঁটে চলেছে অজানা গন্তব্যে। প্রিয়তা লজ্জায় লাল হচ্ছে, প্রিয়ম তা বারংবার আড়চোখে দেখছে আর ঠোঁট চেপে হাসছে। প্রিয়ম নিজের অনামিকা আঙুল নিয়ে প্রিয়তার অনামিকা আঙুল ধরতেই প্রিয়তা চমকে তাকায়। কিছু বলে না। দুজনে হাঁটতে হাঁটতে চলে আসে লেকের পাড়। প্রিয়তা শাড়ি খানিকটা উচু করে পা ডুবিয়ে বসে পানিতে। প্রিয়মও পাশে বসে। দুজনেই অনেকটা সময় চুপ থাকে। নিরবতা ভেঙে প্রিয়তাই প্রথমে বলে,

‘বাড়ি যাবেন না?’

প্রিয়ম ভ্রু কুঁচকে তাকায়। বলে, ‘এতো রোমান্টিক মুডে তোর বাড়ির কথা মনে পড়লো!’

‘আজব! সারাজীবন কি এই লেকের পাড়ে থাকবো নাকি?’

‘তোকে থাকতে কে বলছে? যা তুই।’

প্রিয়তা রাগ করে বলে, ‘ঠিক আছে যাচ্ছি।’

বলেই উঠতে নিলে প্রিয়ম হেঁসে হাত টেনে নিজের বাহুতে আবদ্ধ করে নেয়। প্রিয়তা ছাড়ানোর চেষ্টা করলে প্রিয়ম আরো শক্ত করে ধরে। একসময় ক্লান্ত হয়ে নিজেই প্রিয়মের বুকে মুখ লুকায়।

______________

সন্ধ্যার আগে আগে বাড়ি ফিরে উদয়, তনিমা, প্রিয়ম আর প্রিয়তা। প্রিয়তার মুখে এখনো লজ্জার আভা স্পষ্ট। তনিমা প্রিয়তাকে জ্বালাতে ব্যস্ত। প্রিয়ম বাড়ি এসে ক্লান্ত হয়ে শুয়ে পড়ে। মাথাা ব্যাথা বেড়েছে বলে এই অসময়েই আগে শাওয়ার নেয়। তারপর একটা মাথা ব্যাাথার মেডিসিন নিয়ে মায়ের রুমের দিকে এগোয়। তাহেরা বেগম তখন রেস্ট নিচ্ছে। প্রিয়মকে দেখে মিষ্টি করে হাসলেন৷ প্রিয়ম সোজা এসে নিজের মায়ের কোলে শুয়ে পড়ে। তাহেরা বেগম হেঁসে ছেলের মাথায় হাত বুলাতে থাকে। প্রিয়ম বলে,

‘আম্মু তোমাকে একটা কথা বলার ছিলো!’

তাহেরা বেগম মুচকি হেঁসে বলে, ‘আমি জানি তুই কি বলবি!’

প্রিয়ম অবাক চোখে তাকিয়ে বলে, ‘তুমি জানো?’

‘হুম জানি।’

‘বুঝলাম না আমি। কেমনে জানলা? আর কি জানো?’

‘আমি হলাম তোর মা। তোর মন কি চায় তা আমি ভালোভাবেই বুঝি। এই যে যেমন তুই এখন বলতে এসেছিস তুই প্রিয়তাকে ভালোবাসিস আর প্রিয়তা তোকে।’

প্রিয়ম অবাকের সপ্তম পর্যায়ে। প্রিয়মকে আরো অবাক করে দিয়ে তাহেরা বেগম বলেন, ‘আমি কথা বলবো তাঁরার সাথে। তুই একদম নিশ্চিন্তে থাক। মেয়েটা অনেক কষ্ট পেয়েছে আমি ওকে আমার ছেলের বউ করে এনে সব কষ্টের অবসান করবো। আর যারা ওকে ছোট করেছে তাদের চোখে আঙুল দিয়ে দেখিয়ে দিবো আমার প্রিয়তা বেষ্ট।’

প্রিয়ম খুশিতে জড়িয়ে ধরে তাহেরা বেগমকে। বলে, ‘লাভ ইউ আম্মু।’

বলেই দৌড় লাগায়। পেছন থেকে তাহেরা বেগম ছেলের কান্ড দেখে হেঁসে দেয়। ছেলেমেয়ের সুখেই বাবা-মায়ের সুখ।

প্রিয়ম দৌড়ে নিজের ব্যালকনিতে এসে দাঁড়িয়ে সামনের দিকে তাকায়। প্রিয়তাও দাঁড়িয়ে আছে সেখানে। প্রিয়ম খুশির ঠ্যালায় হুররেএএ বলে টাওয়েল ঘুরিয়ে ফেলে দেয় ফ্লোরে। প্রিয়তা ভ্যাবাচ্যাকা খেয়ে তাকিয়ে থাাকে সেদিকে।

চলবে..

একটি উত্তর ত্যাগ

আপনার মন্তব্য লিখুন দয়া করে!
এখানে আপনার নাম লিখুন দয়া করে