আপনার শুভ্রতা পর্ব-২৪ এবং শেষ পর্ব

0
229

#আপনার_শুভ্রতা
#লেখিকাঃশুভ্রতা_শুভ্রা
#পর্বঃ২৪(অন্তিম পর্ব)

২০.
তূর্য ও নম্রতার, তুর ও রিজভীর বিয়ের অনুষ্ঠানটি ছিল একটি অসাধারণ আয়োজনে ভরা, যেখানে সৌন্দর্য এবং বৈভব একসাথে মিশে গিয়েছিল। পুরো অনুষ্ঠানস্থলটি ফুল, আলো, এবং নানান রঙের সাজসজ্জায় সজ্জিত ছিল। চারপাশে থাকা উজ্জ্বল লাইটিং এবং রঙিন ডেকোরেশন পুরো পরিবেশটিকে এক রূপকথার মতো করে তুলেছিল। প্রতিটি কোণে ছিল শিল্পের ছোঁয়া, আর গাছগাছালিতে টাঙানো ছোট ছোট লাইট পুরো পরিবেশকে মায়াময় করে তুলেছিল।

তূর্য বিয়ের জন্য বেছে নিয়েছিল একটি ক্লাসিক কালো শেরওয়ানি, যা তার ব্যক্তিত্বের সাথে মানানসই। সোনালি এমব্রয়ডারির কাজ তার পোশাকটিকে আরও সুন্দর করে তুলেছিল। মাথায় ছিল একটি কালো পাগড়ি, যাতে ছিল রূপালী মুকুটের আভা। তার পাশে নম্রতা ছিল একটি হালকা গোলাপি বেনারসী শাড়িতে সজ্জিত, যা সোনালী জরির কাজ দিয়ে সাজানো ছিল। নম্রতার হাতে ছিল সোনার চুড়ি আর কানে ঝুলছিল ঝুমকা। তার মেকআপ ছিল হালকা কিন্তু অত্যন্ত স্নিগ্ধ, যা তার স্বাভাবিক সৌন্দর্যকে আরও ফুটিয়ে তুলেছিল।

তুর ছিল একটি উজ্জ্বল লাল লেহেঙ্গায়, যা সোনালী জরির কারুকাজে সজ্জিত। মাথায় পরা ওড়নায় ছিল সোনালি এমব্রয়ডারি, যা তার চেহারাকে আরও সুন্দর করে তুলেছিল। তার কানের দুল আর গলার হার ছিল রূপালী ও মণি মাণিক্যের মিশ্রণে তৈরি। তার স্নিগ্ধ মেকআপ তাকে একটি রাজকীয় রূপে উপস্থাপন করেছিল।

রিজভী বেছে নিয়েছিল একটি হালকা সোনালী শেরওয়ানি, যাতে ছিল লাল কাজের ছোঁয়া। তার পোশাকে ছিল একটি লাল পাগড়ি, যা তার সাজসজ্জাকে সম্পূর্ণ করেছিল। হাতে ছিল সোনালী আংটি আর পায়ে সাদা জুতো, যা তার ব্যক্তিত্বকে আরও প্রাঞ্জল করে তুলেছিল।

রাদিফ ছিলেন একটি চমৎকার ফর্মাল স্যুটে, যা ছিল নেভি ব্লু কালারের। তার সাজে ছিল সাদা শার্ট ও সিলভার টাই, যা তাকে একটি আধুনিক এবং স্মার্ট লুক দিয়েছে। রাদিফের চুল ছিল সুন্দর করে সেট করা, এবং তার ঘড়ি আর চশমা তার ব্যক্তিত্বে একটি পরিণতিপূর্ণ ছোঁয়া দিয়েছে।

শুভ্রতা বেছে নিয়েছিলেন একটি মেরুন রঙের লেহেঙ্গা, যা সোনালী জরির কাজ দিয়ে সাজানো। তার হাতে ছিল সোনার বালা, এবং কানে ঝুলছিল বড় ঝুমকা। শুভ্রতার মাথায় ছিল একটি হালকা সোনালি টিকলি, যা তার পুরো সাজকে পূর্ণতা দিয়েছিল। তার মেকআপ ছিল একটি ক্লাসিক লুকের, যার মধ্যে ছিল লাল লিপস্টিক এবং হালকা স্মোকি আই মেকআপ।

অনুষ্ঠানে সবার চোখ ছিল তুর এবং রিজভীর দিকে। তারা যখন মঞ্চে উঠে এল, সবার মুখে এক আনন্দের হাসি ফুটে উঠল। তুরের খুনসুটি আর রিজভীর হাসি এই মুহূর্তটিকে আরও প্রাণবন্ত করে তুলেছিল।

অন্যদিকে, তূর্য যখন নম্রতার হাত ধরে মঞ্চে এল, তখন চারপাশে আনন্দের উল্লাস শোনা গেল। তাদের সম্পর্কের গভীরতা এবং ভালোবাসা সবার মনে দাগ কাটল।

রাদিফ এবং শুভ্রতা একসঙ্গে মঞ্চে এলে, তাদের সৌন্দর্য এবং আভিজাত্য পুরো পরিবেশকে মোহিত করে তুলল। শুভ্রতার মিষ্টি হাসি এবং রাদিফের মুগ্ধ দৃষ্টি একে অপরের প্রতি তাদের ভালোবাসার সাক্ষী হয়ে রইল।

অনুষ্ঠানের মাঝে, তুর এবং রিজভীর মধ্যে মিষ্টি খুনসুটি চলতে থাকল। রিজভী যখন তুরকে মিষ্টি কিছু বলল, তুর তা শুনে একটু বিরক্তির ভাব এনে হেসে ফেলল। তাদের এই মিষ্টি ঝগড়া সবাইকে আনন্দ দিল।

তূর্য এবং নম্রতা যখন একসঙ্গে মঞ্চে নাচতে শুরু করল, তখন সবাই তাদের দেখে মোহিত হয়ে গেল। তাদের নাচের ছন্দ, একে অপরের প্রতি ভালোবাসা এবং সম্মান সবাইকে মুগ্ধ করল।

রাদিফ এবং শুভ্রতার মুহূর্তগুলো ছিল বিশেষ। রাদিফ শুভ্রতার চোখের দিকে তাকিয়ে বলল
“শুভ্রতা, আজকের দিনটি আমাদের জীবনের একটি বিশেষ অধ্যায়। তুমি আমার জীবনের সবচেয়ে মধুর অংশ।”

শুভ্রতা হেসে বলল
“রাদিফ, আপনি আমার জীবনের সবচেয়ে সুন্দর উপহার।”

রাদিফ মুচকি হেসে বলল
“শুভ্রতা,তোমাকে আজ অসাধারণ লাগছো।”

শুভ্রতা লাজুক হেসে বলল
“আপনাকেও আজ বেশ সুদর্শন লাগছে।”

রাদিফ শুভ্রতার কথা বাঁকা হাসলো।

——————

অনুষ্ঠানের মাঝে, তূর্য মঞ্চে দাঁড়িয়ে ছিল যখন তার সৎ মা, শায়লা, এসে উপস্থিত হলো। শায়লা চোখের পানি মুছে বলল,
“তূর্য, আমি জানি আমি তোমাদের জীবন কঠিন করে তুলেছি। আমার সমস্ত কিছু হারিয়ে গেছে এবং আমি এখন সম্পূর্ণভাবে নিঃস্ব। আমি সত্যিই দুঃখিত।”

তূর্য কঠোরভাবে বলল
“আপনি যে ক্ষতি আমাদের করেছো, তা আমরা কখনো ভুলতে পারব না। আপনি আপনার পথ বেছে নিয়েছেন এবং এখন আপনার পরিণতি ভোগ করতে হবে।”

শায়লা হাহাকার করে চলে গেল। তার ভয়াবহ পরিণতি তার জীবনের এক নতুন অধ্যায় হয়ে দাঁড়াল।

এদিকে, তূর্যয়ের বাবা, নুরুল হক, যিনি এতদিন ধরে তার সৎ মায়ের সঙ্গ দিচ্ছিলেন, শেষ পর্যন্ত একটি ভয়াবহ পরিণতির সম্মুখীন হন। তার ব্যবসায়িক অংশীদারদের সাথে দ্বন্দ্বের কারণে, তার সব সম্পত্তি বাজেয়াপ্ত হয় এবং তিনি অর্থনৈতিকভাবে নিঃস্ব হয়ে পড়েন। এই পরিস্থিতিতে, তার জীবন একেবারেই অন্ধকারে ডুবে যায়। তার মানসিক অবস্থাও চরম দুর্দশার মধ্যে চলে যায়, এবং অবশেষে তিনি স্বাস্থ্যগত কারণে পরলোকগমন করেন। যা তার পরিবারের জন্য একটি কঠিন পরিণতি এনে দেয়।

তূর্যের সৎ মায়ের প্রস্থান এবং তার বাবার কঠিন পরিণতির বিষয়গুলি দেখে, নম্রতা তূর্যকে সান্ত্বনা দিতে এগিয়ে এল। সে তূর্যের পাশে গিয়ে বলল
“তূর্য, আমি জানি এই মুহূর্তটি আপনার জন্য কঠিন। কিন্তু আমরা একসাথে এই সময় পার করব। আপনি একা নন এখন আর।”

তূর্য নম্রতার সান্ত্বনার প্রতি মৃদু ধন্যবাদ জানাল। নম্রতা তূর্যের কাঁধে হাত রেখে বলল
“আমরা একসাথে সবকিছু মোকাবেলা করব।”

তূর্য বোনের হাসি মুখ দেখে এই ঘটনাটা আর জানালো তাকে। থাক না মেয়েটা তো হাসিখুশি আছে। মেয়েটার বিশেষ দিনে এমন কথা না বললেই বা কি। তূর্য খেয়াল করলো ওর জন্য নম্রতার মনটাও খারাপ হয়ে গিছে। সে নিজেকে স্বাভাবিক করে নম্রতার দিকে তাকিয়ে বলল
“নম্রতা, আজকের দিনটি আমাদের জীবনের সবচেয়ে সুন্দর দিন। তোমার সাথে কাটানো প্রতিটি মুহূর্ত আমার জন্য অমূল্য।”

“তূর্য, এই মুহূর্তের আনন্দ শুধু আমাদের নয়, আমাদের পরিবারও যেন আনন্দিত। আপনার সাথে আমার জীবন নতুন এক শুরু পাচ্ছে।”

বিয়ের সমস্ত আনুষ্ঠানিকতা সম্পন্ন হওয়ার পর, তূর্য এবং নম্রতা একে অপরকে আলিঙ্গন করে, তাদের নতুন জীবনের শুরুতে একসাথে হওয়ার অঙ্গীকার করল। তাদের চোখে সুখের আলো এবং নতুন জীবনের জন্য আশা ছিল।

বিয়ের দিন তুর এবং রিজভীও তাদের বিশেষ মুহূর্ত উপভোগ করছিল। সাজানো অনুষ্ঠানে, তুর তার সাজপোশাক আর হাস্যোজ্জ্বল চেহারায় রিজভীর পাশে দাঁড়িয়ে ছিল। রিজভী তার উজ্জ্বল পোশাক আর হাসিমুখে তুরের পাশে ছিল।

রিজভী মুচকি হেসে বলল
“তুর, আজকের দিনটা আমাদের জীবনের একটি নতুন অধ্যায় শুরু করছে। তুমি জানো, আমাদের মধ্যে এই মিষ্টি ঝগড়া আর খুনসুটি আমাদের সম্পর্ককে আরও গভীর করে তুলেছে।”

“হ্যাঁ, রিজভী, তুমি আমার জীবনের অঙ্গ। আমাদের মিষ্টি খুনসুটি আর হাস্যরস আমাদের সম্পর্কের সৌন্দর্য বাড়িয়ে দিয়েছে।”

তুর আর রিজভী একে অপরকে মিষ্টি হাসি দিয়ে বলল
“আজকের দিনটি শুধু আমাদের সম্পর্কের জন্য নয়, আমাদের পরিবারের জন্যও একটি নতুন শুরু। আমরা একসাথে সুখী হওয়ার প্রতিশ্রুতি দিচ্ছি।”

২১.
বিয়ের অনুষ্ঠান শেষে চারপাশে যখন হইচই থেমে গেছে, অতিথিরা বিদায় নিয়েছে, এবং বাড়ি নিস্তব্ধতায় ঢেকে গেছে, তখন রাদিফ ও শুভ্রতা কিছু সময়ের জন্য ছাদে উঠে আসলো। চারদিকে নীরবতা, আকাশে উজ্জ্বল পূর্ণচাঁদ, আর হালকা বাতাস—সবকিছুই যেন তাদের জন্য বিশেষভাবে সাজানো ছিল।

রাদিফ শুভ্রতার হাতটি আলতোভাবে ধরে বলল
“মায়াবতী, তোমার সাথে কাটানো প্রতিটি মুহূর্ত যেন জীবনের সবচেয়ে মূল্যবান সম্পদ হয়ে উঠেছে। এই চাঁদের আলোয় তোমার মুখের মায়াবী আভা আমাকে আরও মুগ্ধ করে।”

শুভ্রতা চাঁদের দিকে তাকিয়ে মৃদু হেসে বলল
“রাদিফ, এই চাঁদ যেমন আকাশের সৌন্দর্য বাড়ায়, তেমনই আপনি আমার জীবনে আলো এনে দিয়েছেন। আজকের এই মুহূর্তটি আমি কখনো ভুলবো না।”

রাদিফ শুভ্রতার চোখের দিকে তাকিয়ে বলল
“তুমি জানো মায়াবতী, এই চাঁদ যেমন পূর্ণিমার রাতে উজ্জ্বল, তেমনি আমার জীবনের প্রতিটি রাত তোমার সান্নিধ্যে পূর্ণ হয়ে উঠেছে। তোমার প্রতি আমার ভালোবাসা যেমন গাঢ়, তেমনই অটুট।”

শুভ্রতা মৃদু হাসি দিয়ে বলল
“আপনার এই কথাগুলো আমার হৃদয়ে সুরের মতো বাজে, রাদিফ। আমি জানি, আমাদের পথচলায় অনেক বাধা আসতে পারে, কিন্তু আপনার হাত ধরে থাকলে আমি সবকিছু পারি।”

রাদিফ হেসে শুভ্রতার কপালে একটি মিষ্টি চুম্বন দিলো। তারা চাঁদের আলোয় কিছুক্ষণ নীরবে বসে রইলেন, যেন সেই মুহূর্তটি সময়ের বাইরে দাঁড়িয়ে আছে। চারপাশের নিস্তব্ধতা এবং চাঁদের আলো তাদের হৃদয়ে এক অন্যরকম প্রশান্তি এনে দিল।

শুভ্রতা মাথা তুলে রাদিফের দিকে তাকিয়ে বলল
“রাদিফ, আমাদের ভালোবাসা যেন এই চাঁদের মতোই চিরকাল উজ্জ্বল থাকে।”

রাদিফ আলতো করে শুভ্রতার গাল ছুঁয়ে বলল
“মায়াবতী, তুমি আমার জীবনের আলো, তুমি আমার সবকিছু। যতক্ষণ তুমি আমার পাশে থাকবে, আমি প্রতিটি মুহূর্তে তোমাকে ভালোবাসায় ভরিয়ে রাখবো।”

শুভ্রতা প্রশান্তির হাসি হেসে রাদিফের কাধে মাথা রেখে বলল
“আমি সারাটা জীবন শুধুমাত্র আপনার শুভ্রতা হয়েই থাকতে চাই।”

রাদিফ আলতো এসে শুভ্রতাকে আগলে নিলো নিজের আরো কাছে।

—————-

পরিশেষে,
রাদিফ ও শুভ্রতার হৃদয় এক হয়ে গেল, যেমন চাঁদ আর তার আলো একসাথে মিলে রাতের অন্ধকারকে দূর করে। তাদের ভালোবাসার গভীরতা, তাদের একে অপরের প্রতি নির্ভরতা, এবং তাদের ভবিষ্যতের প্রতিশ্রুতি—সবকিছুই যেন এই রাতের নিস্তব্ধতার মাঝে ফুটে উঠেছিল।

এই গল্পটি শুধুমাত্র তূর্য, নম্রতা, তুর, রিজভী, রাদিফ এবং শুভ্রতার নয়; এটি সেই সকল ভালোবাসার গল্প, যেখানে সম্পর্কের গভীরতা, ভালোবাসার স্নিগ্ধতা, এবং জীবনের প্রতিটি বাঁক একে অপরের হাতে হাত রেখে পার হয়।

এভাবে, চাঁদের আলোয় রাদিফ ও শুভ্রতার এই মধুর মুহূর্ত তাদের জীবনের নতুন একটি অধ্যায়ের সূচনা করে, যা কখনও ম্লান হবে না। তাদের ভালোবাসা যেমন এই রাতের চাঁদের আলোয় উজ্জ্বল, তেমনি তাদের সম্পর্কও চিরকাল অমলিন থাকবে।

#সমাপ্ত

একটি উত্তর ত্যাগ

আপনার মন্তব্য লিখুন দয়া করে!
এখানে আপনার নাম লিখুন দয়া করে