আপনার শুভ্রতা পর্ব-১৭

0
182

#আপনার_শুভ্রতা
#লেখিকাঃশুভ্রতা_শুভ্রা
#পর্বঃ১৭

রিজভী অসহায় দৃষ্টিতে তাকালো তুরের দিকে। তুর সেদিকে পাত্তা না দিয়ে রাগে রিক্সা থেকে নেমে যেতে নিবে তখনই রিজভী নরম কন্ঠে বলল
“তুমি থাকো। আমি নেমে যাচ্ছি।”

তুর কিছু বলল না। রিজভী নেমে যেতেই তুর রিক্সাওয়ালাকে বলল
“মামা চলেন।”

রিক্সা চলতে লাগল। রিজভী পলকহীনভাবে তাকিয়ে রইলো সেদিকে।

১৪.
দেখতে দেখতে শুভ্রতাদের পরীক্ষার দিন চলে এসেছে। কাল শুভ্রতার পরীক্ষা। শুভ্রতা চারপাশে বইখাতা ছিটিয়ে মাথায় হাত দিয়ে বসে আছে। ঘড়িতে তখন রাত নয়টা।

রাদিফ কেবলি বাহিরে থেকে এসেছে। সে নিজের নতুন বিজনেস নিয়ে বেশ ব‍্যস্ত সময় অতিবাহিত করছে সে। রাদিফ রুমে প্রবেশ করে চোখ বড় বড় করে তাকিয়ে রয়েছে শুভ্রতার এমন কান্ডে। রাদিফ চশমাটা ঠিক করে বলল
“এই শুভ্রতা এ তোমার কি অবস্থা!”

শুভ্রতা ঠোঁট উল্টে তাকালো রাদিফের দিকে। রাদিফ ফুস করে একটা নিশ্বাস ছেড়ে ধীর পায়ে এগিয়ে গেল শুভ্রতার দিকে। শুভ্রতার পাশে বসে ওর হাত নিজের হাতে আবদ্ধ করে বলল
“টেনশন নিও না। তুমি পারবে। আমি তোমার পাশেই আছি।”

শুভ্রতা তাকালো রাদিফের দিকে। রাদিফ ক্লান্তিমাখা মুচকি হাসি দিয়ে শুভ্রতার মুখটা নিজের দুহাত দিয়ে ধরে ঠোঁট ছোঁয়ালো শুভ্রতার কপালে। শুভ্রতা চোখ বুজে নিলো।

দীর্ঘ এক চুমু দেওয়ার পর রাদিফ বলল
“তুমি চিন্তা বাদ দিয়ে ধীরেসুস্থে পড়ো। আমি ফ্রেশ হয়ে আসি।”

শুভ্রতা মুচকি হেসে মাথা নাড়ালো। রাদিফ মুচকি হাসি বজায় রেখেই পকেট থেকে চকলেট বের করে শুভ্রতার দিকে এগিয়ে দিলো। শুভ্রতা খুশি মনে চকলেটটা নিয়ে নিলো।

রাদিফের প্রতিদিনের অভ‍্যাস এটা। সে প্রতিদিনই শুভ্রতার জন‍্য চকলেট নিয়ে আসে বাসায় আসার সময়। শুভ্রতার বেশ ভালো লাগে বিষয়টা।

শুভ্রতা উঠে কার্বাট থেকে রাদিফের টিশার্ট বের করে রাখলো। বইখাতা গুছিয়ে টেবিলে রাখলো। বিছানা গুছিয়ে রাখলো।

রাদিফ শাওয়ার নিয়ে চুল মুছতে মুছতে বের হয়ে দেখলো বেডে তার টিশার্ট রাখা। শুভ্রতা টেবিলে বসেছে পড়তে। রাদিফ মুচকি হেসে তোয়ালেটা বারান্দায় মেলে দিয়ে এসে টিশার্টটা পড়ে নিলো। শুভ্রতা পড়ছে মনোযোগ দিয়ে।

রাদিফ মুচকি হেসে রুম থেকে বেড়িয়ে গেল।

রিজভী আর রফিকুল সাহেব খাবার টেবিলে বসে ছিলেন। রাদিফকে একা আসতে দেখে রফিকুল সাহেব কপাল কুচকে বললেন
”মামুণি কোথায়!”

রাদিফ চেয়ার টেনে বসতে বসতে বলল
“কাল থেকে ওর পরীক্ষা শুরু তো পড়াশোনা করছে টেনশন করো না। খাওয়া শুরু করো আমি খেয়ে ওকে গিয়ে খাইয়ে দিবোনি।”

রফিকুল সাহেব মুচকি হাসলেন ছেলের আচরণ বরাবরই তাকে মুগ্ধ করে। কি সুন্দর ছেলেটা সবদিকে খেয়াল রেখে চলে।

রিজভী খাবার নিয়ে নাড়াচাড়া করছে। রাদিফ বিষয়টি খেয়াল করেছে। বেশকিছুদিন যাবত রিজভী বেশ চুপচাপ। রাদিফ ভেবে নিলো সময় করে ওর সঙ্গে কথা বলতে বসবে সে। রফিকুল সাহেব ছোট ছেলেকে খেতে না দেখে বললেন
“রিজভী কি হয়েছে খাচ্ছিস না কেন!”

রিজভীর ভাবনায় ছেদ ঘটলো। সে ঠোঁটে জোড়পূর্বক হাসি টেনে বলল
“খাচ্ছি তো বাবা।”

বলে সে খেতে লাগল। রফিকুল সাহেব দীর্ঘশ্বাস ফেলে খেতে লাগলেন। ছেলেটা তার বেশ চাপা। পেটে বোম মারলেও কথা বের হয় না। ছোট ছেলেটাকে নিয়ে তিনি বেশ চিন্তিত।

খাওয়াদাওয়া শেষে রাদিফ একটা প্লেটে খাবার আর পানি নিয়ে রুমে চলে গেল।

শুভ্রতা তখনো পড়ছিলো। রাদিফ পাশে থাকা চেয়ারটা টেনে শুভ্রতার পাশাপাশি বসলো। শুভ্রতা তাকালো রাদিফের দিকে। রাদিফ ওর চেয়ার ঘুড়িয়ে সামনাসামনি করলো। শুভ্রতা বলল
“আমাকে ডাকলেই পারতেন। আমি ওখানে গিয়ে খেতাম। আপনার…”

রাদিফ শুভ্রতার ঠোঁটে আঙুল রেখে বলল
“এতো কথা শুনতে চাইছিনা। চুপচাপ বাধ‍্য মেয়ের মতো খাবে।”

বলেই ভাত মাখিয়ে শুভ্রতার মুখে ধরলো। শুভ্রতা খেতে লাগল। চোখ বেয়ে নোনাজল গড়িয়ে পরলো শুভ্রতার। রাদিফ খাবার প্লেটটা টেবিলে রেখে বাম হাত দিয়ে শুভ্রতার চোখের পানি আলতো হাতে পানি মুছিয়ে দিয়ে বলল
“বাবার কথা মনে পড়ছে!”

শুভ্রতা ছলছল নয়নে রাদিফের দিকে তাকিয়ে বলল
“আপনি কিভাবে আমার মনের সব কথা বুঝে যান!”

রাদিফ মুচকি হেসে খাবার প্লেটটা আবারও হাতে নিলো। শুভ্রতা আবারও বলল
“জানেন তো বাবা ও আমাকে পরীক্ষার আগের রাতে এভাবেই খাইয়ে দিতো।”

রাদিফ আরেক লোকমা ভাত শুভ্রতার মুখে তুলে দিতে দিতে বলল
“পরীক্ষাটা শেষ হলে ওই বাড়িতে নিয়ে যাবোনি কিছুদিন মা বাবার সঙ্গে থেকে এসো।”

শুভ্রতার চোখমুখ উজ্জ্বল হয়ে উঠলো রাদিফের কথায়। সে উচ্ছ্বসিত কন্ঠে বলল
“সত‍্যি”

রাদিফ শুভ্রতাকে পানি খাইয়ে দিয়ে মুখ মুছিয়ে দিয়ে বলল
“হুম সত্যি এখন পড়ো। আমি বাবাকে ঔষধ দিয়ে আসছি।”

শুভ্রতা হ‍্যাঁবোধক মাথা নাড়িয়ে পড়তে শুরু করলো।

রাদিফ সবকিছু রান্নাঘরে রেখে রফিকুল সাহেবের রুমে গেল।

রফিকুল সাহেব ল‍্যাপটপে কাজ করছিলেন। রাদিফ বলল
“বাবা কি করছো!”

রফিকুল সাহেব কাজ করতে করতেই বললেন
“রেদোয়ানকে নিয়ে কলেজে বেশ বিশৃঙ্খল পরিবেশ সৃষ্টি হয়েছিল। দেখ তো ছেলেটা কাজটা কি করলো!”

রাদিফ ঔষধ ছিড়তে ছিড়তে বলল
“চাপ নিও না সব ঠিক হয়ে যাবে। এখন ঔষধ খেয়ে ঘুমিয়ে পড়ো। সকালে কাজ করো।”

রফিকুল সাহেব দীর্ঘশ্বাস টেনে ল‍্যাপটপ বন্ধ করে ঔষধ খেয়ে নিলেন। খেয়ে শুয়ে পড়লেন। রাদিফ বাবাকে ঘুম পারিয়ে প্রতিদিন কাজ শেষে রান্নাঘরে গেল।

শুভ্রতা মাথায় হাত চেপে বসে আছে। মাথাটা বেশ ধরেছে তার। রাদিফ রান্নাঘর থেকে কফি বানিয়ে রুমে এসে শুভ্রতার কাছে কফির মগটা এগিয়ে দিতেই শুভ্রতা মুচকি হেসে কফির মগটা হাতে নিয়ে খেতে লাগল। কফিটা শেষ হতেই রাদিফ বলল
“আর কতটুকু বাকি আছে?”

“আর বেশি বাকি নেই আপনি ঘুমিয়ে পড়ুন।”

রাদিফ পাশের চেয়ারেটা টেনে বসতে বসতে বলল
“আমাকে নিয়ে ভাবতে হবে না। তুমি পড়ো আমি তোমার পাশেই আছি। কিছু দরকার হলে আমাকে বলো।”

“সমস‍্যা নেই আপনি ঘুমিয়ে পড়ুন।”

“তোমার সমস্যা নাই থাকতে পারে কিন্তু আমার আছে। চুপচাপ পড়ো। একসঙ্গে ঘুমাবো।”

শুভ্রতা আর কথা বাড়ালো না। কারণ জানে এই লোকের সঙ্গে কথায় সে পারবেনা। এই লোক যা বলবে তাই করবে। শুভ্রতা আবার পড়তে লাগল।

আরো ঘন্টাখানেক মনোযোগ দিয়ে পড়ে শুভ্রতা রাদিফের দিকে তাকাতেই দেখলো সে পলকহীনভাবে তার দিকেই তাকিয়ে আছে। শুভ্রতা নিচু কন্ঠে বলল
“আমার পড়া শেষ।”

রাদিফ মুচকি হেসে বেডের দিকে এগিয়ে গেল। শুভ্রতা লাইট অফ করে বেডে আসতেই রাদিফ ওকে আষ্টেপৃষ্ঠে জড়িয়ে ধরে মাথায় হাত বুলিয়ে দিতে লাগল চোখ বুজে।

শুভ্রতা ও মুচকি হেসে চোখ বুজলো।

————–

নম্রতা অস্থিরচিত্তে ফোন হাতে নিয়ে বসে আছে। সে কয়েকদিন যাবত দেখছে তূর্য তাকে এড়িয়ে চলছে। নিজে ফোন করছেনা। আবার সে কল করলে ব‍্যস্ততা দেখিয়ে কেটে যাচ্ছে। যা নম্রতাকে বিরক্ত করে তুলেছে। হঠাৎ করে কি এমন হলো লোকটার। আজও সে কল করেছিল।

“ব‍্যস্ত আছি ফ্রি হলে কথা কল দিবোনি।” বলেই নম্রতাকে কিছু বলার সুযোগ না দিয়ে কল কেটে দিয়েছে তূর্য।

ঘড়িতে রাত বারোটা তূর্যের এখনো কোনো কল বা মেসেজ নেই। নম্রতা ফোনটা পাশে রেখে মাথা ঠেকালো বারান্দার দেয়ালের সঙ্গে। পলকহীন ভাবে তাকিয়ে রইলো ঘুটঘুটে আকাশটার দিকে। আজ চাঁদ নেই। তাহলে কি তার মতো আকাশের মন খারাপ। হয়তো বা তাই। তা না হলে কি হাসা বন্ধ করে দেয়।

মৃদু বাতাস বইছে। নম্রতার খোলা চুলগুলো বাধাহীন ভাবে উড়ছে। সেদিকে তার খেয়াল নেই। এক ধ‍‍্যানে আকাশপানেই সে তাকিয়ে আছে।

তূর্য এমন ধারার ব‍্যবহার সে সহ‍্য করতে পারছেনা। দিনে পাঁচটা মিনিটও কি ওর সঙ্গে কথা বলা যায় না। এতোই ব‍্যস্ত সে। হয় তো যায় কিন্তু ইচ্ছে করেই করে না সে। নম্রতা চোখ বুজলো। এতক্ষণ যাবত আটকে রাখা নোনাজল গুলো চোখের কাণিশ ছেড়ে গাল বেয়ে নেমে যেতে থাকলো।

নম্রতা হুট করেই উঠে দাঁড়ালো। চোখের পানিটুকু হাতের উল্টো পিঠ দিয়ে মুছে বিরবির করলো
“সে যখন তাকে চায় না। তাহলে তার জন‍্য নিজে কষ্ট পাবে। পাবেনা সে কষ্ট। সে কি কারো খেলার পুতুল নাকি একবার নিজে নিজে কথা বলবে আবার নিজে নিজে কথা বন্ধ করে দিবে। সেই দেখিয়ে দিবে ইগনোর কাকে বলে?”

নম্রতা তূর্যকে সব জায়গা থেকে ব্লক করে দিলো। গটগট পায়ে রুমে এসে ঠাস করে শুয়ে পড়লো। এগুলো ভাবার আর সময় নেই তার কাছে। এখন থেকে আবারও নিজের পড়ালেখায় মন দিবে সে। এগুলো ভাবতে ভাবতেই নম্রতা কখন যে ঘুমের রাজ‍্যে পারি দিলো টেরও পেল না।

#চলবে

একটি উত্তর ত্যাগ

আপনার মন্তব্য লিখুন দয়া করে!
এখানে আপনার নাম লিখুন দয়া করে