#আপনার_শুভ্রতা
#পর্বঃ০৬
#লেখিকাঃশুভ্রতা_শুভ্রা
৭.
অসহ্যকর ভ্যাবসা গরমের ভাব চারিদিকে বিরাজ করছে। এমনিতে ব্যস্তনগরী ঢাকাতে অনবরত জ্যামের অত্যাচার তো আছেই। শুভ্রতা তার ওড়নার শেষ অংশ দিয়ে কপালের বিন্দু বিন্দু ঘাম মুছে নিলো। বিরক্তিতে চোখ মুখ কুচকে আছে সে। এমনিতেই দেড়ি হয়ে গেছে তার মধ্যে এমন ভেবসা গরমে বেশ বিরক্ত লাগছে শুভ্রতার।
তুরটাও আজ নাকি ভার্সিটি যাবেনা। অবশ্য আগে দিন যা ঝড় গেছে তার উপর দিয়ে। আজ সকলেই তূর্য প্রয়োজনীয় তোশক বালিশ এগুলো কিনে দিয়ে অফিস গিয়েছে। তুর ঘর গোছাতে ব্যস্ত।
শুভ্রতা এগুলোই ভাবছিল হুট করেই রিক্সায় কেউ লাফিয়ে উঠায় চমকে গেল শুভ্রতা। চেঁচিয়ে উঠতে নিবে তার আগেই রাদিফ শুভ্রতার ডান হাতটা চেপে ধরে বলল
“ভয় পেও না মায়াবতী আমি রাদিফ।”
মুহুর্তে ভ্রুকুচকে এলো শুভ্রতার। বুকে ফু দিয়ে চোখ ছোট ছোট করে রাদিফের দিকে তাকিয়ে বলল
“এটা আপনি কি করলেন! আর আপনি আমাকে তুমি সম্বোধন করছেন কেন!”
রাদিফ বাঁকা হেসে পাঞ্জাবির বুক পকেট থেকে একটা রুমাল বের করে শুভ্রতার দিকে এগিয়ে দিয়ে বলল
“ঘাম মুছতে মুছতে তো ওড়নাটা ভিজিয়ে ফেলেছো। নেও এটা দিয়ে মুছে নেও।”
“আগে আমার কথার উত্তর দিন।”
রাদিফ ফুস করে একটা নিশ্বাস ছেড়ে বলল
“রিক্সা পাচ্ছিলাম না আর তখনই তোমার দেখা পেয়ে গেলাম। যে গরম পড়েছে ভাবলাম ভাড়াটা ফিফটি ফিফটি করে একসঙ্গে চলে যাই। এক জায়গাই তো। আর তুমি বয়সে আমার অনেক ছোট। আর কত আপনি আপনি করবো। যাইহোক এখন তো রুমালটা নিবে।”
শুভ্রতা মুখ ফুলিয়ে অন্যদিকে তাকিয়ে রইলো। রাদিফ মুচকি হাসলো রুমালটা দিয়ে নিজের কপালের ঘামটাই মুছে আবারও বুক পকেটে রেখে দিলো।
ওদের নিরবতার মাঝেই জ্যাম ছেড়ে গেল। ভার্সিটির গেটের কাছে রিক্সা থামতেই শুভ্রতা পুরো ভাড়াটা দিয়ে নেমে গটগট পায়ে চলে গেল সে। রাদিফ ফুস করে একটা নিশ্বাস ছেড়ে ধীর পায়েই ভার্সিটিতে ঢুকলো।
শুভ্রতা বিরক্ত নিয়েই দুটো ক্লাস করে খালের পাড়ে এলো। শুভ্রতা বেশ অবাক হলো রাদিফকে আগে থেকেই সেখানে দেখে। শুভ্রতা কিছু না বলে ঘুরে চলে যেতে নিবে তার আগেই রাদিফ গম্ভীর কন্ঠে বলে উঠলো
“আমি তোমাকে ভালোবাসি মায়াবতী।”
শুভ্রতা থমকে গেল। কি বলছে রাদিফ এগুলো! মাথা ঠিক আছে তো তার! শুভ্রতার কানে বাজছে রাদিফ বলা কথা। ঘামতে শুরু করেছে সে। মাথাটা ভনভন করছে। বুকটা ধুকপুক ধুকপুক করছে। কি এমন ছিলো রাদিফের কন্ঠে যে তার এমন লাগছে!
রাদিফ এতক্ষণে সামনে এসে দাঁড়িয়েছে শুভ্রতার। শুভ্রতার ডান হাতটা টেনে ধরে ব্রেঞ্চে এনে বসিয়ে রাদিফ ওর কোলে মাথা দিয়ে হুট করেই শুয়ে পরলো। শুভ্রতা শুধু থমথমে হয়ে বসে রয়েছে। ছেলেটির হুট করে কি এমন হলো যে এমন অস্বাভাবিক আচরণ করছে। চুলগুলো এলোমেলো চোখগুলো লাল হয়ে আছে। এই গোছানো মানুষটাকে এই কয়েকদিনে এতটা এলোমেলো লাগেনি শুভ্রতার কাছে। শুভ্রতা নরম কন্ঠে বলল
“কি হয়েছে আপনার!”
রাদিফ হুট করেই উঠে বসলো। শুভ্রতার হাত দুটো নিজের হাতের মাঝে আবদ্ধ করে দমে দমে বলল
“আমি সত্যিই তোমাকে ভালোবাসি মায়াবতী। প্রেম নামক দহনে আমি জ্বলে পুড়ে ছাঁই হয়ে যাচ্ছি। আমি যে আর পারছিনা। আমাকে বাঁচাও তুমি। তুমি ছাড়া যে আর কেউ আমাকে বাঁচাতে পারবেনা মায়াবতী।”
শুভ্রতা নিরব রইলো। রাদিফ কিছু বলতে নিবে তার আগেই শুভ্রতা বলল
“আমাকে বাড়ি যেতে হবে।”
রাদিফ কিছু বললো না। আস্তে করে হাতটা ছেড়ে দিলো শুভ্রতার। ঢুলুঢুলু পায়ে চলে গেল সেখান থেকে। শুভ্রতা পলকহীন ভাবে তাকিয়ে রইলো রাদিফের যাওয়ার দিকে।
রাদিফ চোখের আড়ালে চলে যেতেই শুভ্রতার মাথায় হাজারো প্রশ্ন ঘুর ঘুর করতে লাগল। কি হয়েছে রাদিফের! এমনটা লাগছিল কেন! সকালেই ঠিক ছিলো।
শুভ্রতার ফোনটা বেজে উঠতেই ওর ভাবনায় ছেদ ঘটলো। শুভ্রতা ব্যাগ হাতরে ফোনটা বের করে দেখলো ওর মা কল করেছে। শুভ্রতা একটা দীর্ঘশ্বাস ফেলে কলটা রিসিভ করে কানে ধরলো। রেহেনা বেগম অপরপাশ থেকে বলে উঠলেন
“কোথায় তুই!”
“কেন মা ভার্সিটিতেই আছি! কি হয়েছে! তোমরা ঠিক আছো তো!”
“হুম ঠিক আছি সবাই। তোর ক্লাস শেষ।”
“ভালো লাগছেনা ক্লাস করতে তাই একটু বসে ছিলাম। কি হয়েছে বলো।”
“বাসায় চলে আয় তাহলে। তোর ফুফু ফুপা এসেছে।”
শুভ্রতা তপ্ত নিশ্বাস ছেড়ে বলল
“আচ্ছা দেখি।”
“হুম তাড়াতাড়ি চলে আয়।”
আচ্ছা বলেই কল কাটলো শুভ্রতা। ভিতর থেকে একটা দীর্ঘশ্বাস বেড়িয়ে এলো তার। এই তো এখনি তার রূপ নিয়ে কথা উঠবে। তুলনা করা হবে তার ছোট্ট বোনটার সঙ্গে। কেন মানুষ বুঝতে চায়না যে কারো সঙ্গে কারো মিল থাকেনা। যে যার মতো। আল্লাহ সৃষ্টি তো। তবুও কেন এতো কথা! ভেবে পায় না সে।
ফোনটা ব্যাগে রেখে ব্যাগটা কাধে তুলে উঠে দাড়ালো ব্রেঞ্চ থেকে। ভার্সিটি থেকে বের হতে নিবে তার আগে দেখলো বড় আম গাছটার নিচে রেদোয়ান একটা মেয়ের সঙ্গে লেপটে বসে আছে। মেয়েটাও বেশ গা ঘেঁষে বসে হাসাহাসি করছে। শুভ্রতা তাচ্ছিল্যের হাসি দিয়ে সেদিক থেকে চোখ সরিয়ে সামনে অগ্রসর হলো।
শুভ্রতা মনে মনে আল্লাহর কাছে শুক্রিয়া জানালো তাকে রেদোয়ানের থেকে সরিয়ে নেওয়ার জন্য।
———————
বাসায় ফিরতেই রেহানা বেগম দরজা খুলে শুভ্রতাকে ফ্রেশ হয়ে নিতে বললেন। মাথাটা বেশ ধরেছে শুভ্রতা। একে তো ভ্যাবসা গরম তার উপর জ্যামে বিরক্ত সে। ক্লান্ত চিত্তে বসার রুমে আসতেই শুভ্রতার ফুফু শাফিনা বেগম কপাল কুচকে বললেন
“কোথায় থেকে এলে শুনি তো!”
শুভ্রতা ঠোঁটে জোড়পূর্বক হাসি টেনে বলল
“আপনি তো জানেনই ফুপি। তাহলে জিঙ্গাসা করছেন কেন! এসব বাদ দেন কেমন আছেন!”
“এই তো ভালো। তা বয়স তো কম হলো না বিয়ে কবে করছো!”
“গায়ে হলুদের পরের দিন।”
“হেয়ালি করছো আমার সঙ্গে মেয়ে! এমনিই তো চাপা গায়ের রঙ তার উপর বয়স হলে তো বিয়েই হবেনা বাপু। ভালো কথা তো ভালো লাগবেই না।”
শুভ্রতা দীর্ঘশ্বাস ফেলল। সে তো আগে থেকেই জানতো এই কথা উঠবে। শুভ্রতা নিজেকে ধাতস্ত করে ঠোঁটে হাসি টেনেই বলল
“এতো ভালো আপনাকে কে ভাবতে বলেছে! আর নিজের চরকায় তেল দিন আমারটায় দিতে আসবেন না একদম। আমার মুখ খোলাবেন না দয়া করে। ফুফু আছেন ফুফুর মতো থাকবেন। বেহুদা কথা বলে নিজের সম্মান নষ্ট করবেন না।”
শাফিনা বেগম কথা বলতেই ছিলেন কিন্তু শুভ্রতা তা পাত্তা না দিয়ে গটগট পায়ে নিজের রুমে এসে দরজা লাগিয়ে দিয়ে সস্থির নিশ্বাস ছাড়লো।
ক্লাস এইট নাইনে থাকতে এমন সব কথা শুনে শুভ্রতার সোসাল ফোবিয়া হয়ে যায়। ঘরের কোণেই সময় অতিবাহিত করতে শুরু করে সে। পরে তার বাবা মা তাকে সেখান থেকে বেড়িয়ে আসতে সাহায্য করে। তার বাবা প্রতি সময় তাকে সাহস জুগিয়েছে। তাই তো এখন সে কথা শুনিয়ে দিতে পারে। তবুও মনটা যে তার নরমই রয়ে গেছে। খুব কষ্ট লাগে তার এসব কথা শুনলে।
লম্বা একটা শাওয়ার নিতে হবে শুভ্রতার। শুভ্রতা ব্যাগটা টেবিলে রেখে টাওয়েল আর জামা কাপড় নিয়ে চলে গেল ওয়াশরুমে। প্রায় ঘন্টা খানেক ভিজে নিজের মাথাটা ঠাণ্ডা করে ওয়াশরুম থেকে বের হলো শুভ্রতা।
আজ সে শুভ্র রঙের একটা সেলোয়ার সুট পড়েছে। ঘড়িতে তাকিয়ে দেখলো দুপুর দুটো বাজে। শুভ্রতা টাওয়েল নিয়ে বারান্দায় মিলে দিলো। মাথায় ওড়নাটা টেনে ঠিক করে নিলো। বাড়িতে ফুপা ফুপাতো ভাই থাকা আয়নায় আবারও নিজের ওড়নাটা ঠিক করে নিয়েছে কিনা তা আয়নায় দেখে দরজা খুলে খাবার টেবিলে চলে গেল।
শামসুল হক ছাড়া সবাই খাবার টেবিলে বসে আছেন। অফিসে কাজ থাকায় আজ দুপুরে বাসায় আসেননি শামসুল হক। শুভ্রতা ধীর পায়ে মাথা নিচু করে খেতে বসলো। খুব ক্ষুধা পাওয়ায় কোনো কথা না বলে খাবারটুকু খেয়ে মাথা নিচু করেই আবারও রুমে চলে এলো।
রেহানা বেগম মেয়ের যাওয়ার দিকে তাকিয়ে একটা দীর্ঘশ্বাস ফেলে শাফিনা বেগমের দিকে একপলক তাকিয়ে খাবার নিজের প্লেটে বাড়তে বাড়তে বলল
“আমার মেয়ে মায়াবতী। অসম্ভব মায়া আমার মেয়েটার চোখ মুখ জুড়ে মনোমুগ্ধকর মায়া। যার স্বচ্ছ মন সেই শুধু আমার মেয়ের দিকে তাকিয়ে তার আসল সৌন্দর্য উপলব্দি করতে পারবে। আর জন্ম মৃত্যু বিয়ে তিনটাই আল্লাহর হাতে। শুধু শুধু এতো ভেবে কি লাভ আছে!”
শাফিনা বেগম ভ্রুকুচকালেন। গম্ভীর কন্ঠে বলে উঠলেন
“ভাবি তুমি কি আমারে কথা শুনাইতেছো!”
রেহানা বেগম হাসলেন। মৃদু কন্ঠে বললেন
“না গো শাফিনা আমাকে ভুল বুঝোনা। এমনিতেই কথাগুলো বললাম।”
শাফিনা বেগম রাগে হিসহিসালেন। কিন্তু মুখে কিছু বললেন না। মায়ের কথায় মুচকি হাসি ফুটে উঠলো নম্রতার ঠোঁটে।
নম্রতা খুঁজে পায়না তার আপুনি কত সুন্দর। সে সময় পেলেই তার আপুনির মায়াবী চোখের দিকে তাকিয়ে থাকে। কত ভালো যে লাগে তার। তবে কেন মানুষ এমন করে! খুঁজে পায় না সে।
শুভ্রতা ধপ করে এসে বিছানায় শুয়ে পড়লো। মাথাটা ধরেছে তার। ঘুমও পেয়েছে। শুভ্রতা আর না ভেবে ডুব দিলো ঘুমের রাজ্যে।
৮.
পড়ন্ত বিকালে শুভ্রতা আর তুর দাড়িয়ে আছে ছাঁদের কাণিশ বেয়ে। তুরকে আজ বেশ চুপচাপ দেখে শুভ্রতার ভ্রুযুগল কুচকে এলো। শুভ্রতা এক হাত তুরের কাধে হাত রেখে বলল
“মন খারাপ কি!”
তুর তাকালো শুভ্রতার দিকে। শুভ্রতা মুচকি হেসে আকাশ পানে তাকিয়ে বলল
“জানিস তো আল্লাহ যা করেন ভালোর জন্য করেন। যেমন দেখ না রেদোয়ান একটা প্লে বয়। খারাপ ছেলে। কি সুন্দর আল্লাহ আমাকে ওর থেকে সরিয়ে নিলেন। তুই চিন্তা করিস না রে তুর। দেখবি এখনি তুই ভালো থাকবি। ওখানে তুই ছিলি বন্ধ খাঁচায় বন্দি। আর এখানে তুই মুক্ত পাখির মতো। যা ইচ্ছে তাই করতে পারবি। আর সবচেয়ে ভালো কথা তুই আর আমি একসঙ্গে থাকতে পারবো।”
বলেই তুরকে জড়িয়ে ধরলো শুভ্রতা। তুর মুচকি হাসলো।
#চলবে