আনন্দচারিনী পর্ব:২

0
1680

দুই তিনবার নক করতে দরজা খুলে দিল।
ধাক্কা দিয়ে ভেতরে ঢুকতেই ম্লান হয়ে থাকা ছোট্ট নিপার চেহারার উপর নজর গেল নিরুর।ওকে দেখতে পেয়ে নিপার চেহারায় পূর্ণিমার চাঁদের মতন আলোর ঝলক দেখা গেল। জিনিস পএ রেখে নিরু নিপার দিক ঝুকতেই খিলখিলিয়ে হেসে এক লাফে তার গলা জড়িয়ে ধরল। মূহুর্তের মধ্যেই নিরু তাকে বুকের মধ্যে জড়িয়ে চেপে ধরল।সঙ্গে সঙ্গে এক ঝাঁক চুমু এসে নিরুর দুই গালে আছড়ে পড়ল। প্রত্যহের মত নিপার বায়না অনুসারে তিনটা ডেইরী মিল্ক চকোলেট দিতে হল তাকে। আমার চকোলেট কোথায়?আপু!নিরু সামনে তাকিয়ে দেখে নীলা দাড়িয়ে আছে। উওর না দিয়েই ব্যাগ থেকে একটা চকোলেট বের করে নীলার দিকে এগিয়ে দিল। নিপাকে নীলার কোলে দিয়ে ফ্রেশ হতে চলে গেল সে।ফ্রেশ হয়ে বাবার রুমের দিকে চলে গেল সে। বাবা একমনে পত্রিকা পড়ছেন। নিঃশব্দে এগিয়ে গিয়ে বাবার পাশে গিয়ে বসল।নিরুর বাবা ডাক শুনে চমকে উঠে পাশে বসা নিরুর দিকে একদৃষ্টিতে তাকিয়ে থাকল।
চার বছর আগেও যে মেয়েটি ছিল হাসিখুশি প্রাণোচ্ছল কিশোরী, তাকে আজ দেখলে মাঝবয়সী মনে হয়।চার বছর আগেও যে মেয়েটির চোখে সম্ভাবনারা জ্বলজ্বল করত,সেখানের দখলদার আজ একরাশ হতাশা।
তোর কি খুব কষ্ট হয় রে মা? রহমান সাহেবের প্রশ্নের উত্তর দিতে পারেনি নিরু। তীব্র কালো চোখের কোনে মুক্তো কনার মতো জ্বলজ্বল করতে লাগল। নির্বিকার চিত্তে তাকিয়ে ছিল মাথার উপর ঘুরতে থাকা সিলিং ফ্যানের দিকে।
বাবা জানইত আজ নিপার জন্মদিন।তাই ভালমন্দ কিছু রান্না করতে হবে। আমি যাই।
পালাচ্ছিস??
না বাবা। বাস্তবতা বড়ই কঠিন চাইলেও পালাবার পথ নেই। রহিমা আপা আর রাহি, রাফি আসবে।নিপার জন্মদিন উপলক্ষ্যে রাতের খাবারের দাওয়াত দিয়েছিলাম।
ভাল করেছিস মা।যা কিছু রান্না কর গিয়ে।
নিরু মেয়ে আমার জাহানারার মতো হয়েছে সব কষ্ট নিজের মাঝে লুকিয়ে রাখবে আর আনন্দ ভাগ করবে সবার মাঝে। মায়ের মতো এতটা ফর্শা হয়নি কিন্তু তীব্র কালো চোখ আর ভুবন ভোলানো হাসি দিয়ে এদিকটা পুষিয়ে নিয়েছে। তীব্র কালো চোখের দিকে তাকিয়ে থাকলে মনে হবে অন্তর্দৃষ্টিতে সব পড়ে নিয়েছে। চোখে কর্তৃত্বের ধার যেন মূহুর্তেই সব নিয়ন্ত্রণে নিবে।কিন্তু লাজুক মেয়ে কারো দিকে তাকায় না।হাসলে নিটোল গাল রক্তিম হয়ে উঠে।চোখ জোড়া সামান্য ছোট হয়, ভ্রু জোড়া রংধনুর বাঁকের আকৃতি ধারণ করে। ঠোঁট কিছুটা সম্প্রসারিত হয় ফলে দুই জোড়া দাঁতের সামান্যই দেখতে পাওয়া যায়। তার এই অনিন্দ্য সুন্দর হাসিতে অন্তর জুড়িয়ে যায়। তার হাসি যেন এক ছোঁয়াচে রোগ।তাকে হাসতে দেখলে সবাই তার সাথেই হাসে। কিন্তু গত চার বছরে তার একবারও হাসি দেখেনি।
আপি!রাহি,রাফি এসেছে।চল আমার সাথে। একটুখানি দাঁড়াও সোনা আমি ভাতের মাড় ফেলে আসছি। ততক্ষণে নীরুর রুমে উৎসব মূখর পরিবেশে সৃষ্টি হয়েছে। নিপা ,রাহি ,রাফি খেলছে আর নিরু, নীলা, রহিমা আপা মুগ্ধ হয়ে দেখছে। একটুপরে কেকের ওপর রাখা মোমবাতি জ্বালিয়ে দেয়া হয়।নিপা ফু দিয়ে মোমবাতি নিভিয়ে দেয়।সবাই নিপাকে জন্মদিনের শুভেচ্ছা জানাল।নিপা কেক কেটে প্রথমে নিরু ও বাবাকে দিল। তারপর সবাই সবাইকে কেক খাইয়ে দিল। মেঝেতে মাদুর বিছিয়ে বসে সবাই মুরগির মাংস,ডাল,বেগুন ভর্তা দিয়ে ভাত খেয়ে রাতের খাবার শেষ করল।সবাই মিলে বস্তির পাশের মাঠে গিয়ে ফানুস উড়িয়ে দিল। কিছুক্ষণ আনন্দ করার পর রহিমা আপাকে বিদায় জানিয়ে ঘরে ঢুকল সবাই।নিপা আজ নীলা ও নিরুর সাথে থাকবে।তাই নিপা কে নিয়ে নীলা রুমে ঢুকল।
আজকে তোর হাসিমাখা মুখটা দেখে খুব আনন্দিত হলাম।সবসময় হাসিখুশি থাকবি।হুম বাবার কথার
জবাব না দিয়ে নিরু রুমে এসে নিপাকে মাঝখানে রেখে জড়িয়ে ধরে ওর ক্লান্ত দেহটাকে বিছানায় এলিয়ে দিল।নিপা আর নীলার ভবিষ্যতের চিন্তায় ডুব দিল।নিরুর মন অনুভূতি শূন্য হতে লাগল ,ইন্দ্রিয়গুলোর কাজ বন্ধ করে দিল, মস্তিষ্কের নিউরনে প্যাচ লাগতে শুরু করলো।আস্তে আস্তে নিরু গভীর ঘুমে আচ্ছন্ন হয়ে গেল।

একটি উত্তর ত্যাগ

আপনার মন্তব্য লিখুন দয়া করে!
এখানে আপনার নাম লিখুন দয়া করে