#আধার_রাতের_আলো
#নুসাইবা_ইভানা
পর্ব -২০
হুর ফুয়াদের কপালে আলতো করে ঠোঁট ছুঁয়ে বলে,আপনাকে এতো ভালো হতে কে বলেছে?
ফুয়াদ মুচকি হেসে বলে,আমার হুর পরি।
হুর বলল,আল্লাহ তায়ালার কাছে লাখো কোটি শুকরিয়া আপনার মতো জীবনসঙ্গী পেয়েছি। আলহামদুলিল্লাহ।
ফুয়াদ বলে,তা খাওয়া দাওয়া করবো নাকি বসে থাকবো।
– আমাকে ছাড়ুন আর খাবার খাওয়া শুরু করুন। ফুয়াদ এক হাতেই খাবার বেড়ে নিয়ে লোকমা তুলে হুরের মুখের সামনে ধরলো। হুরও লক্ষী মেয়ের মতো খেয়ে নিলো। এভাবেই একে অপরকে খাইয়ে দিয়ে খাওয়া দাওয়া শেষ করে রেস্টুরেন্ট থেকে বের হলো। ফুয়াদ ড্রাইভারকে বললো, চাচা আপনি চলে যান আমরা রিকশায় আসবো।
দুপরের রোদ পরে মাত্র বিকেল হতে শুরু করেছে। রিকশায় পাশাপাশি দু’জন হাতে হাত রেখে বসে আছে। ফুয়াদ বললো, আমি নাহিদের সাথে কথা বলবো। নাহিদ যা চায় তাই হবে।
– আমার মনে হয় নাহিদ ভাইয়া রাজী হলেও আদিয়া আপু রাজি হবে না।
– ওদের দু’জনের উপর ছেড়ে দেবো।
-হুম সেটাই ভালো।
______________________________________________
আদিয়া আর নাহিদ মুখোমুখি বসে আছে। দুজনেই ভেতর থেকে বিধস্ত। আদিয়ার চোখ থেকে নিরব অশ্রু গড়িয়ে পরছে।
নাহিদ অবাক হয়ে আদিয়ার দিকে তাকিয়ে আছে। যে মেয়ে সব সময় টপস, জিন্স আর টি-শার্ট পড়তো। সে আজ বোরকা হিজাব পরিহিত!
আদিয়া বলল,আমি জানি তুমি কি ভাবছো নাহিদ! তবে এখন এসব ভাবার সময় না। আমি এও জানি তোমার মনের অবস্থা ভালো না। এই মূহুর্তে এসব কথা বলা হয়তো আমার ঠিক হচ্ছে না। তবুও না বলে যেনো শান্তি পাচ্ছিলাম না।
– এভাবে কথা বলছো কেন আদু। আমি জানি আমি তোমার যোগ্য না। তাই তোমার কথা আমাকে কষ্ট দেবেনা। তুমি নির্দ্বিধায় বলতে পারো।
– শুনলাম যুক্তরাষ্ট্রে চলে যাচ্ছ? তা ফ্লাইট কবে?
– পরশু রাতে। কথাটা বলে, নাহিদ মনে, মনে আশাহত হলো। দীর্ঘ শ্বাস ছেড়ে বললো,জীবন বড়ই অদ্ভুত জানো তো!”আমরা তার কাছেই বারবার আশাকরি, যার কাছ থেকে আশাহত হই বারংবার”।
– নাহিদ আমি তোমার যোগ্য না। আমি নিকৃষ্ট। তুমি আমার চেয়ে ভালো কাউকে ডিজার্ভ করো।
– বাজে কথা রাখো আমি তোমার যোগ্য না।সেটা আমি জানি আমার পরিবার নেই, যে ছিলো সে কেমন ছিলে তুমি তো জানোই।
– নাহিদ আমি প্রেগন্যান্ট। এটা জানার পরে তুমি কি বলবে?
– চলে যাবে যাও তাই বলে নিজের চরিত্রে দাগ দিতে হবে না।
– নাহিদ আমি সত্যি কথা বলছি।
নাহিদ বোকার মতো তাকিয়ে রইলো আদিয়ার দিকে। তার চোখে ফুটে উঠেছে হাজার হাজার প্রশ্ন।
– আমি জানি তুমি ভাবছো আমি তোমাকে ঠকিয়েছি।তবে সত্যি কথা হলো আমি নিজেকে ঠকিয়েছি। আর সেই দায়ভার আমি কাউকে দেবো না।
আদিয়ার চেহারা দেখে নাহিদ বুঝে গেছে আদিয়ার কথাগুলো সত্য। নাহিদ কিছু বলবে তার আগেই আদিয়া বলে,তোমার কিছু বলতে হবেনা। আমার পাপের বোঝা আমি কাউকে বয়ে বেড়াতে দেবো না। ভালে থাকবে আর ভুলে যাবে আমার মতো কালো অতীতকে।
আদিয়া সামনে পা বাড়ালো নাহিদ তাচ্ছিল্য হেসে বলে,ভুলে যাওয়া কি এতোই সহজ!
– ভুলে যাওয়া কেবল শব্দ মাত্র আসলে তো ভুলা সহজ নয়। তবে চাইলেই আমরা চলমান জীবনের সাথে নিজেকে মানিয়ে নিতে পারি। এক জীবনে হয়তো সব চাওয়া পূর্ণতা পায়না। কিছু চাওয়া না হয় তোলা থাক।
– তুমি কি পিছু ফিরবে না।
– আমার পিছু ফেরার সাধ্য নেই। তাই সামনে এগোনোই শ্রেয়। জানি ক্ষমা করতে পারবে না। তবুও কিছু করার নেই নাহিদ। এ পাপের শাস্তি আমি বয়ে বেড়াতে চাই।
আদিয়া চলে গেলে। নাহিদ আসহায় দৃষ্টিতে তাকিয়ে রইলে। কিছু কিছু সময় হৃদয়ের সুপ্ত ভালোবাসা বড্ড অসহায় হয়ে পরে। দুঃখগুলো গলায় কাটার মত বিঁধে থাকে। না উগড়ে ফেলা যায়,না গিলে নেয়া যায়!
______________________________________________
সময়ের নৌকা বিরামহীন চলতে চলতে আজ ফুয়াদ আর হুরের বিয়ের পাঁচ বছর পার হয়ে গেলো। হুর জোহরের নামাজ শেষ করে মোনাজাত ধরলো।ফুয়াদ মসজিদ থেকে নামাজ পরে এসে হুরের কোলে মাথা রাখলো, হুর সুরা ফাতাহ তিলাওয়াত করছে.
**ফজিলত- হজরত রাসুলুল্লাহ (সা.) হজরত ওমর (রা.)-কে বলেন, ‘আজ রাতে আমার ওপর এমন একটি সুরা নাজিল হয়েছে, যা আমার কাছে সূর্যালোকিত সব স্থান থেকে উত্তম। এরপর তিনি সুরা ফাতহের প্রথম আয়াত তেলাওয়াত করেন।’ (সহিহ বুখারি, হাদিস : ৪১৭৭)**
তেলওয়াত শেষ হতেই ফুয়াদ হুরের ঠোঁটে আলতো করে ঠোঁট ছুঁয়ে বলে,বিবিজান চলেন-তো আজকে ঘুরে আসি।
– ফারাজ অসুস্থ আর তোমার ঘুরতে যেতে ইচ্ছে হলো! কোথাও যাওয়া হবেনা। বয়স হচ্ছে নাকি দিনদিন ইয়াং হচ্ছ?
– তোমার মত হুর পরি বউ সামনে থাকলে মনটা একদম একুশ বছরের যুবক হয়ে যায়।
– আপনার খেজুরে আলপ শেষ হলে আমাকে যেতেদিন আমাকে নাস্তা বানাতে হবে। আজ আদিয়া আপু আর নিয়াজ আসবে।
ফুয়াদ হুরকে কোলে তুলে নিয়ে বলে,এসব কি বিবিজান, আমি ছাড়া তোমার সবার খেয়াল থাকে। আর এই অসহায় স্বামীটাকেই পাত্তা দাও না। একটা সময় ছিলো যখন আমার অগোছালো জীবনে হুর পরি এসে এত্তো এত্তো ভালোবসা দিয়ে আমাকে আগলে রাখতো। আর এখন একটা বউ আছে যে কিনা তার হ্যাসবেন্ডের দিকে নজর দেয়না। বেচারার কত কষ্ট। হুর ফুয়াদের গলা দু’হাতে জড়িয়ে ধরে বলে,শেষ আপনার দুঃখ বিলাস! আমার হ্যাসবেন্ডকে
তার হুর পরি আগেও ভালোবাসতো এখনো বাসে। সময়ের সাথে সাথে শুধু হুর পরির দায়িত্ব বেড়েছে।হুর ফুয়াদের ঠোঁটে চুম দিয়ে বলে,ও ডাক্তার এবার আমাকে ছেড়ে দাও এতোদিন পর আদিয়া আপু আর তার ছেলেটা আজ বাড়ি ফিরবে তারজন্য আয়োজন করতে হবে তো?
ফুয়াদ হুরকে নামিয়ে দিয়ে জড়িয়ে ধরলো,হুরের কাঁধে মুখ গুঁজে বলে,তোমাকে কি বলে ধন্যবাদ দেবো আমার বিবিজান তুমি আমার #আধার_রাতের_আলো হয়ে আমার জীবন থেকে সব আঁধারকে দূর করে দিলে।
– এই চুপ থাকো তো আসছে ধন্যবাদ দিতে। তাহলে তো আমাকেও ধন্যবাদের পুকুর না না সমুদ্র তৈরি করতে হয় তোমার জন্য। তুমি শুধু আমার জীবনের আঁধারকে দূর করোনি। আমার পুরো পরিবারকে নতুন জীবন দিয়েছো।তাই আমাদের মধ্যে এসব ধন্যবাদের দরকার নেই। আমাদের মধ্যে ভালোবাসা আর সম্মান থেকে যাক শেষ নিশ্বাস পর্যন্ত।
– আমার বউটা এতো ভালো যে মাঝে মাঝে নিজেকে হিংসে হয়। আচ্ছা এতো ভালো কেন তুমি!
– তুমি ভালো তাই আমিও ভালো। হুর আর ফুয়াদের কথার মধ্যেই ছোট ফারাজ চোখ ডলতে ডলতে বলে আম্মু আমার বাবাই শুধু আমাকে কোলে নেবে।তুমি কেন বাবাইয়ের কোলে। ততক্ষণে ফুয়াদ হুরকে নিজের বাহু থেকে সরিয়ে দিয়েছে। ফুয়াদ ফারাজকে কোলে নিয়ে বলে,তোমার আম্মু ও আমার কাছে বাবু তাই মাঝে মাঝে একটু কোলে উঠে পরে।
তিন বছরের ফারাজ ঠোঁট উল্টে বলে,আমার বাবাইয়ের কোলে আমি ছাড়া কেউ উঠবে না। বাবাই শুধু আমার।
হুর বলে,আচ্ছা এই কথা তাহলে আমি ও তোমাকে কোলে নেবো না।
ফারাজ মূহুর্তেই কেঁদে দিয়ে বলে কোলে নাও আমাকে।
হুর মুচকি হেসে ফারাজকে কোলে নিলো। নুর এসে বলে, আমার আদর কই বাবাই?
তুমি তো আমার শাহজাদী তোমার আদর সবচেয়ে বেশি।
আলো বেগম চোখের চশমাটা মুছে আবার চোখে পড়ে নিলেন।
আদিয়া এবাড়িতে থাকে না। সে আলাদা থাকে। আজ আসবে ছোট নিয়াজকে নিয়ে।
গাড়ি মধ্যে বসে আছে আদিয়া এ বাড়িতে তার আসতে ইচ্ছে করে না। নাহিদের স্মৃতি যেনো তাকে কুড়ে কুড়ে খায়। নিয়াজ সারে চার বছরে পরেছে। নিয়াজের দিকে এক পলক তাকালো। নিয়াজ নামটা নাহিদের দেয়া। নাহিদ সব সময় বলতো ছেলে হলে নাম রাখবো নিয়াজ আর মেয়ে হলে আনাবিয়া। চোখের কোন ভিজে উঠলো আলতো হাতে চোখ মুছে নিলো।
বাড়িতে আসতেই সবার সাথে কথা বলল। নিয়াজ তো মহা খুশি। একটা ভুল সব কেড়ে নিলো আদিয়ার জীবন থেকে।
“আসলে জীবন বড়ই অদ্ভুত ভাবে রঙ বদলায়, কখন মেঘলা আকাশ তো কখনো ঝলমলে রোদ”।
কিন্তু আদিয়ার জীবন যেনো আন্ধকারে ছেঁয়ে গেছে।
হুর আদিয়ার পাশে বসলো।হুর কিছু বলার আগেই আদিয়া বলে,সখের পুরুষকে না পেলে আর কোন পুরুষকে পেতে ইচ্ছে করে না। আমি জানি তুমি কি বলবে!যদি চাও আর কিছুটা সময় এবাড়িতে থেকে যাই তাহলে সেসব বলো না। হুর আর কিছু বললো না।
দুপুরে খাওয়া দাওয়া করে বিকেলে চলে গেলো আদিয়া।
হুর রাতে সবার খাওয়া শেষ হতেই নিজের কাজ করতে লাগলো। ফুয়াদ ফারাজকে ঘুম পাড়িয়ে নিচে আসলো। কিচেনে যেয়ে দেখে হুর ওড়না কোমড়ে বেঁধে থালা বাসন ধুচ্ছে। ফুয়াদ হুরকে পেছন থেকে জড়িয়ে ধরে বলে,বিবিজান যদি আপনাকেই এসব কাজ করতে হয় তাহলে আমি এতো টাকা দিয়ে সার্ভেন্ট কেনো রেখেছি।
– নিজের সংসারে কাজ নিজে হাতে করলে সদকায়ে জারিয়ার সোয়াব হবে। আমার সোয়াব আমি নষ্ট করবো কেন!
ফুয়াদ হুরকে কোলে তুলে নিয়ে বলে,বিবিজান আপনি আমাকে ভালোবাসলেও সওয়াব পাবেন। তাই চলুন একটু ভালোবাসা দিবেন আপনার প্রিয়তম কে।
হুর লজ্জা পেয়ে ফুয়াদের মুখেই মুখ লুকালো। ফুয়াদ মৃদু কন্ঠে বলে বিবিজান মেয়েদের এই বিষয়টা আমার বড্ড আদুরে লাগে।লজ্জা পেয়ে স্বামীর বুকে মুখ লুকায়।হুর আর কিছু বললো না শুধু শক্ত করে জড়িয়ে ধরলো ফুয়াদের গলা। ধৈর্য ধরলে যে তার ফল মধুর হয় তার জলজ্যান্ত প্রমাণ হুর।
কুরআনে তো বলাই আছে, নিশ্চয়ই ধৈর্যশালীরদের সাথে আল্লাহ তায়ালা আছেন। (কুরআনের বানি)
সমাপ্ত