#আধারে_তুমি
#লেখিকাঃ মার্জিয়া রহমান হিমা
#পর্বঃ ৩৯
খাওয়া শেষ হতেই ইতি আর ইমনের আগমন ঘটে। দুজন একই সাথে এসেছে। সোহা দুজনকে বসিয়ে চলে গেলো এটো প্লেট রেখে আসতে। ইতি শানকে দেখে খুবই ভয় পেলো। কালকেই সুস্থ শরীরে তাদের ভার্সিটিতে নামিয়ে দিয়ে এসেছে আর আজই এই অবস্থা। ভাবা যা ? ক্ষণিক সময়ের মাঝেই কখন কার সাথে কি হয়ে যায় কেউ বলতে পারে না।
ইমন কোলে কুশন নিয়ে সোফায় আয়েশ করে বসলো তারপর দুষ্টু হাসি হেসে ঠাট্টার স্বরে বলে উঠলো
” আহহ ! তোর দেখছি এখন ভালোই আদর, ভালোবাসা কপালে জুটছে ! বউ নিজে খাইয়ে দিচ্ছে !”
শান ঠোঁট বাঁকিয়ে হেসে বললো
” শুধু খাইয়ে দিচ্ছে না আদরও দিচ্ছে। কতো রোম্যান্স করি আমরা। আমার বউ আমাকে কম ভালোবাসে নাকি ?” দুজনের কথাবার্তা শুনে ইতির হাসির সাথে লজ্জাও পেলো। ইতি মনে করলো দুই বন্ধুর মাঝে না থাকলে ভালো হবে। ইতি উঠে বাইরে যেতে যেতে বললো
” আমি সবার সাথে দেখা করে আসছি।”
ইতি চলে যেতেই ইমন কোলের কুশন টা শানের উপর ছুড়ে মারে। শান কোনো রকমে ধরে নেয় বা হাতে। ইমন রেগে বলে
” শা*লা একে তো বিয়ে করে আদর, ভালোবাসা দেওয়া নেওয়ায় করছিস আবার আমি জিজ্ঞেস করি, তোদের প্রেম কতদূর ? তখন বলিস এসব এখনও বলিসনি সোহাকে !” শান ভ্রু কুঁচকে বলে
” এসব না বল হলে কি আমরা রোম্যান্সও করতে পারবো না তোর জন্য ? তোর এতো হিংসে লাগলে নিজেও বিয়ে করে রোম্যান্স কর, প্রেম কর, ভালোবাস কে বাধা দিয়েছে তোকে ? তোর বউ ও তো রেডিই আছে। বিয়ে করে ফেল জলদি ! আর কতো একা একা থাকবি ? বিয়ের বয়স পেড়িয়ে গেলে সবাই তখন বুড়ো ডাকবে আর বউও হাতছাড়া হয়ে যাবে তখন হায় হায় করবি নাকি ?”
ইমন তীক্ষ্ম দৃষ্টিতে তাকিয়ে বললো
” তুই দেখি আজ কাল বড্ড রসকষে কথা বলিস ! বিয়ে করলে বুঝি এভাবেই চেঞ্জ হয়ে যায় ? আগে তো গম্ভীরতা ভাব ছাড়া চতুর কিনারায়ও অন্য কিছু দেখা যেতো না।” শান দীর্ঘনিশ্বাস ফেলে বললো
” আমি আগের মতোই আছি শুধু সোহার সামনে আমি রাগারাগি না করার চেষ্টা করি। এখন কেসের কথা বল। নতুন কি খবর আছে কেসের ?”
ইমন জায়গা থেকে উঠে এসে বিছানায় ধুপধাপ করে শুয়ে পড়লো। শান নাইসার দিকে একবার চোখ বুলিয়ে ইমনকে কুশন দিয়ে বাড়ি মারে। ইমন দাঁত কেলিয়ে বললো
” কেসের কোনো খবর নেই আপাতত। গ্যাংটার হুদিশ খুঁজে বের করার অপেক্ষায় রয়েছে সবাই। তারা কোনো গোপন জায়গায় ঘাপটি মেরে বসে আছে। পুলিশ ফোর্স তাদের কাজে লেগে রয়েছে।”
শান ভাবনায় মগ্ন হয়ে বললো
” বেশি দিন ঘাপটি মেরে থাকবে না। হয়তো তারা দেশের বাইরে পালিয়ে যাওয়ার প্ল্যান করছে কয়েকদিনের মধ্যেই ! তুই এক কাজ কর এয়ারপোর্ট সহ দেশের বাইরে যাবার যতো পথ রয়েছ্র সব বন্ধ করে দেওয়ার ব্যবস্থা কর। আর ওই গ্যাং এর আসল গুরুসহ অনেক লোকের স্কেচ রয়েছে আমাদের কাছে সেগুলোও প্রত্যেকের কাছে সেন্ড করে দিবি। কোনো মতেই যেনো তারা এখন দেশের বাইরে যেতে না পারে সেটার দায়িত্ব তোর উপর।” ইমন মাথা নেড়ে সায় দিলো। হঠাৎ উঠে বসে বললো
” কিরে! তোর হানিমুনটা দেখি এখনও করা হলো না ! কবে করবি ?” শান বিরক্তিকর চাহনি দিয়ে দাঁতে দাঁত চেপে বললো
” আমাকে এই অবস্থায় দেখেও তোর হানিমুনের কথা মনে পড়ে ? লাইক রিয়েলি ? তোর এতো মাথা ব্যাথা কেনো আমার হানিমুন নিয়ে সেটা বল।”
ইমন নিশ্বাস নিয়ে বললো
” ভাবছিলাম তুই হানিমুনে চলে গেলে আমি ঠাস করে ইতিকে বিয়ে করে তোদের সামনে গিয়ে চমকে দেবো।” শান প্রতিউত্তর দিলো না। ইমন অন্য বিষয় নিয়ে কথা বলতে থাকে।
কিছুক্ষণ পর সোহা আর শাহানাজ বেগম আসলো রুমে। আসতে আসতে ইমনের কিছু গালি শুনতে পেলো যেগুলো ইমন শানকে উদ্দেশ্য করে দিচ্ছিলো কোনো এক কারণে। সোহা আর শাহানাজ বেগম রুমে ঢুকতেই ইমন মুখ বন্ধ করে বোকার মতো হাসি দিলো।
সোহার হাতে ইমনের জন্য চা নাস্তা রয়েছে। সোহা মুচকি হাসি দিয়ে সোফার টি টেবিলে ট্রে টা রেখে ইমনের হাতে চা তুলে দেয়।
ইমন শাহানাজ বেগমের সাথে টুকটাক কথা বলতে থাকে। নিলা ইতির সাথে নিচে গল্প করছিলো কিছুক্ষণের মধ্যে ইতি এসে পরে আর শাহানাজ বেগম আরো কিছু কথা বলে চলে গেলো। গল্পগুজব করে ইমন আর ইতি সন্ধ্যার পর বাড়ির উদ্দেশ্যে রওনা দেয়।
সোহা ক্লান্ত হয়ে বিছানায় গা এলিয়ে দেয়। নাইসা কিছুক্ষণ আগে ঘুম থেকে উঠে দৌঁড়ে মায়ের কাছে চলে গিয়েছে। শান সোহাকে দেখে ধীর গলায় শুধালো
” শরীর খারাপ লাগছে ?” সোহা আলতো হেসে মাথা নেড়ে বললো
” নাহ একটু ক্লান্ত লাগছে। আপনার কিছু লাগলে বলবেন আমাকে।” শান বা হাতে ভর দিয়ে কিছুটা এগিয়ে আসলো সোহার দিকে। সোহার মাথায় হাত রেখে রাশভারী গলায় বললো
” তুমি ঘুমাও আমি মাথায় হাত বুলিয়ে দিচ্ছি।”
সোহা আলতো হেসে চোখ বন্ধ করে নেয়। শান সোহার মাথায় হাত বুলিয়ে দিতে থাকে। ক্লান্ত থাকায় কিছুক্ষণের মধ্যে ঘুমিয়ে গেলো সোহা।
রাতে বাড়ি ফিরেই ইশান শানের সাথে এসে দেখা করে গেলো। শানের মেডিসিনসহ সব প্রয়োজনীয় জিনিসও দিয়ে গেলো। মুসফিক চৌধুরীরও রাগে চোখমুখ শুকিয়ে রাখে কিন্তু ছেলেকে দেখতে আসে।
সকালের একদম হাড় কাপানো ঠান্ডায় কাঁপতে কাঁপতে সোহার ঘুম আলগা হয়ে আসে। সোহা আধোআধো চোখে তাকাতেই নিজেকে আবদ্ধ অবস্থায় দেখতে পেলো। সোহা ভ্রু কুঁচকে ভালোভাবে নিজের অবস্থান পর্যবেক্ষণ করে দেখে সে শানের বলিষ্ঠ বাঁধনে অবদ্ধ হয়ে রয়েছে শক্তপোক্ত ভাবেই। সোহা হতবুদ্ধি হয়ে গেলো নিজের অবস্থান দেখে। শান তো আগে এভাবে কখনো জড়িয়ে ধরেনি ! সোহা লজ্জায় কুঁকড়ে গেলো। সোহা নিজেকে শানের বাঁধন থেকে ছাড়িয়ে নেওয়ার চেষ্টা করে কিন্তু শান আরো শক্ত ভাবে সোহাকে চেপে ধরে। সোহার এবার মনে হলো দমবন্ধ হয়ে মরেই যাবে সে। একেতো শানের এহেন কাণ্ড তাকে হতবুদ্ধি করে দিয়েছে। শানের হঠাৎ হঠাৎ ছোঁয়া তার উপর হঠাৎ বিদ্যুৎ চমকানোর মতোই প্রভাব ফেলে। শানের বাঁধণে সোহার অন্যরকম লাগলে নিজেকে দ্রতু বাঁধন ছাড়া করে নিতে চাইছে সে। সোহা কোনো রকমে মাথা উঁচিয়ে ব্যালকনির দিকে দৃষ্টিপাত করে তারপর ঘড়ির দিকে করলো। সকাল ৬টা বাজে কিন্তু আকাশের অবস্থা দরুণ খারাপ। আকাশ অত্যন্ত কালো মেঘের সঙ্গে নিজেকে সাজিয়ে নিয়েছে আজ। শান ঠাণ্ডায় সোহাকে আরো চেপে ধরছে। সোহা কি করবে বুঝতে পারছে না। এদিকে চোখে ঘুমও নেই যে আরো ঘুমাবে। গতকাল সন্ধ্যার পর ঘুমিয়েছিলো আর উঠা হয়নি আর কেউ ডেকেও তুলেনি। সোহা নিজের উপরে থাকা শানের হাতটা সরিয়ে দিলে আবারও শান তা সোহার উপরে রাখে। সোহা আবারও সরিয়ে কোনোরকমে শানকে ছাড়িয়ে বাঁধন ছাড়া হলো।
বেড থেকে নেমেই শানকে ব্ল্যাংকেট দিয়ে ঢেকে এসি অফ করে দেয়। সোহা ফ্রেশ হয়ে কিছুক্ষণের মধ্যে বারান্দায় ছুটে এসে বসে।
আকাশে কালো মেঘ জমেছে প্রতিদিনের সকালের উত্তপ্ত রোদকে পুরোপুরিভাবে ঢেকে। গত অনেকদিনই বৃষ্টির দেখা পাওয়া যায়নি আজ মনে হচ্ছে বেশ ভালো করেই ঝড় বৃষ্টি হবে। সোহা উঁকি দিয়ে রুমের দিকে তাকালো কিন্তু এই নিমেষ আকাশের আধারের খেলায় রুমের কিছুই দেখা গেলো না। লাইট জ্বালাতে হবে পরে জ্বালাবে ভেবে সোহা আবারও বাইরের দিকে মনোযোগ দিলো। প্রচণ্ড পরিমাণ বাতাস হচ্ছে। বাতাসের শব্দ শুনে মনে হচ্ছে ঝড় হচ্ছে। সোহা বারান্দার আধখোলা থাই ক্লাস খুলে দিলো পুরোটা। এতোক্ষণ যেই পরিমাণ বাতাস আসছিলো তাতেই হাড় কাঁপছিল এখন পুরোপুরি খুলে দেওয়ায় হুরহুর করে বাতাস ঢুকতে থাকে মুক্ত ভাবে। সোহাকে উড়িয়ে নিয়ে যেতে পারবে তেমন গতি বাতাসের। সোহা আপনমনে হেসে চোখ বন্ধ করে কিছুক্ষণ বাতাস খেলো। কিছুক্ষণ পর মনে হলো এক কাপ কফি হলে মন্দ হয় না ! সোহা শানকে একবার দেখে নিয়ে নিচে ছুটে গেলো কফি বানানোর উদ্দেশ্যে। বাড়ির সবাই এখন ঘুমিয়ে রয়েছে যদিও ৭টা বাজতে চলছে ইতিমধ্যে উঠে যাওয়ার কথা সবার কিন্তু আজকের আবহাওয়াটা অন্যরকম ঘুমটা বেশিই হবে সবার।
কফি বানানো করে সোহা তার রুমে এসে পড়লো। আসার পথে স্টাডি রুম থেকে দুটো গল্পের বইও নিয়ে এসেছে। মুসফিক চৌধুরীর আবার বই পড়ার আগ্রহটা খুব বেশিই। তাই স্টাডি রুমে বই এর অভাব নেই বললেই চলে। নিলার থেকে শুনেছে যখনই কারো ভালো লাগে না সময় কাটে না তখনই যেকোনো বই এনে পড়তে বসে যায় সবাই। বাড়ির প্রত্যেকেরই নাকি স্বভাবটা রয়েছে যদিও ছেলেরা শুধুমাত্র ছুটির দিনেই বেশি সময় পায়।
বাতাসের সাথে তালমিলিয়ে এখন বৃষ্টি হচ্ছে প্রচুর। হুটহাট প্রচণ্ড শব্দে আকাশের বিদ্যুৎ চমকানো তো রয়েছেই। আকাশের বিদ্যুৎ চমকানোকে সোহা মারাত্মক ভয় পায় বলা যায়। সে কফির সাথে সাথে বই এর সাথে মেতে থাকলেও এই শব্দ শুনলেই কাঁদোকাঁদো হয়ে গুটিয়ে বসে থাকে। এভাবেই প্রায় অর্ধেকের বেশি বই পড়ে শেষ করলো। এখন আর আকাশের বিদ্যুৎ চমকানোর ঘনঘন শব্দটা সহ্য করতে পারলো না। ভয়ে বই নিয়ে রুমে চলে আসে।
শানের অপরপাশে গিয়ে চুপটি করে বসে রইলো। হঠাৎ হাতে টান অনুভব করতেই সোহা পাশ ফিরে তাকালো। শান ঘুম থেকে উঠে পড়েছে। শান সোহার হাত টেনে বললো
” একটু হেল্প করো তো !” সোহা দ্রুততার সঙ্গে শানের কাছে গেলো। শানকে উঠিয়ে বসাতেই শান সোহাকে টেনে নিজের কাছে আনলো আরো। সোহা জিজ্ঞেসু দৃষ্টিতে তাকাতেই শান ধ্যান মগ্ন স্বরে বললো
” এতো রোমেন্টিক একটা ওয়েদার এখন ! আর রোম্যান্স না করলে চলে বলো বউ !” সোহা সাথে সাথে লজ্জায় মাথা নুইয়ে নেয়। শান সোহার দুই কোমড়ে হাত রেখে সোহাকে ধীরেধীরে নিজের সাথে মিশিয়ে নেয়। সোহার খোলা চুলগুলোর সরিয়ে ঘাড়ে মুখ গুঁজে দিলো। সোহার সর্বাঙ্গ কেঁপে উঠে শানের উষ্ণ নিশ্বাস তার ঘাড়ে পড়তেই। সোহা আবেশে চোখ বন্ধ করে শানের পিঠের শার্ট খামছে ধরে এক হাতে। শান সোহার ঘাড়ে ছোট ছোট চুমু দিতে থাকে। ঘাড় থেকে ধীরে ধীরে তা উপরে উঠতে থাকে। ঠোঁটের কাছে এসেই শান থেমে গেলো। শানের নিশ্বাস সোহার নাকে মুখে আছড়ে পড়ছে। শান ঘোড় লাগা কণ্ঠে জিজ্ঞে করলো
” may i ?” সোহা লজ্জামাখা হাসি দিয়ে মাথা নামিয়ে নেয়। শান মুচকি হেসে সোহার থুঁতনি ধরে সোহার ওষ্ঠদ্বয়ের সাথে নিজের ওষ্ঠদ্বয় এক করে নেয়। সোহার কামিজ উঠিয়ে সোহার কোমড়ে হাত রাখলো। শানের শীতল হাতের ছোঁয়ায় সোহার নিশ্বাস ভারী হয়ে আসে আরো। সোহা চোখ বন্ধ করে শানের শার্ট খামছে ধরে। কিছুক্ষণ পর সোহাকে ওষ্ঠদ্বয় ছেড়ে দিয়ে আবারও সোহার ঘাড়ে মুখ গুঁজে দেয় শান। সোহা শুধু শানের ছোঁয়ায় ছটফট করছে।
বৃষ্টি থামার কোনো নাম গন্ধ নেই। আজকে সবাই ঘরেই জমপেশ আড্ডা জমিয়েছে। সকালের ব্রেকফাস্ট শেষ করে আড্ডা জমিয়েছে সবাই শানও চলে এসেছে। কতো আর ঘরে বসে থাকবে সে ? ইশান আজ ইম্পরট্যান্ট কোনো সার্জারি ছাড়া বাইরে যাচ্ছে না। মুসফিক চৌধুরীও আজ দুপুরের খাওয়া দাওয়া করে বিকেলে অফিসে যাবেন। নাইসা টমিকে নিয়ে খেলনা দিয়ে খেলছে মাঝে মাঝে সোহাও সঙ্গ দিচ্ছে । মেয়েরা গল্প করার মাঝে মাঝে তাদের রান্নার টুকিটাকি কাজও সেরে নিচ্ছে। এতোসবের মাঝে সবাই সোহা আর সামিরকে প্রচণ্ড মিস করছে বলা চলে। দুপুরের খাওয়া দাওয়াও আজ সেরকম হচ্ছে। কিছুক্ষণ ধরে সোহার কেমন কেমন লাগছে তবে কি হচ্ছে বুঝতে পারছে না।
.
.
চলবে……….
#আধারে_তুমি
#লেখিকাঃ মার্জিয়া রহমান হিমা
#পর্বঃ ৪০
কিছুক্ষণ ধরে সোহার কেমন কেমন লাগছে তবে কি হচ্ছে বুঝতে পারছে না। সালমার রুম থেকে তার ফোন আসার শব্দ শুনতে পেয়ে ছুটে যায়।
বাড়ি থেকে ফোন করেছে হয়তো। শাহানাজ বেগম সবার গল্পের মাঝে গরম গরম কিছু ভাজাপোড়া এনে দিয়ে যায় খাওয়ার জন্য। অন্যসময় প্রিয় হলেও এখন সোহা সেগুলোতে হাতও দিলো না। শুকনো গলায় ঢোক গিললো সোহা। শরীর খারাপ লাগছে তার রুমে গিয়ে রেস্ট নিতে চাইলো। শব্দ না করে উপরে চলে যেতে চাইলো। কিন্তু সিরি বেয়ে উপরে আসতেই দিন দুনিয়া ঘুরে যায়। মাথার সব ফাকা হয়ে মনে হয় সোহার। সোহার চোখের সামনের সব ডাবল ডাবল দেখে ধীরেধীরে ঝাপসা ভাবে দেখতে দেখতে অন্ধকার হয়ে যায়। সোহা মাথা ঘুতে পড়ে যাওয়ার আগেই সালমা ছুটে এসে সোহাকে ধরে নেয় আর সোহার ভর সব সালমার উপর পড়ে। সালমা কোনো রকমে সোহাকে নিয়ে নিচে বসেই গলা ছেড়ে ডাক দিয়ে বসে
” ইশান ভাই ! খালাম্মা ! ভাবি ! ও ভাবি ! শান ভাই ! তাড়াতাড়ি আসেন সোহা ভাবির কি হইছে দেইখা যান !”
সালমা গলা ছাড়া ডাক শুনে সবাই একে অপরের দিকে তাকিয়েই ছুটে যায় উপর। শানকে বসে থাকতে দেখে নিলা আর শাহানাজ বেগম এগিয়ে আসতেই শাহানাজ বেগম অস্থির গলায় বললো
” নিলা গিয়ে দেখো সোহার কি হলো ! আমি শানকে নিয়ে আসছি।” শান উঠে দাঁড়িয়ে অস্থির গলায় বললো
” মা আমি যেতে পারবো।” সবাই উপরে উঠে যায়। শান কোনোরকমে খুঁড়িয়ে খুঁড়িয়ে সোহার কাছে এসে দাঁড়ায়। ইশান সোহাকে দেখে কয়েকবার গালে হাত দিয়ে ডাকলেও কাজ হয় না। নিলাকে বললো
” পানি নিয়ে এসো !” নিলা পানি নিয়ে আনতে আনতে ইশান সোহাকে কোলে তুলে নেয়। শানের রুমে গিয়ে শুইয়ে দেয়। শান এসে অস্থির গলায় বললো
” ভাইয়া কি হয়েছে সোহার ?” ইশান শান্তনা দিয়ে বললো
” তেমন কিছু না অজ্ঞান হয়ে গিয়েছে। শরীর দুর্বল সোহার।” শাহানাজ বেগম রাগি স্বরে বললো
” হবে না শরীর দুর্বল ? গত পরশু রাত থেকে তো ভালো করে কিছুই খায়ানি। কালকেও সারাদিন কিছু খায়নি। কতো করে বললাম খেতে মেয়ের নাকি ভালো লাগছে না পরে খাবে। এমন করলে আর কি হবে ?” মুসফিক চৌধুরী রেগে বললো
” মেয়ের হাল দেখেছো ? এভাবে না খেয়ে আছে আগে বলোনি কেনো ? আর তোমরা কি জোড় করে খাওয়াতে পারো না ? ধমক দিয়ে, জোড় করে হলেও তো খাওয়ানো উচিত তোমাদের ! এমন খাপছাড়া ভাবে থাকলে তো কে মরছে কে বাঁচবে সেটারও খেয়াল নেবে না তোমরা।”
ইশান থামিয়ে বললো
” আচ্ছা বাবা, মা থামো তোমরা দুজন ! এভাবে ঝগড়া করে এখন লাভ নেই। তোমরা ঘরে যাও। সোহার জ্ঞান ফিরে আসবে।” মুসফিক চৌধুরী চৌধুরী শাহানাজ বেগমের দিকে গম্ভীর চাহনি দিয়ে চলে গেলো। শাহানাজ বেগম তাকে পাত্তা দিলো না। সোহার উপরই নিজের খেয়াল রাখে। শান গিয়ে সোহার উপর পাশে বসে। নিলা পানি নিয়ে আসতেই ইশান গ্লাসটা নিয়ে সোহার মুখে পানি ছিটিয়ে দিতে দিতে বললো
” এতো সময় লাগে পানি আনতে ?” নিলা উত্তর দিলো না। শান সোহার গালে হালকা চাপড় মেরে উৎকণ্ঠিত কন্ঠে ডাকতে শুরু করে
” সোহা ! এই সোহা ! সোহা…” শানের ডাকের মাঝে সোহা পিটপিট করে তাকালো। সবাই স্বস্তির নিশ্বাস ফেলে। সোহা ঘাড় ফিরিয়ে একবার শানের দিকে তাকালো। শানের চিন্তিত মুখশ্রীর মধ্যে এবার রাগের আভাস দেখা যায়। সোহা ঢোক গিলে চোখ ফিরিয়ে নেয়। ইশান রাগি গলায় বললো
” এভাবে কেউ না খেয়ে থাকে ? শানের চিন্তায় চিন্তায় না খেয়ে থেকে নিজে অসুস্থ হয়ে কি করে সেবা করবে শানের ? এখন থেকে খাওয়া দাওয়া করো নাহলে সবসময় স্যালাইন লাগিয়ে রাখা লাগবে। পড়ে জামাই বউ কেও কারো সেবা করতে পারবে না।” ইশান নিলাকে বললো
” সোহাকে একটু পর খাইয়ে দিও কিছু।”
নিলা আর ইশান চলে গেলে শাহানাজ বেগম সোহাকে পড়ে বকবে বলে বেরিয়ে গেলো।
সবাই চলে যেতেই শান রাগি গলায় বললো
” তুমি দুদিন ধরে খাওয়া দাওয়া বন্ধ করে বসে আছো আমার জন্য ? তোমাকে ইচ্ছে করছে ঠাস ঠাস করে দুটো থাপ্পড় দেই। তোমাকে আমি বলেছি ! এভাবে আমার সেবা যত্ন করতে ? তুমি ভাবিমনির সাথে খাবে বলে মিথ্যা বলেছিলে আমায় ! সাহস কতো বড় তোমার ?” শানের রাম ধোলাই ধমক শুনে সোহা ভয় পেয়ে যায়। সোহা উঠে বসে শানের থেকে কিছুটা দূড়ে বসে কাঁদোকাঁদো গলায় বললো
” আমি অসুস্থ আর আপনি এভাবে আমাকে বকছেন ?” শান ধমক দিয়ে বললো
” তো কি মাথায় তুলে নাচবো ? নিজ থেকে অসুস্থ হয়ে বসে আছো আর তোমাকে আমি বকবো না আদর করবো ভাবছো ?”
সোহা নাক ফুলিয়ে কাঁদো কাঁদো চাহনি দিয়ে তাকালো। শান অসহায় চাহনি দিয়ে খাটে হেলান দিয়ে বসলো। কিছুক্ষণের মধ্যে নিলা আসলো খাবার নিয়ে। সোহা মুখ কুঁচকে নিতেই নিলা কঠোর স্বরে বলে
” এখম যদি না খেয়েছো ! তাহলে তোমার ভাইয়া আর শানকে বলে রামক ধোলাই দেওয়াবো আর মা তো রেগেই আছে। নিচে গেলেই তোমাকে বকে দেবে।” সোহা মুখ লটকিয়ে ফেলে। শান তা দেখে গম্ভীর গলায় বললো
” ভাবিমনি ! ও যদি এখন না খায় আমাকে বলবে থাপ্পড় দিয়ে সোজা করে দেবো পরে নিজেও খাবে আর টমিকেও খাওয়াবে।” সোহা ক্ষুদ্ধ দৃষ্টিতে তাকালো। নিলা সোহাকে সোফায় বসে খাইয়ে দিতে থাকে। সোহা খেতে খেতে ব্যালকনির দিকে তাকিয়ে বললো
” আপু ! তোমার রুমের ব্যালকনিতে ফুল গাছ আছে ?” নিলা সায় দিয়ে বললো
” হুমম আছে তো। আমাদের সবার রুমেই দুচারটা করে ফুল গাছ রয়েছে তবে তোমার রুমেই একটু বেশি। কেনো বলো তো ?”
সোহা মুখে খাবার নিয়ে আড়চোখে শানের দিকে তাকিয়ে বললো
” বাবাকে বলবো ছাঁদের জন্য গাছ আনতে নার্সারি থেকে।” শান সব কথোপকথন শুনে গম্ভীর গলায় বললো
” আমি এক সপ্তাহ আগেই নার্সারিতে গিয়ে কথা বলে এসেছি। নতুন কিছু বিদেশি গাছের চারাসহ এই সপ্তাহের মাঝেই সব দিয়ে যাবে।” নিলা মিটমিট করে হেসে বললো
” বাহ ! আমাদের শানের দেখছি সব দিকেই খেয়াল থাকে ! সোহার মনের কথা বলার আগেই বুঝে গিয়েছে। এরকমই তো হওয়া উচিত।” শান প্রতিউত্তর না দিয়ে সোহার দিকে কটমট দৃষ্টিতে তাকালো। সোহা মিটমিট করে হাসলো। নিলা খাইয়ে চলে যেতেই সোহা বারান্দায় চলে গেলো। লোকটা যদি বকে আবার ! বলা তো যায় না। সোহা বারান্দার থাই গ্লাস খুলে দেয়। নিচে যাওয়ার আগে বৃষ্টি ভেতরে আসবে বলে লাগিয়ে গিয়েছিলো।
গ্লাসটা খুলতেই হুরমুর করে বাতাস ঢুকতে থাকে। দুপুর গড়িয়ে এসেছে কিন্তু আকাশের কালো ভাবটা সকালের মতোই হয়ে রয়েছে। যেনো কালো মেঘগুলো আজ আকাশে দিনের আলোর দেখা দিতেই দেবে না। বৃষ্টিরও কমছে না বরং বেড়ে চলছে আরো। কয়েকদিন কাঠ পোড়া রোদের জ্বালায় অতিষ্ঠ হয়ে উঠেছিলো সবাই। আজ বৃষ্টির সাথে এই ঠাণ্ডা আবহাওয়ায় ভালোই
আজকের দিনিটা।
সোহা রেলিং এর উপর বসতেই শানের শীতল হাত সোহার হাত ধরে আচমকা নিজের উপর টেনে ফেলে দেয়। সোহা অনেকটা ভয় পেয়েই শানের বুকের উপর শার্ট খামছে ধরে। সোহা নিশ্বাস নিয়ে শানের চোখের দিকে তাকালো। শান এক ভ্রু উঁচিয়ে গম্ভীর গলায় বললো
” আমাকে কি অক্ষম মনে করছো তুমি ? যদি ভেবে থাকো তাহলে খুবই ভুল করছো। এইটুকু হাত পা ভাঙাতেই আমি অক্ষম হয়ে যাবো না। এখনও আমার গায়ে তোমার থেকে শতগুণ বেশি শক্তি রয়েছে।” সোহা ফ্যালফ্যাল করে তাকিয়ে থাকে। হঠাৎ কি বলছে এসব ? ভাবনার মাঝেই শান সোহার কোমড় জড়িয়ে সোহাকে নিজের সাথে মিশিয়ে নিলো। সোহা কেঁপে উঠতেই শান বাকা হাসি দিয়ে বললো
” তোমাকে বকার জন্য বা ভালোবাসার জন্য আমি যেকোনো অবস্থাতেই তোমার কাছে পৌঁছতে পারি।” সোহা মুখ ফুলিয়ে নেয়। শান মুচকি হেসে সোহার গালে উষ্ণতার সাথে নিজের ঠোঁট বসিয়ে আবারও কপালে চুমু দিয়ে বললো
” চলো রেস্ট করবে। বৃষ্টি পরেও দেখতে পারবে।”
সোহা কথা না বাড়িয়ে শানকে নিয়ে রুমে চলে গেলো। শানকে বসিয়ে শুইয়ে দিতেই শান সোহার হাত ধরে টেনে শুইয়ে দেয়। সোহা শুতেই আবার উঠে বসে বললো
” আমি টমিকে নিয়ে আসছি আপনি ঘুমান।” শান সোহার হাত ধরে আটকে বললো
” তোমার টমি নাইসার সাথে খেলছে। কেনো দুজনকে গিয়ে জ্বালানোর মতলব করছো বলো তো ! তার সাথে আমাকেও।”
টমিকে নিয়ে কথা শুনে সোহা অসন্তুষ্ট হলো। মুখ ফুলিয়ে নেয় আবারও। মুখ ঘুরিয়ে উল্টো দিকে শুয়ে থাকে। শান সোহাকে টেনে মজা করে বললো
” আরে কথায় কথায় মুখ ফুলিয়ে রাখো কেনো ? এমন করলে তো বিয়েই হবে না তোমার।” সোহা ফট করে ঘুরে চমকে বললো
” কতোবাদ বিয়ে হবে আমার ? একবার তো হলোই !” শান অবাক হওয়ার ভান করে বললো
” ওমা জানো না তুমি ? তোমার তো দুবার বিয়ে হবে।” সোহা বোকার মতো তাকিয়ে থাকে।
শান ফিক করে হেসে বললো
” বোকা মেয়ে ! মজা করেছি। দুবার বিয়ে হতে হলে আমাকে মরতে হবে। আমি না মরলে তুমি কোনোদিন আমার থেকে দূড়ে যেতে পারবে না। দুঃখ, কষ্ট, যন্ত্রণা যাই পাওনা কেনো তোমাকে তো বাকিটা জীবন আমার সাথেই কাটাতে হবে। আমার #আধারে_তুমি হয়ে থাকবে।”
মরা কথাটা শুনে সোহার বুকে তীর লাগার মতো ছেত করে উঠে। সোহা শানের হাত জড়িয়ে মায়ার দৃষ্টিতে তাকালো। শান সোহার এমন চাহনির কারণ বুঝে উঠতে না পেরে বললো
” কিছু বলবে ?” সোহা মথা নেড়ে না করে চোখ বন্ধ করে নেয়।
চোখের পলকে দুটো সপ্তাহ পেড়িয়ে যায়। এর মাঝে পরিবার আর সোহার সেবা যত্নে শান সুস্থ হয়ে থানায় জয়েনও করে নিয়েছে। শানের অসুস্থতার সময় সোহার মা,বাবা এসে দেখে গিয়েছিলো। সিমি আর সামিরও এসে পরেছে বাড়িতে। সোহা নিয়মিত ভার্সিটিতে গেলেও ইতি কিছুটা ভয়েই বলা চলে। কখন সিনিয়র দের খপ্পরে পরে যায় ঠিক নেই। এখনও পর্যন্ত তাদের ত্রিসীমানার চোখে পরেনি দুজন।
.
.
চলবে……….