আধারে তুমি পর্ব-৩৭+৩৮

0
1010

#আধারে_তুমি
#লেখিকাঃ মার্জিয়া রহমান হিমা
#পর্বঃ ৩৭

শান আহত আর ভালো হাত দিয়ে সোহার কানের উপর হাত রেখে সোহার কপালে ঠোঁট ছুঁয়ে আশ্বস্ত করে বললো
” আল্লাহ তায়ালা সাথে থাকলে কিছু হবে না আমার। চিন্তা করো না তুমি। তুমি তো আছোই আমার সাথে। তোমাকে আমি আগলে রাখবো আমার আর কোনো ভয় নেই।” সোহা অশ্রুসিক্ত নয়নে তাকিয়ে থাকে শানের দিকে। শান ভ্রু নাচিয়ে বললো
” ব্যাপার কি বলো তো ! আমাকে ভালো টালো বেসে ফেলেছো নাকি ? এভাবে কেঁদে কেঁদে ভাসাচ্ছো কেনো তুমি ?” শানের কথা চরম পর্যায়ে চমকে উঠলো সোহা। চমকিত দৃষ্টিতে শানের দিকে তাকিয়ে অস্ফুট স্বরে উচ্চারণ করলো
” ভালোবাসা !” শান ভ্রু কুঁচকে বললো
” হ্যা ভালোবাসা। শব্দটা প্রথম শুনছো মনে হচ্ছে !” সোহা ঘন ঘন মাথা নেড়ে না বোঝালো এবং বললো
” কি বলেন আপনি ! শুধু কি ভালোবাসলেই মানুষ কাঁদে ! আপনার অবস্থা দেখে আমার অনেক কষ্ট লাগছে তাই কাঁদছি।” শান ঠোঁট চেপে আলতো হাসলো। হা করতেই সোহা শানের মুখে খাবার তুলে দেয়।
খাওয়া শেষ করে সোহা সব কিছু নিচে রেখে আসে। সোহা বিছানা ঠিক করে শানকে মেডিসিন দেয়। ডক্টরের দেওয়া মেডিসিন ড্রাইভার যাওয়ার আগে সব দিয়ে গিয়েছিলো। টমি সেই তখন থেকে শুধু শানের দিকে তাকিয়ে আছে। বেচেরারও বড্ড মায়া হচ্ছে শানের জন্য কিন্তু আজ কথা বলতে পারে না বলে হয়তো কিছু বলতে পারছে না। কিন্তু তার চোখ দেখে শানের মায়া হলো আজ কিছু বললো না টমিকে। টমি শানের গা ঘেঁষে বসতে গিয়েও কিছুটা দূরত্ব রাখে। সোহা টমিকে উদ্দেশ্যে করে বললো
” টমি ! ঘুমিয়ে পড় গিয়ে অনেক রাত হয়েছে।” টমি সোহার কথা শুনলো না বসেই রইলো ঘাপটি মেরে। সোহা আরেকবার বললে গিয়ে ঝুড়িতে শুয়ে থাকে। শান সোহার কাধে ভর দিয়ে উঠে দাঁড়ায়। শানের ছোঁয়া প্রচণ্ড পরিমাণ কাপিয়ে সোহাকে। সোহা কোনো রকমে শানকে বিছানায় শুয়ে দেয়। শানের পায়ের নিয়ে একটা বালিশও দিয়ে দেয়। সোহা লাইট অফ করে শানের থেকে অনেকটা দুরত্ব বজায় রেখে শুয়ে পরে। শান সোহার দুরত্ব বুঝতে পেরে বিরক্ত হয়ে বলল
” তুমি কি পরনারী ? এতো দূড়ে দূড়ে থাকো কেনো তুমি ?” সোহা অসহায় স্বরে বললো
” আরে আজকে যদি আমার হাত পা লেগে ব্যাথা পান আপনি ! তাই তো দূড়ে শুয়েছি।” শান কঠোরতার সাথে বললো
” চুপচাপ কাছে এসো। তোমার থেকে ব্যাথা পাবো কেনো আমি ? আর যদি ব্যাথাও পাই না ! তাহলে সেটাও আমার জন্যে আনন্দের বিষয়। জলদি, অতিদ্রুত নিজের স্থানে এসো।” সোহা হাসফাস করে ভয় নিয়ে কিছুটা এগিয়ে আসতে আসতে বললো
” ব্যাথা দিলে কেউ আনন্দ পায় প্রথম শুনলাম।”
শান ফিচলে হেসে বললো
” ওসব তুমি বুঝবে না।” সোহা উত্তরে বললো
” কেনো বুঝবো না? আমি কি বাচ্চা ?” শান শান্ত কন্ঠে বললো
” এসব বোঝার জন্য কিছু বিশেষ অমূল্য জিনিসের প্রয়োজন। যেদিন সেই অমূল্য জিনিসটা বুঝতে পারবে সেদিন তুমি আমাকে বোঝাতে চাইবে তোমার অমূল্য সম্পদের গুরুত্ব।”
অন্ধকারে আচ্ছন্ন ঘরটাতে শানের কথাগুলো শুনে সোহা ভাবনায় পরে গেলো। কি সেই অমূল্য জিনিস ! অবুঝ ভাবনায় সেই অমূল্য জিনিসটা কে ধারণা করা ধরা ছোঁয়ার বাইরে হয়তো।
নিরবতার মাঝে কেটে গেলো কিছুক্ষণ সময়। শানের ছটফট অনুভব করলো সোহার। সোহা কিছুটা ভয় পেয়েই ল্যাম্প লাইট অন করে শানের দিকে তাকালো। শান হাতে পায়ে ব্যাথা নিয়েই এদিক ওদিক করছে বারবার। সোহা কিছুটা অস্থির হয়ে বললো
” আপনার কি বেশি ব্যাথা করছে? মা, বাবাকে ডেকে আনবো?” শান উঠে না বসেই সোহাকে আরো কাছে টেনে আনে। সোহার হাতটা নিজের মাথার উপর রেখে অস্থির গলায় বললো
” ডাকতে হবে না। মাথা ব্যাথা করছে টিপে দাও তো।” সোহা সুন্দর করে বসে কোলে শানের মাথা নিয়ে শানের মাথায় মালিশ করে দিয়ে থাকে সাথে চুলও টেনে দেয়। শান আখি জোড়া বন্ধ রেখেই মিহি হেসে বললো
” তুমি যে এতো ভালো করে মাথা টিপে দিতে পারো জানতাম না তো।” সোহা মুখ টিপে হেসে বললো
” এসব কি জানার কথা ? এক্সিডেন্ট করে পাগল হয়ে গিয়েছেন দেখছি !” শান উত্তরে শুধু হাসলো
সোহা মাথা টিপে দিতে দিতে শান কোলেই ঘুমিয়ে পড়লো। সোহার আর শানের মুখ দেখে শানকে সরাতে ইচ্ছে হলো না। শানকে কোলে রেখেই পেছনে পালিশ রেখে বালিশে হেলান দিয়ে চোখ বন্ধ করে নিলো সোহা।

সকালে ঘুম ভাঙতেই শান নিজের অবস্থান বোঝার চেষ্টা করে দেখলো সে এখনও রাতে থাকা অবস্থাতেই রয়েছে। শান অবাক হয়ে উঠে বসলো। সোহা বালিশে হেলান দিয়ে এখনও ঘুমিয়ে রয়েছে। শানের হাতে ব্যাথা থাকায় ইচ্ছে থাকলেও সোহাকে ঠিক করে শুয়ে দিতে পারলো না। ঘাড় ঘুরিয়ে ঘড়ির দিকে তাকিয়ে দেখে ৯ টা বাজে। শান সোহাকে না ডেকেই কষ্ট করে ওয়াসরুমে গেলো। এরমাঝে দজায় কড়া নড়ে উঠে কিন্তু সোহার কান অবধি পৌঁছায়নি তা। অনেক্ষণ পর শান ফ্রেশ হয়ে বের হলো আবারও দরজায় নক হতেই শান দরজা খুলে দেয়। দরজা খুলতেই শাহানাজ বেগমকে দেখতে পেয়ে চোখ বড়বড় করে নেয় শান। শাহানাজ বেগম ছেলের এমন অবস্থা দেখে হতবাক হয়ে কিছুক্ষণ চেয়ে থেকে জোড়ে জোড়ে চিৎকার করে উঠে। শাহানাজ বেগমের চিৎকার শুনে সোহা ঘুম থেকে ধড়ফড়িয়ে উঠে বসে। দ্রুত উঠে শানের কাছে গিয়ে দাঁড়িয়ে বললো
” কি হয়েছে ? আপনি উঠেছেন কেনো?” শান ইশারায় শাহানাজ বেগমকে দেখাতেই সোহার তার দিকে খেয়াল হলো। শাহানাজ বেগম কেঁদে দিলো ছেলেকে দেখে। সোহা শাহানাজ বেগমকে শান্তনা দিয়ে বললো
” মামনি কেঁদো না দেখো আল্লাহর রহমতে উনি ঠিক আছে।” শাহানাজ বেগমের মন তাও শান্ত হলো না। শানকে সযত্নে বিছানায় বসিয়ে কাঁদতে থাকে আর দেখতে থাকে কোথায় ব্যাথা পেয়েছে। সোহা ফ্রেশ হতে চলে গেলো। ইতিমধ্যে শাহানাজ বেগমের চিৎকারে সবাই ছুটে এসেছে। শানের এমন অবস্থা দেখে সবার প্রাণ যায় যায়। শানের বাবাও অস্থির হয়ে উঠে। নাইসা তো দেখেই কেঁদে দিয়েছে। তার শান ব্যাথা পেয়েছে !
শান সবার অবস্থা দেখে শান্তনা দেওয়ার চেষ্টা করে বললো
” আরে তোমরা এভাবে কান্নাকাটি করলে কি করে হবে ? আমি ঠিকাছি তো দেখো ! জাস্ট হাতে আর পায়ে লেগেছে।” মুসফিক চৌধুরী বড়সড় ধমক দিয়ে বসলো
” বেশি বড় হয়ে গিয়েছো তুমি ? আমাদের শান্তনা বানী শোনাচ্ছো তুমি ! কোথায় কি লেগেছে আমরা ভালো করেই দেখতে পারছি। এমন অবস্থা হলো কি করে সেটা বলো আগে !”
শান ধমক খেয়ে মুখ কালো করে নেয়। কালকের ঘটনা সব খুলে বললো। সব শুনে শাহানাজ বেগম কাঁদতে কাঁদতে বললো
” ওদের ধরতে গিয়ে নিজের কি হাল করলি দেখ তুই !” শান নিজেকে শান্ত রেখে বললো
” মা ঠিকাছি আমি !” ইশান শানের হাত, পা টেনে দেখে ব্যান্ডেজ কিছুটা রক্তাক্ত হয়ে গিয়েছে আবার ব্যান্ডেজ করতে হবে। নিলা বুঝতে পেরে রুমে চলে গেলো ফার্স্টএইড বক্স আনতে গেলো। সোহা ফ্রেশ হয়ে বের হলো ওয়াসরুম থেকে। সোহাকে দেখেই মুসফিক চৌধুরী সোহার মাথায় হাত বুলিয়ে বললো
” রাতে ডাকলি না কেনো আমাদের ? তোর কষ্ট হয়েছে না !” সোহা ভ্রু কুঁচকে বললো
” কি বলো বাবা ! আমি কি এইটুকু করতে পারিনা উনার জন্য ! আর আমি তো কিছুই করিনি শুধু খাবারটাই গরম করেছি।” শান মুচকি হাসলো সোহার কথায়। নিলা ফার্স্টএইড বক্স আনতেই ইশান শানের ব্যান্ডেজ খুলে পুনরায় যত্নে করে দিতে থাকে। সোহা শানের আঘাত দেখেই ভয় পেয়ে জামা খামছে ধরে তার। ঢোক গিলে নিলার সাথে বেড়িয়ে গেলো রুম থেকে। শাহানাজ বেগম এসে সোহাকে বললো
” সোহা ভার্সিটির টাইম হয়ে গিয়েছে তোর। তুই যা আমরা তো আছিই।” সোহা অবাক হয়ে বললো
” কি বলছো মামনি ? আমি উনাকে এই অবস্থায় রেখে চলে যাবো ! পাগল হয়ে গিয়েছো ? তোমরা থাকলেও আমি ভার্সিটিরে গিয়েও শান্তি পাবো না। কালকে এক্সিডেন্ট করো আর আজই আমি ভার্সিটিতে চলে যাবো ?” শাহানাজ বেগম কয়েকবার বোঝালেও সোহা শুনলো না। শাহানাজ বেগম হাল ছেড়ে দেয়। সোহা ইতিকে ফোন করে জানিয়ে দেয় শানের কথা আর যেতে পারবে না সেটাও জানিয়ে দেয়। দুপুরটা রেস্টের মাঝে গেলো শানের। দুপুর পেরোতেই থানা থেকে ইমনের ফোন আসে।

.

.

চলবে……..

#আধারে_তুমি
#লেখিকাঃ মার্জিয়া রহমান হিমা
#পর্বঃ ৩৮

দুপুর পেরোতেই থানা থেকে ইমনের ফোন আসে।
শানের শরীরের খোঁজ খবর নিয়ে ইমন অনেকটা আনন্দিত গলায় বললো
” পুলিশ ডিপার্টমেন্টের সবাই তো তোর এক্সিডেন্ট এর কথা জানে। ডিপার্টমেন্ট থেকে তুই পুরোপুরি ভাবে সুস্থ না হওয়া পর্যন্ত তোর ছুটি দিয়ে দিয়েছে।” শান কিছুটা অবাক হয়ে বললো
” আমি তো ছুটি চাইনি ! তাহলে ছুটি দিলো কেনো ? আর আমি দু একদিনের মাঝেই সুস্থ হয়ে থানায় জয়েন করবো। আমি যতো তাড়াতাড়ি সম্ভব এই গ্যাং কে হাতেনাতে ধরে উচিত শিক্ষা দেবো আর আমি কুইজ এই কেসটা ক্লোস করতে চাই। এক্সিডেন্ট করায় বাড়ির সবাই অস্থির হয়ে আছে আর ঘটনা শোনার পর থেকে তো বলে যাচ্ছে ওদের কেস ক্লোস করে দিতে কিন্তু আমি পারবো। যখন একবার এই কেস হাতে তুলে নিয়েছি এর শেষ দেখেই ছারবো।” ইমন বিরক্তির শব্দ উচ্চারণ করে ক্ষেপে বলে উঠলো
” শা*লা তুই জোর করে নিজেকে দুই একদিনের মাঝে ঠিক করে তুলবি ? ডক্টর কি বলেছে তুই শুনিস নি ? এক সপ্তাহ তো তোর পা নিয়ে বেড থেকেই নামা যাবে না তারপর যদি ঠিক হয় ! আর তুই এসব বলছি ? তোকে তো আমার অজস্র ভাষায় গালি দেওয়ার ইচ্ছে করছে তবে থানায় সবার সামনে আছি দেখে দিলাম না। শোন, শান ! ডিপার্টমেন্ট থেকে আসা ছুটির ইমেল তোকে পাঠিয়ে দিচ্ছি আর বিকালে আসছি আমি। তোকে দেখতে আসবো আর মন ভরে গালি দেবো, তৈরি থাকিস।” ইমন খট করে ফোন কেটে দিলো। শান ভাবলেশহীন ভাবে ফোনটা বিছানার একপাশে রাখলো। পাশে চোখ দেরাতেই সোহাকে কোমড়ে হাত দিয়ে দাঁড়িয়ে থাকতে দেখে কিছুটা চমকে গেলো। সোহা কখন এসে দাঁড়ালো ? ভাবতে ভাবতেই সোহা শানের সামনে বসে গম্ভীর গলায় বলে
” আপনি দু এক দিনের মাঝে সুস্থ হয়ে থানায় জয়েন করবেন ? তা কিভাবে সুস্থ হবেন ? ম্যাজিক ট্যাজিক জানেন নাকি ?” শান অবাক হয়ে গেলো সোহার গম্ভীর গম্ভীর ভাব দেখে। সোহাকে ভালো করে পর্যবেক্ষণ করে শানের মনে হলো সোহার নিজের সাথে গম্ভীর ভাবটা ধরে রাখাটা বড্ড কঠিন হয়ে পড়ছে। যেকোনো সময় আসল রূপটা বেড়িয়ে আসবে তার। হঠাৎই শান হা হা করে হেসে উঠে। সোহা ভ্যাবাচ্যাকা খেয়ে চেয়ে থাকে। হঠাৎ শানের এমন হাসির কারণ বুঝতে পারলো না সোহা। কোনো হাসির কথা কি বলেছে সে ? কই নাতো মনে করতে পারলো না। সোহা জিজ্ঞেসু দৃষ্টিতে তাকিয়ে অবুঝ স্বরে বললো
” এভাবে পাগলের মতো হাসছেন কেনো ? হাস খেয়েছেন নাকি ?” শান হাসতে হাসতে সোজা হয়ে বসে সোহার গাল টিপে বললো
” ওহো ! সোহারানী তুমি এতো কিউট কেনো বলো তো ? শোনো তোমার সাথে না ! রাগ স্বভাবটা খুবই বেমানান লাগে। এই যে এখন গম্ভীর গম্ভীর ভাব নিয়ে ছিলে ! মনে হচ্ছিলো তুমি অভিনয় করছো আর সেই অভিনয়টা খুবই নিকৃষ্ট হচ্ছে। সোহা কে তো হাসি, খুশি, বাদর স্বভাবের সাথেই মানায়।” সোহা মুখ ফুলিয়ে নিলো শানের এমন কথায়। সোহা আবারও রাগ নিয়ে বললো
” আপনি কথা ঘোরালেন কেনো ?” শান হেসে বললো
” নাহ ঘুরাইনি তো ! সোজাই আছে কথা। আমি তো ভেবেছিলাম আমার বউ এর সেবায় দু একদিনে সুস্থ হয়ে যাবো।” শানের এই প্রথম ‘বউ’ বলে সম্মোধন করাটা সোহার গায়ে আলাদা কম্পন সৃষ্টি করে তুললো আজ। সোহা বিছানার চাদর খামছে ধরে শানের দিকে দৃষ্টি পাত করলো। শান হাসি মুখে তাকিয়ে রয়েছে। ছেলেটা আগে সবসময় তার সাথে গম্ভীর ভাবে, রাগ নিয়ে বা দাম্ভিকতা নিয়ে কথা বলতো আর এখন যেনো তার সাথে কথা বলতে গেলেই আগে মুখে হাসির মুক্ত ঝড়ে। সোহার ফ্যালফ্যাল করে চেয়ে থাকা দেখে শান আলতো করে হাত বা হাত সোহার হাতের উপর রাখলো। সোহা চমকিত হয়ে পূর্ণ হুশে শানের দিকে তাকিয়ে বললো
” কিছু বলবেন ?” শান সোহার হাতটা টেনে নেয় নিজের দিকে। সোহা ভ্রু কুঁচকে হাত টানায় নিজেও কিছুটা এগিয়ে বসে। শান সোহার কাধে হাত রেখে বাকা হেসে বললো
” একটু রোম্যান্স করবো বউ এর সাথে।” সোহা চোখ বড়বড় করে তাকালো। মনে হলো বাক্যটা তার কাছে নতুন ! সোহা চোখ ফাটিয়ে ফুঁসে বলে উঠলো
” কি সব বলেন আপনি ? লাজলজ্জা নেই ?”
শান বাকা হেসে বললো
” বউ সাথে আবার লাজলজ্জা কিসের বলো তো ! আমার মতো ছেলে খুঁজে পাবে তুমি? অন্য ছেলে হলে বাসর রাতেই বাসর হয়ে যেতো কিন্তু আমি তো এখনও পর্যন্ত একটা কিসও করলাম না মন ভরে ! আর কতো লাজলজ্জা পাবো তুমিই বলো ! এবার অন্তত একটু একটু করে ভালোবাসো ! আমারও তো বউ কে আদর করতে ইচ্ছে করে তাই না !” শানের ঠোঁট কাটা কথাবার্তা শুনে সোহা লজ্জায় নুইয়ে যায়। শান ঠোঁট কামড়ে সোহাকে দেখে যাচ্ছে। সোহার লজ্জায় নুইয়ে যাওয়া দেখে এবার শানের সত্যিই সোহার সাথে রোম্যান্স করার ইচ্ছে জাগলো। শান সোহার কোমড়ে তার বা হাত রেখে সোহাকে নিজের কাছে নিয়ে আসলো। সোহা কম্পিত স্বরে বললো
” ককি ক…রছেন কি ! আ..পনি অসুস্থ …”
শান ঘোড় লাগা গলায় ফিসফিস করে বললো
” অসুস্থ হলে বেশি করে বউ এর আদর নিতে হয় এতো তাড়াতাড়ি সুস্থ হয়ে যাবো। বোকা বউ আমার !” সোহা বড়বড় শ্বাস নিয়ে নিজেকে ঠিক রাখার চেষ্টা করে। শান সোহার ঠোঁটের কাছে মুখ নিতেই কোথা থেকে দৌড়ে এসে নাইসা দরজা ঠেলে ঢুকে পড়লো। শান আর সোহা চমকিত হয়ে দুজন ছিটকে পড়ে। নাইসা দৌঁড়ে এসে সোহা আর শানের মাঝে বসে খুশি খুশি গলায় শুধালো
” কি করো মিষ্টিপাখি আর শান ?” শান হতাশা ভরা গলায় বিরবির করে বললো
” করছিলাম তো রোম্যান্স কিন্তু তোমাকে কি এখনই আসতে হলো বাবাই ? একটু আদর করতে যাচ্ছিলাম বউ কে !” সোহার শানকে দেখে পেট ফেটে হাসি আসলো কিন্তু সোহা হাসলো না। ঠোঁট চেপে হাসতে থাকে। নাইসা শানের ব্যাথা পাওয়া হাতের উপর তার ছোট হাত বুলিয়ে ঠোঁট ফুলিয়ে কাঁদো কাঁদো গলায় বললো
” শান ব্যাথা পেয়েছো ?” শান আহত দৃষ্টিতে সোহার দিকে তাকালো। সোহা বুঝতে পেরে নাইসাকে কোলে তুলে নেয়। আদুরে গলায় বললো
” নাইসু পাখি কাঁদো কেনো ? তোমার শান বাবাই একটুখানি ব্যাথা পেয়েছে ঠিক হয়ে যাবে। তুমি কাঁদলে বাবাজ আরো ব্যাথা পাবে।” নাইসা কি বুঝলো কে জানে ! তবে সোহার কথায় মাথা নাড়ালো। নাইসা শানকে বললো তার সাথে বসে বসে এখন কার্টুন দেখবে। সোহা নাইসাকে শানের পাশে বসিয়ে টিভি অন করে কার্টুন চ্যানেল বের করে দিলো। নাইসা শানের গা ঘেঁষে শুয়ে শুয়ে টিভি দেখতে থাকে। শানও নাইসার সাথে গল্প করতে থাকে। সোহা নিচে চলে গেলো শানের জন্য খাবার আনতে। শান এখনও খায়নি তাই শাহানাজ বেগম শানের পছন্দ খাবার রান্না করতে ব্যস্ত। মুসফিক চৌধুরী রাগ ছেলেকে দেখে অশান্ত মন নিয়ে অফিসে চলে গিয়েছে। ইশান ব্যান্ডেজ করার পর খুঁটিয়ে খুঁটিয়ে শানকে দেখে গিয়েছে। অন্য কোথায় ব্যাথা আছে কিনা ! তাহলে সব মেডিসিন নিয়ে আসবে হসপিটাল থেকে আসার পথে। নিলা আর সালমা শাহানাজ বেগমের রান্নায় সাহায্য করে দিচ্ছে। কাটাকুটি করে এগিয়ে দিচ্ছে সব। সোহা শাহানাজ বেগমের কাছে গিয়ে দাঁড়ায় শাহানাজ বেগম চুলায় জ্বলন্ত বিরিয়ানির পাতিলটা ঢাকনায় ঢেকে দিলো। রান্না প্রায় শেষ প্রান্তে ওড়না দিয়ে কপালের ঘাম মুছে বললো
” তুই এখানে কি করছিস ? যা লিভিংরুমে গিয়ে বস।” সোহা বিরক্ত হয়ে বলে
” মামনি ভালো লাগে না আমার সব সময় বসে থাকতে ! তোমরা আমায় বেশি ভালোবাসো বুঝলাম তাই বলে আমায় সব কিছু থেকে দূড়ে রাখবে তোমরা ? আমাকে দেখে কেউ বলবে আমার বিয়ে হয়েছে ? আমার কতো ক্লাসমেট দের থেকে শুনতাম তারা বিয়ের পর দু দণ্ড বসার সময় পেতো না আর আমি কিনা সারাদিন বসেই কাটাই। আমার ভালো লাগে না এভাবে বসে থাকতে। আমি সবার সাথে মিলেমিশে কাজ করতে চাই। এভাবে আমাকে বসিয়ে রাখো আমার নিজেকে অসুস্থ ব্যক্তি মনে হয় !” সোহার অভিযোগ শুনে শাহানাজ বেগম, নিলা আর সালমা একে অপরের দিকে চাওয়া চাওয়ি করে। সোহা মুখ কালো করে দাঁড়িয়ে আছে। বাবার বাড়িতে কাজ করতে দেয়নি শশুড় বাড়ি এসে করতে হবে ভেবে এখন শশুড় বাড়িরও কেউ কাজ করতে দেয় না। কাজ বিহীন জীবনক্টা অতিষ্ঠ মনে হলো সোহার কাছে। শাহানাজ বেগম শান্ত গলায় বললো
” এখন তোর পড়াশোনা করার সময়। এসব রান্নাঘর সামলানোর জন্য আমরা আছি। আমরা যখন থাকবো না তখন তুই সামলাবি। নিলা তো সামনেই আছে জিজ্ঞেস করতো ও যখন পড়াশোনা করতো ওকে রান্না করতে দিতাম কিনা !” সোহা নিলার দিকে তাকালো নিলা হেসে বললো
” মা সত্যি বলছে সোহা ! মা আমাকে রান্নাঘরের ধারেও ঘেষতে দেয়নি। আমার পড়াশোনা শেষ করার পরও মা বলেছিলো এসব দেঝার দরকার নেই চাকড়ি করে নিজের পায়ে দাঁড়াতে কিন্তু আমার ইচ্ছে ছিলো না আর এর কয়েক মাস পড়েই আমি কনসিভ করেছিলাম তাই একদমই চাকড়ির কথা ভাবিনি।” সোহার মন ক্ষান্ত হলো না। মন ক্ষুণ্ণ হয়ে দাঁড়িয়ে থাকে। শাহানাজ বেগম কাজে মন দেয়। নিলা সোহার ব্যাপার বুঝতে পেরে বললো
” আচ্ছা তোমার যখন যা ইচ্ছে করো কেউ বাধা দেবে না। তবে আমাদের সাথে সাথে করবে আএ সাবধানে ঠিকাছে ?” সোহা আড়চোখে তাকিয়ে বললো
” সত্যি তো ?” শাহানাজ বেগম হাফ ছেড়ে বললো
” হ্যা হ্যা সত্যি। তোর মুখ ফুলানো দেখলে আর না করা যায় ? নে শানের খাবার দেবো সেটা নিয়ে যাবি। নিজেও তো খাসনি কালকে থেকে। কখন খাবি তুই ? শানকে বললে তাণ্ডব না বাজায় ! রাতে দুমুঠো খেয়ে ছিলি আর খেয়েছিস ?” সোহা মুখ কুঁচকে বললো
” পড়ে খাবো মামনি এখন ইচ্ছে করছে না। আচ্ছা আপুরা কবে আসবে ?” নিলা শষা কাটতে কাটতে বললো
” সামিরের কাজ শেষ হওয়ার পথে ছিলো কিন্তু আরেকটা ডিল এক কাজ এসে পড়েছে সেখানে তাই আরো কয়েকদিন দেড়ি হবে।” সোহা আর কিছু বললো না।
কিছুক্ষণ পর শানের জন্য খাবার সুন্দর করে সার্ভ করে নিয়ে এলো। এসে দেখে নাইসা ঘুমে কাতর আর শান আধখোলা চোখ ফোনে কি করছে। সোহা খাবার প্লেটটা রাখতে রাখতে শানকে বললো
” চলুন ফ্রেশ হবেন আপনার খাবার এনেছি।” শান ফোন রেখে সোহার সাহায্যে ওয়াসরুমে গিয়ে ফ্রেশ হয়ে আসে। সোহা শানকে খাইয়ে দিতে থাকে। শান খেতে খেতে জিজ্ঞেস করলো
” তুমি খেয়েছো ?” সোহা আমতা আমতা করে হুম বলে সায় দিলো। শান ভ্রু কুঁচকে বললো
” মিথ্যা বলছো কেনো ?” সোহা ঢোক গিলে বললো
” মিথ্যা বলবো কেনো ?” শান রাগি গলায় বলে
” কাকে মিথ্যা বলে মানাছো তুমি ? খাওনি কেনো এখনও ? চেহারা দেখেই বোঝা যাচ্ছে।”
সোহা মুখ ফুলিয়ে বললো
” খান তো আপনি ! আমি খাবো এখনই আপুর সাথে।” সোহা শানকে জোড় করে খাইয়ে দিতে থাকে। খাওয়া শেষ হতেই ইতি আর ইমনের আগমন ঘটে। দুজন একই সাথে এসেছে।

.

.

চলবে……..

একটি উত্তর ত্যাগ

আপনার মন্তব্য লিখুন দয়া করে!
এখানে আপনার নাম লিখুন দয়া করে