#আধারে_তুমি
#লেখিকাঃ মার্জিয়া রহমান হিমা
#পর্বঃ ২০
ইতিকে দাঁড়িয়ে থাকতে দেখে ইশান নিশ্বাস ফেলে বলে
” তুমিও যাও নাহলে শান পুরো ক্যাম্পাস মাথায় উঠিয়ে তারপর তাকে খুঁজে বের করে মারবে।”
ইতি ঢোক গিলে ছুটে গেলো। ইশান নার্সকে সোহার খেয়াল রাখতে বলে অন্য পেশেন্ট দেখতে চলে গেলো।
শান আবারও গাড়ি নিয়ে আগের গন্তব্যের উদ্দেশ্যে বেরিয়ে যাওয়ার আগেই ইতি ছুটে এসে বসে পরলো। শান কোনোদিকে না তাকিয়ে গাড়ি চালাতে থাকে।
উক্ত জায়গায় এসে পৌঁছোতেই হনহন করে গাড়ি থেকে বেরিয়ে গেলো। ইতিকে বললো
” কোন মেয়েটা ধাক্কা দিয়েছে খুঁজে বের করে দেখাও আমাকে।” ইতি মাথা নেড়ে সায় দিলো। দুজন এদিক ওদিক খুঁজতে থাকে তাকে। কিছুক্ষণ পর ইতি সেই মেয়েটাকে দেখতে পেলো পাশে আরেকটা মেয়ে বসে রয়েছে। দুজন আইসক্রিম খাচ্ছে আর হাসাহাসি করে কথা বলছে। সম্ভবত দুই বোন তারা। ইতি শানকে সেই মেয়েটাকে দেখালো। শান রাগে লাল হয়ে যাওয়া চেহারায় সেই মেয়েটার সামনে গিয়ে দাঁড়াল। দুজনই দাঁড়িয়ে গেলো শানকে দেখে। শান শক্ত গলায় বললো
” কে ফেলেছে ?” ইতি ছোট মেয়েটার দিকে ইশারা করলো। শান দাঁতে দাঁত চেপে তার দিকে তাকালো। শানকে এভাবে দেখে দুজনেরই কলিজা শুকিয়ে যাচ্ছে। শান রেগে চেঁচিয়ে বললো
” মাথায় কি কমন সেন্স আছে তোমার ? কোথায় কিভাবে চলতে হয় জানো না ? না জানলে নিজের বাড়িতে বসে থাকতে পারো না ? বাইরে বের হও কেনো ? ক্যাম্পাসে কি দৌঁড়োদৌঁড়ি করার জায়গা ? কিছুক্ষণ আগে একটা মেয়েকে ফেলে দিয়েছো আর এখন বসে বসে আইসক্রিম খাচ্ছো ? জানো তোমার জন্য এখন হসপিটালে শুয়ে আছে ? কয়েকদিন আগেই একটা এক্সিডেন্ট করেছে বড়সড় আর তোমার জন্য আজ আবারও ব্যাথা পেয়েছে। এটা কি পার্ক মনে হয় তোমার ?” শান আরো কিছু কড়াকড়া কথা শুনিয়ে দিলো মেয়েটাকে। পাশের মেয়েটা ইতির থেকে সোহার অবস্থা জেনে শানদের কাছে বারবার ক্ষমা চাইলো। শানও বাচ্চা মেয়ে দেখে আর কিছু বললো না। যা বলার বলে ফেলেছে। ইতি মেয়েটার দিকে তাকিয়ে দেখে টলমল চোখে তাকিয়ে রয়েছে। মনে হচ্ছে একটা বালতির প্রয়োজন। কান্নার বন্যা শুরু হবে বলে কথা।
শান তার কাজ শেষ করে হনহনিয়ে চলে এলো সেখান থেকে। ইতি এসে বললো
” মেয়েটা ছোট ছিলো ভাইয়া এতো বকার দরকার ছিলো না।” শান গম্ভীর গলায় বলে
” যা বলার বলা শেষ। এরপর থেকে যেনো খেয়াল রাখে সেটার জন্যই এতো কথা বলেছি।” ইতি মাথা নেড়ে বলে
” ঠিকাছে তাহলে আমি বাড়ি চলে যাচ্ছি। আপনি সোহাকে বাড়িতে পৌঁছে দেবেন কষ্ট করে।”
শান জিজ্ঞেস করলো
” তুমি সোহার বাড়িতে যাবে না আজ ?” ইতি না করে বললো
” নাহ একটু কাজ আছে তাই যেতে পারবো না। পরে যাবো।” শান ইতিকে ড্রপ করে দিয়ে আসার কথা বললে ইতি আলতো হেসে বলে
” না ভাইয়া আপনি সোহার কাছে চলে যান আমি চলে যেতে পারবো।” শান ইতির জন্য গাড়ি ডেকে দিলো। গাড়ি ছাড়ার আগে শান জিজ্ঞেস করে বসলো
” ইমনের সাথে কথা হয় ?” ইতি লজ্জায় পরে গেলো। কি বলবে বুঝলো না মিথ্যাও বলা ঠিক না তাই মাথা নেড়ে হ্যা বোঝালো। শান আলতো হেসে বিদায় দিলো ইতিকে।
গাড়ি ঘুরিয়ে হসপিটালে চললো আবার। বারবার ছোটাছুটি করায় ক্লান্ত হয়ে গিয়েছে শরীরটা। বাড়িতে গিয়ে রেস্ট করতে হবে। বাড়ি থেকে এখনও কোনো ফোন আসেনি তাই নিজ থেকে কিছু জানালো না। বাড়িতে গিয়েই নাহয় জানাবে সবাইকে নাহলে সবাই চিন্তা করতে বসে যাবে।
সোহার কেবিনে ঢুকে পানি খেয়ে সোফায় গা এলিয়ে বসলো। এখনও মেয়েটার ঘুম ভাঙেনি। শান চোখ বন্ধ করে কপালে হাত রেখে বসে থাকে। ইশান নিঃশব্দে এসে শানের পাশে বসলো। কারো উপস্থিতি অনুভব করে শান চোখ খুলে তাকালো। ইশান বললো
” কিছু খেয়েছিস বলে তো মনে হচ্ছে না। ক্যান্টিনে চল ! লাঞ্জ করে নেই দুজন।” শান আলতো হেসে বলে
” বিকেল হতে চললো লাঞ্চ করোনি এখনও ?”
ইশান শরীর মুচড়ে বলে
” কি আর করার এতো পরিমাণ রোগী দেখা লাগে যে।” শান সোহার দিকে তাকালো ইশান বুঝতে পেরে বলে
” এখন ঘুম ভাঙবে না চল !”
ক্যান্টিনে এসে দুই ভাই দুই চেয়ার টেনে বসলো। ইশান তার পড়নের এপ্রোন খুলে রাখলো পাশের খালি চেয়ারটাতে। ইশান খাবার অর্ডার দিয়ে গলা ঝেড়ে বললো
” মেরেছিস নাকি তাকে ?” শান অন্যদিকে চোখ ফিরিয়ে গম্ভীর গলায় বলে
” বাচ্চা মেয়ে ছিলো মারবো কেনো ? শুধু বকাই দিয়েছি। এমন ভাবে বলছো যেনো আমি একজন গুণ্ডা। যে কথায় কথায় মারে।”
ইশান আলতো হাসলো। কিছুক্ষণ চুপ থেকে শান ব্যথিত গলায় বলে উঠলো
” আচ্ছা ভাইয়া ! তুমিও কি মনে করো আমি পুলিশ হওয়ার পথ বেছে নিয়ে ভুল করেছি ?”
ইশান অবাক হয়ে গেলো। শানের কথাটা শুনে অবাক না হওয়ার মতো কিছুই না। ইশানের এখনও মনে আছে মুসফিক চৌধুরী যখন শানের পুলিশে জয়েন হওয়া নিয়ে প্রথম আর শেষ বারের মতো রাগারাগি করেছিলো তখনই শুধুমাত্র শানের মুখে এই কথাটা ছিলো। আজ আবারও এতোদিন পর বলায় অনেকটা অবাক হয়েছে ইশান। শান শান্ত গলায় বললো
” উত্তর দিচ্ছো না যে !” ইশান অবাক হয়ে বলে
” তুই হঠাৎ এসব কথা বলছিস কেনো ? অকারণে এসব কথা একজন সৎ আর দায়িত্ববান পুলিশ অফিসারে মুখে বেমানান লাগে শান !”
শান মাথা নিচু করে আবার অন্যদিকে তাকালো নিচু স্বরে বললো
” অকারণে কোথায় ? কারণ কি নেই ? আজও বাবাকে কখনো দেখিনি আমি পুলিশ বলে গর্ববোধ করেছে। গর্ববোধ তো দূড়ে থাক পুলিশে জয়েন হওয়ার পর আজও বাবা আমার সাথে এসব নিয়ে কথা বলেনি খুশি হয়ে। তোমাদের মতো আমি বাবার ভালো ছেলে হতে পারলাম না।”
ইশান বড় একটা নিশ্বাস ফেললো। হেসে বললো
” বাবার কথা বলছিস ? বাবা মাঝে মাঝে বলে আমার তিন ছেলের মতো ছেলে যেনো সোবার ঘরে ঘরে জন্মে। তিন ছেলের মধ্যে কিন্তু তুইও রয়েছিস ! তুই যখন অফিসার পোস্টে প্রমোশন পেয়েছিলি বাবা কিন্তু কম খুশি হয়নি ! বাবা পুরো অফিসে মিষ্টি খাইয়েছিলো তবে বাড়ির কেউ জানতো না। আমিও জানতে পেরেছি ম্যানেজার আংকেল এর কাছ থেকে। তিনি মুখ ফসকে বলে ফেলেছিলো। বাবার বলার বারণ ছিলো তাই কাউকে বলেনি। টিভিতে যখন তোর কথা বলা হয় তখন বাবাই বেশি খুশি হয়। বাবার একটাই দোষ। বাবা কখনো এসব প্রকাশ করেনি। পুলিশ পেশাটা বাবার অপছন্দ ছিলো ! কিন্তু এখন আর নেই। বাবা কাউকে বুঝতে দেয়না। আমরা সবাই তোকে নিয়ে গর্ববোধ করি। তুই একজন সৎ পুলিশ অফিসার। সমাজের দায়িত্ব তো তোর কাধেই।” শানের মুখে প্রশান্তির হাসি। ইশান তা দেখে মুচকি হাসলো।
খাবার এসে পড়তেই দুজন অন্য কথা বলতে বলতে খেয়ে নিলো। ইশান সোহার জন্য খাবারও পার্সেল করে নিলো যেগুলো তার জানামতে সোহার পছন্দের। দুজন সোহার কেবিনে এসে পরে। এসেই দেখে সোহা বেডে হেলান দিয়ে বসে বসে ড্যাবড্যাব করে তাকিয়ে মোবাইল দেখছে। ইশান আর শান বোকার একে অপরের দিকে তাকালো। সোহা মোবাইল দেখতে দেখতে দরজার দিকে চোখ পরতেই দুজনকে দেখে ইশানকে উদ্দেশ্য করে একটা মন ভোলানো হাসি দিয়ে বললো
” কেমন আছো ভাইয়া ?” ইশান হেসে এগিয়ে এসে বললো
” আমি তো ভালোই আছি কিন্তু তুমি এখন কেমন আছো ?” সোহা মিটমিট করে হেসে বলে
” আমিও ভালো। তোমরা আমাকে রেখেই খেয়ে এসেছো ?” শান সোহার খাবারটা টেবিলের উপর রেখে বললো
” তোমাকে কে বলেছে আমরা খেতে গিয়েছি ?”
সোহা ফোন রেখে বললো
” কে আবার ! নার্স বলেছে। আচ্ছা আমার খিধে পেয়েছে আমিও কিছু খাবো।” শান সোহার জন্য আনা পার্সেল ব্যাগটা সোহার পাশে রেখে বললো
” নাও তোমার জন্যও আনা হয়েছে। তুমি যে খাদক সেটা ভালো করেই জানি তাই খাবার নিয়ে এসেছি।” সোহা ভেংচি কেটে নিজের হাত এগিয়ে দেখিয়ে দেখিয়ে বলে
” এতো চিকন একটা মানুষকে আপনার কোন দিক থেকে খাদক মনে হলো, হ্যা ? নিজেই তো আস্ত খাদক।”
শান খাবার বের করতে করতে বলে
” আমি খাবো না তো আর কে খাবে ? সারাদিন ক্রিমিনাল দের পেছনে তো আমিই ছুটি তুমি তো সারাদিন বসেই থাকো বাড়িতে।” সোহা মুখ ফুলিয়ে ইশানের দিকে তাকাতেই ইশান হেসে বলে
” আচ্ছা শান এবার থাম। আমি নার্সকে বলছি এসে সোহার খাবার সার্ভ করে দিয়ে যাবে।”
ইশান চলে যেতেই শান সোহার পাশে বসলো। শান্ত গলায় বললো
” এখন কেমন লাগছে ? ব্যাথা করছে আর? ”
সোহা কোণাচোখে শানের দিকে তাকিয়ে বললো
” নাহ ব্যাথা নেই। ভালো আছি এখন আগের থেকে।” শান মুচকি হাসলো। সোহা পূর্ণ দৃষ্টিতে মুগ্ধ চোখে শানের মুচকি হাসির দিকে তাকিয়ে থাকে। শানের এই অমায়িক হাসিটা মারাত্মক সুন্দর যা বলে বোঝানো মুশকিল। শান সোহাকে এভাবে তাকিয়ে থাকতে দেখে ভ্রু নাচিয়ে বললো
” এভাবে কি দেখছেন মিস. বাদর ?” সোহা জোড়ে জোড়ে মাথা নেড়ে কিছু না বোঝালো।
নার্স এসে খাবার সার্ভ করে দিয়ে যেতেই সোহা মনের সুখে খেতে থাকে। শান তাকিয়ে তাকিয়ে সোহাকে দেখতে থাকে। সকালের পর আর খাওয়ার সুযোগ পায়নি মেয়েটা খিধে লাগারই কথা।
খাওয়া শেষ হতেই শান ইশানকে বলে সোহাকে নিয়ে বেরিয়ে গেলো। সোহার চোখে ঘুম না থাকলেও বাতাসের এতো গতিতে চোখে আবারও ঘুম এসে ধরা দেয়। সিটে মাথা এলিয়ে ঘুমিয়ে পড়লো। শান চোখ ভরে সোহাকে দেখতে থাকে।
বাড়ির সামনে গাড়ি থামিয়ে শান সোহার দিকে এগিয়ে গেলো। সোহার গালে হাত রেখে সোহার কপালে ঠোঁট ছুঁয়ে দিলো গভীর ভাবে। সোহার এলোমেলো চুল গুলো ঠিক করে দিয়ে সোহার থেকে দূড়ে সরে আসে। ঘুমের মাঝেই শানের ছোঁয়ায় বেশ কয়েকবার কেঁপে উঠেছে তা খেয়াল করে শান মুচকি হাসি দিলো। দুইবার সোহাকে ধীরে ধীরে ডাকতেই সোহার ঘুম আলগা হয়ে আসে। সোহা ঘুমঘুম চোখে শানের দিকে একবার তাকিয়ে আবার বাড়ির দিকে তাকালো।
দুজন বাড়িতে ঢুকতেই রিয়ানা রহমান আর সিমি এগিয়ে আসে হন্তদন্ত হয়ে। সিমি চিন্তিত হয়ে বলে
” ঠিকাছিস তুই ? ইতি মাত্রই ফোন করে আমাদের জানালো সব। কতো চিন্তা হচ্ছিলো।”
সোহা হেসে বলে
” আমি ঠিকাছি চিন্তা করো না তো !” রিয়ানা রহমান শানের হাত ধরে বললো
” তোমাকে কি বলে ধন্যবাদ দেবো বাবা বুঝতে পারছি না। মেয়েটা দুইবার বিপদে পড়লো প্রত্যেকবার তুমি পাশে ছিলে। সুন্দর করে সব সামলে নিয়েছো।” শান স্মিত হেসে বলে
” ধন্যবাদের কিছু নেই আন্টি। আজকে পুরোদিন সোহা আমার দায়িত্বেই ছিলো। আমি আমার দায়িত্ব পালন করার চেষ্টা করেছি। তাও তো আজকে অঘটন ঘটে গেলো কিছু করতে পারিনি।”
সিমি সোহাকে জড়িয়ে ধরে বলে
” তুমি তো এসব কিছু করোনি। তুমি কেনো গিল্টি ফিল করছো ? সেইদিন তুমি ছিলে বলেই সোহা এখনও সুস্থ আছে।” শান বললো
” ভাবি রাখো না সেদিনের কথা ! বারবার সেই কথা তুলে কি হবে ?”
” হুম তাও ঠিক। আচ্ছা তুমি বসো আমি আসছি।”
শান মাথা নেড়ে বলে
” নাহ আজ যাচ্ছি আমি। তুমি কবে যাবে বাড়িতে ?” সোহা সিমির কাধে মাথা রেখে বলে
” নিয়ে যান, নিয়ে যান। আমার বাড়িতে এসে আবার জায়গা বসাচ্ছে।” সিমি সোহার মাথায় গাট্টা মারলে সোহা মুখ ফুলিয়ে নেয়। শান হেসে দিলো সোহাকে দেখে।
ওয়াসরুম থেকে বের হতেই দেখতে পেলো শাহজাহান বেগম কফি নিয়ে বসে আছে। শান টাওয়াল রেখে এগিয়ে আসলো। মায়ের কোলে মাথা রেখে শুয়ে পড়লো। ঘন্টাখানিক আগেই এসেছে বাড়িতে। এসেও ফ্রেশ হতে ঢুকেছে।
শাহানাজ বেগম শানের ভেজা চুলে হাত বুলিয়ে দিতে দিতে বললো
” সোহা কেমন আছে এখন?” শান চোখ বন্ধ করে বলে
” হ্যা ভালো এখন।” শাহানাজ বেগম কফির মগটা হাতে নিয়ে বললো
” কফিটা খেয়ে নে নাহলে ঠান্ডা হয়ে যাবে। পরে মাথা ব্যাথা কমবে না।” সময় লাগিয়ে শান আলসেমি ভেঙে আবারও উঠে বসলো। কফিটা নিয়ে তাতে চুমুক দিলো। শাহানাজ বেগম শানের দিকে তাকিয়ে রয়েছে। তার কথা গুলো এখনই বলবে কিনা সেটা ভাবছে। শাহানাজ বেগমের মনের কথা হয়তো না বলার পরও বুঝতে পেরেছে শান। তাই বললো
” কি বলবে ? বলো না !” শাহানাজ বেগম গলা ঝেড়ে নিলো।
.
.
চলবে……..
#আধারে_তুমি
#লেখিকাঃ মার্জিয়া রহমান হিমা
#পর্বঃ ২১
শাহানাজ বেগমের মনের কথা হয়তো না বলার পরও বুঝতে পেরেছে শান। তাই বললো
” কি বলবে ? বলো না !” শাহানাজ বেগম গলা ঝেড়ে নিলো। শান কফিতে আরো কয়েকটা চুমুক দিয়ে কিছুটা শেষ করলো।
” তুই সোহাকে পছন্দ করিস ?” শানের গলায় আধ গিলন্ত কফি আটকে গেলো। শাহানাজ বেগম উত্তরের আশায় অধির আগ্রহে চেয়ে আছেন শানের পানে। শান কোনো রকমে কফিটা গিললো। ঢোক গিলে বললো
” অপছন্দ করার কি আছে ?” শাহানাজ বেগম শানের কথা ঘোরানোর ব্যাপারটা বুঝতে পেরে বললো
” শান ! আমি কি বলছি ভালো করেই বুঝতে পারছিস তুই। তুই সোহাকে ভালোবাসিস কিনা !”
শান দৃষ্টি লুকিয়ে বললো
” মা কি বলছো এসব ? আমি কেনো ওকে…”
শাহানাজ বেগম শানের কথা মাঝ পথে থামিয়ে বলে উঠে
” আমাকে মিথ্যা বলার চেষ্টা করবি না শান। আমি সব জানি।” শান চমকানো দৃষ্টিতে তাকালো শাহানাজ বেগমের দিকে। শাহানাজ বেগমের শান্ত দৃষ্টি। মনে মনে তার মেলা বসেছে। শানকে চমকে দিতে তার ভালোই লাগছে। শাহানাজ বেগম ভ্রু কুঁচকে বললো
” কি মনে করেছো ? তোমার গোপন কথা কেউ জানবে না ? আমি তোমার মা। তোমার কথা জানতে বেশি সময় লাগবে না আমার।” শান মাথা নিচু করে নেই। শাহানাজ বেগম মুচকি হেসে বলে
” আমি আজই তোর বাবা আর ভাইদের জানাবো তারপর তোদের বিয়ে ঠিক করার ব্যাপারে কথা বলব।” শান মায়ের কথা শুনে মুচকি দিলো। তারপর কিছুটা চিন্তিত হয়ে বলে
” কিন্তু যদি সোহা বা ওর মা,বাবা রাজি না হয়?”
শাহানাজ বেগম শানের মাথায় হাত বুলিয়ে বলে
” সেসব নিয়ে তোকে চিন্তা করতে হবে না। আর ওদের না করার কোনো উপায় নেই। আমার ছেলে কোনো দিক দিয়ে কম নয়।” শান আলতো হাসলো। শাহানাজ বেগম উঠে বেরিয়ে গেলো রুম থেকে। শান দরজা লাগিয়ে এসে আবারও কফি হাতে নিলো। মুখে দিতেই মুখ কুঁচকে নেয় শান। এসির ঠাণ্ডা বাতাসে থেকে কফি ঠাণ্ডা হয়ে গিয়েছে তাই স্বাদ টা তেতো হয়ে গিয়েছে। শান কফির মগটা রেখে শুয়ে পড়লো। ঘড়ির দিকে চোখ বুলিয়ে দেখলো রাত ৯টা ছুঁইছুঁই। সোহার খোঁজ নিতে হবে নাহলে অশান্ত মনটা শান্ত হবে না। কিন্তু কিছুক্ষণ ভেবে পরক্ষনেই ঠিক করলো আজ আর খোঁজ নেওয়ার চেষ্টা করবে না সোজা দেখেই আসবে। তবে এখনও সময় হয়নি যাওয়ার তাই ল্যাপটপ নিয়ে বসলো। অনেকদিন তো হলো কিন্তু দুঃখের ব্যাপার হচ্ছে এখনও পর্যন্ত সেই লোকটা কে খুঁজে পায়নি শান বা শানের টিম যে সোহাকে ছুড়ি দিয়ে আঘাত করে পালিয়েছিলো। শান অন্যান্য কেসের পাশাপাশি এই কেসটাকে নিয়ে প্রচুর পরিমাণে বিভ্রান্ত হয়ে রয়েছে। লোকটা কিভাবে কোথায় খুঁজে পাবে বুঝতে পারছে না। লোকটকে খুঁজে বের করার জন্য পুরো কেসের ইনভেস্টিগেশন করতে হবে। কয়েকদিন ডিস্টার্ব থাকায় এসব নিয়ে ইনভেস্টিগেশন করার করহা ভাবেনি। তবে কাল থেকেই কাজ শুরু করবে। শান ইমনকে ফোন করলো। কল রিসিভ হতেই শান বললো
” শোন তোকে যে লোকটাকে খুঁজে বের করার দায়িত্ব দিয়েছিলাম ! লোকটা কে তো খুঁজে পেলাম না। আমি ভাবছি এটা নিয়ে অফিসিয়ালি ইনভেস্টিগেশন শুরু করবো।” ইমন বড়সড় হাই তুলে বললো
” কে দেবে তোকে অফিসিয়ালি ইনভেস্টিগেশন করতে ? রিপোর্ট লিখা লাগবে জানিস ?”
শান কপাল ঘষতে ঘষতে বলে
” সেটা দেখে নেবো আমি। তুই ইনভেস্টিগেশন শুরু কর।” ইমন আবারও হাই তুললো। শান বিরক্তি নিয়ে বললো
” সারাদিন ঘুমিয়েও তোর ঘুম শেষ হয় না ?”
ইমন ক্ষেপে বললো
” ধুর শালা ! সারাদিন ঘুমাবো না তো আর কি করবো ! পুলিশ হয়েছি একটু ঘুমাতে পারিনা শান্তিতে। ছুটির দিনে তো একটু ঘুমাতে দিবি ! নাকি এখনও অফিসার এর তো অর্ডার দিবি ?”
কথা বলতে বলতে আরো দুইবার হাই দেওয়া শেষ। শান হেসে বলে
” না ভাই ঘুমা তুই। কেউ অর্ডার দিচ্ছে না তোকে।” ইমন হাই তুলে বলে
” হ্যা ঘুমাবোই তো। তোর তো আর বিয়ে লাগেনি যে গিয়ে নাচবো।”
শান কথায় কথা বলে ফেললো
” লাগতে কতো দিন ?” ইমন অবাক হয়ে বলে উঠে
” কি ভাই তোর বিয়ে লাগবে ? কবে কবে ?”
শান হচকচিয়ে বলে
” আরে এমনি বলেছি। তুই ঘুমা এখন।” ইমন হাই তুলে ফোন রেখে দিলো। কিছুক্ষণ পর ডিনারের জন্য ডাক পরতেই শান বেরিয়ে যায় কিন্তু নিচে নামার আগেই সালমাকে দেখতে পেলো খাবার নিয়ে আসছে। শান ভ্রু কুঁচকে বলে
” কোথায় নিয়ে যাচ্ছিস এগুলো ?” সালমা পেছনে ঘুরে শাহানাজ বেগমের দিকে একবার তাকিয়ে আবার শানের দিকে তাকিয়ে বললো
” আপনার ঘরেই তো নিয়ে যাচ্ছি ভাই। খালাম্মা নাকি সবার সাথে কি কথা বলবে তাই আজকে উপরেই খেতে বলেছে।” শান বুঝতে পেরে সালমার হাত থেকে ট্রে নিয়ে নিজের রুমে ঢুকে গেলো।
নিস্তব্ধ রাতে শা শা করে বাতাস হচ্ছে। বাতাসের গতিটা খুবই বেশি। হাড় কাপানো ঠাণ্ডা আবহাওয়া। মনে হচ্ছে আজ বৃষ্টি হবে। বেশ কয়েকদিন হয়ে গিয়েছে বৃষ্টির মুখ দেখা হয়নি। ভালোই হবে বৃষ্টি হবে। হুরহুর করে বাতাসের সঙ্গে সোহার ব্যালকনি দিয়ে রুমে ঢুকে পড়লো শান। শান রুমে ঢুকেই অন্ধকারে আচ্ছন্ন রুমে চোখ বুলালো। এসি অফ থাকা সত্ত্বেও রুমটা পুরোই ফ্রিজের মতো ঠাণ্ডা হয়ে রয়েছে। হবে নাই বা কেনো ? ব্যালকনির দরজারসহ রুমের জানলা সবই হা করে খোলা রয়েছে। শান জানলা গুলো লাগিয়ে পর্দা টেনে দিলো। ধীরে ধীরে পা চালিয়ে সোহার মাথার পাশে গিয়ে হাটু গেড়ে বসলো শান। বসতেই সোহার গোঙ্গানির শব্দ কানে আসলো। শান ভয় পেয়ে যায়। ভাবলো সোহার জ্বর এসেছে। সোহার কপালে উল্টো পিঠে হাত ছুঁয়ে দিতেই বুঝতে পারলো ঠাণ্ডায় কাঁপছে সোহা। শরীর বরফের মতো ঠাণ্ডা হিম হয়ে রয়েছে। অথচ মেয়েটা পুতুল জড়িয়ে ঘুমিয়ে ঘুমিয়ে কাঁপছে ! শান দীর্ঘ নিশ্বাস ফেললো। উঠে সোহার পায়ের নিচ থেকে ব্ল্যাংকেট টা টেনে সোহার গায়ে দিয়ে দিলো। সোহা ব্ল্যাংকেট জড়িয়ে বিড়ালের মতো ঘুমিয়ে থাকে। বিড়ালের কথা মনে পরতেই শানের টমির কথা মাথায় আসলো। শান আশেপাশে উঁকিঝুঁকি দিয়ে দেখে টমি আছে কিনা। হঠাৎ নিজের পাশে চোখ যেতেই শান ভয়ংকর ভাবে চমকে উঠে। টমি তারই পাশে নিজের সুন্দর ঝুড়িতে বসে আছে আর ড্যাবড্যাব করে শানের দিকে তাকিয়ে আছে। শান বুকে হাত দিয়ে স্বস্তির নিশ্বাস ফেললো। একটুর জন্য প্রাণটা বেঁচে গেলো শানের। শান ক্ষেপে পকেট থেকে মাস্ক বের করে পরে নিলো। কিছুটা ঝুকে ফিসফিস করে বলে
” তুই এমন জিনদের মতো ভয় দেখাস কেনো ? আমাকে না জ্বালালে ভালো লাগে না তোর ? ভবিষ্যৎ এ তোকে নিয়ে কি করবো সেটাই ভাবছি।” টমি ফ্যালফ্যাল করে তাকিয়েই থাকে শুধু। শান হেসে দিলো। লুকায়িত প্রেম আলাপের জন্য বাক্যহীন প্রাণিই আশেপাশে থাকা উচিত বলে মনে হলো শানের। শান সোহার দিকে গভীর দৃষ্টি দিয়ে তাকালো। মুখটা কেমন নেতিয়ে গিয়েছে মেয়েটার। কম ধকল তো যায়নি ! শান সোহার দিকে ঝুকে কপালে আর দুই চোখের পাতায় ঠোঁট ছুঁয়ে দিলো। সোহা কেঁপে উঠে তার টেডি কে শক্ত করে জড়িয়ে ধরলো। শান মুচকি হাসি দিয়ে টমির দিকে তাকালো। তাকিয়ে দেখে টমি ঢুলে ঢুলে বিছানায় ধপ করে শুয়ে চোখ বন্ধ করে রেখে দিয়েছে। শানের পেট ফেটে হাসি আসলো টমির কাণ্ডকারখানা দেখে কিন্তু হাসিটা চেপে রেখে বেরিয়ে আসে। আজ জায়গা প্রস্থান করার সময় হয়ে গিয়েছে। শান ব্যালকনির দরজা চাপিয়ে আগের মতো বেয়েই নিচে নেমে গেলো।
সকালে আজ অন্যান্য দিনের মতো না হলেও দেখলো সবাই কেমন থম মেরে রয়েছে। শান গিয়ে সোজা টেবিলে বসে পরলো। সালমা এগিয়ে এসে খাবার দিতে থাকে শানকে। শান সালমাকে জিজ্ঞেস করলো এসব কি। সালমা ফিসফিসা গলায় বললো
” সবাই এখন সোহা আপাদের বাড়িতে যাবে।” শানের বিষম উঠে গেলো। সালমা দৌঁড়ে পানি নিয়ে এগিয়ে আসে। নিলক এগিয়ে এসে শানের পিঠে মাথায় হাত বুলিয়ে দেয়। শান পানি খেয়ে থামলো। নিলার দিকে তাকিয়ে দেখলো নিল্ব মিটমিট করে হাসছে।
.
.
চলবে……….