আধারে তুমি পর্ব-০৪

0
1230

#আধারে_তুমি
#লেখিকাঃ মার্জিয়া রহমান হিমা
#পর্বঃ ০৪

কিছুক্ষণ পর হাতে গ্লাভস আর মুখে রুমাল দিয়ে বাধা অবস্থায় টমিকে কোলে নিয়ে চুপিসারে নিজের রুমে ঢুকে গেলো। টমিকে রুমে রেখে সোহার রুমে গিয়ে দাঁড়িয়ে থাকে শান।
সোহার এতো কান্না দেখে সবাই এবার হতাশা ভরা মন নিয়ে বেরিয়ে গেলো রুম থেকে। শান সুযোগ বুঝে টমিকে নিজের রুমে থেকে এনে সোহার রুমে ঢুকেই দরজা লাগিয়ে দিলো। সোহা দরজা বন্ধের শব্দ শুনে দরজার দিকে তাকাতেই চমকে উঠে। সোহা কান্না বন্ধ করে দৌঁড়ে শানের কাছে গিয়ে টমিকে কেড়ে নিজের কোলে তুলে নিলো। সোহা টমিকে চুমু কে খেয়ে বলে
” কোথায় গিয়েছিলি টমি ? জানিস না তোকে ছাড়া থাকতে পারি না আমি! আমাকে না বলে কেনো চলে গিয়েছিলি তুই ?” শান বিরক্তিমাখা স্বরে বললো
” এই এবার তো করো, মেরি মা ! এই পাঁচ ছয় ইঞ্চি একটা কুকুরের জন্য আর কতো কাঁদবে বলো তো ! তোমার ফ্যাচফ্যাচানি কান্না শুনে শুনে আমার মাথা ব্যাথা করছে।”
সোহা চোখের পানি মুছে টমিকে নিয়ে বসে থাকে। কান্নার হিচকি এখনও কমেনি কিন্তু সোহার মুখে হাসি দেখে শানের মনে হলো অনেক দিন পর আকাশ থেকে কালো মেঘ সরে গিয়েছে। শান অপলক চাহনি দিয়ে সোহার দিকে তাকিয়ে থাকে।
সোহার মাথায় হঠাৎ একটা প্রশ্ন আসতেই সোহা ভ্রু কুঁচকে তীরের মতো সুক্ষ্ম দৃষ্টিতে শানের দিকে তাকালো। শানের চাহনি দেখলেও সেটা খেয়াল না করে টমিকে রেখে সোহা অগ্নিদৃষ্টিতে শানের সামনে গিয়ে দাঁড়াল। সোহাকে হঠাৎ এতো কাছে দেখে শানের হুশ আসে। শান মনে করে এভাবে তাকিয়ে থাকায় সোহা বোধয় রেগে গিয়েছে তাই হচকচিয়ে বলে
” আমি আমার রুমে যাচ্ছি।” সোহা শানের পথ আটকে বলে
” দাঁড়ান কথা আছে আমার। আপনি টমিকে কোথায় পেয়েছেন ? আচ্ছা আপনিই ওকে লুকিয়ে রাখেননি তো ?” শান গম্ভীর গলায় বলে
” আমাকে কি নিজের মতো মনে করেছো ? ছোট একটা কারণে এই কুকুরকে আমি লুকিয়ে রাখতে যাবো ! তোমার মতো মানুষ দেখিনি আমি। কোথায় আমি ইমনকে দিয়ে এতো কষ্ট করিয়ে টমিকে খুঁজে বের করেছি আর তুমি আমাকে ধন্যবাদ না দিয়ে সন্দেহ করছো !” শানের ধমক শুনে সোহা ভয়ে কেঁপে উঠে। সোহা মুখটা ইনোসেন্ট বানিয়ে ঠোঁট উল্টে বলে
” সরি ! আর ধন্যবাদ টমিকে খুঁজে বের করে আনার জন্য।” সোহার ইনোসেন্ট ফেস দেখে বড্ড হাসি পেলো কিন্তু শান একদমই হাসলো না। গম্ভীর গলায় উত্তরের বললো
” হুমমম।” শান দরজা খুলে চলে যেতে নিলে আবারও পেছন থেকে সোহা তাকে ডাকলো। শান ভ্রু কুঁচকে বলে
” কি হয়েছে ?” সোহা শানের দিকে ইশারা করে বলে
” আপনি এমন গ্লাভস, রুমাল এসব পড়ে সং সেজেছেন কেনো ?” শান রেগে চোখ বন্ধ করে নেয়। সোহা শানের মুখের দিকে তাকিয়ে বোঝার চেষ্টা করে কি হয়েছে। শান ঠাস করে চোখ খুলে দাঁতে দাঁত চেপে বলে
” আমার এলার্জি আছে কতোবার বলবো তোমাকে ? তোমার টমির পশমের থেকে বাঁচার জন্য এসব পরেছি। এবার যাবো আমি !”
সোহা দাঁত কেলিয়ে মাথা ঝাঁকিয়ে সায় দেয় শানের কথায়। শান ধুপধাপ পায়ে নিজের রুমে চলে গেলো। সোহা টমিকে নিয়ে নিচে চলে যায় সবাইকে বলতে।
শান গ্লাভস, মাস্ক সব খুলে বড় একটা নিশ্বাস নিয়ে বারান্দায় চলে গেলো। ব্যালকনির ফুল গাছ গুলোর কাছে গিয়ে ফ্লোরে বসে পড়লো। শান গিল্টি ফিল করে কিছুটা নিজের কাজের জন্য। শানই টমিকে লুকিয়ে রেখেছিলো গাড়ির ডিঁকিতে। শান ভেবেছিলো সোহা কিছুক্ষণ কান্না করে ঠিক হয়ে যাবে আর শান কালকে টমিকে সোহার বাড়িতে রেখে আসবে কিন্তু সোহার এতো কান্না দেখে শান আর নিজেকে ঠিক রাখতে পারেনি। তাই টমিকে সোহার কাছে ফিরিয়ে দিলো।
দরজায় নক হতেই শান ভেতরে আসতে বলে। সালমা এসে শানের কফি দিয়ে চলে যেতে নিলে শান বললো
” শোনো সোহাকে বলে দেবে ওর কুকুর যেনো কোনোমতেই আমার রুমে না আসে।”
সালমা আমতা আমতা করে বলে
” ভাই আমি বললে কি আপু শুনবে ? উনি তো কারোর কথা শুনবে না।”
শান বিরক্তি চাহনি দিয়ে বলে
” কে বলেছে শুনবে না ? বলে দেখেছো কখনো ? যাও ! আর ওকে বলবে আমার সাথে যেনো দেখা করে যায় আমিই বলে দেবো সব।” সালমা মাথা নেড়ে চলে গেলো।
শান কফি খেতে খেতে গাছের ফুল গুলোকে ছুঁয়ে দিতে থাকে।

শান তার রুমের সোফায় বসে বসে থানার কিছু ফাইল দেখছিলো। তখন সোহা হুরমুর করে রুমে ঢুকে বলে উঠে
” আমাকে ডেকেছেন কেনো ?” শান চমকে চোখ বড় বড় করে সোহার দিকে তাকিয়ে থাকে। সোহা রুমে ঘুরতে ঘুরতে গান গাইতে থাকে
” লালালালা লালালা লা লা লালা।” শান ধমক দিয়ে বললো
” চুপ একদম ! এটা কেমন ভদ্রতা ? রুমে ঢোকার আগে পারমিশন নিতে হয় জানো না ! আর রুমে ঢুকেই গান গাইছ কেনো ? এটা কি তোমার পারফর্মেন্স সো পেয়েছো ? নাকি তোমার রুম এটা ?”
সোহা নাক ফুলিয়ে রাগ দেখিয়ে বললো
” এই একদম আমাকে ভদ্রতা শেখাতে আসবেন না। আমার যা ইচ্ছে আমি তাই করবো এই বাড়িতে। আর পারমিশন নেওয়ার কি আছে ! আপনি কি বিবাহিত নাকি ? বিবাহিত লোকরা বউ এর সাথে রোমেন্স টোমেন্স করে তাই পারমিশন নেওয়া দরকার। কিন্তু আপনি তো বিবাহিত না তাহলে আপনার পারমিশন নেওয়ার কি আছে ?”
শান সোহার কথা শুনে থতমত খেয়ে যায়। নিজেকে সামলে সোহার কাছে দাঁড়িয়ে বলে
” বিবাহিত না হলেও আমি একটা ছেলে। ওকে ? নেক্সট টাইম পারমিশন না নিয়ে ঢুকলে হাত পা বেধে রেখে দেবো।” সোহা রেগে বলে
” গেস্ট এর সাথে কেউ এভাবে কথা বলে ? ছি! ছি! ছি! আমি আন্টি কে বলবো। এবার আসল কথায় আসুন। আমকে কেনো ডেকেছেন এখানে ?” শান গম্ভীর গলায় বলে
” তোমার টমি যেন আমার রুমে না আসে সেদিকে ভালো করে খেয়াল রাখবে। শুধু টমি কেনো তুমিও আসবে না এই রুমে। আমি পারমিশন ছাড়া আমার রুমে তোমরা কেউ আসবে। গড ইট ?”
সোহা এক ভ্রু উঁচু করে পুরো রুমে চোখ বুলিয়ে বললো
” কেনো কেনো ? এই রুমে কি এমন জিনিস আছে যে এখানে আসা যাবে না ?”
শান চোখ রাঙিয়ে বলে
” যা বলেছি শুধু সেটুকুই শুনবে। আমার রুমে কিছু থাকুক আর না থাকুক সেটা একান্তই আমার পারসোনাল ম্যাটার। যাও এবার নিজের কাজে যাও।”
সোহা শানকে ভেংচি দিয়ে মুখ ফুলিয়ে চলে গেলো। শান সোহার কাজ দেখে আলত হাসলো।
ডিনার টেবিলে সবাই একসাথে খেতে বসে। শাহানাজ বেগম আর নিলা, সোহা কি খাবে সেই নিয়েই ব্যস্ত। আর সবাই গল্প করছে আর খাচ্ছে। সোহা সবার সাথেই মজা করছে। শুধুমাত্র শান গম্ভীর হয়ে বসে আছে। মুসফিক চৌধুরী গল্প করতে করতে এক পর্যায়ে জিজ্ঞেস করে
” সোহা ? পড়াশোনা শেষ করে কি করতে চাও তুমি ?” সোহা দাঁত কেলিয়ে বলে
” কি আর করবো বলুন আংকেল ! মেয়েদের তো বিয়ের পিরিতে বসতে হয় তাই ভেবেছি যেকোনো সময় বিয়ে করে ফেলবো তারপর নিজে পড়বো আর বাচ্চা, হাজবেন্ড কেও পড়াবো।” সোহার কথা শুনে শান আর সিমি বাদে সবাই অবাক হয়ে চোখ বড় বড় করে তাকিয়ে থেকে হঠাৎ হেসে উঠে। সোহা নিজেই লজ্জা পেয়ে যায়। সিমি সোহার দিকে চোখ রাঙিয়ে বলে
” বাবা তোকে তোর স্বপ্নের কথা জিজ্ঞেস করছে আর তুই মজা করছিস ?” সোহা সিমির দিকে তাকিয়ে ভেংচি কাটলো। সিমি এবার রেগে তাকায়। ইশান হেসে সিমিকে উদ্দেশ্য করে বলে
” আরে সিমি থাক। একটু আধটু মজা তো করবেই এটা ব্যাপার না।”
সোহা এবার সিরিয়াস হয়ে বলে
” আমি একটা NGO খুলতে চাই। ” সবাই অবাক হলো সোহার কথা শুনে। সোহা সবার চাহনি দেখে ইনোসেন্ট ফেস করে বলে
” আমি মজা করছি না এবার। সত্যিই আমার ইচ্ছে একটা NGO খুলবো আমি। আর কোনো ইচ্ছে নেই।” সামির মাথা নেড়ে বলে
” বাহ অনেক ভালো একটা কাজ।” নিলা আলতো হেসে সোহার মাথায় হাত রেখে বলে
” তুমি সামলাতে পারবে এসব ?”
সোহা মুচকি হেসে উত্তরে বললো
” চাইলে তো সবই সম্ভব। আমি যখন চাই NGO খুলতে। তাহলে সেটা ভালোভাবে সামলানোর দায়িত্বও আমার হবে।” সোহার কথাটা শুনে সবার ভালো লাগলো। শান মনে মনে বলে
” বাদর হলেও কাজে কোনোদিক থেকে কম না।”

পরদিন সকাল হতেই সবাই যার যার কাজে চলে গেলো। শানও থানায় চলে গেলো। শান বেরিয়ে যেতেই সোহা চুপিচুপি শানের রুমে ঢুকে পড়ে। তাও আবার টমিকে নিয়ে। টমি তো তার ছোট ছোট চোখ দিয়ে পুরো রুমে চোখ দিয়েই চক্কর কেটে নিলো। সোহার আদেশ মেনে চলছে টমি। সোহা ঢোকার আগেই টমিকে সাবধান করে দিয়েছে চুপচাপ তার পেছন পেছন আসার জন্য। তাই তার জন্য আপাতত এটাই সবচেয়ে বড় কাজ। সোহা শানের ব্যালকনিটা আগে ঘুরে দেখলো তারপর একে এক রুমের আগা টু গোরা সব দেখলো। শান মানুষটা খুবই গোছালো এবং শান্ত, গম্ভীর একজন মানুষ।
সোহা দরজা আলতো ভাবে চাপিয়ে নেয় তারপর কিছু না ধরে গিয়ে সোজা আলমারি খুলে বসলো। আলমারি খোলাই ছিলো তাই সুবিধা হলো। সোহা একে একে সব জায়গা খুঁজে নিলো কিন্তু শানের পারসোনাল এর মতো তেমব কিছু খুঁজে পেলো না। তবে সব খুঁজে শেষে একটা লক করা ড্রয়ার খুঁজে পেলো। সোহা তার সব শক্তি দিয়ে টেনে টেনে খোলার চেষ্টা করে কিন্তু বিফলে গেলো। সোহা আবারও টানতে টানতে বিরবির করে বলে
” ড্রয়ারের বাচ্চা খোল বলছি ! এতো কষ্ট করছি আমি আর আমার জন্য একটু খুলতে পারবি না তুই ? কেমন বেইমানি এটা ! আরে কেমন লক দিয়েছে উনি ! বাড়িতে কোনো চোর আসলেও এটা খুলতে পারবে না। চোরের চুরি করা সফল হবে না। আরে এমন হলে আমার কৌতূহলও ক্লিয়ার হবে না কখনও।”
” চোরের আর আসার দরকার কি ? তুমি নিজেই তো চোর হয়ে এসেছো। বাদর চোর কে দেখলে আসল চোরও পালিয়ে যাবে।” সোহা পাথরের মতো দাঁড়িয়ে যায়। সোহা ঢোক গিলে সামনে তাকাতেই শানকে দেখে তার হাত পা কাপাকাপি করতে থাকে।

.

.

চলবে……..

একটি উত্তর ত্যাগ

আপনার মন্তব্য লিখুন দয়া করে!
এখানে আপনার নাম লিখুন দয়া করে