#আধারে_তুমি
#লেখিকাঃ মার্জিয়া রহমান হিমা
#পর্বঃ ০২
শান শান্ত ভাবে বলে
” দেখুন বউকে নিয়ে যেতে চাইছেন ভালো কথা। তবে বউ যখন নিচ্ছেনই তখন একটু ভালো করে নিয়ে যান ! আপনার বউকে নাহয় পূর্ণ রূপে সাজিয়ে নিয়ে আসি আমরা ! তারপর নিয়ে যান আপনি ” শানের কথা শুনে পাগলের চোখ মুখ জ্বলজ্বল করে উঠে। শান সোহার হাত ধরতে নিলেই পাগলটা সোহাকে সরিয়ে নেয়। আর সোহা একনাগাড়ে কেঁদেই যাচ্ছে। শান পাগলের উপর বিরক্ত হলেও মুখে হাসি নিয়ে বলে
” কি হলো ? আপনার বউকে বউ সাজিয়ে নিয়ে যাবেন না ?” পাগল তার উল্টো পাল্টা বিলাপ করতে থাকে। শান পাগলের কথা শুনে বুঝতে পারে পাগলও যেতে চাইছে। শান পাগলকে
উদ্দেশ্য করে বলে
” আপনি গেলে কি করে হবে ? সোহাকে বউ আর আপনাকেও জামাই সাজাতে হবে তো নাকি ! ইমন আপনাকে সাহায্য করবে। আমি সোহাকে নিয়ে যাচ্ছি।” ইমন তড়িঘড়ি করে এগিয়ে এসে চোখ বড়বড় করে বলে
” এই তুই এখন আমাকে ফাসাতে চাইছিস নাকি ! পরে এই পাগলটা সোহাকে না পেয়ে আমাকেই যদি বউ মনে করে নিয়ে যায়! তোকে কিন্তু ছাড়বো না আমি !” শান দাঁতে দাঁত চেপে ইমনের কাছে এসে বলে
” শালা কিছু না বুঝেই বকবক করিস। আমি সোহাকে নিয়ে গেলে তোরা পাগলকে বেধে তার আস্তানায় রেখে আসবি। তোকে বিয়ে করার জন্য প্রস্তাব দেইনি পাগলকে। আর হ্যা সেখানেও বেধে রাখিস না। আমি গাড়ি নিয়ে বেরিয়ে গেলে তার বাধন খুলে দিবি। এবার কথা ঢুকেছে মাথায় ?” ইমন দাঁত কেলিয়ে সায় দেয়। শান জোড় করে সোহাকে পাগলের কাছ থেকে ছাড়িয়ে নিয়ে বলে
” এই যে আপনার বউকে একটু পরই নিয়ে আসছি আমি।” পাগলকে কিছু বলতে না দিয়েই শান সোহাকে নিয়ে দৌঁড়ে থানার ভেতরে ঢুকে যায়। ইমনরা সবাই এবার পাগলকে বেধে রাখার জন্য উঠে পরে লাগে।
কেবিনে এসে শান হাফ ছেড়ে চেয়ারে বসে পরে। আর সোহা বাবাকে দেখে আহ্লাদী হয়ে আরো জোড়ে জোড়ে কাঁদতে থাকে। ইমতিয়াজ রহমান ভ্যাবাচ্যাকা খেয়ে গেলো সোহার কান্না দেখে। ইমতিয়াজ রহমান উঠে সোহার কাছে গিয়ে বলে
” কি হয়েছে সোহা ? কাঁদছিস কেনো ?” সোহা কিছু না বলে কাঁদতেই থাকে। শান পানি খেয়ে বলে
” আংকেল আপনার মেয়ে এখনই পাগলের বউ হয়ে যাচ্ছিলো। আমি বাঁচিয়ে নিয়ে এলাম।”
ইমতিয়াজ রহমান কিছু বুঝতে না পেরে বলে
” পাগলের বউ মানে?”
সোহা কান্না থামিয়ে কাঁদোকাঁদো গলায় বললো
” আমি বউ হতে যাচ্ছিলাম ? আপনিই তো ওই পাগলকে আরো উস্কানি দিয়েছেন আমাকে নিয়ে যাওয়ার জন্য।” কথা শেষ করে সোহা আবারও কেঁদে উঠলো। শান এক ভ্রু উঁচু করে সন্দেহী দৃষ্টিতে তাকিয়ে বলে
” আগে বলো পাগলের কাছে গিয়ে ঘুরছিলে কেনো তুমি ? রাতে তো এউ পাগলকে তার আস্তানা ছাড়া অন্য কোথাও পাওয়া যায় না। আগে যতোবার এমন করেছে সবসময় দিনের বেলায় করেছে। এই পাগল দিনেই শুধুমাত্র থানার সামনে থাকে। তুমি এখন যেচে সেখানে না গেলে পাগল অবশ্যই নিজে নিজে আসবে না।”
সোহা থতমত খেয়ে দাঁড়িয়ে থাকে। কান্নাও বন্ধ হয়ে গিয়েছে তার। ইমতিয়াজ রহমান বুঝতে পেরে শব্দ করে হেসে দেয়। সোহা চোখ মুখ মুছে মুখ ফুলিয়ে রাখে ।
শান ঘড়ির দিকে একপলক তাকিয়ে বলে
” চলুন আংকেল আপনাদের ড্রপ করে দিচ্ছি। আপনারা তো মনে হচ্ছে গাড়ি আনেননি।”
ইমতিয়াজ রহমান বাধা দিয়ে বলে
” না না তোমাকে আমাদের জন্য ডিউটি ছেড়ে যেতে হবে না। তুমি কাজ করো আমরা চলে যাবো।” শান হেসে বলে
” আমার ডিউটির টাইম কিছুক্ষণ আগেই শেষ আমি আপনার জন্যই বসে ছিলাম। যদি কোনো প্রবলেম হয় ! তাই যাইনি এখনও। আপনারা বাইরে গিয়ে দাঁড়ান আমি আমার গাড়ি নিয়ে আসছি।”
ইমতিয়াজ রহমান আলতো হেসে সোহাকে নিয়ে বাইরে চলে যায়। শানও তার অর্ধপূর্ণ কাজ রেখেই সব গুছিয়ে বেরিয়ে গেলো।
সোহা ইমতিয়াজ রহমানের পাশে দাঁড়িয়ে রয়েছে কিন্তু পাগলের ভয়ে বারবার চারপাশে উঁকিঝুঁকি দিয়ে দেখছে আশেপাশে পাগল আছে কিনা। এর মাঝেই শান তার গাড়ি নিয়ে চলে আসে। ইমতিয়াজ রহমান শানের পাশে বসে পড়লেও সোহার সেদিকে কোনো খেয়াল নেই। সে পাগলকে খুঁজে যাচ্ছে। শান সোহার কাজ দেখে মনে মনে হাসতে থাকে। সোহার ধ্যান ভাঙার জন্য গাড়ির হর্ণ বাজালো শান। সোহা ভয়ে চমকে উঠে। শান এবার মুখ টিপে হাসলো। ইমতিয়াজ রহমান নিশ্বাস ফেলে বলে
” সোহা ! সারারাত এখানেই দাঁড়িয়ে থাকবি ? খেয়াল আছে রাত কয়টা বাজে ? ওদিকে তোর মা কি থেকে কি করে বসে আছে সেটাও জানি না। তাড়াতাড়ি গাড়িতে উঠ।”সোহা তড়িঘড়ি করে গাড়িতে উঠে বসে।
বাড়ির সামনে গাড়ি থামাতেই সোহা চলে গেলো। শানের কথার অর্থমতে বাদরের মতো গান গাইতে গাইতে আর নাচতে নাচতে চলে গিয়েছে। শান প্রচণ্ড বিরক্ত হলো সোহা বাঁদরামি দেখে। ইমতিয়াজ রহমান শানকে কয়েকবার জোড় করলো বাড়িতে আসার জন্য কিন্তু শান উত্তরে বলে
” আংকেল ছুটির দিন সাথে ভাইয়া আর ভাবিকেও নিয়ে আসবো তবে আজ না। আজকে অনেক রাত হয়ে গিয়েছে।” ইমতিয়াজ রহমান আর জোড় করতে পারেননি। শান গাড়ি নিয়ে চলে যেতেই ইমতিয়াজ রহমান বাড়িতে ঢুকলো। ঢুকতেই তার গুনোধর স্ত্রী আর কাজের মেয়ে শষীর মুখোমুখি হলো। রিয়ানা রহমান চিন্তিত হয়ে বলে
” কি গো ! তোমার মেয়ে দেখি নাচতে নাচতে উপরে চলে গেলো। আমার কথার কোনো পাত্তাই দিলো না এই মেয়ে ! আমি যে এতোক্ষণ ধরে চিন্তায় চিন্তায় মরছিলাম সেদিকে কারোর খেয়াল নেই।” ইমতিয়াজ রহমান শান্তভাবে আগে সোফায় গিয়ে বসলো। শষীকে পানি দিতে বলে, স্ত্রীকে উদ্দেশ্য করে বলে
” পাত্তা দেবে কি করে ! তোমার আর তোমার প্রাণপ্রিয় সঙ্গীর কাজকর্ম যে আমাদের বিরক্ত করে তোলে সেই সম্পর্কে সম্পূর্ণ সবই জানো তুমি। তারপরও বারবার কেনো উল্টো পাল্টা কাজ করো ?”
রিয়ানা রহমান শষীর হাত থেকে পানির গ্লাসটা নিয়ে তড়িঘড়ি করে ইমতিয়াজ রহমানের মুখের সামনে ধরে যার ফলে কিছুটা পানি ইমতিয়াজ রহমানের পরনের পাঞ্জাবীতে ছিটে পড়লো। ইমতিয়াজ রহমান কিছু না বলে পানির গ্লাসটা হাতে নিলো। রিয়ানা রহমান উত্তেজিত হয়ে বলে
” কি বলতে চাইছো তুমি ? আমরা দুজন বিরক্ত করি তোমাদের ? এতোবড় কথা ! বাড়িতে পুলিশ এসে স্বামীকে টানতে টানতে নিয়ে গেলো আর আমি চুপচাপ বসে বসে টিভি দেখবো ? আমার মন বলে তো কিছু আছে নাকি ? একটু কাঁদতে পারবো না ?”
ইমতিয়াজ রহমান দীর্ঘ থেকেও দীর্ঘনিশ্বাস ফেললো। এই মহিলাকে কিছু বোঝানো অসাধ্য ব্যাপার বলা যায়। ইমতিয়াজ রহমান কঠিন রূপ ধারণ করে। গম্ভীর গলায় বললো
” পুলিশ আমাকে টানতে টানতে কোথাও নিয়ে যায়নি বুঝেছো ? শান তার থানার এক কনস্টবলকে পাঠিয়েছিলো আমারই জরুরী কাজে। আমি দুদিন আগে যেই FIR করে এসেছিলাম সেটার ব্যাপারে। আমি শষীকে বলে গিয়েছিলাম তোমাকে বলে দিতে। কিন্তু তোমার শীর্ষ তো তোমার মতোই কাজ করবে তাই না ! পুরো কথা না বুঝেই কি না কি বলেছে সেটা তুমিই জানো !” ইমতিয়াজ রহমান তার রুমে চলে যেতেই রিয়ানা রহমান শষীর দিকে অগ্নিদৃষ্টিতে তাকায়। শষী থতমত খেয়ে দাঁড়িয়ে থাকে। রিয়ানা রহমান এমন ভাবে তাকিয়েছে যে শষী আগে, পিছে কোথাও যেতে পারবে না। রিয়ানা রহমান চেঁচিয়ে বলে উঠে
” দাঁড়িয়ে আছিস কেনো মূর্তির মতো ? তোর জন্য আজও কথা শুনতে হলো আমার। বজ্জাত মেয়ে ! কতোবার বলবো তোকে ? আগে পুরো কথা বুঝবি তারপর বলবি। আজ পুরোটা সময় নষ্ট হয়ে গেলো।” শষী মুখ ছোট করে দাঁড়িয়ে থাকে। বারবার একই ভুল হয়ে যায় তার দ্বারা। রিয়ানা রহমান ঘড়ি দেখে বলে
” এই এখনও দাঁড়িয়ে আছিস কেনো ? চল জলদি রান্নাঘরে চল। রাত ১০টা বেজে গিয়েছে এতো ঝামেলায় আর বেশিক্ষণ দেড়ি হলে সবাই না খেয়ে ঘুমিয়ে যাবে।” রিয়ানা রহমান শষীকে নিয়ে রান্নাঘরে ছুটলো।
এদিকে শান খাবার টেবিলে বসে সোহার করা সব কাণ্ডর কথা বললো। একেকজন খাবার রেখে হাসতে ব্যস্ত হয়ে পড়েছে। শান তার খাবার খেয়ে যাচ্ছে শান্তিতে। শাহানাজ বেগম হাসতে হাসতে মুসফিক চৌধুরীর উদ্দেশ্যে বলে
” আচ্ছা সোহাকে কয়েক দিনের জন্য আমাদের বাড়িতে আনা যায় না ! তুমি একটু বেয়াইন সাহেবের সাথে কথা বলে দেখো তো ! মেয়েটা বাড়িটাকে মাথায় তুলে রাখবে সাথে আমাদের নাইসা তো আছেই।”
মুসফিক চৌধুরী মাথা নেড়ে খেতে খেতে বলে
” ঠিকাছে কথা বলে দেখবো। তো ইশান ! আজকে নিউজে দেখলাম গতকাল রাতে নাকি কোথাও বড়সড় এক্সিডেন্ট হয়েছে ! কি খবর সেখানে ?”
ইশান সহ সবাই একসঙ্গে শানের দিকে তাকালো। শানও মুখে খাবার নিয়ে স্তব্ধ হয়ে বসে থাকে। তারপর সরাসরি বাবার দিকে তাকালো। শানের একপাশে সামির আর অন্যপাশে সিমি বসে ছিলো। শানকে চুপচাপ দেখে সিমি কনুই দিয়ে গুঁতো দিতেই শান চমকে উঠে। সবার মুখের দিকে তাকিয়ে দেখে সবাই ইশারায় বলছে কথা বলার জন্য। নিলা নাইসাকে খাইয়ে দিচ্ছিলো ইশানের পাশে এসে ফিসফিস করে বলে
” indirectly ভাবে হলেও আজ প্রথম দিন বাবা তোমার কাজ নিয়ে কথা বলছে। সময় নষ্ট করো না কথা বলো !” শান ঢোক গিলে বলে
” জি, তেমন বড়সড় নয়। তবে বাসের ড্রাইভার ড্রিংক্স করে ছিলো তাই রাতে এমন দুর্ঘটনা ঘটেছে। বেশিরভাগ মানুষ আহত হয়েছে তাদের পাশের হাসপাতালে হসপিটালাইজড করা হয়েছে আর পাঁচজন নিহত হয়েছিলো। ড্রাইভার আপাতত আমাদের থানার জেলে রয়েছে।”
মুসফিক চৌধুরী আর কিছু না বলে খাবার শেষ করে উঠে গেলো। শান হতাশার নিশ্বাস ফেলে।
শাহানাজ বেগম শানকে বললো
” এভাবে চোখ মুখ শুকিয়ে রাখলে হবে নাকি ? তুই তোর কাজ করে যা। তোর বাবা একদিন না একদিন তো বুঝতে পারবে তুইও তার বাকি দুই ছেলের মতোই এক টুকরো হিরে।” শান স্মিত হাসি দিলো। সামির শানের পিঠে জোরেশোরে থাপ্পড় বসিয়ে বলে
” ভালো করে কাজ কর।” শান ভ্রু কুঁচকে বলে
” আগে বল তুই শান্তনা দিচ্ছিস আমাকে নাকি মারছিস?” ইশান হেসে বলে
” তুই যা ভাবছিস সেটাই দিয়েছে তোকে ।” শান রেগে তাকালো সামিরের দিকে কিন্তু মহাশয় পাত্তা না দিয়ে খেতে থাকে।
শাহানাজ বেগম আর মুসফিক চৌধুরীর বড় ছেলে ইশান চৌধুরী এবং নিলা তার স্ত্রী। তাদের তিন বছরের মেয়ে সন্তান নাইসা চৌধুরী সুমি। সামির চৌধুরী মেজো ছেলে আর সিমি তার স্ত্রী। মাত্র আট মাসের একটা নতুন দম্পতি তারা।
শান ছোট ছেলে। ইশান একজন ডক্টর তার নিজস্ব হসপিটাল রয়েছে। সামির বাবার সাথে বিজনেস চালাচ্ছে। মুসফিক চৌধুরীর ইচ্ছে ছিলো তার দুই ছোট ছেলেই তার বিজনেস সামলাবে বা আর্মিতে যোগ দেবে কিন্তু শান নিজের স্বপ্ন পূরণ করতে গিয়ে অজান্তেই নিজের বাবার অপছন্দের তালিকায় যোগ হয়েছে। মুসফিক চৌধুরী সব সময় পুলিশ পেশাটাকে অপছন্দ করে কিন্তু তার ছেলেদের কাছে সেটা অজানা ছিলো। শান পুলিশের চাকড়ি পাওয়ার পর থেকে মুসফিক চৌধুরী তার সঙ্গে কখনো তার কাজ নিয়ে কথা বলেনি।
.
.
চলবে…….