আত্মা পর্ব-০৪

0
139

###আত্মা(৪র্থ পর্ব)
###লাকি রশীদ

বিশাল বাড়ির একপাশে দেয়াল তুলে দেয়া। দেয়ালের ওপাশে একটা পাকা বাড়ি দেখা যাচ্ছে। কিন্তু এখানকার যে বাসা সেটার বেশ জরাজীর্ণ অবস্থা। ভেতরে এখনো ঢুকিনি, উঠোনে এক কিশোর ছাগল নিয়ে দাঁড়িয়ে আছে। বাবা দীঘির ঘাটে নেমে বলছেন, আমার বাবার এতো কষ্টের,
এতো শখের দীঘির এটা কি অবস্থা !!! বেলা প্রায় দেড়টা বাজে। তীব্র রোদে পুড়ে যাচ্ছে যেন সব কিছু। মাহির বলছে, এতো রোদ লাগিয়ে দেখবে বাবা,মা আর বাচ্চারা জ্বর বাধাবে। চলো আল্লাহ আল্লাহ করে ঘরে যাই। উঠোন থেকে একটু দূরে ঘর। আমি চেয়ে দেখি সমস্ত বাড়ির মধ্যে একটা জিনিস ই সুন্দর তা হলো, উঠোনের দুই পাশে কিছুটা ফাক রেখে রেখে অসংখ্য গাছ লাগানো।কৃঞ্চচুড়া, চাঁপা, আমি নাম নাম জানি না এরকম আরো অনেক ফুলের গাছ এতো গরমের মধ্যে স্নিগ্ধ ছায়া দিয়ে দাঁড়িয়ে আছে।

এত গরমে মাথাগরম অবস্থা,এরমধ্যে সমস্যা হল
মাহির ও ড্রাইভার দুপাশে ধরে ধরে বাবাকে নিয়ে যাচ্ছে। ইভানের হাঁটা দেখে সিমিন রহিমার হাত ছেড়ে একা একা হাঁটতে গিয়ে পড়ে গেছে। এখন সে তারস্বরে চেঁচাচ্ছে। এতো সব ঝামেলা দেখে এবার মাহির গজগজ করছে,গ্ৰামের পরিবেশ দেখে মা কবি হয়ে গেছেন। মেয়ে আছাড় খেয়ে পড়ে চিৎকার করছে…….. বাহ্ বেশ ভালো কিন্তু। এখনো তো অনেক কিছু বাকি। “উঠলো বাই তো কটক যাই”………….কারো কোনো কথা বুঝতে বা
শুনতে রাজি না। আমি কিছু না বলে সিমিন কে কোলে নিয়ে হাঁটা শুরু করেছি, রহিমা কে বলেছি মাকে ধরে ধরে নিয়ে আয়‌। হঠাৎ দেখি এক বৃদ্ধ বলছেন,কে রে তোমরা? মাহির সালাম দিতেই বাবা বলছেন, কিরে আমাকে চিনতে পারছিস না ছোটন? এবার বৃদ্ধ দৌড়ে কাছে এসে বলছেন,
ভাইজান !!! এ কি অবস্থা হয়েছে তোমার? দুই বৃদ্ধ একজন আরেকজনের গলা জড়িয়ে ধরে এবার হু হু করে কাঁদতে আছেন।

আমি মাহিরের এতো অস্বস্তির কারণ বেশ ভালো বুঝতে পারছি। এতো বেশি দূরত্ব সৃষ্টি হয়ে গেছে
এবং ভালো অবস্থানে থেকেও এদের প্রতি কিছু না
করার অপরাধবোধে ভুগছে সে। আমার শশুড় এবার আমাকে দেখিয়ে বলছেন, আমার ছোট বৌমা রে। বুঝছিস্ ছোটন ঠিক আমাদের মায়ের মতো আদর ভালোবাসা দিয়ে সমস্ত শরীর ভরা।
ছোট চাচা এবার বলছেন, ভালো আছো তো মা?
আমি মাথা নাড়তেই বললেন,চলো চলো বাড়িতে গিয়ে ফ্যানের নিচে বসলে আরাম পাবে তোমরা।
আমি খেয়াল করে দেখেছি,সবার সাথে কথা বললেও আমার শাশুড়ি কে কিছু বলেননি। ঘরের
বাইরে থেকেই আঙ্গুর আঙ্গুর বলে চিৎকার করে যাচ্ছেন তিনি। এবার টকটকে ফর্সা এক বৃদ্ধা, রোদ পড়ে যার সোনার নাকফুল ও নথ চিকচিক করছে তিনি বের হয়ে মুখে হাসি নিয়ে বলছেন,ও আল্লাহ !!! কারে দেখছি? আজকে আমার ভাগ্য এতো ভালো কি করে হলো? এতো সমাদর দেখে হতবাক মাহির এবার আমার দিকে অবাক দৃষ্টিতে তাকিয়ে আছে।

তিন রুমের টিনের ঘর। প্রথম রুমে ঢুকেই দেখি,
বড় বড় দুটো খাট দুপাশে রাখা। ওখানেই বসলাম আমরা। চাচা কথা না বললেও চাচী দেখলাম মা কে সালাম করে নিয়ে বসাচ্ছেন। বললেন, এখানে বসেন আমি ডাব পাড়াই।মা বলছেন,ব্যস্ত হইও না
তো আঙ্গুর,বসো গল্প করি। উনি এসব না শুনেই মহব্বত আলী বলে চিৎকার করছেন। এবার দেখি খালি গায়ে সেই মহব্বত আলী হাজির। কিচ্ছুক্ষণের মধ্যে একেক জনের হাতে একেকটা ডাবের পানির গ্লাস চলে এসেছে। মহব্বত আলী চাচীর আদেশ মতো ড্রাইভারকে একগ্লাস দিয়ে এসেছেন। চাচী এবার মাহিরের গায়ে মাথায় হাত বুলিয়ে দিয়ে বলছেন,কত্তো বড় হয়ে গেছে মাহির।
মাহির হেসে বলল,না গো চাচী বলেন কত্তো বুড়ো হয়ে গেছি আমি। এবার জিজ্ঞেস করলেন, বৌ কেমন হয়েছে বাপ? তোমায় যত্নআত্তি করে তো?
মাহির হেসে বললো, আমার,আমার বাবা মার সবার যত্ন করে সে। তার কাছে আমাদের ঋণের শেষ নাইগো চাচী। আমি অবাক হয়ে চেয়ে আছি।

চাচী এবার দীর্ঘশ্বাস ফেলে বললেন, তোমার মা বাবার কিসমত ভালো বাপ। জানোই ত আমার ৬ মেয়ের পর এই ১ টাই ছেলে। সবচেয়ে বড় পাস দিয়েও ৮ মাস ধরে চাকরি পাচ্ছে না। আজকে সে
চেয়ারম্যান এর কাছে গেছে,যদি তার ফার্মেসীতে
থাকার কাজ দেয়। মাহির জিজ্ঞেস করলো, তার সাথে ফোন আছে? ফোন থাকলে বলুন, ওখানে না বসে এক্ষুনি এখানে যেন চলে আসে। উনি এবার ব্যস্ত হয়ে ভেতরে চলে গেলেন। ওই খাটে দেখি আমার শশুড় ভাইয়ের সাথে গল্পে মশগুল।
দেখে ভালো লাগছে, মনে হচ্ছে অনেক দিন পর তৃঞ্চার্ত চাতক পাখি যেন পানির দেখা পেয়েছে।

এরমধ্যে শাড়ি পরা হাতে অনেক গুলো খাতা নিয়ে একটা মেয়ে ঢুকেছে। আমার মতোই বয়স হবে বা কিছুটা কমও হতে পারে। চাচা তাকে ডেকে বলছেন, হুমায়রা দেখে যা তোর বড়চাচা এসেছেন। সে কাছে গিয়ে বললো, আমাকে কি চাচা চিনে বাবা? তুমি না বললে আমিও জানতাম না উনি আমার বাবার ভাই আর উনিও জানতেন না আমি তার ভাইয়ের মেয়ে। সুতরাং, নতুন করে সম্পর্ক ঝালাই করতে যেও না বাবা। তাহলে তুমি আগের মতো কষ্টই পাবে শুধু। আমি চাই না, তুমি নতুন কষ্টে জড়াও। ঘরের মধ্যে অস্বস্তিকর এক নীরবতা নেমে এসেছে। চাচী এবার তাকে ধমকে উঠলেন, এই মেয়ে এতো চ্যাটাং চ্যাটাং করে কথা
বলছিস কেন? রক্ত তো রক্ত ই। তোর সাথে তার রক্তের সম্পর্ক। এতো সহজে ছিন্ন হয়ে যায় না কি? এদিকে আয়, তোর চাচী,ভাই ভাবী এখানে বসে আছে। কথা বলে যা তো।

সে এসে সোজা মায়ের সামনে দাঁড়িয়ে সালাম দিয়ে তীক্ষ্ম কন্ঠে বললো, চাচী কি ছিলেন আর কি হয়েছেন। সব বয়সের থাবা চাচী, বুঝলেন? মা
কোনো কথা না বলে মাথা নাড়ছেন। এবার আঙ্গুর
বেগম আবার পরিবেশ রক্ষায় সচেষ্ট হয়ে বললেন
এই মেয়ে বয়স তোর মা বাপের হয় নাই? এ তোর
মাহির ভাই আর ও তোর ভাবী। সালাম দে। মুখে
শ্লেষের হাসি দিয়ে মাহিরকে বলছে,ভালো আছেন
ভাইয়া? মাহির স্পষ্ট স্বরে বলে, আলহামদুলিল্লাহ
তুই ভালো আছিস হুমায়রা? “তুই” শোনে এবার হকচকিয়ে গেল সে। হাসিমুখে বলছে,ভালো।ভাবী
কিভাবে এখানে বসছেন বলেন তো? আমাদের তো এসিও নেই। এতো গরমের মধ্যে আপনি সিদ্ধ হয়ে যাচ্ছেন না? আমি হেসে বলি, না আমার এই
অভ্যাস খুব আছে। বাবার বাড়িতে এসি ছিল না।
এবার চাচী বলছেন, শুনে যাতো হুমায়রা এদিকে।

৫ মিনিট পর চাচী ফিরে এসেছেন, হুমায়রা দেখি
ভেতর থেকে আসেনি এখনো। এদিকে ওদের ভাই
মামুন চেয়ারম্যান এর ওখান থেকে এসে, মাহির এর সাথে গল্প করছে,সার্টিফিকেট দেখাচ্ছে। মা ও চাচী গল্প করছেন,মা একেক জনের নাম বলছেন আর চাচী বর্তমানে তাদের অবস্থান, কর্মকাণ্ড সব বিস্তারিত জানাচ্ছেন। রহিমা উঠোনে গিয়ে গাছের ছায়ায় বাচ্চাদের নিয়ে খেলছে। বাবা ও চাচা যথারীতি গল্পে মশগুল। একমাত্র দলছাড়া দেখা যাচ্ছে আমিই। কি করবো, আল্লাহ আল্লাহ করে ভেতরে ঢুকি। মনে আবার ভয়ও লাগছে, হুমায়রা
ধমকে চলে যেতে বলে নাকি? বললে বলুক,ধমক
খেয়ে খেয়ে তো বছর সাতেক কেটেই গেল। নতুন আর কি এমন মন খারাপ হবে?

পরের রুমে কেউই নেই। সিঙ্গেল একটা খাট, এক টা চেয়ার ও টেবিল ও একটি আলনা পরিপাটি করে রাখা। বুঝাই যাচ্ছে এটা হুমায়রার রুম‌। এর
পরের রুমে একপাশে একটা খাওয়ার টেবিল ও ৬টা চেয়ার এবং অন্যপাশে মাটির চুলা,রান্নাঘরের
সরঞ্জামাদি রাখা। চুলা নীচু হওয়াতে পিড়িতে বসে
হুমায়রা চুলায় পাপড় ভাজছে। অপর চুলায় কি
ঠিক বুঝা যাচ্ছে না। তার ফর্সা মুখ গরমে লাল টকটকে হয়ে গেছে। পাশে দাঁড়িয়ে থাকা মহিলা আমাকে দেখে ব্যস্ত হয়ে বলছে,আরে এই ভাবী আফনে এইহানে আইছেন ক্যান? গরমে বইবেন কি কইরা ? আমি বলি, আপনারা যেভাবে বসছেন সেই ভাবেই বসবো।

হুমায়রা এবার তাকিয়ে ইশারা দিয়ে তাকে বলে,
একটা চেয়ার টেনে দেয়ার জন্য। আমি তার দিকে চেয়ে বলি, চাচী বললেন আপনি নাকি একটা স্কুলে পড়ান। দেখুন তো সারাদিন খেটে খুটে এসে না বলে কয়ে আসা, আমাদের জন্য এখন আবার কি ঝামেলায় পড়ে গেলেন। আমার আসলেই খুব খারাপ লাগছে। হুমায়রা ঝাজরিতে পাপড় তুলছে
আর হেসে হেসে বলছে, বলে কয়ে আসবেন কি করে ভাবী? আপনার শশুড়বাড়ির একটা মানুষও কি আমাদের কারো ফোন নম্বর জানে? তাহলে?
আপনি ভাববেন না, গরীবের এতো সহজে কষ্ট হয় না। তাদের শরীর আল্লাহ কঠিন ধাতুতে তৈরি করে দিয়েছেন। আমি মনে মনে বলি, চুপ করে থাক্ নওশীন। আবার কোন কথার জালে পড়বি।

ঐ মহিলা এবার ওকে বলছেন,আফা চুলা না দিলে মোরগের চামড়ার লোম পুড়ামু ক্যামতে? হুমায়রা চোখ তুলে বললো, তুমি দেখো না মামুন
কতো গুলো খড়ি জমা করে রাখছে। ঐগুলো তে
আগুন ধরিয়ে পুড়াও না কেন? সে চলে যেতেই
আমি উঠে বাসনের ষ্ট্যান্ড থেকে ট্রে নিয়ে এসে সেমাই আর পাপড় তুলে রাখি। হুমায়রা ঘন দুধ
দিয়ে চা বানাচ্ছিলো। হেসে বললো, আপনি কি এসব করেন না কি? শুধু শুধু কষ্ট করছেন। আমি হেসে বলি, করি না মানে? আপনার ভাই রীতিমত
শর্ত দিয়ে বিয়ে করে এনেছে। সে সহ পরিবারের সবার খেয়াল যেন রাখি‌। এবার সে এতো অবাক
হয়েছে যে, আমি দ্বিধায় পড়ে গেছি। চা বানানো বন্ধ করে সেকেন্ড দশেক আমার দিকে তাকিয়ে বললো,বড়চাচীর আসলেই ভাগ্য ভীষণ ভালো। আমরা সবাই ভেবেছিলাম, বুড়ো বয়সে তার অনেক কষ্ট হবে। এখন দেখি ছেলে,বৌ অনেক কেয়ার করছে তাকে। বুঝলেন ভাবী, কোনো কোনো মানুষকে আল্লাহতাআলা দুনিয়াতে এতো
বেহিসাব সৌভাগ্য, শান্তি দিয়ে পাঠিয়েছেন। তারা
দেখবেন খুব কম মানসিক ও শারীরিক কষ্ট পায়।

আমি বুঝি কোনো কারণে এরা মায়ের উপর ভীষণ খেপে আছে। অনেকগুলো কাপে চা ঢালল
সে। এবার বিড়বিড় করে বলছে, আমার মায়ের
কারবার !!! সকালের পাওয়া সব দুধ আমাকে দিয়ে ঘন করিয়েছে। ঘন দুধ ছাড়া নাকি চা মজা হয়না। আরে বাবা, আপনারা কতো মজার মজার খাবার খান। মনে হচ্ছে, এখানে এই মজার চা না
খেলে আপনাদের যেন খুব ক্ষতি হয়ে যাবে। মা
আগেও বোকা ছিল এখনো আছে আর দেখবেন ভবিষ্যতেও থাকবে। কোনো উন্নতি হবে না তার।
চা এর সব কাপ আরেকটা ট্রে তে নিতেই আমি অন্যটা নিয়ে হাঁটা দিলাম। ভয় লাগছে আবার কি
শুনি।পিছন ফিরে দেখি মন্থর পায়ে হেঁটে আসছে।

চাচী একদম হুলস্থুল লাগিয়ে দিয়েছেন। হুমায়রা কে বলছেন, বাচ্চাদের জন্য দুই কাপ দুধ নিয়ে আয়। হুমায়রা এনে টেবিলে রেখে বললো, তুমি একটু শুনে যাওতো মা। চাচী ওর সাথে যেতেই আমি ভাবছি, এই অবস্থার মাঝে মোরগ জবাই দেয়া হয়েছে। এখন আবার ভাতের ব্যবস্থা করতে
কতো ঝক্কি পোহাতে হবে তাদের। বাবা কে সেমাই
ও চা খাইয়ে দিয়ে দেখি, সিমিন চাচীর হাতে দুধ খাচ্ছে আর ইভান তার হাতে খাবে বলে বায়না ধরেছে। এবার মাহিরকে ইশারা দিয়ে উঠোনে নিতেই বলে, বাহ্ নওশীন তোমার তো খুব উন্নতি হয়েছে। কি রকম ইশারা দিয়ে আমাকে বের করে প্রেম করতে এখানে নিয়ে এসেছো !!! আমি বলি, আমার খেয়ে দেয়ে আর কাজ নাই তো তোমার সাথে প্রেম করতে আসবো।

আমি……..বলে কথা শেষ করতে পারিনি বলছে, আজকের যত কাজ ছিল সাগরে ফেলে তোমার সীমানা কতটুকু তা বোঝাতে নিয়ে এসেছি। এর কি কোনো পুরস্কার নেই? আমি মৃদু হেসে বলি,
বেশ তো বলো পুরস্কার কি চাও তুমি? সে বললো,
রাতে কিছু কথা বলবো। তুমি সেটা খুব মন দিয়ে শুনবে। তাহলেই হবে। এখন বলো কি বলতে এসেছিলে? আমি সবকিছু খুলে বলে যোগ করলাম, শেষ সময়ে আসা ঠিক হলো। কিছুই তো এদের জন্য আনলাম না। তুমি কি মাছ বাজারে গিয়ে দেখবে বড়মাছ পাও কিনা? মাহির রাজ্যের বিরক্তি নিয়ে বললো,বেলা বাজে সোয়া দুইটা। এখন মাছ নিয়ে আসতে গেলে বাসায় যাবো কখন? তুমি মোরগ খাওয়া নিয়ে চিন্তা করো না। আমি এমনিতেই চাচী কে বেশ ভালো একটা এমাউন্ট দিয়ে যাবো। এতো কিছুর পরেও তিনি আন্তরিক ভাবে যে ভালবাসা দেখিয়েছেন, তার তো আর দাম হয় না। তবে মনে মনে ঠিক করে রেখেছি এখনো ওদের বলিনি, আমি স্থায়ী ভালো একটা আয়ের উৎস দেখাতে চাই ওদের। কারো মুখাপেক্ষী যাতে ওরা আর না হয়।

রান্নাঘরে ট্রেতে করে খালি বাসন রেখে আসলাম। লাল শাক বাছছে হুমায়রা,আর ঔ মহিলা মশলা বাটছেন। অনেক ধোঁয়া রান্নাঘরে, আমি বসতে চাইলেও এবার হুমায়রা আমাকে আর বসতে দিলো না।

ঘরে ঢুকতেই বাবা বলছেন,ও বৌমা ছোটন না কি
কি সুন্দর সবজি বাগান করছে। চলো তুমি আমি দেখে আসি। আমি কিছু বলার আগেই মাহির বলল, বাইরে অনেক রোদ বাবা। তুমি অনেক কষ্ট পাবে। তোমার বৌমা যাক্, মোবাইলে ফটো তুলে এনে তোমাকে দেখিয়ে দিবে না হয়। কি যেন ভেবে
রাজি হলেন। আমি চাচার সাথে গিয়ে দেখি কতো সুন্দর করে যে সবজি বাগান করা যায়……. এটা
না দেখলে বুঝতে পারতাম না। চাচা উদার মনে বলছেন বলো তো মা তুমি কি কি নিতে চাও? যা যা তোমার পছন্দের সব নিয়ে যাও। ভাইজান আমাকে বলেছে, তুমি না থাকলে নাকি আসাই হতো না তার। একটা পরিবারকে খুশি করতে বা কষ্ট দিতে বৌদের যে অনেক বড় অবদান আছে
……….. আজকে আবার তুমি মনে করিয়ে দিলে।

অনেক বছর আগে তোমার শাশুড়ি সেটা মনে করিয়েছিলেন। তুমি যেভাবে দেখছো সেভাবে আমরা ছিলাম না মা। ভাইজান কঠোর পরিশ্রমের পর যখন সফল হলেন, আমাদের দুই ভাইকে অনেক কিছু করেছেন। আপদে বিপদে সবসময় পাশে থাকতেন। কিন্তু ভাবী কোনো দিনই এসব পছন্দ করতেন না। একবার রেগে গিয়ে খাওয়া বন্ধ করে দিয়েছিলেন। সব সাহায্য বন্ধ করে দিতে চাইলেন। যন্ত্রণা সহ্য করে ভাইজান তারপরও অনেক বছর দেখে গেছেন। এরপর একদিন হয়তো ভেবেছেন নিজের শান্তির জন্য ভাইদের না হয় ছেড়ে দেই। আমাদের কারো সাথে ফোনে কথা বলার তিনি সহ্য করতে পারতেন না। আমার আরেক ভাইয়ের মৃত্যুর পর শেষ দেখা ভাইজান ও তার ছেলেদের সাথে।

তারও অনেক বছর আগে, আমার দ্বিতীয় মেয়ের
বিয়ে ঠিক করে টাকার কথা বলতে বাসায় গিয়ে ছিলাম। ভাইজান বাসায় ছিলেন না,ভাবী অনেক কড়া কড়া কথা শুনিয়ে বিদায় দিয়েছিলেন। খুব বাজে ভাবে বলেছিলেন,বৌ না পালতে না পারলে
………… থাক্ মা বাজে কথায় শুধু দুর্গন্ধই ছড়ায়।
এসব তোমাকে বললাম কারণ তুমি ভাবতে পারো
যতদিন ভাই দিয়েছেন ততদিন আমরা যোগাযোগ রেখেছি মনে হয়। কতোজন মানুষের দিল ঠান্ডা করেছো আজ……. তুমি নিজেও জানো না মা। তুমি তো কি নিবে বলছোই না। আচ্ছা আমি দিয়ে
দিবো, তোমার কষ্ট হচ্ছে দাঁড়াতে চলে এসো।

বের হয়ে দেখালেন,ওই ভাইয়ের অংশ টুকু বিক্রি
করে ছেলেরা শহরে চলে গেছে। মাঝে মাঝে আসে, এটুকুই। দেখো মা মায়ের পেটের তিন ভাই
এর তিন রকম ভাগ্য। তোমার চাচী প্রায়ই বলেন,
মায়ের এতটুক্ পেটে সব বাচ্চার জায়গা হয় কিন্তু সারা দুনিয়ায় হয় না। কথাটা খুব সত্যি রে মা। অনেকবার ভেবেছি ওখানে গিয়ে খাবো না,বসবো না শুধু একবার ভাইজান কে দেখে চলে আসবো।
কিন্তু মন আর সায় দেয়নি। দুই ভাইয়ের মৃত্যুর আগে দুজনে মিলে এতোটা সময় কাটালাম………
এটাই আমার অনেক বড় পাওয়া। তোমাকে এর উত্তম প্রতিদান নিশ্চয়ই আল্লাহতাআলা দিবেন।সম্পর্ক জোড়া লাগানোর সওয়াব বেহিসাব মা। আমি চেয়ে দেখি, চোখের পানিতে দাড়ি ভিজে গেছে চাচার। চিরকালের ইডিয়ট নওশীন তখন
তাকে ধরে কাঁদতে শুরু করেছে।

ঘরে ঢুকতেই দেখি খালি গায়ের মহব্বত আলী ও তার স্ত্রী মোরগের পশম তিনি পুড়িয়েছিলেন সেই ছমিরণ দৌড়াদৌড়ি করে খাওয়ানোর ব্যবস্থা করছেন। চাচী টিউবওয়েল থেকে প্রথমে চেপে চেপে কিছু পানি ফেলে ঠান্ডা পানি আনার জন্য বলছেন। মহব্বত আলীকে বুঝিয়ে বলছেন, কোন গাছ থেকে গন্ধরাজ লেবু ও বোম্বাই মরিচ পেড়ে আনবে। আবার উল্টো পাল্টা যেন না করে।

আমার চোখ আর বশ মানেনি, এতো ভালবাসার স্রোত দেখে অঝোর ধারায় আমার চোখ দিয়ে পানি পড়ছে। মনে হয়েছে খাঁটি মানুষ দেখতে হলে, কেউ গ্ৰামের এই সহজ সরল মানুষ গুলো দেখে যা। চুপ করে বারান্দার এককোণে গিয়ে চোখ মুছতেই দেখি, হুমায়রা পাশে এসে জড়িয়ে ধরে পরম মমতায় জিজ্ঞেস করছে, কি হয়েছে ভাবী? কেউ কিছু বলেছে? এতো কাঁদছেন কেন বলেন ? আমি তাকে কি বলবো বুঝতে না পেরে বললাম, কিছু না। চাচাকে দেখে আমার বাবার কথা মনে পড়ে গেছে। সে “ও আমার আল্লাহ” !!! বলে এবার আমায় আদর করছে।

(চলবে)

একটি উত্তর ত্যাগ

আপনার মন্তব্য লিখুন দয়া করে!
এখানে আপনার নাম লিখুন দয়া করে