আত্মা পর্ব-০২

0
163

###আত্মা(২য় পর্ব)
###লাকি রশীদ

রান্না চড়িয়েছি মাত্র,একতালে কলিংবেল বেজে উঠলো। এরকম বেল শুনলে আমরা বুঝতে পারি লিউনা এসেছে। আমার বড় ভাসুর সাহিলের মেয়ে সে। মনে হয় ঘোড়ায় জিন দিয়ে এসেছে।এক সেকেন্ড অপেক্ষা করতে চায় না। চট্ করে দরজা খুলে দিয়ে বলি, তোর কি জীবনেও বুদ্ধি শুদ্ধি হবে না? দাদা ঘুমিয়েছেন মনে থাকে না? এইবার জিহ্বা তে কামড় দিয়ে বলে,স্যরি নওশীন আমি ভুলে গিয়েছিলাম। আমার নিস্পৃহ ভাব দেখে ও কথা কম বলি দেখে এই বাসার বাচ্চারা আমার খুব একটা কাছে আসে না। কিন্তু লিউনা কে আটকায় কার সাধ্য !!! ক্লাশ নাইনে পড়ুয়া মেয়ে অনেকটা জোর করেই যেন এই জায়গা দখল করে নিয়েছে।

আমি চেয়ে দেখি,কি একটা লো কাটের টপস পরেছে। আর এতো আঁটসাঁট, বলার মতো না।
হাসিমুখে বললাম, কি রে সেদিন না বললাম এসব পরে বাইরে বের হবি না। পরলে শুধু বাসায় পরতে পারিস। এবার হেসে বলল, ভুলে গেছি । আমি মৃদু হেসে বলি, তোর তো বাবার চেয়েও অবস্থা খারাপ রে। যা ই বলছি তা ই ভুলে যাস্। বাসায় গিয়ে একদৌড়ে বদলে আয় তো মা। এবার তার গড়িমসি শুরু হয়েছে। আবার উপরে উঠবো? কথা দিচ্ছি আর এটা পরে বের হবো না। আজকে তেঁতুল ভর্তা করবে না? আমি বলি, তুই খেলে খুব করবো।

প্রেসার কুকারে তড়কা ডাল বসাচ্ছিলাম। দেখে
এখন সে নাড়ার জন্য ব্যস্ত হয়ে পড়েছে। বললাম,
তোর মা যদি জানে তবে আমাকে ভর্তা বানিয়ে দিবে। চতুর্দশী কিশোরী মৃদু হেসে বলল,হ্যা মার তো আর কাজ নাই, সমাজসেবা ছেড়ে আমার খোঁজ নিবে। বাবার কথাই আজকাল শোনে না।
আমি ধমকে উঠি,মা বাবার কথা আড়ি পেতে শুনে বাইরে বলতে হয় না। এবার ফোঁস করে উঠে, বাইরের কাউকে বলিনি তো। তোমাকে শুধু বলেছি। আমি বলি, তবুও। আল্লাহ তাআলা বলে
দিয়েছেন,আড়ি পেতে শুনলে কানে সীসা ঢালা হবে। এসব গোনাহের কাজ করার দরকার টা কি?
এবার বলছে,এসব যে গোনাহ সেটাই তো আমি জানতাম না। মাঝে মাঝে এই মেয়ে একেকটা কথা বলে,ইডিয়ট নওশীন কে নাড়িয়ে দিয়ে যায়।

আমাকে রান্না শেষ করে আবার স্কুলে দৌড়ুতে হবে। বাচ্চারা ছোট বেলা থেকেই আমরা যা খাই তা ই খায়। সবজি ২ পদের, মাছ ভাজা, মাছের তরকারি ও ডাল আজকের আইটেম। মাহির ও তার ছেলের মাছ ভাজা ভীষণ পছন্দের। তেঁতুল ভর্তা খাওয়া চলছে আর চোখ দিয়ে পানি পড়ছে লিউনার। আমি বোম্বাই মরিচ কুচি কুচি করে দেই। প্রচন্ড ঝাল ছাড়া আমার মজা লাগে না। ওর জন্য এটা ছাড়া স্বাভাবিক ঝালে দিয়েছিলাম প্রথম দিন। খায়নি সে,তাই এভাবেই দেই‌।

আমার শাশুড়ি গোসল করে এসেছেন। লিউনাকে দেখেই শুরু হয়েছে, আমাকে বকা। শোনো বৌমা, তোমাকে ওর মা যেদিন এসে কথা শোনাবে সেদিন তোমার শিক্ষা হবে। ওর মা চায় না, আমাদের কারো সাথে তার বাচ্চারা মিশুক। আমি কিছু বলার আগেই, লিউনা উঠে সারেন্ডার এর ভঙ্গিতে বলছে, ঠিক আছে ঠিক আছে আমি চলে যাচ্ছি। নওশীন কে এজন্য বকার কি হলো? মা এবার আমার দিকে তাকিয়ে বললেন, পৃথিবীতে কোথাও কেউ শুনেছে চাচীর নাম ধরে কেউ ডাকে? সে এবার দাদুকে রাগানোর তালে আছে, বলে বলে অনেকেই বলে। তুমি আদ্যিকালের বুড়ি,তুমি কি একালের কিছু জানো? বলেই ধুপধাপ শব্দ করে তেঁতুলের বাটি নিয়ে প্রস্থান।

আমার শাশুড়ি এবার দীর্ঘশ্বাস ফেলে বলছেন,
রাগ করে চলে গেল। আমি বলি, সারাদিন একা একা থাকে। এখানে আসলে হয়তো ওর ভালো লাগে মা। আমার শাশুড়ি বলছেন, তুমি চেনো না।
আমি ওর মাকে হাড়ে হাড়ে চিনি। প্রচন্ড ঝগড়ুটে
সে। আমার ভয় কোনো দিন যদি এসব ঝগড়া হয়
আর মাহিরের কানে যায় তবে কুরুক্ষেত্র বাধাবে।
আমি কোনো কথা না বলে উনার লেবুর শরবত দেই‌। গ্লাসের দিকে তাকিয়ে একমনে বলছেন, কি
একটা ভয় বুকে চেপে আছে বৌমা। বললাম,ভয়
কিসের?

সত্তোরোর্ধ বৃদ্ধা এবার টলটলে চোখে বলছেন,
তোমার উপর এতো নির্ভরশীল হয়েছি যে স্কুলে গেলেও মনে হয় তোমার শশুড় ক্ষেপে গেলে আমি কি করবো? রমুটা চলে এলে এতো ভয় হয়তো বা লাগতো না। আমি বলি,রহমত আলী কে বলে যাচ্ছি নীচে এখানে বসে থাকবে। আপনি দরকার পড়লে ডাক দিয়েন, উপরে চলে যাবে। এবার আরেক শঙ্কা জানাচ্ছেন, ওকে গেটে না দেখলে কেউ যদি রাগ করে মা? আমি হেসে বলি, বাড়ির কর্তা যে এই সবকিছু বানিয়েছেন, ছেলেরা শুধু তৈরি পেয়েছে……… তাকে দেখার চেয়েও গেট দেখা তো জরুরি নয় মা। এতো ভাববেন না।

রহমত আলীকে সবকিছু বুঝিয়ে বড়গেট লক্ করে চলে যেতে বলি। গাড়ি চলছে, এতোক্ষণ গরমে থেকে এসির ঠাণ্ডা হাওয়ায় ভাবছি, এই যে এতো এতো কষ্ট করে আমাদের বাচ্চাদের বড় করা, আবদার সব মেটানো……….. কয়েকটি বছর একই বৃত্তে ওদের নিয়ে আবদ্ধ থেকে,বয়স হলে ওদের সাথে ই ভয়ে ভয়ে কথা বলতে হবে? বাড়ির বৃদ্ধ হর্তাকর্তা পড়ে যাওয়ার চেয়েও অন্যেরা গাড়ি সময়মতো ঢুকাতে না পারলে যদি ভীষণ রাগ করে………বাড়ির বৃদ্ধা কত্রীকে সেটাও ভাবতে হবে। অথচ এই বাচ্চাদের বাইরে কতো বোলচাল। কতো মানুষ এদেরকে সভ্য,ভব্য মনে করে।আমার বড়মামী ঠিকই বলতেন, নিজের পশমও আপন না রে মা। তখন বুঝতাম না, এখন ঠিকই বুঝি।

আমার শশুড় কে এতো ভালবাসার কারণ,আমার
বাবার সাথে যেন মিল খুঁজে পাই। অথচ দেখতে বা আচার আচরণে দুজন সম্পুর্ন বিপরীত চরিত্রের মানুষ। আমার বাবার গায়ের রং শ্যামলা
আর শশুড়ের গায়ের রং ধবধবে ফর্সা। আমার শশুড় ভীষণ আমুদে স্বভাবের আর বাবা ভীষণ রাশভারী। তারপরও দুজন ই শশ্রুমন্ডিত বলেই হয়তো বা আমার অবচেতন মনে এ ভাবনা কাজ করে। স্কুলের গেটে অভিভাবকদের ভিড় জমেছে।
ছুটির এখনো ১০ মিনিট বাকি। দাঁড়িয়ে আছি হঠাৎ সুমনা ভাবী জড়িয়ে ধরে বলছেন, আমার আজ ভাগ্য ভীষণ ভালো বলতে হবে। এতো কাছে থেকেও আমাকে তো আপনার দেখতে মন চায় না। আমি হেসে বলি, আমার ভাই সারাদিন দেখে,
আদর যত্ন করে……… তারপরও আমি দেখি না বলে আফসোস !!!

সুমনা ভাবীর স্বামী ভীষণ স্ত্রী পাগল সেটা সবাই জানে। কিন্তু, জীবনে একটা না একটা অপূর্ণতা তো থাকবেই। উনার কোনো বাচ্চা নেই। বাচ্চাদের
ভদ্রমহিলা এতো ভালবাসেন যে বলার মতো না। আমার মতোই শশুড় শাশুড়ি নিয়ে থাকেন। ছোট দেবর ও জা ডাক্তার। ওদের দুইটা বাচ্চাকে নিয়ে যেতে আসেন মাঝে মাঝে। আমাদের পাড়ায় ৩/৪
টা বাড়ির পেছনেই উনাদের বাসা। আরেক দেবর
ইংল্যান্ড এ পরিবার নিয়ে থাকে। দেখতে এতো সুন্দর ভদ্রমহিলা,যেন একটা স্নিগ্ধরুপ চারপাশে বিরাজ করে। ডাক্তারী পরীক্ষা শেষে যখন বুঝা যায় প্রবলেমটা উনার স্বামীর, তখন ভাইয়েরা নিয়ে যেতে চায়। নিশ্চিত উনারো সায় ছিল, নয়ত
ভাইয়েরা বলতো না।

তখন তার স্বামী অস্থির হয়ে গিয়েছিলেন। আমার শশুড়, শাশুড়ি কে ভাবীর শাশুড়ি খবর দিয়ে নিয়ে বলেছেন, আমার ছেলে ওকে ছাড়া পাগল হয়ে যাবে। আপনারা ভাইদের সাথে কথা বলে দেখেন, কি করলে ওকে এখানে রেখে যাবে ওরা। আমার বিবেচক শশুড় না কি তখন বলেছিলেন, ভাবী তার ভাইদের আগে তাকে জিজ্ঞেস করা উচিত। জীবন তো ওর, ডিসিশন নেবার মতো যথেষ্ট বয়স হয়েছে ওর। উনার শাশুড়ি তখন বলেছেন, ওর হাতে ধরে বুঝিয়েছি। ও যাবে না বলেছে। আমার শশুড তখন না কি বলেছেন,
ওকে আমার সামনে এসে বলতে বলুন। মানুষকে জোর করে কিছু করানো ঠিক নয় ভাবী। এসব আমার শাশুড়ি গল্প করতে করতে আমায় বলে ছিলেন।

ভাবী আসতেই বাবা চেয়ারে বসতে বলে জিজ্ঞেস করলেন, তুমি কি করতে চাও মা। শোনো কারো জোরাজুরিতে কিছু বলতে হবে না। শুধু তোমার নিজের ইচ্ছা টা আমায় বলো। উনি বললেন,
আমি থাকবো চাচা। তবে আমার ভাইদের মতামত আপনাদের শুনতে হবে। পরের শুক্রবার ভাইরা দাবি জানালো, বাচ্চাকাচ্চা নেই। স্বামীর কিছু হলে শশুড়বাড়ি তাদের বোনকে লাথি মেরে বের করে দিবে। তাই বাসার জায়গার অর্ধেক তাদের বোনকে রেজিষ্ট্রি করে দিতে হবে। সুমনা ভাবীর স্বামী আফজাল ভাই তাতেও রাজি। বাবা তখন বললেন,সম্পত্তি তো তিন ভাইয়ের। আগে তাদের সাথে তুমি কথা বলে দেখো। ডিসিশন নিলে তাদেরকে জানাবে। ভাইরা কেউই রাজি হননি। পরে তাদের মা কান্নাকাটি করে অনুমতি আদায় করেছেন। রেজিস্ট্রি করে তাকে বাসার অর্ধেক লিখে দেয়া হয়। বাবা না কি মাকে বলে ছিলেন, সবকিছু সুমনার ইচ্ছেমতো হয়েছে। কিন্তু দেখাতে চেয়েছে ভাইয়েরা করেছে। এখানে এতো লুকোচুরির কি আছে, বুঝলাম না তো আমি।

আর মাহির তো উনাকে দেখতেই পারে না। কথা প্রসঙ্গে উনার কথা উঠলেই বলে,খবরদার নওশীন
এই ভদ্রমহিলার সাথে দেখা হলে বেশি কথা বলো না। এতো চালাক উনি আর যতো দুর্বুদ্ধি উনার মনে আছে……… সব তোমাকে শিখিয়ে দিবেন। কিন্তু আমার উনাকে ভীষণ ভালো লাগে। আমুদে একজন মানুষ, খুব সুন্দর করে উনি কথা বলতে পারেন। আমি তো খারাপ কিছু দেখিনা। আমার কথার জবাব দিতে হাস্যমুখ করে বলেন, আপনার ভাই তার ভাগের আদর দেয়। তাই বলে আপনি আমাকে দেখতে বাসায় যাবেন না মোটেই? বলি,
ঠিক আছে একদিন সময় করে যাবো। ওইটা ই তো সমস্যা,টাইম ই পাই না সারাদিন। এই ১০ মিনিট দুজনে গল্প করতে করতে কাটালাম।

বাচ্চাদের নিয়ে গাড়িতে উঠতেই ইভান বায়না ধরেছে আইসক্রীম খাবে। আমি বলি, চুপচাপ বসে থাকো। ইনশাআল্লাহ পরে তোমায় খাওয়াব।
সে জেদ করতেই বললাম,বুঝো না দাদা দাদু একা আছে। এবার গাল ফুলিয়ে বসে আছে সে। আমি পাত্তা দেইনি। গেটের সামনে এসে দেখি,২ ভাবীর গাড়ি বাইরে দাঁড়িয়ে আছে। মনে মনে ভাবছি,
হায়রে !!! আজকেই তোমাদের সময়মতো আসতে
হলো। বাচ্চাসহ ভেতরে ঢুকে ড্রাইভারকে বলি,
আপনি আপনার স্যারের ওখানে চলে যান।

আমি ভেবেছিলাম দুই ভাবী হয়তো ঝগড়া করতে দাঁড়িয়ে আছেন। না কেউ নেই,দেখেই খুব শান্তি
লাগছে। কিন্তু বাসায় ঢুকতেই রহমত আলী ডেকে
বললো, সর্বনাশ হইছে মামী। কি হয়েছে জিজ্ঞেস করতেই হড়বড় করে বলে যাচ্ছে। আমি তো আর বুঝিনি এই মিনিট পঞ্চাশে কতো ঘটনা যে ঘটে যাবে। বলছে,আফনে যাওনের একটু পরেই তো মাইঝ্যা মামী আইছে। হর্ণ দিতাছে সমানে, তারপর আমারে ফোন দিসে। আমি কইছি,ছোট মামী এই
হানে বইতে কইয়্যা গেছে।সাথে সাথে গাল পাড়ছে
“হারামজাদা তোর চাকরি যদি আজকে না খাই”।
মামী আমি গরীব মানুষ, চাকরি গেলে খামু কি?
বললাম, বললাম তো তোমার চাকরি যাবে না।
শুধু কেউ কিছু বললে জবাব দিতে যেও না, মাথা গরম করো না। বাকিটা ইনশাআল্লাহ আমি দেখবো তো বললাম। তোমাকে চিন্তা করতে হবে না। এখন গিয়ে তুমি বড়গেট খুলে গাড়ি দুটো ভেতরে ঢুকাও তো। সে মাথা নেড়ে নেড়ে চলে যাচ্ছে। বুঝাই যাচ্ছে ভীষণ চিন্তায় আছে সে।

সবসময় নিরুপদ্রব থাকার পক্ষপাতী এই আমি, কেন যেন আজ এসব করতে মোটেও ভয় লাগছে না। আমি বেশ বুঝতে পারছি, আমার শাশুড়ির চোখের জল দেখে এরকমটা হয়েছে। ভীষণ ভাবে দেউলিয়া একজন মানুষ ই মনে হয় অন্য একজন দেউলিয়া কে চিনতে পারে। নিজেদের ব্যবসা বলে মাহির ৬টার মধ্যেই চলে আসে। ও এলে তারপর আমরা সবাই মিলে চা নাস্তা করি। আজ গোসল
সেরে বের হতেই দুই ভাবী ও মেজভাই চলে এসে
ছেন। আমি এখনো মাহির কে কিছু বলিনি। ভেবে ছিলাম চা খাওয়ার পর ধীরে সুস্থে বলবো। কিন্তু বলার আগেই এরা এসে হাজির।

এসেই মেজভাই চিৎকার করছেন, কিরে তুই তোর বৌয়ের কাছে শুনেছিস নিশ্চয়ই সবকিছু। মাহির বুঝতে পারছে কিচ্ছু একটা ঝামেলা হয়েছে। সে মুখে বিদ্রুপের হাসি নিয়ে বললো, না কিছু তো শুনিনি। এই ব্যাপারে আমার বৌ আবার তোমার বৌয়ের চেয়ে অনেক পিছিয়ে আছে। মেজভাবীর মতো স্বামী ঘরে এলেই, সত্য মিথ্যা দিয়ে মুড়ে রাখা সারাদিনের সংসারের সব ঘটনা বলে না সে। এবার মেজভাই চেঁচিয়ে উঠেছেন,বড়ভাবী ও তোর ভাবী একঘন্টা গাড়ি বাইরে রেখেছে। কোন দেশে দারোয়ান কে ঘরের কাজের জন্য এনে বসিয়ে রাখা হয়? এটা তো শ্রেফ একটা দুষ্টামি।

এবার মাহির আমার দিকে অবাক দৃষ্টিতে তাকাতে
ই আমি স্পষ্টস্বরে বলি, আমি স্কুলে যাওয়ার সময় মা ভয় পাচ্ছিলেন, রমুও নেই। বাবা ক্ষেপে গেলে তিনি সামলাতে পারবেন কি না। তখন আমি রহমত আলী কে বড়গেট লক করে এখানে আসতে বলি। সাহায্য লাগলে মা ডাকার সাথে সাথেই যেন হাজির হতে পারে। আমি ওদের নিয়ে স্কুল থেকে ফিরে আসতে আসতে ৫০ মিনিট সময় গেছে। ইতিমধ্যে ভাবীরা আসায় তাদের গাড়ি বাইরে ছিল। এই হচ্ছে মূল ঘটনা।

ইডিয়ট মেজভাই বলছেন,মার এতো ভয় পাবার কি আছে? এটুকু বুদ্ধি নেই যে, দারোয়ান কে এসব কাজে লাগাতে হয় না। আমি আগের মতোই পরিষ্কার গলায় বলি, মা সেটা আমাকে বলেছিলেন। কিন্তু আমার মনে হয়েছে, বাড়ির কর্তার চেয়ে অন্য কোনো কাজ ই ইম্পোর্টেন্ট নয়। তাই এ ব্যাবস্থা করে গেছি। এবার কান পাতলা মেজভাই চুপ। আমি তাদের ৩ জনের দিকে এবার তাকিয়ে বলি,বসুন আপনারা চা খেয়ে যাবেন। এবার মেজভাই বলছেন, না না ঠিক আছে। সারাদিনে এসেছে,মাহির কে তুমি চা দাও।

ওরা বের হয়ে যেতেই আমার শাশুড়ি এসে বসেছেন। বুঝাই যাচ্ছে ইচ্ছে করেই এতোক্ষণ সামনে আসেননি। মাহির একটা চেয়ারে বসে বলে, দশটা কথা জিজ্ঞেস করলে একটা উত্তর আসে আর এখন নেত্রীগিরি শুরু করেছো নাকি?
আসার সাথে সাথেই আমাকে এটা বললে কি হতো? আমি রান্নাঘরে যাবার জন্য পা বাড়াতেই বললো, কি হলো কথা শোনো না? আগে আমার কথার জবাব দিয়ে যাও। এতো সব কান্ড ঘটানোর আগে, আমাকে একটা ফোন দিলেই তো হতো। আমি কিছু বলে গেলে এরা কি বিচার দিতে এখন আসতে আসতে পারতো? আমি বলি, সবেমাত্র তো তুমি গেছো তাই আর বলিনি। মাহির কিছু বলার আগেই আমার শাশুড়ি কান্না করতে করতে বলছেন, নিজের পেটের বাচ্চারা যা বুঝেনি এই মেয়েটা তা বূঝে করছে। বাবা পড়ে গেলে সমস্যা নেই কিন্তু ঘন্টাখানেক গাড়ি বাইরে থাকলে সমস্যা আছে। ওকে এখন বকে আমাকে আর ধুলোয় মিশিয়ে দিস্ না। আমি মাহির কে বলি,বাবা কে ধরে ধরে নিয়ে আসো। আমি চা নাস্তা দিচ্ছি।

সবসময় শক্ত খাবার খেতে পছন্দ করা আমার শশুড় এখন নরম সবকিছু খান। সাগু, সেমাই, লাচ্ছা সেমাই,পায়েস,পাতলা খিচুড়ি…….এসবই তার খাবার। আজ একসাথে সবার জন্যই করেছি
বেশি দুধ দিয়ে বানানো সেমাই। মাহির বাটিতে নিয়ে চামচ দিয়ে মুখে তুলে খাওয়াচ্ছে। বাবাও বাধ্য ছেলের খাচ্ছেন।আমার শাশুড়ির ডায়বেটিস
বলে নোনতা বিস্কুট দিয়ে খাচ্ছেন। হঠাৎ বাবা বলে উঠলেন, গাড়ি রেডি তো মা? এই আসমা আমাদের কাপড় চোপড় ব্যাগে ভরেছো? মাহির শোনেও কিছু বলছে না কারণ তিনি প্রায়ই এসব বলেন।

আমি মনে মনে ভাবছি,এক ঝড় শেষ না হতেই হতেই আবার অন্য ঝড় শুরু হবে না কি? কিন্তু বৃদ্ধ মানুষ টাকে কথা দিয়েছিলাম, কালকে
তার দীঘিওয়ালা বাড়িতে নিয়ে যাবো। তার বাবার তৈরি মোকাম্মেল মাষ্টারের বাড়ি নিয়ে যাবো‌। এটা শুনে কি অপরিসীম তৃপ্তিতে অনেকক্ষণ ঘুমিয়ে উঠেছেন। এবার পিছন ফিরি কিভাবে? আবেগে
কথা দিয়ে এখন মনে হচ্ছে,পরশু বললাম না কেন? কালকে তো অনডে। কিন্তু, গোয়ার মাহির কে ম্যানেজ করবো কিভাবে? বেশ ভালো দুর্ভোগে পড়লাম মনে হচ্ছে।

মেয়েকে নীচু গলায় গল্প বলে বলে খাওয়াচ্ছি। হঠাৎ মনে হলো,কি এক অর্থহীন বৃত্তে ঘুরপাক খাচ্ছি শুধু আমি। আমার এসব আর ভালো লাগে না। এতো ভালো বৌমা সেজে, ভালো বৌ সেজে, ভালো মা সেজে থাকতে মোটেও ইচ্ছে করছে না। একটানে সব আবরণ ছিড়ে দূর কোথাও চলে যেতে মন চাইছে। মনে হচ্ছে স্কুল জীবনের টিফিন টাইমের ঘন্টা বাজুক, কাগজের মধ্যে ঝাল চালতার আচার মাখা কিনে এনে খাবো। তারপর অকারণে হি হি করে বন্ধুরা সবাই হাসতে হাসতে কলের পাড়ে হাত ধুতে যাবো। কিন্তু কল্পনায়ও সেই শান্তিরাজ্যে ঢোকার সব দরজা তো আমার বাবা মা রীতিমতো বন্ধ করে দিয়েছেন।

সিমিন কে ট্যিসু দিয়ে মুখ মুছিয়ে নামাতেই, মাহির বলছে সবকিছু রেখে চা খাও আগে। ঠান্ডা হয়ে যাবে। আমার চা খেতে খেতে মনে হয়,ধ্যাত এতো এতো চিন্তা না করে বলে দিলেই তো হয়। ইভান এর সাথে খোশগল্প রত মাহির এর দিকে তাকিয়ে এবার ধুম করে বলে উঠি, আগামীকাল কিন্তু মা ও আমি বাবাকে নিয়ে তোমাদের বাড়িতে যাচ্ছি।

(চলবে)

একটি উত্তর ত্যাগ

আপনার মন্তব্য লিখুন দয়া করে!
এখানে আপনার নাম লিখুন দয়া করে