আত্মা পর্ব-০১

0
197

###আত্মা(১ম পর্ব)
###লাকি রশীদ

রাতে চুলে তেল দিয়ে রেখেছিলাম। তারিন এক মাস আগে হারবাল তেল নিয়ে এসেছে। অনেক বার দিতেও বলেছে। মাথায় তেল দিলে আমার প্রচন্ড গরম লাগে। সারা রাত গা যেন কেমন এক টা খিতখিত করে। মাস দুয়েক আগে জোর করে দিয়ে গেছে তারিন,সেও নাকি এটা ব্যবহার করে খুব উপকার পেয়েছে। বেসরকারি এক মোবাইল কোম্পানির উঁচু পদে আসীন তারিন আফসোস করে শেষ, এতো সুন্দর ঘন লম্বা চুল তোর আপু।
একটু যত্ন করলে কি হয়? কি রে দিবি তো? রাতে চুলের গোড়ায় ঘষে ঘষে লাগাবি, সকালে শ্যাম্পু করে ফেলবি। আমি তখন বলেছি, দিবো না কেন?
রেখে যা। গতকাল ফোনে জিজ্ঞেস করেছে, আপু সত্যি কথা বলতো তেলটা মাথায় লাগিয়ে ছিলি? আমি বলি,আজ রাতে লাগাবো ইনশাআল্লাহ। কতোক্ষণ চেঁচামেচি করেছে,আর লাগাবি !!! কাল
সকালে আমি আবার ফোন দিয়ে জানবো কিন্তু।

আমার এসব ভীষণ বিরক্ত লাগে। তেল বাটিতে ঢালো, মাইক্রোওয়েভে গরম করো তারপর ঘষে ঘষে লাগাও। অসুস্থ শশুড় শাশুড়ি, ছোট দুটি বাচ্চা নিয়ে ই সারাটা দিন পাগলের মতো শেষ হয়। বিয়ের প্রথম দিকে অসংসারি, সবকিছু তেই অনভিজ্ঞ নওশীন কম গাল খায়নি। কিচ্ছু পারতো না, তখন বিশেষ করে মাহির সর্বক্ষণ রেগে থাকত
আর কথায় কথায় বলতো, সবকিছু ক্লিয়ারকাট কথা বার্তা বলেই তো বিয়ে করলাম। তখন তো তোমার বাবা মা শুধু বলেছেন, আমার মেয়ে সব কিছু সামলাতে পারবে। তুমিও তাই বলেছো।এখন তো আমি দেখি,সব কাজেই তুমি অষ্টরম্ভা।

কথাটা অবশ্য সে ভুল বলেনি। আমার বড় খালুর
বন্ধু হলেন আমার শশুড়। বড় খালু যেদিন সম্বন্ধ আনেন সেদিন আমার মনে আছে, আমি অনার্স সেকেন্ড ইয়ারের প্রথম ক্লাশ করে এসেছি। তারিন মাত্র একই ভার্সিটিতে ভর্তি হয়েছে। খালু মাকে বলছেন, চৌধুরী এন্ড সন্স এর ছোট ছেলের জন্য তোমার মেয়ের বিয়ের প্রস্তাব এনেছি। ছেলের বাবার সাথে আমার ৩০ বছরের বন্ধুত্বপূর্ণ সম্পর্ক। খুব ই ভালো মানুষ। দু দুটো চালু ইন্ডাষ্ট্রি। ছেলের একটা বোন শুধু বিয়ের বাকি। শশুড়, শাশুড়ি ও স্বামী নিয়ে বড়লোকের ঘরে তোমার মেয়ে খুব সুখে থাকবে। মা তো শুনে খুশিতে ডগমগ। বাবা শুধু বললো, এতো লাফানোর দরকার নেই আগে
খবর নিয়ে দেখি। পরবর্তী ৫দিন আমি শুধু মনে মনে দোয়া করছি, এই বিয়ে যেন না হয়। তারিন বলেছে, এতো চিন্তা করিস কেন? বিয়ে না করার কতো উপায় আছে।

মাহির দের মতো এতো টা না হলেও আমাদের আর্থিক অবস্থাও অনেক ভালো ছিল। ওদের মতো বাবাও ব্যবসায়ী ছিল। পাথরের ব্যবসা, ২টা বড় গ্ৰোসারি শপ্ ও শহরের উপকণ্ঠে ভালো ১টা চালু রেষ্টুরেন্ট ছিল। আমার ৬ ভাই, বাবা ৪ জন কে নিয়ে ব্যবসা দেখতো। বাকি দুজন পরিবার নিয়ে প্রবাসে স্থায়ী ভাবে বসবাসরত। বড় বোন দুজনও প্রবাসী। একজন অষ্ট্রেলিয়া ও একজন কানাডাতে থাকে। সুতরাং এক্ষুনি বিয়ে না দিলে যে, খুব সমস্যায় পড়বে এই পরিবার…………. তা
কিন্তু না। ৫ দিন পর বাবা বলল,সব খবর ভালো।
শুধু লেখাপড়ার চর্চাটা এদের কম। ছোট ২টা ছেলে মেয়ে ছাড়া আর কেউ ভার্সিটিতে যায়নি। আমাদের দরকার হলো, ছেলের সমন্ধে জানা।
আমি খোঁজ নিয়েছি ভদ্র ছেলে। বয়সও কম,মাত্র
মাষ্টার্স ফাইনাল দিলো। তবুও পরশু পরিবারের কিছু সদস্য কে নিয়ে আসবে। সামনাসামনি দেখা হবে। আমি ওদের ডিনারের দাওয়াত দিয়েছি।

সেই মুহূর্তে কে যেন ভেতর থেকে বলছে, বাবাকে বলে দেখ। মানতেও তো পারে তোর কথা। কাতর
স্বরে বলি, আমি এখন বিয়ে করবো না বাবা। ৪টা বছর সময় দাও,এর মধ্যে অনার্স শেষ হয়ে যাবে ইনশাআল্লাহ। প্লিজ বাবা, আমার কথা টা রাখো।
বাবা বললো, কালকে সকালে এটা নিয়ে কথা বলবো। পরদিন রুমে ডেকে নিয়ে বললো, আমার শরীর ভালো যাচ্ছে না। বাবার হাতে বিয়ে আর ভাইয়ের হাতে বিয়ে তে অনেক পার্থক্য আছে মা। আমি চাই, কালকে ওদেরকে উল্টোপাল্টা কিছু যেন বলা না হয়। তুমি এটা কথা দাও আমাকে। কেন যেন সেই মুহূর্তে মনে হয়,এইসব কিছুর পেছনে আমার মা ই কলকাঠি নাড়ছেন। অদ্ভুত এক অভিমানে পুড়ছে হৃদয়। বাবা হাত বাড়িয়ে দিয়েছে, হাত ধরে অস্ফুটে শুধু বলি “ঠিক আছে বাবা”।

পরদিন সন্ধ্যায় মাহির তার বাবা,মা ও বোনকে নিয়ে আসে। ভাবীকে না কি আগেই বলেছিল, আমার সাথে একা কিছুক্ষণ কথা বলতে চায়। প্রথমে অনেকক্ষণ কি করি,কি পড়ি,হবি কি এসব বলে হঠাৎ বললো, আপনাকে আগে থেকেই বলা ভালো আমার বাবা মা আমাদের মানুষ করতে অনেক কষ্ট করেছেন। কিন্তু বিনিময়ে আমরা কিছু ই উনাদের দিতে পারিনি। আমাদের বাসায় কিন্তু সহকারী ৩/৪ জন আছে। কিন্তু আমি চাই, আমার যে বৌ হবে সে আমার প্যারেন্টস কে একটু যত্ন করুক। একটু খেয়াল করে রান্না করে খাওয়াক।
ঔষধ টা টাইম মতো দুজনকে দিক। সবচেয়ে বড় কথা হলো,এরা অথর্ব নয়। বাবা এখনো কাজে যায়‌। আমি জাষ্ট উনাদের একটু খুশি করতে চাই। আপনি যদি এগুলো তে রাজি থাকেন এবং পড়া শোনার ইতি ঘটাতে চান………..তবেই এই বিয়ে হবে। আর যদি ভাবেন, বিয়ে না করে মেইড রাখলেই তো পারে…………. তাও বলতে পারেন। মোটকথা, আগে থেকেই আমার অবস্থান, চাওয়া ক্লিয়ার করছি। যতবারই কিছু বলবো ভেবেছি, বাবার হাত ধরে কথা দেয়াটা মনে পড়েছে। তারিন কতো উপায় দেখালো, কিন্তু বুরবক নওশীন কিচ্ছুই করতে পারলো না। হয়ে গেল তার বিয়ে।

তখন আমার ননদ মাহা ভার্সিটিতে পড়ে ও তার
বিয়ে হয়নি। বকা শুনে ও মাহির কে বলে,একটু সময় দে ছোট ভাইয়া। ২০ বছরের একটা মেয়ের কাছে তুই কিভাবে এতো এতো কিছু আশা করিস বলতো? অনেক পরে আমার শাশুড়ি একবার বলেছিলেন,নরম মাটিতে আঁচড়াতে খুব সুখ বলে এরকম করছিস। কথায় কথায় ও যদি ফোঁস করে উঠতো তবে বুঝতি। শর্ট টেম্পারড্ মাহির দাঁতে দাঁত চেপে বলতো, এতো বেশি বেশি করো না তো মা। তাহলে,তোমার বড় ৩ বৌমার মতো নওশীনও হবে। দয়া করে মা মেয়ে দয়ার প্রতিমা বনে যেও না। আমি প্রতারণা করে বিয়ে করিনি, সহকারী আছে তবু বাবা ও তুমি নয়টার মধ্যে নাস্তা খেয়ে ঔষধ না খেলে আমি অশান্তি করবোই। এটা দয়া করে সবার মাথায় গেঁথে নাও।

এই ঘটনার দুদিন পরেই, বিকেলে আমার শশুড় শাশুড়ি কে চা খাইয়ে দিয়ে ছাদে উঠেছি। ছাদটা দারোয়ান ঝকঝকে পরিস্কার করে রাখে। এক কোণে বসে রেলিং এর খাজকাটা অংশ দিয়ে,
বাইরের পৃথিবী দেখছি আর কেঁদে বুক ভাসাচ্ছি। হঠাৎ কারো হাতের স্পর্শে কেঁপে উঠে দেখি,মাহা বলছে কেঁদো না ভাবী। আসলে ছোট ভাইয়া কিন্তু মানুষ খারাপ না। বড় ভাবীদের দুর্ব্যবহার দেখে দেখে এমন করছে আসলে। না হয় মাষ্টার্স দিয়ে ই কেউ বিয়ের জন্য পাগল হয়ে যায়? আর তুমি তো জানো ই আমাদের পরিবারে লেখাপড়ার চর্চা কম‌। বাবার অপরিসীম কষ্টে গড়া দুটো ইন্ডাষ্ট্রি ই
৪ ভাই মিলে চালাচ্ছে। বাবা মাকে শেষবয়সে একটু আরাম দেয়াই তার মুখ্য উদ্দেশ্য, কিন্তু পথটা যে ঠিক নয় সেটা সে পরে বুঝবে। তুমিও কিন্তু অনেক বোকা আছো। রাতে বলতে পারোনা,
এতো জ্বালালে আর সময়মতো ঘুমাতে না দিলে আমি সকালে উঠে এসব করতে পারবো না? এক
দিন বললেই দেখতে ঠিক হয়ে যেতো। সবসময় বোবা হয়ে থাকলে সংসারে বাঁচা খুব ই কঠিন।

তারপর একে একে সাতটা বসন্ত চলে গেছে। নওশীন দ্বায়িত্বজ্ঞান সম্পন্ন হয়েছে, সাংসারিক কাজে পটু হয়েছে। কাজেকর্মে খুঁত ধরার উপায় ই
নেই। শুধু বাবা,মা আর মাহিরের উপর অভিমান জমে জমে কথা বলতে ইচ্ছে করে না। বাধ্য না হলে মুখই খুলে না। সে এখন খুশি না রাগ তার ছাপ মুখে আনেই না বলতে গেলে। এখন আবার কথা বলেনা কেন, সে দুঃখ করলে আদৌও কি লাভ হবে কখনো?

সকালে উঠে ইভান চুপচাপ খেয়ে নিলেও সিমিন ভীষণ যন্ত্রণা করে। তার একঘেয়ে লাগবে না বলে একদিন কর্ণফ্লেকস তো একদিন দুধের সাথে ব্রেড
বাটার দেই। মাঝে মাঝে শরীর ভালো থাকলে আমার শ্বশুরও একসাথে খান‌। উনার খাওয়া দেখে দুধচিড়েও খেতে চায়। কিন্তু সারকথা হলো,
কিছুই খায় না। মুখে পুরে বসে থাকে। চিবোতে বললে রাগী একটি দৃষ্টি দিয়ে চুপচাপ বসে থাকে। আমার শাশুড়ি বলেন, বেশি বেশি আদর করে করে বাঁদর বানাচ্ছো। শোনো বৌমা যদি আমাদের সময়ের মতো সকালে উঠে দেখতো,ভাত আর আলুভর্তা দিয়ে খেয়ে পাঠশালা তে দৌড়ুতে হবে,
তবে দেখতে এসব সোনামুখ করে খেয়ে নিতো।
আমি যথারীতি জবাব না দিলেও মাহির হাসিমুখে বলে, শুধু শুধু সকালে উঠেই আমার মেয়েটাকে বকা দিও না তো মা। মা তখন ছেলের দিকে এক দৃষ্টিতে তাকিয়ে বলেন,আর মাটা যে এখনো মুখে কুটোটি কাটেনি…….সে হিসেব আছে নাকি তোর?

সেলিমা ওর মেয়ের কাছে কাল গেছে,একা হাতে সকাল থেকে তোর বাবা আর আমাকে প্রথমে রুমে নিয়ে নাস্তা করালো। আবার তোদের ৩জন এর নাস্তা বানিয়ে এখন মেয়ে নিয়ে যন্ত্রণায় আছে এইসব দেখলে আমার খারাপ লাগে বলেই বলি।
এবার আমার দিকে তাকিয়ে মাহির বলে, তোমার বৌমার মুখ দেখে তো তেমন মনে হচ্ছে না মা। আমার শাশুড়ি এবার বিড়বিড় করেন, কোনসময়
ওর মুখ দেখে বুঝা যায় বাবা? মাহির এবার বলে,
তাহলে কি আর করা !!! তোমার বৌমার মুখ দেখে কিছু বুঝা যায় না, মুখে কিছু বলেও না……. মানুষ তো আর ভেতর পড়তে পারে না………। আমি খুব জানি, আমাকে রাগানোর জন্য ই এসব কথা ও বলছে। মনে মনে হাসি, না চিনলে ৭ বছরেও মনে হয় চিনবে না মাহির। তোমার পক্ষে আদৌও চেনা
সম্ভবও নয়।

আমার ছেলে তখন গুড বয় হবার তাগিদে তার কর্ণফ্লেকস এর বাটি দেখিয়ে বলছে, দেখো মা আমি ফারষ্ট। আমি ওর মুখে আদর করে দিতেই রাজ্যজয়ের হাসি এবার। পানি খাইয়ে কুলি করার জন্য বেসিনে নেবো সিমিনকে, মাহির বলল আমি
ওকে কুলি করাচ্ছি। তুমি চট্ করে চা এককাপ খেয়ে ফেলো। আমি সরে দাঁড়াই, রান্নাঘরে টিফিন বক্স দুটো নিয়ে টিফিন ভরি। নিয়ে আসার পর মা
কে বলছে শুনি, বলার পরও চা খেয়েছে তোমার বৌমা? ওর যা ইচ্ছে তাই করে মা, শুধু শুধু তুমি আমাকে দিয়ে বলাও। আমার শাশুড়ির মুখ তখন
রীতিমত অপ্রসন্ন। আমি এসব দিকে নজর না দিয়ে বলি, রহিমা দরজা লাগিয়ে দিবে মা। বাবার কাছে চলে যান আপনি।

এইমাত্র ঘুম থেকে উঠা কিশোরী রহিমা এবার বকা খাচ্ছে, আসলে বলা ভালো আমার শাশুড়ি সব রাগ,ক্ষোভ ঝাড়ার মানুষ পেয়ে গেছেন। গজগজ করছেন, এতো নবাবের মাইয়্যা তো কাজ করতে আসছিস কেন? সকালে আটটায়ও তোর ঘুম ভাঙ্গে না। আমার কোমরের ব্যথার জন্য নড়তে পারি না। মামী যে আজ একা হাতে সব কিছু করবে,তা জানো না? যখন মামী আদর করে তোকে যে বেশি বেশি খাওয়া, কাপড় দিয়ে থাকে……………….তখন তা নিতে তো হাত লম্বা হয়ে যায়। সব তোমার দোষ বৌমা, রাতে সিরিয়াল দেখতে চাচ্ছে দেখুক না মা। ওদের এসব বলে বলে বেশি বাড় বেড়ে গেছে। মাহির বলে, কি মুস্কিল !!! ঘর থেকে বের হবো কোথায় দোয়া করে দেবে তা না, চিৎকার করতে করতে শেষ। ছেলের কথায় এবার বলছেন,হ্যা যা। আল্লাহর হাওলা। ইভান চেঁচাচ্ছে,টা টা দাদু। মাও হাসিমুখে টা টা করছেন।

গাড়িতে উঠে মাহির বলছে, তুমি এই ভালোমানুষী
মুখোশ পরে কি সুখ পাও বলোতো? আল্লাদ করে কাজের মেয়েকে ঘুম না ভাঙ্গিয়ে মহৎ সাজার মানে কি বুঝিনা। আমাকে নিশ্চুপ দেখে এবার সে খেকিয়ে উঠলো, কি হলো? আমি কিছু জিজ্ঞেস করছি না কি? আমি মৃদু হেসে বলি, মুখোশ পরে পরে অভ্যাস হয়ে গেছে হয়তো। তাই, ছাড়তে পারি না। আপনমনে গজগজ করছে, নিজেকে খুব করিৎকর্মা ভাবো, এজন্য বাচ্চাদেরকে নিজে স্কুলে না নিয়ে এলে শান্তি পাবে না। কোথাও তুমি দেখেছো, বাবা স্কুলে দিয়ে গেলেও মা বাচ্চাদের জন্য ভেবে ভেবে সারা হয়? তোমার কর্মকান্ড দেখে মনে হয়, পৃথিবীতে একমাত্র তোমারই ২টা ছেলেমেয়ে আছে। আর কাউকেই যেন আল্লাহ তাআলা দেন নি।

কথা বললেই বাড়বে, তাছাড়া ড্রাইভার শুনছে।
কতোবার বলেছি প্রথম প্রথম, গাড়িতে উঠে এসব বলো না। কিন্তু কে শোনে কার কথা !!! মাঝে মাঝে আমার মনে হয় সেই ভীতু,শরীর অনবরত কাঁপতে
থাকা নওশীন কে মাহির ভীষণ মিস্ করে। মানুষ আশেপাশে তার বাধ্য প্রজা দেখে খুব আনন্দ পায়। ভীষণ ভালো লাগে, নিজেকে কেউকেটা ভাবে। কে জানে হয়তো বা আমার ধারণা সঠিক নাও হতে পারে। ইদানিং গুলিয়ে ফেলি কে সঠিক আর কে বেঠিক। স্কুল খুব একটা দূরে নয় বলেই রক্ষা। আমি গেলে আমাকে বাসায় নামিয়ে দিতে মাহিরকে আবার ঘুরতে হয় বলে ও রাগ করে। কতোদিন বলেছি, তুমি চলে যাও। আমি যেতে পারবো। তখন আবার চেঁচায়,ঢং করো না তো।উঠো তাড়াতাড়ি। স্কূলের গেইটে সাড়ে ৩ বছরের সিমিন কে নামিয়ে দেই। মাহিরের হাতে ধরা ইভান বোন কে নিয়ে টুকটুক পায়ে এগিয়ে যাচ্ছে। ঘুম ঘুম চোখে সিমিন খুব ই বিরক্তি নিয়ে এগোচ্ছে।
বাসায় ফেরার পথে মাহির বলে,গিয়েই আগে চা খেও না। হেভি কিছু খেয়ে চা খাবে।

আমি ঘরে ঢুকতেই রহিমা বলছে, মামী নানা খালি চিক্কুর পাড়তেছে। আমি দৌড়ুতে দৌড়ুতে সিঁড়ি দিয়ে উঠি আর জিজ্ঞেস করি, বাবা পড়ে গেছেন না কিরে? বলছে,ক্যামনে কমু? আমারে তো নানী উফর থাইক্যা বিদায় করে দিছে। আমি এটাই বুঝি না,বয়স হলে তো সবাইকেই রোগশোক পাকড়াও করবেই। এতে লজ্জা পেয়ে কাজের মানুষ কে সরানোর মানে কি? নিজেই হাঁটুর ব্যথা, কোমরের ব্যথায় অস্থির থাকেন,এর মধ্যে একা একা বাবাকে সামলানো সম্ভব না কি? বাবাকে যে
দেখে সেই রমু ছেলেটা ওর অসুস্থ মাকে দেখতে এক সপ্তাহের জন্য বাড়িতে গেছে। আল্লাহ মালুম কি হয়েছে,পড়ে গিয়ে হাড় ভেঙে গেলে আরেকটা বিপদ উপস্থিত হবে।

রুমে ঢুকে দেখি মা বাবাকে বিছানায় জোর করে বসাচ্ছেন আর বাবা চিৎকার করছেন, না বললাম
না আমি এখানে থাকবো না। আমি এক্ষুনি আমার নিজের বাড়িতে যাবো। আমি “কি হয়েছে বাবা?” বলতেই মা স্বস্তির নিঃশ্বাস ফেললেন,এসো গেছো
বৌমা আমি সাহিলকে খবর দিতে চাচ্ছিলাম। দেখো তোমার শশুড় কি পাগলামি শুরু করেছে।
বাবা এবার রক্তচক্ষু মেলে বললেন,ইস্ সাহিল কে
খবর দিবে যেন সাহিল শুনলেই বাবা বাবা বলে চলে আসবে !!! এসব নাটক আমার সাথে করবে না বলে দিলাম। আমি দেখি ফর্সা মুখটা রাগে লাল হয়ে গেছে। দুহাতে মুখ তুলে বললাম, কি হয়েছে বাবা? এই সকালেই না আমার সাথে কতো হাসলেন আর কতো গল্প করলেন।

বাবা রেগে গেছেন, আমার বাড়িতে না নিলে আমি কিভাবে ভালো থাকবো? আমি হেসে বলি, এটাই তো আপনার বাড়ি বাবা।এটাই আপনার বেডরুম। এই তো আপনার প্রিয় রকিং চেয়ার,যেটাতে বসে বসে দোল খেতে খুব ভালবাসতেন। এবার গলা আরো চড়েছে, আমার বাড়ি এটা না। আমার বাড়ি দীঘিওয়ালা বাড়ি। মোকাম্মেল মাষ্টারের বাড়ি বললেই সবাই দেখিয়ে দিবে। শোনো বৌমা এরা মা ছেলেরা দুষ্টুর শিরোমণি। আমাকে এরা নিবে না। তুমি আমাকে নিয়ে চলো মা। বাড়ি না গেলে আমি শান্তি পাবো না একটুও। রাতে কড়া সিডেটিভ খেয়েও ঘুমুতে না পারা ডিমেনসিয়ার রোগী ঢুলু ঢুলু চোখে তাকিয়ে থাকা আমার শশুড়ের দিকে তাকিয়ে এমন মায়া লাগছে বলেই
ফেলি, আল্লাহ যদি আমাকে বাঁচায় তবে কালকে আপনাকে নিয়ে বাড়িতে যাবো বাবা। খুশিতে হাত দুটো ধরে বলছেন, সত্যি নিবে তো মা? এরা মা ছেলের মতো বাটপারি করবে না তো? হেসে বলি,
কিন্তু শর্ত আছে একটা। সারা রাত শুধু পায়চারি করেছেন। এখন লম্বা একটা ঘুম দিতে হবে। ছোট বাচ্চাদের মতো বলছেন, ঠিক আছে ঘুমুচ্ছি কিন্তু তুমি তোমার কথা কিন্তু রেখো বৌমা। বললাম,
ইনশাআল্লাহ রাখবো। শুয়ে পড়তেই গায়ে কাঁথা দিয়ে, পর্দা গুলো টেনে নিচে এলাম।

কিচ্ছু খেতে ইচ্ছে করছে না, কিন্তু খেতে তো হবেই। বমি বমি ভাব করছে,মুড়ি দিয়ে চা খেলাম। আমার শাশুড়ির গলা শুনি, শুধু মুড়ি দিয়ে খাচ্ছ,
ভারী কিছু খেয়ে নিলেই পারতে। আমি বলি, এখন আর কিছু খেতে ইচ্ছে করছে না মা। পরে
খাবো। এবার জিজ্ঞেস করলাম, বাবা ঘুমিয়েছেন?
ভারী শরীরটা চেয়ারে রাখতে রাখতে বললেন,হ্যা
ঘুমিয়ে কাদা। আমি বুঝিনা বৌমা, আমি কক্ষণো তো তোমার শশুড়ের অবাধ্য হইনি।তবে, আমাকে সে একদম দেখতে পারে না কেন? আমি হেসে বলি, আপনিও ছেলেমানুষি শুরু করে দিলেন মা?
আপনি তো সেদিন ডাক্তারের কাছে যাননি।ডাক্তার আপনার ছেলেকে রোগের ধরণ,কি কি মনে হয় তখন রোগীর………. সেটা বিস্তারিত বলে
দিয়েছে। বাংলায় রোগটি কে স্মৃতিভ্রম বলে।

(চলবে)

একটি উত্তর ত্যাগ

আপনার মন্তব্য লিখুন দয়া করে!
এখানে আপনার নাম লিখুন দয়া করে