আত্মজা

0
1000

আমাকে নিয়ে আজ বাসায় জরুরী সভা বসেছে। সভার মধ্যমনি বা কারণ আমি হলেও আমার ভূমিকা মূলত নীরব দর্শকের। কথা বলবে আমার চার ছেলে আর তাদের কথায় সম্মতি দেয়ার নিমিত্তে ছেলের বৌরা ও উপস্থিত আছে। ভাবছেন এত বড় বড় চার ছেলের মা কি এমন ঘটনা ঘটিয়েছে? আসলে আমি কিছু করিনি কিন্তু আমার শরীর নামক মেশিনটা বেশ বেয়াড়াপনা শুরু করেছে। সে যাই হোক সভার কারণ বলার আগে একটু নিজের কথা বলে নেই।

আমি রোকেয়া বেগম। পেশায় কলেজের অধ্যাপক ছিলাম। এখন অবসর জীবন কাটাচ্ছি। স্বামী গত হয়েছে প্রায় বছর পাঁচেক। কলাবাগানের এই পাঁচতলা বাড়িটার মূল মালিক এখনো আমি। আমার স্বামী ইকবাল হোসেন এভাবেই উইল করে গেছেন যেন শেষ বয়সে কোন ঝামেলায় পরতে না হয় আমাকে। চার ছেলেকে পড়াশোনা করিয়ে বিয়ে দিয়েছি। বিয়ের পরপরই যার যার সংসার আলাদা করে বাড়ির এক এক ফ্লাট ছেড়ে দিয়েছি। আসলে ছেলের বৌদের মানিয়ে নিতে যেন কোন সমস্যা না হয় সেজন্যই এই ব্যবস্থা। সব ছেলেই বৌ বাচ্চা নিয়ে ভালো আছে। আমার নিজস্ব একটা কাজের লোক আছে। ছেলেরা তাদের বৌ রা আসা যাওয়ার পথে সারাক্ষণ খোঁজখবর রাখে তাই একা লাগার কোন সুযোগ নেই বরং নিজের স্বাধীনতাটুকু আছে। এই স্বাধীনতায় বাঁধ সাধে ছোট ছেলে। হুট করে একদিন নিজের সমবয়সী বান্ধবী বিয়ে করে নিয়ে আসে। বাকী সবাই আপত্তি করলেও আমি ঝামেলা এড়াতে মেনে নিয়েছি। যদিও মনে মনে একটা চাপা ক্ষোভও আছে, আমাকে না জানিয়ে বিয়ে করার জন্য।

ছোট বৌ, দীপা অন্য বৌদের থেকে একটু আলাদা ধরনের। আমার খোঁজ যেন একটু বেশীই রাখে। আমার এতোদিনের একরকম ভাবে অভ্যস্ত জীবনে ওর এই এতো গায়ে পরে খেয়াল রাখা আমার যে সবসময় ভালো লাগে তা যেমন না আবার খুব যে খারাপ লাগে তা ও না। মেয়েটার মা মারা গেছে খুব ছোটবেলায়। তাই বুঝি একটু মায়ের আদর চায়। তবে আমি একটু সন্তর্পনে ওর এই গায়ে পরা আচরণ এড়িয়ে চলি। আর তাছাড়া চার ছেলের শাশুড়ি হওয়া তো আর চাট্টিখানি কথা না। কোনদিকে একটু বেশী হেলে পরার সুযোগ নেই। খামোখা ঘরের ভেতর কথা চালাচালি হবে। যে যার মতো সুখে থাক ভালো থাক তাতেই যে আমার শান্তি। আপাত দৃষ্টিতে চার ভাইয়ে বেশ খাতির থাকলেও বৌদের মধ্যে একটা অলিখিত প্রতিযোগিতা থাকবে এটা যে জগতের আর দশটা নিয়মের মতো স্বাভাবিক ব্যাপার।

ঐ যে বললাম দীপা মেয়েটা খুব গায়ে পরা, সে ই খেয়াল করে আমি সিঁড়ি বেয়ে উঠতে ভীষণভাবে হাপিয়ে যাচ্ছি, খাওয়ায় রুচি কমে যাচ্ছে দিনদিন। আমি অন্য কিছু সেভাবে না বুঝলেও গায়ে একটু একটু পানি আসা আর সারাদিন লাগা ক্লান্তির ভাবটুকু কিছুতেই কাটাতে পারছিলাম না। প্রথম প্রথম ভেবেছি এতোদিন ধরে ডায়াবেটিসের কারণেই বুঝি এতো ক্লান্তি। বয়স ও তো একেবারে কম হলোনা। দীপাই জোর করে ডাক্তারের কাছে নিয়ে গেল। নানাপদের টেস্ট করে দেখা গেল আমার কিডনি দুটো আর নিজে থেকে কাজ করবেনা বলে জানিয়েছে। ডাক্তার জানিয়েছে ডায়ালাইসিস করতে হবে আপাতত এবং পরবর্তীতে একটা নতুন কিডনি লাগাতে হবে যদি কারো থেকে পাওয়া যায়।

আমার স্বামী গত হওয়ার পরে আমি আমার একলা বিকেলগুলোতে সবসময় ভাবতাম আমি একটা সার্থক জীবন কাটিয়েছি, মরে গেলে এখন আর কোন দুঃখ থাকবে না। কিন্তু অদ্ভুত হলেও সত্যি যখন চিকিৎসা ছাড়া মৃত্যুর হাতছানি দেখতে পাচ্ছিলাম তখন আরো কয়েকটা দিন বেঁচে থাকার কি যে আকুল ইচ্ছা হলো, তা বুঝি কাউকে বলে বোঝানো যাবেনা। আর সেই আকুল ইচ্ছে মেটাতেই যে আজকের এই সভা। আমার শুধু মনে হচ্ছিলো আমার চারটা ছেলের আটটা কিডনি থেকে একটাতো মা হিসেবে আমি পেতেই পারি। কিন্তু সভা শুরুর আগে পর্যন্ত আমার জানা ছিল না আমার জানা বা ভাবনার মধ্যে কতোটা ভুল ছিল।

সেদিন ফেসবুকে একটা ট্রল দেখেছিলাম। ছোটবেলায় দুই ছেলে মা কে দুইদিক থেকে টানছে, আমার মা আমার মা বলে আর মায়ের বুড়ো বয়সে দুজনেই মাকে দুদিক থেকে ঠেলছে, তোর মা তোর মা বলে। কি প্রহসন, অথচ কি নিদারুন সত্যি একটা ব্যাপার কোন কোন পরিবারে। আমি নিজে নিজে খুব হেসেছিলাম আর ভেবেছিলাম, নাহ আমার ছেলেরা এমন নয় মোটেও। আমার বিপদে ওরা কখনোই দূরে ঠেলে দেবেনা নিশ্চিত। সভায় আমার সব ছেলেই এক যোগে জানায়, ডায়ালাইসিস করার টাকা দিতে কোন আপত্তি কারোই নেই কিন্তু পরবর্তীতে কিডনি প্রতিস্থাপনের ব্যাপারে একটা টু শব্দ কেউ করেনা। ছেলে বৌ রা তো আরো নিশ্চুপ। অথচ ওদের কারো টাকারই আমার দরকার নেই, আমার নিজের একাউন্টে নিজের চিকিৎসার টাকা যথেষ্ট পরিমাণেই আছে।

সভার সবার মুখের ভাষা যখন থেমে গেলো সবার দিকে একবার তাকিয়ে এতোক্ষণ নীরব থাকা এই আমি তখন মুখ খুললাম, ‘ আমার চিকিৎসা নিয়ে ভেবোনা, আমারটা আমি ম্যানেজ করতে পারবো। তোমরা আমাকে নিয়ে আমার বুড়ো বয়সে ভেবেছো আমি তাতেই খুশী।আমি উঠলাম।’ পেছন থেকে শুধু একটা মেয়ে কন্ঠ বলে উঠলো, ‘ মা, আমি কাল আপনার সাথে সব টেস্ট করতে যাবো। আমার সবকিছু মিললে আমি আপনাকে আমার একটা কিডনি দিতে চাই।’ ঘরে তখন পিনপতন নীরবতা। অদ্ভুত হলেও সত্য ঘরে বসে থাকা আরো সাত জোড়া চোখ অবাক বিস্ময়ে দীপাকে দেখছিল, যেন কোন ভীনগ্রহের প্রাণী কথা বলছে আর আমি দেখছিলাম আমার ছেলেদের। সবার চোখে শুধু নিজেকে বাঁচিয়ে রাখার কি আপ্রান চেষ্টা। অথচ জীবনের কত শত শখ, আহ্লাদ, চাহিদা বাদ দিয়ে সময় দিয়েছি শুধু ওদেরকে প্রতিষ্ঠিত দেখার জন্য। কত রাত নির্ঘুম কেটেছে শুধু ওদের ভালো রাখতে গিয়ে। নামাজ পরে নিজের জন্য কিছু চাওয়ার আগে ওদের মঙ্গল আর সমৃদ্ধি চেয়েই কেটেছে মোনাজাতের বড় একটা অংশ।

না আবার বেঁচে থাকার স্বপ্নে আমি খুশীতে কেঁদে দেইনি শুধু মরমে মরে গেছি নিজের ব্যর্থতার প্রশ্নে। নিজে বেঁচে থেকে আমি নিজের আত্মজদের যা শেখাতে পারিনি একজন শৈশবে মা হারানো সত্যিকার মানবিকতার মানুষ আমাকে তথা আমার পুরো পরিবারকে চোখে আঙ্গুল দিয়ে দেখিয়ে দেয়, পরের মা কেও নিজের মায়ের জায়গা দিতে শুধু পরিস্কার একটা মন লাগে।

ডা. জান্নাতুল ফেরদৌস

একটি উত্তর ত্যাগ

আপনার মন্তব্য লিখুন দয়া করে!
এখানে আপনার নাম লিখুন দয়া করে