#আজ_রিক্তার_মৃত্যুবার্ষিকি।
#পর্বঃ- পাঁচ (০৫)
রিক্তার শাশুড়ির কথা সম্পুর্ণ পরিবেশ পরিবর্তন করে দিল। ঘটনার কতটুকু সত্য আর কতটুকু মিথ্যা সেটা পরের বিবেচ্য বিষয় হলেও কথাগুলো মাথার মধ্যে গেঁথে গেল সবার।
সাজু বললো,
– কে মেরেছে রিক্তাকে? আর সেই খুনির ক্ষমতা এতটা বেশি কীভাবে হলো যে তিনি এই গ্রামের মধ্যে এসে সাব্বিরকে খুন করেছে।
মাহবুব আলম বললেন,
– আমরা আপনার ছেলের একটা ডায়েরি পেয়েছি। সেখানে তিনি এরকম কিছু লিখে যাননি। সেরকম কিছুর আশংকা থাকলে আপনার ছেলে অবশ্যই সেটা লিখে যেতেন।
– হয়তো সুযোগ পায়নি। তাছাড়া সাব্বির আমার কাছে যখন কল করেছিল তখন কেঁদে কেঁদে বলছিল ও নাকি সুইসাইড করবে।
– কেন? সুইসাইড করার কথা কেন বলছিল? আর আপনি তখন কিছু বলেন নাই কেন।
– রাত তিনটার দিকে আমাকে সাব্বির কল করে। আমার ছেলে এ বাড়িতে এসেছে আমি জানতাম না। সাব্বির কল করে যখন বললো ” মা আমি যদি আত্মহত্যা করি তাহলে কি তুমি কষ্ট পাবে? ” তখন ওর কথা শুনে আমার ঘুম কেটে যায়। আমি তখন বললাম, কিসব পাগলের মতো কথা বলিস। সাব্বির তখন বলে, মা আজ আমি রিক্তাদের বাড়িতে এসেছি। এখন যদি এখানে মারা যাই তাহলে ওরা আমাকে রিক্তার কবরের কাছে কবর দিবে। এভাবে পালিয়ে আর কতদিন থাকবো। একদিন তো ঠিকই ওরা খুঁজে বের করে মারবে।
সাজু বললো,
– কারা মারবে? আর কাদের জন্য সাব্বির পালিয়ে থাকতো?
– বউমার বান্ধবীর বান্ধবীর বড়ভাই।
সাব্বিরের বন্ধু ইলিয়াসের দিকে তাকিয়ে মহিলা বললেন,
– ছেলেটার নাম কি ছিল যেন?
– আলফাজ। আলফাজের ছোটবোন ভাবির বান্ধবী ছিল। ভাবি খুলনা থেকে পালিয়ে যাবার সময় প্রথম তাকে দেখেছিল।
– তিনি ঢাকায় কী করতেন?
– ঠিক নাই, জাল টাকার ব্যবসা, বিভিন্ন স্থানে জুয়ার আসর বসানো, মাদকদ্রব্য বিক্রি ইত্যাদি।
তার পরিবার থেকে এসব জানতো কিনা জানি না। আমি এসব সাব্বিরের কাছে শুনেছি। সাব্বির যখন নাটোর থেকে ঢাকায় আসে তখন ওদের দুজনের চলতে খানিকটা অসুবিধা হয়ে যেত। পরীক্ষা শেষ হবার আগেই ভাবি তার সেই বান্ধবীর সাহায্যে আলফাজের মাধ্যমে একটা ছোট জবের ব্যবস্থা করে। ভাবি চাইলে তার বাড়ি থেকে টাকা নিতে পারতো কিন্তু আত্মসম্মানের দিক থেকে কেউ সেটা চায়নি। তবে চাকরির ব্যবস্থা করার সুবাদে আলফাজের সঙ্গে সাব্বির ও ভাবির একটা আলাদা পরিচয় সৃষ্টি হয়। সম্ভবত সাব্বির কিছুটা বুঝতে পেরেছিল যে আলফাজের মনের মধ্যে কিছু একটা খারাপ উদ্দেশ্য আছে। সাব্বির সেটা নিয়ে ভাবির সঙ্গে কথা বলে কিন্তু ভাবি গুরুত্ব না দিয়ে উল্টো রিয়্যাক্ট করেন। সাব্বির তখন আমাকে বলতো আর আফসোস করতো। আমি বলতাম যে ভাবি যদি সাবধানে থাকে তাহলে তো কোনো সমস্যা নেই। ঢাকা শহরে ভালো খারাপের অনেক মানুষ আছে, তাই নিজেকে নিজের মতো রক্ষা করতে হবে।
তবুও বাসায় মাঝে মাঝে সাব্বিরের সঙ্গে ভাবির ঝগড়া হতো। তারপরই ভাবির পরীক্ষা শুরু হয়। সাব্বির আর কোনো কথা বলে না, রাগারাগি করে না কারণ পরীক্ষা খারাপ হতে পারে।
পরীক্ষা শেষ করে ভাবি তার পার্ট টাইম জবটা ফুল টাইম হিসেবে শুরু করে। এরিমধ্যে একদিন সাব্বির একটা রেস্টুরেন্ট থেকে ভাবির বান্ধবী, ভাবি আর আলফাজকে বের হতে দেখেন। সেদিন নাকি আলফাজের জন্মদিন ছিল।
সেই রাতে সাব্বির আর ভাবির সঙ্গে সারারাত ঝগড়া চলে। সাব্বির দুটো চড় মেরেছিল ভাবিকে৷ পরদিন সকাল বেলা ভাবি রাগ করে তার বান্ধবীর বাসায় চলে যায়। আমি এসব কিছুই জানতাম না। ঘটনার চারদিন পরে সাব্বির আমার কাছে টাকা চায়। আমাকে বলে চট্টগ্রামে যাবে তাই টাকার দরকার। আমি কারণ জিজ্ঞেস করতেই সাব্বির সবকিছু খুলে বলে।
ভাবি নাকি চাকরির কাজে চট্টগ্রামে গেছে। তাদের মধ্যে চারদিন আগে বাসায় যা কিছু হয়েছে সবকিছু খুলে বলে আমাকে। আমি সাব্বিরকে বকাবকি করি তারপর সাব্বির টাকা নিয়ে আমার কাছ থেকে বিদায় নিয়ে চলে যায়।
এরপর সাব্বিরের সঙ্গে আমার যখন কথা হয় তখন ভাবি মারা গেছে। চট্টগ্রাম যে হোটেলে তিনি ছিলেন সেই হোটেল থেকে বের হয়ে দামপাড়া বাসস্ট্যান্ডে যাবার সময় সিএনজি এক্সিডেন্ট করে ভাবি৷ সাব্বির তখনও জানতো না ওর স্ত্রীর মৃত্যুতে আলফাজের হাত আছে।
সাজু বললো,
– সাব্বির কীভাবে জানলো? সাব্বির তো তখন চট্টগ্রামে থাকার কথা। নাকি তখনও ঢাকা থেকে চট্টগ্রামে যায়নি।
– সাব্বির চট্টগ্রামেই ছিল। হাসপাতালে ভাবির লাশ নিয়ে দৌড়ঝাঁপ করলো৷ ভাবির বাবা ভাবির লাশ নিয়ে এলেন, সাব্বিরকে তার গ্রামের বাড়িতে আসার জন্য বারবার নিষেধ করলেন।
রিক্তার বাবা কখন এসে সবার পিছনে দাঁড়িয়ে ছিলো কেউ বুঝতে পারেনি। সবার খেয়াল ছিল সাব্বিরের বন্ধু ইলিয়াসের দিকে।
রিক্তার বাবা পিছন থেকে কান্না জড়িত কণ্ঠে বললেন, এজন্য আমার মেয়ের সঙ্গে ওর অমন মেসেজ দেখেছিলাম। আমার মেয়ে বারবার বলছিল সে খারাপ কিছু করছে না। আর ছেলেটার মধ্যে খারাপ কিন্তু দেখছে না। কিন্তু জামাই ওকে বারবার ভুল বুঝতো আর কতো কথা বলতো। আহারে আমার কলিজার টুকরো মেয়ে।
জুলফিকার মৃধা সেখানে কাঁদতে লাগলো। গ্রামের মানুষজন এক অসহায় বাবার মেয়ে হারানোর অনুভূতি দেখতে পেল। যে মানুষটা এলাকার চেয়ারম্যান হিসেবে দশটা বছর পার করলো সেই মানুষটা আজ কেমন কান্না করছে।
সাজু বললো,
– সাব্বির কীভাবে জানলো যে আলফাজ রিক্তাকে এক্সিডেন্ট করে মেরেছে। যেহেতু এক্সিডেন্ট ছিল তাই এসব তো জানার কথা নয় তাই না।
– সাব্বির তখনও খুনের বিষয় জানতো না। কিন্তু আলফাজের জন্যই যত সমস্যা হয়েছিল তাই সাব্বির তাকেই অপরাধের জন্য দায়ী করতো। ঢাকায় ফিরে সাব্বিরের একটাই কাজ ছিল আর সেটা হচ্ছে আলফাজের মৃত্যু। আমি সবসময় সাব্বিরকে বোঝাতাম যে এসবের পিছনে গিয়ে নিজের জীবন নষ্ট করিস না। কিন্তু সাব্বির আর কিছুতেই কারো কথা শুনতো না। গ্রামের বাড়িতে গিয়ে জমিজমা কিছু বিক্রি করে আসে। যেহেতু ওর বাবা ছিল না তাই নিজের জমি বিক্রি করতে পেরেছিল। আমার কাছে ওর মা জানতে চায় যে সাব্বির জমি বিক্রি করবে কেন। তখন আমি সব তাকে খুলে বললাম। আন্টি নিজেও বোঝাতে শুরু করে কিন্তু কাজ হয় না।
অবশেষে একদিন অনেক মালামালসহ আলফাজ পুলিশের কাছে ধরা পড়ে। সাব্বিরই কাজটা করেছিল। আর তখন আলফাজের এক সহকারীর কাছে জানতে পারে যে আলফাজই ভাবিকে খুন করেছে। আলফাজের ওই সহকারীকে সাব্বির মেরে ফেলে৷
– কিহ, সাব্বির খুন করে?
– হ্যাঁ। তবে আলফাজের তো উপরের মাথা আছে তাই দশদিনের মধ্যে জেল থেকে বের হয়। আর সাব্বিরের কথা জানতে পারে। সাব্বির যে তার একটা সহকারীকে খুন করেছে সেটাও জেনে যায় আলফাজ৷ তারপর থেকেই সাব্বিরকে মারার জন্য খুঁজে বেড়াচ্ছিল আলফাজ। সাব্বির পালিয়ে থাকতো সবসময়, তবে সেও সুযোগ খুজতো আলফাজকে শেষ করার। আর এভাবে পালিয়ে পালিয়ে আর নিজের জেদের কারণে এতদূর এসে যায়। সেদিন ভাবির মা সাব্বিরকে কল দিয়ে রিক্তা ভাবির চতুর্থ মৃত্যুবার্ষিকীতে ডাকার পরে সাব্বির আমার কাছে বলে। আমি বললাম যে সাবধানে গিয়ে ঘুরে আয় তাহলে।
গতকাল সকালে আমি আমাদের আরেকটা বন্ধুর কাছে জানতে পারি সাব্বির ওর শশুর বাড়িতে মারা গেছে। আলফাজের কাছেই নাকি জানতে পেরেছে সাব্বিরকে তারা মেরে ফেলেছে। তারপর আমি সাব্বিরের মাকে সবকিছু কল দিয়ে বললাম। আন্টি নাটোর থেকে ঢাকায় এলো। এরপর আমি তাকে নিয়ে এখানে এসেছি।
– রিক্তাকে আলফাজ কেন মেরেছে সেটা জানেন না কিছু? মানে সাব্বির জানতে পারে নাই?
– নাহ। সেই কারণটা শুধু আলফাজই বলতে পারবে। আপনারা আলফাজকে যেভাবেই হোক গ্রেফতার করুন। লোকটা খুব খারাপ, দেশের মধ্যে মাদকদ্রব্য ছড়িয়ে দেওয়া, নকল টাকার ব্যবসা করা ইত্যাদি অনেক কিছু বন্ধ হবে।
↓
রাত ৮ঃ৪৯ pm.
তিনটা লোক নদীর পাড়ে দাঁড়িয়ে দাঁড়িয়ে অপেক্ষা করছে। ঠিক দুদিন আগে এখানেই সাজুর সঙ্গে ঘুরতে এসেছিল সাব্বির। যারা এখন দাঁড়িয়ে আছে তাদের মধ্যে একজন শুধু এই গ্রামের আর বাকি দুজন ঢাকার।
রিক্তার কবরের পাশে সাব্বির লাশ দাফন করা হয়েছে আসরের নামাজের পড়ে। সাজু সন্ধ্যা বেলা চলে গেছে খুলনায়, তার দাদার শরীর তেমন একটা ভালো নয়। সাব্বিরের মা এবং ইলিয়াস চেয়ারম্যান বাড়িতেই আছে।
শহুরে দুজনের একজন আবারও মোবাইলের স্ক্রিনে সময় দেখলো। সামনের ইটের পাকা রাস্তায় কেউ একজন মোবাইলের বাতি জ্বালিয়ে এগিয়ে আসছে। লোকটা কাছাকাছি আসতেই শহুরে দুজনের একজন বললো,
– কিরে ভাই, এতক্ষণ লাগে আসতে?
– ভাই আপনিও এসেছেন এখানে?
– কেন কি ভেবেছিলে ইলিয়াস ভাই? তোমার বন্ধুকে খুন করেছি বলে তুমি পুলিশের কাছে সাক্ষী দিবে আর আমি জানতে পারবো না।
– ভা ভাই আমি তো আমার নিজের উপর থেকে সন্দেহ ওঠার জন্য বলছি। যদি ওরা জানতে পারে যে…
– কি? যদি সবাই জানতে পারে তুমি সাব্বিরকে সেই রাতে কল দিয়ে দরজা খুলতে বলছো। তুমি দরজা খুলতে বলছো বলে সাব্বির অনায়াসে দরজা খুলে দিয়েছে। আমি ঘরে ঢুকে সাব্বিরকে মেরেছি। তাহলে তোমার বিপদ হবে তাই তো।
– হ্যাঁ ভাই, আলফাজ ভাই আপনি কিন্তু আমাকে বলেছিলেন যে আমার সব রকমের নিরাপত্তা আপনি দিবেন।
– কিন্তু তুমি তো পুলিশের কাছে সবকিছু বলে দিয়েছ ইলিয়াস। তোমাকে বাঁচিয়ে রাখলে আমার আরো কতো বিপদ হবে কে জানে৷ যে মানুষ তার নিজের বন্ধুর সঙ্গে বিশ্বাসঘাতকতা করে আমাকে খুন করতে সাহায্য করে। সেই তুমি আমার সঙ্গেও বেঈমানী করবে জানতাম। কিন্তু এতো তাড়াতাড়ি করবে জানতাম না। পুলিশের কাছে সব বলে দিলে।
তিনজনের মধ্যে গ্রামের যে লোকটা আছে সে বললো,
– ভাই তাড়াতাড়ি মারেন। রাস্তা থেকে ইট নিয়ে নৌকায় রাখছি৷ মারার পরে লাশের সঙ্গে ইট বেঁধে নদীতে ফেলে দেবো। আর কোনদিন কেউ এর লাশ খুঁজে পাবে না।
.
.
চলবে…
লেখা:-
মোঃ সাইফুল ইসলাম (সজীব)