#আজ_রিক্তার_মৃত্যুবার্ষিকি।
#পর্বঃ- তিন (০৩)
– আপনি মিথ্যা বলছেন না তো সাজু সাহেব?
– আশ্চর্য! আমি কেন মিথ্যা বলবো? আপনার কেন মনে হয় যে আমি আপনার সঙ্গে মিথ্যা বলছি।
মাহবুব আলম খানিকটা হাসার চেষ্টা করলেন। তারপর আস্তে আস্তে বললেন,
– সাজু সাহেব, রিক্তার হাসবেন্ড সাব্বির খুন হয়েছে গতরাতের আগের রাতে। সম্ভবত শেষ রাতের দিকে হতে পারে। গতকাল সকাল নয়টার দিকে তার লাশ আবিষ্কার করে চেয়ারম্যানের স্ত্রী। আমরা চেয়ারম্যানের বাড়িতে গেলাম সাড়ে এগারোটার দিকে। কিন্তু আপনার এলাকার ঘটনায় আপনিই গেলেন না এটা আশ্চর্য নয়?
– হ্যাঁ অবশ্যই আশ্চর্য।
– আপনি গতকাল সারাদিনের মধ্যে কিন্তু খবর নেননি। অথচ আমি যতটুকু জানি যে এরকম ঘটনা ঘটলে আপনি সবার আগে উপস্থাপন হোন।
সাজু ভাই বললেন,
– আপনার উত্তরগুলো আমি দেবো। তবে সেটা সেই রাতে চেয়ারম্যান বাড়িতে যাবার পর থেকে যা যা ঘটেছে সব বলবো। এখন আপনি আমাকে বলুন আপনারা রিক্তার বাবাকে খুনি ভাবছেন কেন আমি তো সেটাই বুঝতে পারছি না।
দারোগা মাহবুব আলম বললেন,
– আমি এখন পর্যন্ত সাব্বিরের লেখা যতটুকু পড়ে শেষ করেছি তাতে স্পষ্ট বোঝা যাচ্ছে চেয়ারম্যান খুন করেছে বা করিয়াছে। এখন কাকে দিয়ে করিয়েছে সেটাই আসল বিষয়।
– কিন্তু কেন মনে হচ্ছে? ডায়েরিতে লেখা আছে, সেজন্য?
– হ্যাঁ, আমার মনে হয় সাব্বির নিজের মৃত্যুর কথা নিশ্চিত বুঝতে পেরেছিল। সেজন্য ঘটমান সবকিছু সে লিপিবদ্ধ করে গেছে। এবং খুব সুন্দর করে গল্প বা উপন্যাসের মতো সাজিয়ে লিখেছে।
সাজু একটু বিরক্ত হলো। মাথা মোটা দারোগার কথার যুক্তি তাকে হতাশ করেছে। একটা মানুষ নিজের মৃত্যুর কথা জেনে সে কীভাবে সাজিয়ে সাজিয়ে নিজের প্রেম, বিয়ে সংসারের কথা লিখতে বসবে। মানুষটা তো তখন নিজের জীবন বাঁচানোর চেষ্টা করবে। এটা তো ফাঁসির দণ্ডপ্রাপ্ত আসামি নয় যে কোনকিছু করবে না। যদি সেরকম কিছু হতো তাহলে হয়তো আসামি বলতো যে আমি মরার আগে কিছু কথা লিখতে চাই, এটাই আমার শেষ ইচ্ছে। তাহলে হয়তো সেই আসামি সুন্দর করে নিজের মনের আবেগ লিখতে পারে।
কিন্তু সাব্বিরের তো সেরকম করার কথা নয়। তার কাছে মোবাইল ছিল, সে যে কাউকে কল করে সাহায্য চাইতে পারতো৷ ডায়েরি লিখে সময় নষ্ট না করে সে অন্য উপায় খুঁজতো।
সাজু বললো,
– আর কি কি লেখা আছে ডায়েরিতে?
– আর তেমন কিছু নাই। ঘটনার রাত্রে আপনি সেই বাড়িতে যাবার পরে সাব্বিরকে নদীর পাড়ে যাবার প্রস্তাব করেন। তারপর রিক্তার মায়ের সঙ্গে কথা বলতে ভিতরে চলে যান৷ সেখান থেকে ফিরে দুজন মিলে নদীর দিকে রওনা দেন, এতটুকুই লেখা আছে।
– তাহলে চলুন গ্রামের দিকে যাই। যাবার সময় আমি বাকিটা বলবো আপনাকে। সেই থেকে শুরু করে এখন আপনার কাছে আসার আগ পর্যন্ত সব বলবো।
– সত্যিটা বলবেন তো, নাকি…
– মানে?
– না কিছু না, আসলে পুলিশের মন তো। সন্দেহের তালিকা বিশাল বড়।
সাজু স্থির দৃষ্টিতে তাকিয়ে রইল। তাকেও সন্দেহ করছে পুলিশ, কিন্তু কেন? সেই রাতে চেয়ারম্যান বাড়িতে যাবার জন্য, নাকি রিক্তার হাসবেন্ডকে সঙ্গে নিয়ে বের হবার জন্য।
সাজু তার বাইক নিয়েই এসেছে। দারোগা মাহবুব আলমকে পিছনে বসিয়ে গ্রামের দিকে রওনা দিল সাজু ভাই। আর চলতে চলতে দারোগার সঙ্গে বলতে লাগলো,
আমি ভিতরে গিয়ে দেখি চাচি বসে আছে। বাদল বলেছিল চাচি আম্মা ঘুমাচ্ছে। আমি বাদলের কথা আর না তুলে সরাসরি চাচিকে বললাম,
– চাচিআম্মা আপনি অনেকবার কল করেছিলেন। কি হয়েছে? আমি তো জরুরী ভেবে সরাসরি বাড়ির ভিতর এলাম।
– চাচি বারবার বাদলের দিকে তাকালেন। আমি বাদলকে চাচির ঘর থেকে বের হতে বললাম।
বাদল বের হয়ে গেল, কিন্তু চাচি এবং আমি উভয়ই বুঝতে পারলাম বাদলের দুটো কান আমাদের এদিকেই পাতানো আছে।
– বলেন চাচি।
– না তেমন কিছু না বাবা, রিক্তার জামাই সেই দুপুরের আগে আসলো। সারাদিন একা একা বসে আছে। শহরের মানুষ তো তাই হয়তো ভালো লাগে না ওর। তুমি যেহেতু গ্রামের বাড়িতে তাই ভাবলাম যদি একটু সঙ্গে করে বাজারের দিকে যেতে।
– ওহ্! আসলে চাচিআম্মা নামাজ পড়ে মোবাইল আর চেক করা হয়নি।
– ঠিক আছে বাবা, এতো রাতে আবার শুধু শুধু কষ্ট করে এলে।
– সমস্যা নেই, চাচি আমি একটু রিক্তার জামাইকে নিয়ে বাইরে যাচ্ছি।
– এতো রাতে?
– সমস্যা নেই চাচি তাছাড়া আজ অক্টোবর মাসের ২১ তারিখ। এখনো শীত তেমন বেশি পড়া শুরু হয়নি।
চাচির সঙ্গে কথা শেষ করে আমি রিক্তার হাসবেন্ড সাব্বিরকে নিয়ে বের হলাম। নদীর পাড়ে দুজন একসঙ্গে বসলাম, সাব্বির বললো,
– ভাই আপনি বিয়ে করেন নাই?
– বললাম, করেছিলাম কিন্তু ডিভোর্স হয়ে গেছে। কেন বলেন তো, হঠাৎ এরকম প্রশ্ন?
– না তেমন কিছু না। এতো রাতে আমাকে নিয়ে ঘুরতে এলেন। বাসায় ভাবি থাকলে তো এরকম বের হতে পারতেন না।
– কেন, রিক্তাকে বিয়ে করার পড়ে আপনার কি সেরকম অবস্থা হয়েছিল নাকি।
সাব্বির তখন হাসার চেষ্টা করলো৷ আমি কিছু না বলে তার উত্তরের অপেক্ষা করলাম।
মাহবুব আলম বললেন,
– তখন কি তার মধ্যে কোনো চিন্তার ছাপ ছিল? কোনকিছু নিয়ে মানুষ টেনশন করলে যেরকম মনে হয় তেমন কিছু।
– নাহ তা তো মনে হয়নি। তবে একটা সেখানে অবাক করা একটা ঘটনা ঘটেছিল।
– কি ঘটনা?
– বাদল আর মোতালেব ভাইকে আমরা দেখেছি সেখানে। দুরে দাঁড়িয়ে দাঁড়িয়ে সিগারেট টানছে। সিগারেটের আগুন কিন্তু বহুদুর থেকে দেখা যায়। আমরা তখন সেখানে গেলাম। প্রথমে তারা একটু লুকানোর চেষ্টা করে। কিন্তু পরে ঠিকই দেখে ফেলি আমরা।
– কেন গেল তারা, জিজ্ঞেস করেন নাই?
– করেছিলাম।
– তারপর।
– বললো চেয়ারম্যান চাচা নাকি পাঠিয়েছে। তার কোনো শত্রু যদি আক্রমণ করে তাই ওরা দুর থেকে আমাদের পাহারা দিচ্ছে।
– সাব্বির তাদের পারিবারিক সমস্যার কোনো কথা শেয়ার করেছে?
– নাহ সেরকম কিছু বলেনি। আচ্ছা স্যার, সাব্বিরের লাশটা কোথায়? মর্গে নাকি।
– সেটা তো বাগেরহাট পোস্টমর্টেম করার জন্য গতকাল পাঠানো হয়েছে। লাশ কোথায় দাফন হবে কিছু জানেন নাকি?
– নাহ, আমি তো খুলনা থেকে সরাসরি আপনার সঙ্গে দেখা করতে গেলাম। গ্রামের কারো সঙ্গে এখনো দেখা হয়নি আমার।
– গতকাল কোথায় ছিলেন বললেন না তো৷
– খুলনাতে ছিলাম। পরশু রাতে চেয়ারম্যান বাড়িতে সাব্বিরকে রেখে আমি দ্রুত বাড়িতে যাই। কাছে দাদি কল করে বলেছিলেন দাদার শ্বাসকষ্ট হচ্ছে। আমি সাব্বিরকে বারবার অনুরোধ করলাম আমার সঙ্গে যাবার জন্য কিন্তু সে রাজি হলো না। তাই তাকে বাড়ির সামনে ছেড়ে দিয়ে আমি আমাদের বাড়িতে চলে যাই। বাজারের ডাক্তার হারুন আঙ্কেলকে গিয়ে নিয়ে আসলাম। তিনি সবকিছু দেখে দ্রুত হাসপাতালে নিতে বলেন। তাই বাইকে রেখে আমাদের গাড়ি নিয়েই বের হলাম।
দারোগা মাহবুব আলম এবং সাজু ভাই চেয়ারম্যান বাড়ির সামনে এসে থামলো। বাড়িতে প্রচুর ভিড় এবং সোরগোল চলছে। আগে দুবার চেয়ারম্যান থাকার কারণে এখনো এটা চেয়ারম্যান বাড়ি হিসেবে পরিচিত।
বাড়ির ভিতর প্রবেশ করে ভিড় এবং সোরগোলের কারণ জানা গেল। সাব্বিরের মা এসেছে, ছেলের মৃত্যুর খবর শুনে তিনি নাটোর থেকে এসেছেন। তার আগমনকে কেন্দ্র করে পাড়াপ্রতিবেশির ভিড় জমেছে।
রিক্তার বাবা বাড়ির উঠোনে বড় চেয়ার পেতে বসে আছেন। তার পাশে কিছু বয়স্ক লোকজন। সাজু কাছে যেতেই রিক্তার বাবা বললেন,
– সাজু একটা পরামর্শ দে তো।
– কি চাচা?
– আমি চাই রিক্তার কবরের পাশে জামাইরে কবর দিতে। বিষয়টা কেমন হবে, ভালো হবে না?
সাজুর আগেই দারোগা মাহবুব আলম বললেন,
– হঠাৎ এরকম সিদ্ধান্ত কেন বলেন তো। নিজেকে নির্দোষ প্রমাণ করার জন্য নাকি।
– কি বলছেন দারোগা?
– সরি চেয়ারম্যান সাহেব, আপনার বাড়িতে কাজ করে বাদল কোথায়? ওকে ডাকেন তো।
– কেন বাদলকে কেন ডাকবো।
– কাজ আছে আমার।
– সে নাই, বাজারে গেছে।
– আসবে তো, নাকি হারিয়ে যাবে।
– আপনার মোবাইলটা দিন তো!
– কেন?
– হ্যাঁ দিন, আর সেই সাথে আপনার মেয়ে মৃত্যুর আগে যে ফেসবুক আইডি ব্যবহার করতো সেটা ওপেন করে দিন।
– আমার মেয়ের পারসোনাল আইডি আপনার কাছে কেন দেবো বলেন তো।
– কারণ বিষয়টার সঙ্গে আপনার মেয়ের হাসবেন্ডের হত্যাকান্ড জড়িত।
চেয়ারম্যান সাহেব মোবাইল এগিয়ে দিলেন। সিনথিয়া আক্তার রিক্তা নামের যে আইডি আছে সেখানে সাব্বিরের কোনো মেসেজ নেই। সবগুলো মেসেজ একসঙ্গে রিমুভ করা হয়েছে।
– কোনো মেসেজ নেই কেন? আপনার মেয়ে ও তার হাসবেন্ডের মেসেজ গুলো দরকার আমার।
সাজু সাহেব, আপনি কিছু বলেন। তিনি আইডি থেকে সব মেসেজ ডিলিট করে দিয়েছে কেন।
সাজু বললো,
– চাচা কেন করেছেন বলেন।
রিক্তার বাবা দীর্ঘশ্বাস ছেড়ে বললেন,
– আমি করিনি সাজু, তোর চাচি আম্মা ডিলিট করেছে গতকাল রাতে।
ঘরের ভিতর থেকে মহিলারা সবাই একসঙ্গে চেচিয়ে উঠলো। সাজু দৌড়ে ঘরের ভেতরে চলে গেল।
সবার চেচামেচির কারণ হচ্ছে, রিক্তার মা নিজের ঘরে শাড়ি গলায় ফাঁস দিয়ে মরার চেষ্টা করছিল। সেটা দেখেই চিৎকার করে। পুরনো আমলের কাঠের দরজা হওয়ায় দরজা ভেঙ্গে এযাত্রা রক্ষা করলো সবাই।
সাজু রিক্তার মায়ের সামনে গিয়ে বললো,
– চাচি কি হয়েছে, পাগলামি করছেন কেন? বাড়ি ভর্তি মানুষের সামনে এসব কি চাচি আম্মা?
~
– চলবে…
লেখাঃ-
মোঃ সাইফুল ইসলাম (সজীব)