আজল পর্ব-০৮

0
554

#আজল
#পর্ব-আট

১৯.

সকালে অফিসে আসার পর পরই শশুরের ফোন পেলো তানভীর। খুবই অবাক হলো। প্রিয়তার বাবা কালেভদ্রে ওকে ফোন করে। ওর মনেও পরে না শেষ কবে ফোন দিয়েছিলেন উনি। শাশুড়ি মা আর ফুয়াদ ভাই মাঝে মাঝে ফোন দিয়ে খোঁজ খবর নেয়। আর এতো কাছাকাছি ডিস্টেন্সে থাকে ওরা! কারনে অকারনে দেখাও হয়! তাই আর সেভাবে ফোন দেওয়ার প্রয়োজন পড়ে না। আর তাছাড়া প্রিয়তা আর প্রিতি তো এতদিন ওখানেই ছিলো, দু’তিন দিন হয় মাত্র বাসায় এসেছে। তানভীর ও তো প্রায়ই যেতো বাবার অসুস্থতা উপলক্ষে। তবে আজ আবার কেন ফোন দিচ্ছে? তানভীর চিন্তিত হয়ে ফোন রিসিভ করলো-
“জ্বী বাবা! আসসালামু আলাইকুম।”
“ওয়ালাইকুম সালাম। ”
“বাবা, ভালো আছেন তো? ”
“হ্যা, ভালোই আছি। তোমরা কেমন?”
“জ্বী বাবা, ভালো। হঠাৎ ফোন দিলেন যে বাবা! কোন কি দরকার? জরুরি কিছু?”
“কেন বাবা, দরকার ছাড়া কি ফোন দিতে পাড়ি না?”
“না না বাবা, তা বলছি না? কখনো ফোন টোন দেননা তো, তাই বলছিলাম আর কি!”
তানভীরের কন্ঠে স্পষ্ট দ্বিধা।
“বাবা তানভীর, দরকার একটু ছিলো বইকি!।”
“কি বাবা, বলুন। কোনো সমস্যা হয়েছে নাকি? সবাই ভালো আছে তো? মার শরীর? ”
” সবাই ভালো আছে। আসলে না সেরকম কোনো সমস্যা না….আবার বলতে গেলে সমস্যা। আমি…..আসলে…. তোমার সাথে একটু কথা বলতে চাচ্ছিলাম।”
“আচ্ছা, তবে আমি বিকেলে বাসায় আসছি? ”
“না..না… বাসায় না…. আমি তোমার সাথে বাইরে কোথাও দেখা করতে চাই। আসলে….. তোমার সাথে একটু পারসোনালি কথা বলতে চাচ্ছি। ”
ফোনের ওপাশে তানভীর কিছুক্ষণ চুপচাপ হয়ে ছিলো। ও আসলে বুঝতে পারছিলো না কি হচ্ছে! ওর শশুরের ওর সাথে কি পারসোনার কথা থাকতে পারে এটা ওর মাথায় আসছিলো না।
“আচ্ছা, বাবা! আমি তবে গাড়ি পাঠাচ্ছি। আপনি তৈরী হয়ে নিন। আমার অফিসের কাছে ভালো একটা রেস্টুরেন্ট আছে, বেশ নিরিবিলি। আমরা ওটাতেই বসি তবে??”
“ঠিক, আছে। রাখছি তবে?”
তানভীর চিন্তিত ভঙ্গিতে ফোন রাখলো। কি কথা বলবে বাবা? ফুয়াদ ভাইয়ার কি কোন সমস্যা? না, না…..তা হবে কেন? সে রকম হলে তে ভাইয়াই বলতো? তবে? তবে কি হতে পারে? আচ্ছা! প্রিয়তা কি কিছু বলেছে নাকি? কিন্তু কি বলবে? ওর সাথে ইদানিং কালে সম্পর্ক টা একটু ঠান্ডা যাচ্ছে। অবশ্য ওকে কোনো কালেই সহ্য হতো না তানভীরের। হবেই বা কিভাবে? এতটুকু বাচ্চা মেয়ে, কোনো কথাই বোঝে না তানভীরের। বিয়ের পরে পরে তো শুধু কান্নাকাটি করতো! অসহ্য লাগতো তানভীরের। বিয়ে হয়েছে, কোথায় খুশি থাকবে? তা না শুধু ভেউ ভেউ কান্না। ওর কাছ ঘেসা যেতো না। ওকে কাছে যেতে দেখলেই কান্না জুড়ে দিতো মেয়ে।পাক্কা পাঁচ মাস পরে ওর কাছে যাওয়ার সুযোগ হয়েছিল তানভীরের। তারপরও কত ঘ্যানঘ্যান, প্যানপ্যান! কি করতে যে এই মেয়েকে পচ্ছন্দ করেছিলো বুঝে পায় না তানভীর! চেহারাটাই যা সুন্দর, বোধবুদ্ধি একদম বাচ্চাদের মতো। একটা কাজই ভালো পারে তা হলো পড়ালেখা। সে সব কথা মনে হতেই বিরক্তিতে ভ্রু কুচকে গেলো তানভীরের।

২০.

“একটা কবিতা শুনবে, সাঁচি?”
রুমে ঢুকতেই ফুয়াদের এরকম অদ্ভুত প্রস্তাবে যেন আকাশ থেকে পড়লো সাঁচি। অবাক হয়ে কিছুক্ষণ ফুয়াদের দিকে তাকিয়ে রইলো। এই লোক আর কবিতা! ভ্রু কুচকে বুঝতে চাইলো ফুয়াদের কথার মানে।পাগল হয়ে গেছে নাকি লোকটা? ঘুরতে যাওয়ার কথা শুনে নিশ্চয়ই মাথা নষ্ট হয়ে গেছে! এখন ওকে পটিয়ে পটিয়ে নিশ্চয়ই বেড়াতে যাওয়া ক্যানসেল করাতে চাইবে!
“কি হলো তোমার? তুমি খুব অদ্ভুত সাঁচি? সবসময় দেখি কিছু একটা বললেই তুমি ভাবনার জগতে চলে যাও। আজব ব্যাপার! কি ভাবো এতো সবসময়?”
“না…না…. কি ভাববো? কি যেন বলছিলেন?”
“বলছিলাম যে চলো আজ বারান্দায় মাদুর পেতে বসি। তোমাকে কবিতা আবৃতি করে শোনাবো। আজ বহু…বহুদিন পর কেন জানিনা আমার ইচ্ছে হচ্ছে, আবৃত্তি করার ইচ্ছে। ”
লোকটার মাথা সত্যি সত্যি গেছে নাকি? এ বলে তাকে কবিতা শোনাবে?? যে লোক ওর সাথে বসে ঠিকমতো দুটো কথাই বলে না,সে শোনাবে আবৃত্তি!!! তাও আবার বারান্দায় মাদুর পেতে বসে…..উহ! আল্লাহ! এতো রোমান্টিক প্রস্তাব? সহ্য হবে তো সাঁচির….!!!
সাঁচি নিজের হাতটা বাড়িয়ে দিলো ফুয়াদের দিকে-
“দেখি, হাতে একটা চিমটি কাটেন তো? সত্যি সত্যি আপনি ফুয়াদই তো নাকি?”
ফুয়াদ ও দুষ্টুমি করে একটু জোরেই চিমটি কাটলো সাঁচির হাতে-
“উফ…..আল্লাহ.. মরে গেলাম গো….আপনি কি মানুষ? এতো জোরে কেউ চিমটি কাটে?উহ….হাত জ্বলে গেলো তো???”
“আমার কি দোষ! তুমিই তো বললে চিমটি কাটতে?”
ঠোঁট উল্টালো ফুয়াদ।
“আমি বললাম বলেই কি এতো জোরে চিমটি কাটতে হবে?”
“আচ্ছা বাবা, সরি। হয়েছে? এখন এখানেই দাঁড়িয়ে থেকে মুড নষ্ট করবে নাকি দু মগ কফি বানিয়ে আনবে? আমি বারান্দায় মাদুর বিছাচ্ছি।”
সাঁচি আবারও ঝাটকা খেলে যেন। এই লোক তো আজ সারপ্রাইজ এর উপর সারপ্রাইজ দিয়েই যাচ্ছে। এতো সারপ্রাইজ আবার বদ হজম না হয়ে যায়!?

★★★
বুকের মধ্যে বাহান্নটা মেহগনি কাঠের আলমারি।
আমার যা কিছু প্রিয় জিনিস, সব সেইখানে।
সেই সব হাসি, যা আকাশময় সোনালী ডানার ওড়াওড়ি
সেই সব চোখ, যার নীল জলে কেবল ডুবে মরবার ঢেউ
সেই সব স্পর্শ, যা সুইচ টিপলে আলোর জ্বলে ওঠার মতো
সব ঐ আলমারির ভিতরে।
যে সব মেঘ গভীর রাতের দিকে যেতে যেতে ঝরে পড়েছে বনে
তাদের শোক,
যে সব বন পাখির উল্লাসে উড়তে গিয়ে ছারখার হয়েছে কুঠারে কুঠারে
তাদের কান্না,
যে সব পাখি ভুল করে বসন্তের গান গেয়েছে বর্ষার বিকেলে
তাদের সর্বনাশ
সব ঐ আলমারির ভিতরে।
নিজের এবং অসংখ্য নরনারীর নীল ছায়া এবং কালো রক্তপাত
নিজের এবং চেনা যুবক-যুবতীদের ময়লা রুমাল আর বাতিল পাসপোর্ট
নিজের এবং সমকালের সমস্ত ভাঙা ফুলদানির টুকরো
সব ঐ বাহান্নটা আলমারির অন্ধকার খুপরীর থাকে-থাকে, খাজে-খাজে
বুকের মধ্যে।
★★★

ফুয়াদ আবৃত্তি করছিলো, মাঝে মাঝে আকাশের দিকে তাকিয়ে, আবার মাঝে মাঝে ওর চোখ দুটো আপনাতেই বন্ধ হয়ে যাচ্ছিলো। আবেগে মাঝে মাঝে ফুয়াদের গলাটা কাঁপছিলো…. সাঁচি এক অপার বিস্ময় আর মুগ্ধতা নিয়ে ফুয়াদের দিকে তাকিয়ে আছে এক দৃষ্টিতে। ওর গলার ভয়েজ একদম চেন্জ হয়ে গেছে। কি সুন্দর ভরাট গলায় কাটা কাটা উচ্চারনে কথাগুলো বলছে। বলার সময় ওর ঠোঁট দুটো বাড়ি খাচ্ছে একে অপরের সাথে, চুলগুলো হাওয়ায় দুলছে একটু একটু, চাঁদের হালকা আলোয় ফুয়াদের মুখটা দেখতে কি যে অসাধারণ লাগছে…. কি এক অপার্থিব সৌন্দর্য্য ফুটে আছে ফুয়াদের চোখে মুখে….সাঁচি নেশারুর মতো তাকিয়ে রইলো…. চোখের পলকও ফেললো না একবারও। ফুয়াদের আবৃত্তি শেষ হওয়ার পর….অনেক…বেশ অনেকটা সময় পর…. ওরা দুজনেই চুপচাপ বসে আছে….. ফুয়াদ চোখ বন্ধ করে দেয়ালে হেলান দিয়ে বসে আছে….. সাঁচি ওর দিকে তাকিয়ে থাকতে থাকতে নিজেও কখন যে চোখদুটো বন্ধ করে ফেললো…জানে না…. কি এক অদ্ভুত অনুভুতি ওকে গ্রাস করে রাখলো…..আপনাতেই ওর চোখ দুটো থেকে জল গড়িয়ে পড়লো দু’ফোটা। চোখ দু’টো বন্ধ রেখেই সাঁচি প্রশ্ন ছুড়ে দিলো-
“আবৃতি করতেন, আপনি?”
ফুয়াদ তখনো বুদ হয়ে আছে সেই পুরনো স্মৃতিতে। এই কবিতা ওকে কত কিছু মনে করিয়ে দেয়….কত…স্মৃতি…. আবেগ….ভালোবাসা….. এসব তো কখনো ধুসর হওয়ার নয়!? ভার্সিটিতে ওর এই আবৃতি, ওকে কতো মেয়ের ক্র্যাশ বানিয়েছে ও নিজেও জানে না। এটা ছিলো ওর নেশার মতো….মানুষের মদ,গাজা, বিড়ি, সিগারেট এর নেশা হয়…. ওর ছিলো কবিতার নেশা। আজ কতগুলো বছর পর আবার সেই নেশাটা মাথাচারা দিলো….কেন দিলো জানে না…..শুধু খুব ইচ্ছে হচ্ছিল ও একটু কবিতা আবৃতি করবে আর কেউ একজন শুনুক! ওকে বাহবা দিক একটু! হাতে স্পর্শ পেতেই চোখ খুললো ফুয়াদ, সাঁচি তাকিয়ে আছে ওর দিকে। সাঁচির হাতটা ফুয়াদের হাতের উপর আলতো করে রাখা। ফুয়াদ সাঁচির হাতের দিকে তাকাতেই সাঁচি হাতটা সরিয়ে নিলো। হাত থেকে দৃষ্টি সরিয়ে ফুয়াদ সাঁচির মখের দিকে তাকালো। ফুয়াদের মনে হলো সাঁচির চোখদুটো ভেজা ভেজা। কাঁদছিলো নাকি মেয়েটা!
“আপনাকে ডাকছিলাম অনেকক্ষণ ধরে।”
“ওহ, সরি। আসলে অনেকদিন পর আবৃতি করলাম তো…. একদম নস্টালজিক হয়ে গেছিলাম। ”
“ওহ! আপনি আবৃতি করতেন আগে?”
“হুম! আমার ছোট থেকেই খুব শখ ছিলো, গুনটাও ছিলো হয়তো! ভার্সিটিতে একসময় প্রচুর আবৃতি করেছি।”
“খুব সুন্দর আবৃতি করেন। তা বাদ দিলেন কেন? মাঝে মাঝে করলেও পারেন।”
“কি যে বলোনা? এইসব চাকরি বাকরি করে কি আর সাহিত্য চর্চা হয়? আর তাছাড়া আবৃতি ছেড়েছি আমি অনেক আগে। আট নয় বছর তো হবেই।”
“এতোদিন??? এতোদিন পরেও তো ভোলেননি কিছুই! আমি অবশ্য এসব কবিতা টবিতা অতো বুঝি সুঝি না। তবে আপনার গলায় শুনতে বেশ লেগেছে! মনে হচ্ছিল আরো শুনি, শুনেই যাই! একেবারে বুদ হয়ে গেছিলাম!”
নিজের প্রশংসা শুনে একটু যেন লজ্জা পেলো ফুয়াদ। সে চুপ করে বসে রইলো।
“কার কবিতা?”
“পূর্নেন্দু পত্রী। আমার খুব পছন্দের একজন।”
“আমারও ভালো লাগলো খুব। মাঝে মাঝে আমাকে এরকম দু একটা আবৃতি করে শোনাবেন প্লিজ।”
সাঁচি আকুতি জানালো। তারপর দুজনেই আবারও চুপচাপ বসে আছে। যেন কি বলবে বুঝতে পারছে না। সাঁচি উসখুস করছে একটু। ফুয়াদের সাথে ও সিরিয়াসলি আজ কথা বলতে চাচ্ছিলো কিন্তু ও তো আজকের পরিবেশটাই বদলে ফেললো। এই পরিস্থিতিতে কথা বলে এত সুন্দর পরিবেশ টা নষ্ট করা কি ঠিক হবে?? বুঝে উঠতে পারছে না সাঁচি। বেশ কিছুক্ষণ দোটানার মধ্যে চুপচাপ বসে রইলো। এই সুন্দর আধো চাঁদের আলোর মধ্যে দুজনে পাশাপাশি বসে থাকাও তো অনেক বড় পাওয়া?
“তুমি কি কিছু বলবে? এরকম উসখুস করছো কেন?”
হঠাৎ ফুয়াদের কথায় চমকে ওঠে সাঁচি। বলবে না বলবে না করেও বলে ফেললো সাঁচি-
“আপনাকে একটা কথা জিজ্ঞেস করতে চাচ্ছিলাম। প্লিজ ঠিক ঠিক উত্তর দেবেন!!”
ফুয়াদ মনে মনে ভয় পেল-
“এই সেরেছে! যে কথার ভয়ে এত কিছু করলো, তারপরও মনেহয় সেটা থেকে রেহাই পাওয়া গেল না???!!”
কি প্রশ্ন করবে সাঁচি? কি জানতে চাইবে ও? অধীর আগ্রহে সাঁচির মুখের দিকে তাকিয়ে রইলো ফুয়াদ……….।

চলবে—-
©‌‌‌‌Farhana_Yesmin

একটি উত্তর ত্যাগ

আপনার মন্তব্য লিখুন দয়া করে!
এখানে আপনার নাম লিখুন দয়া করে