আজকে আমার মন ভালো নাই।
নাহিদা সানজিদ।
১২.
“তোর বউয়ের গহনা বেচে দিলেই তো পারিস। ওগুলো তো তোরই।”
রূমী ভ্রু কুঁচকে তাকালো। সেদিন মিহীকা রূমীর ভীতু চেহারা দেখে খিলখিল করে হেসে উঠেছিলো। তারপর হাসি চেপে বলেছিলো, “মজা করেছি, স্যার। বাসায় সবাই আছে। আপনাকে একটা পরীক্ষা করলাম। সাইকোলজি বলে, মেয়েরা তাদের জীবনে থাকা পুরুষদের ব্যাপারা নিশ্চিন্ত থাকতে চায়। এজন্য সম্ভবত মেয়েরা একটু বেশি সন্দেহপ্রবন হয়।”
রূমী প্রথমবারের মতো ধমকালো ওকে, “এসব ভুলভাল সাইকোলজি কে শেখাচ্ছে আপনাকে? আমি অনেক রাগ করেছি।”
মিহীকা আবারও হেসে উঠলো। সেদিনের মতো পড়িয়ে বেরিয়ে এসেছিলো সে। হাত-পায়ের কাঁপন স্পষ্ট অনুভব করতে পারছিলো। কত কিছুই না হয়ে যেতে পারতো চোখের পলকে! আল্লাহ বাঁচালেন।
ইদানীং তার আর এসব ঝামেলা ভালো লাগে না। একটা পিসি নিয়ে নিলে নিজের মতো কিছু করতে পারতো। এসব দ্বারে দ্বারে টিউশনি করে অপদস্ত হতে হতো না। মিন্টুকে ঝামেলার কথা বলতে না বলতেই তার শয়তানি সমাধান হাজির।
— “কোন গহনা?”
— “তোর বউরে বাপের বাড়ি থেকে কিছু দেয় নাই? মাইয়ারে সাজায় টাজায় দেয় স্বর্ন দিয়ে। ওগুলা আরকি।”
— “আমার বউকে গহনা আমি কিনে দিব। ওর বাবা কেন দিবে?”
মিন্টু অনুচিত উচ্চারণের একটা গালি দিয়ে বলল, “আবার বালের ঢঙ শুরু হইছে। দ্যাখ, এগুলা বইয়ে মানায়। বক্তৃতা দিলে বাহবা পাইবি মাইয়াগো থেকে, বাস্তবে এসবের কাম নাই। অহন লবি, এরপর টাকা পয়সা হলে আবার কিনে দিবি।”
রূমীকে মাথা নাড়িয়ে বলল, “আমি ফেরত দিতে পারব তার নিশ্চয়তা কী? আম্মার গহনা বেচে আব্বা একটা বিজনেসে দিয়েছিলো। সব টাকা খোয়া। আর স্বর্ণের এখন যা দাম! আমি এত রিস্ক নিতে পারবো না। আর এটা কেমন যেন! স্বর্ন তো বাবা-মায়ের কাছ থেকে পেয়েছে, ওর জন্য স্মৃতি, আমি কীভাবে নেই? আমার গায়ে লাগবে। আর যদি আমার বাড়ি থেকে দেওয়া হয়, তাহলে তো উপহার ফিরিয়ে নেবার মতো জঘন্য কাজ হবে!”
মিন্টু বিরক্ত হয়ে গেলো। এই ছেলের নীতিবাক্য তার আর ভালো লাগে না। সবকিছুতে তার একহাত লম্বা ভাষণ নিয়ে আসতে হবে। সে ফ্যাকাশে রঙা একটা কাঁথা গায়ে টেনে দিয়ে ঘুমানোর চেষ্টা করলো, “তাইলে আমার কাছে ক্যাচক্যাচ করস ক্যান? তোর আল্লার কাছে চা, যা। আল্লাহ তরে আকাশ থেইকা পয়সার বৃষ্টি দিব। শালা, আবাল একটা। বউ যখন ফট কইরা পল্টি নিয়া কইব, তর মতো ফাতরা জামাই জীবনেও দেহি নাই, তখন কান্দিস না। গালে একটা চটকনা লাগামু।”
রূমী দীর্ঘশ্বাস ফেললো। ওর গালিগালাজ শুনে এখন আর মারামারি করতে ইচ্ছা করে না। ওর কথায় একটু খারাপি আছে, মনটা ভালো। বাজে পরিবেশে বড় হওয়ায় একটু রগচটা গোছের হয়ে গেছে। রূমীর মাঝেমাঝে অনেক প্রশ্ন জাগে। কেউ যদি ভালোর সংস্পর্শে বড় হয়ে ভালো হয়, তাতে তার অবদান সামান্য থাকে। কেউ যদি আঁধারের দুনিয়ায় বড় হয়ে আপাতদৃষ্টিতে মন্দ মানুষ হয়েই বড় হয়, তবে তার অপরাধ আর কতটুকু? আমরা ভালোর মুখোশ ধরে কেন তাদের দূরে রেখে দেই?
রূমীকে অনেকবার অনেকে বলেছে রুম বদলে ফেলতে। কিন্তু ওর মায়া লাগে। মিন্টু সেই ছেলে, যে একদিন এক মাদকসেবক সিনিয়রের কাছ থেকে তাকে বাঁচিয়ে নিয়েছিলো বন্ধুত্বের খাতিরে। তাই তার মন বারবার বিভ্রান্ত হয়, একজন মানুষ কী সম্পূর্ণ ভালো হতে পারে?
কেউ কী তার সমস্তটা জীবন কলঙ্কহীন রাখতে পারে?
তবুও কেন আর ভালো খারাপের তকমা দিয়ে বেরাই আজীবন!
**
অর্পার ফোন হঠাৎ করে বালতিতে পড়ে গেছে। স্পট ডেথ। অনেক আগের মোবাইল। বাবা, বড় আপার হাত হয়ে তার কাছে এসেছিলো। তবুও এই পুরোনো বস্তুটার প্রতি তার মায়া পড়ে গেছে। সে সুন্দর করে তার সমাধি করলো আপন স্মৃতির সংগ্রহে। পুরোনো জিনিস ফেলে দেওয়ার ধাঁত তার নেই। বরং প্রতিটি জিনিস সযতনে আগলে রাখা তার স্বভাব। এ যেমন রূমীর বই, তার উপহার দেওয়া গাছ? কি যে দুশ্চিন্তা হচ্ছিলো গাছটাকে নিয়ে! নতুন কোনো পাতার দেখা না পেয়ে তার মনে হচ্ছিলো, এই বাচ্চাটা অঙ্কুরেই ঝরে পড়বে মৃত্যুর কোলে, ঠিক তাদের যুগল জীবনের মানবীয় প্রেমের মতো।
ক্যান্টিনে খাওয়াদাওয়া বন্ধ করে টাকা জমিয়ে একটা টব কিনলো মাঝারি ধরনের। গাছের পুনর্বাসন দিলো আবারও। এবার রেখে আসলো উঠানে। ভয় লাগছিলো, কোনো দুষ্ট ছেলে এসে যদি ভেঙে ফেলে? প্রতিদিন একবার করে দেখতে যেতো এমন করে যেন মায়ের কোল থেকে একটা ছোট্ট শিশুকে দূরের কোনো মাদরাসায় দিয়ে দেওয়া হয়েছে। অদ্ভুত এই বস্তুগত সংসার নিয়ে তার দিন চলে যাচ্ছে। আজ প্রথম গাছটায় ফুল এসেছে। ছবি তোলার জন্য ফোন নেই। নয়ত রূমীকে পাঠানো যেতো। রূমী মারওয়ার সঙ্গে কথা বলছে কলে। ইনিয়ে বিনিয়ে সম্ভবত স্ত্রীর কথা জানতে চাইছে। কিন্তু মারওয়ার সঙ্গে কী এসব ছুতো করা সম্ভব? কাট কাট গলায় জবাব দিচ্ছে সে। আগ বাড়িয়ে একটুকিছুই বলছে না। অর্পাও ইচ্ছা করে সামনে গেল না।
বিকেলে ওদের একটা গোপনীয় সাক্ষাৎকার আছে। সাফার জন্য ছেলে দেখতে যাবে তারা তিনজন। গুরুজন হিসেবে বাড়ির বড় বউই যাচ্ছে। পেছন পেছন শ্বশুরমশাই যাবেন ঠিকই, কিন্তু দেখা দেবেন না। মেয়েদের চোখে এমন অনেককিছুই ধরা পড়ে যা পুরুষ মানুষের পক্ষে বোঝা সম্ভব না। ষষ্ঠ ইন্দ্রীয়ের গুনগান তো পুরোনো কথাই। তারা তিনজন প্রস্তুতি নিচ্ছে। সাফা ঠিক প্রস্তুতি নিচ্ছে না, জোর করে নেওয়ানো হচ্ছে। সে চোখমুখ লাল করে ফেলেছে। ফর্সা হওয়ায় চোখে লাগছে বেশ।
দাদী ওর পিঠে হাত বুলিয়ে বলছেন, “আমার জাদুসোনা, যাইয়া একবার পোলাডার চেহারাছবি দেখবি। কালা না ধলা দেখতে হইব না? ভালা লাগলে তো লাগছে, না লাগলে বাদ। একজন দেখতে চাইলে কী না করন যায়? লক্ষ্মী না আমার বইন?”
সাফা মনে মনে এবার কিছুটা সাহস পেলো। গিয়ে ছেলেটার ভুল ধরার জন্য মানসিকভাবে প্রস্তুতি নিলো, বাহ্যিক সাজসজ্জা তার সামান্যই। বলা যায়, করেইনি।
***
“ছেলেটাকে দেখলাম। আমার পনেরো ষোলো বছরের এই নাতিদীর্ঘ জীবনে এরচেয়ে বিচ্ছিরি ছেলে আর দেখিনি! এত কুচকুচে কালো কারো গায়ের রঙ হতে পারে, ধারণাই ছিলো না। অথচ ভাবী দেখে বলল, “আরে! এ তো দেখছি হুমায়ুনের নায়ক মুহিব!”
আমার একবার বমি করে দিতে ইচ্ছা করলো, এ? নায়ক? ভাবী বেশ উৎসাহী গলায় ভাইয়ার একটা বইয়ের গল্প বলতে লাগলেন।
ছেলেটার নাম মুহিব। গায়ের রঙ এত কালো যে অন্ধকারেও দেখা যায় না। শুধু দাঁতগুলো মজবুত, টেকসই, ফর্সা। কী আশ্চর্য! বিবরণ খাপেখাপ মিলে যাচ্ছে! তার মানে কী এটা একই ঘটনার পুনরাবৃত্তি হচ্ছে? লেখক তার জীবনে একবার এই ঘটনা দেখে লিখে ফেললেন এসব ছাঁইপাশ পিরিতের কাহিনী, আর আমি দেখে লিখতে যাচ্ছি আরেকবার? কী ভয়ানক ব্যাপার? এই লোক কী তাহলে আমার দুলাভাই হতে চলেছে? অন্ধকারে যাকে ঠাওর করা যাবে না!
ভাবী আমার কথা শুনে বললেন, “সাদা মানুষের তো আলাদা কোনো আলো নেই অন্ধকারে দেখতে পাওয়ার। আছে?”
এসব ঢঙের কথা আমি শুনতে পারি না। বিয়ে হবে না, ক্যানসেল। কিন্তু আমার ধারণা, সাফা খুব শিগগিরি এই লোকের কালোজাদুতে কবজা হবে, ঠিক আমার নীরিহ ভাইটির মতো। এই মহামারীর জালকে আমি স্পষ্ট চিনতে পারি, আমার সেটুকু জ্ঞান আছে। সাফা হেঁটে আসছে লাজুক পায়ে, তার ঠোঁটের কোণে মৃদু হাসি, ইয়া আল্লাহ! লা ইলাহা ইল্লা আংতা সুবহানাকা ইন্নী কুনতি মিনাজ জোয়ালিমীন! এই ডায়েরীতে তোমার কাছে লিখিত দোয়া চাচ্ছি, এই অনিষ্ট থেকে রক্ষা কর।”
****
মারওয়ার দ্রুত ডায়েরি বন্ধ করে ক্ষ্যাপা গলায় বলল, “এতক্ষণে আসার সময় হয়েছে? কি পিরিতির আলাপ করলি শুনি?”
সাফা বিব্রত বোধ করলো। লোকটার সঙ্গে তার ব্যক্তিগত কথাগুলো কী ফাঁস করে দেওয়া বুদ্ধিমানের কাজ হবে? নাকি অনুমতি নেবে আবার ফিরে গিয়ে? জিজ্ঞেস করবে, “আচ্ছা, আমি কী আমার বোনকে আমাদের সব কথাগুলো বলতে পারি? এটা কী কথার আমানতের খেয়ানত হবে?”
কিন্তু তার লজ্জা করছে। লোকটা এত ভালো! প্রথম দেখায় লোকটাকে দেখে ভড়কে গেছিলো বটে। তবে চেহারাসুরতের নম্রতা তার সেই ভাবনাকে মেরে ফেলতে বাধ্য করেছিলো। গায়ের রঙ কবে থেকে আবার চিন্তায় ফেলে দেওয়ার বিষয় হয়ে দাঁড়ালো? লোকটি তাকে শুরুতেই সালাম দিলো, এরপর বলল, “এর আগে ৩৪ বার রিজেকশন খেয়েছি, এবার ৩৫ নম্বর সাক্ষাৎ।”
লোকটার কথায় তার ভেতর একটা হাহাকার জেগে উঠলো। আহারে! সে সরল গলায় শুধালো, “কেন?”
লোকটা অজ্ঞতা প্রকাশ করলো, “কি জানি! হয়ত এই গায়ের রঙ?”
সাফা মাথা নাড়ালো, “উহুম। এমনও তো হতে পারে আপনার স্বভাব চরিত্র ভালো মনে হয়নি?”
তার অবলীলায় মুখের উপর বলা থেকে লোকটা বোধহয় কিছুক্ষণ থমকালো। এরপর মাথা নিচু করলো, “আমার ক্যারেক্টার সার্টিফিকেট তো আর আমি দিতে পারি না। আপনি আমার এলাকায়, বন্ধু-বান্ধবদের থেকে জেনে নিতে পারেন। তাছাড়া, আপনার মনে হয় এই চেহারায় আমি ক্যারেক্টারলেস কিছু করার সু্যোগ পেয়েছি?”
— “তার মানে কী? সুযোগ পেলে করতেন? সুযোগ না পেয়ে ভালো মানুষ হয়েছেন?”
লোকটা থতমত খেয়ে বলল, “এভাবে তো ভেবে দেখিনি।”
সাফা হাসলো, “আপনার চেহারায় তো কোনো সমস্যা দেখছি না। আপনার নাক অনেক সরু। আপনি জানেন? আমিও রিজেকশন খেয়েছিলাম, নাক বোচা বলে।”
বলে সে নাকে হাত দিলো। জহির হেসে ফেলল, “আপনাকেও কেউ রিজেক্ট করতে পেরেছে! এত তাড়াতাড়ি বিয়েই বা করছেন কেন? আমি ভাবিনি, আপনি এত ছোট!”
সাফা এমনভাবে গল্প করতে শুরু করলো যেন শত সহস্র বছর ধরে তার বন্ধুত্ব এই লোকটির সাথে। কখন যে সময় ফুরিয়ে এলো! মানুষটা যাওয়ার সময় বলে গেল, তার মায়ের পর প্রথম কোনো মেয়ে তার সঙ্গে এত সুন্দর করে কথা বলেছে। ছোটবেলায় অবশ্য আরেকজন বলেছিলো, মেয়েটির নাম টিনা। তখন তো আর রঙের ভেদাভেদ বুঝতো না। সাথে সে ধরেই নিলো, তার বিয়েটা এখানেও হচ্ছে না। মেয়ের মনে হালকা একটু জায়গা করে নিতে পারলেও , বাবা-মায়েরা রাজি হবেন না। এমন কত অনুভূতি চাপা পড়ে যায় বাস্তবতার ফাঁদে! সব কী আর পার্মানেন্ট হয়? কিছু জিনিস দলছুটো হয়ে স্মৃতিতে আজীবন জায়গা করে রাখে।
মারওয়া এসব গল্প কিছুতেই ওর পেট থেকে বের করাতে পারলো না। বিরক্ত হয়ে বলল, “এই কালাচানের চিন্তা বাদদে। লোকটাকে দেখলেই আমার গা জ্বালা করছে। ইইই..”
সাফা খুব কষ্ট পেলো। রাগে লালা হয়ে গেলো সে, “বিয়ে হলে আমার সাথে হবে, তোর গা জ্বালা দিয়ে আমি কী করব? তোর গা জ্বালাই থাকা উচিত, শালী আর দুলাভাই একশ হাত দূরত্বে থাকবে, এটা নিয়ম।”
মারওয়ার বিস্ময়ের পারদ ছাড়িয়ে যাচ্ছে। আজ থেকে ও ডায়েরি লেখাই ছেড়ে দেবে। আর ভাগ্যলিখন লিখে সে বাবার দেয়া ডায়েরিটার পৃষ্ঠা নষ্ট করতে চায় না। বরংচ গণকের কাজ শুরু করা যায়, হাত দেখে দেখে পয়সা কড়ি নেবে। একটা অনলাইন পেজ খুলে ফেলবে আপডেটের জন্য। প্রথম রিভিউ দেবে তার ভাই-বোন। আশ্বাস দিয়ে বলবে, “ও যা বলে, হান্ড্রেড পার্সেন্ট মিলে যায়। আমরা তার প্রমাণ। আপনারাও ট্রাই করতে পারেন, আশা করি ধোঁকা খাবেন না। ট্রাস্টেড পেজ।”
চলবে ~
আজকে আমার মন ভালো নাই।।
নাহিদা সানজিদ।।
১৩.
আরিব বর্তমানে মধ্যপ্রাচ্যের একটি দেশে, বাবার সঙ্গে। ঘুরে বেড়াচ্ছে নিজের মতো। মন চাইলে চলে যাচ্ছে এদিক ওদিক। কিন্তু কোথাও মন বসে না। মনের সঙ্গে মস্তিষ্কের দ্বন্দ্ব চলছে। ছোটবোন আরিবাকে বলেছে মারওয়ার বাড়ির খোঁজখবর রাখতে, যেন ফট করে আবার তাকে কেউ দেখতে না চলে আসে। বাঙালি ঘরের তো আবার ব্যারামের অভাব নেই। হঠাৎ শোনা যাবে, দেখতে এসে বিয়ে হয়ে গেছে। আরিবা অবশ্য বলেছে,
—“এত কী দরকার? তোর জন্য আরো ভালো মেয়ে দেখছি। মারওয়া একটা মেয়ে হলো?”
আরিব ধমকে বলেছে, “তুই চুপ থাক।”
বাবা হজ্বের নিয়ত করেছেন। খুব শীঘ্রই বের হবেন মদিনার উদ্দেশ্যে। ওর প্রথমে যাবার ইচ্ছা ছিলো না, কিন্তু কি মনে করে সাথে চলল। হুটহাট সিদ্ধান্তে তেমন কিছু গোছানোর সুযোগ পেলো না। একটা ট্রাভেল ব্যাগ নিয়েই চড়ে বসলো উড়োজাহাজে। সাদাত হোসাইনের একটা কবিতার লাইন মনে পড়ছে,
“তোমার জন্য যতটা পথ হেঁটেছি,
ততটা পথ হাঁটলে আমি পৌঁছে যেতে পারতাম জেরুজালেম, আমার প্রিয়তম শহর।”
লাইনটা ওর মনে দাগ কেটে গেলো। তার প্রিয় শহর কোনটি? বাবাকে জিজ্ঞেস করায় বললেন, “মদিনা”।
সে তার হাঁটার উদ্দেশ্য বদল করার জন্য হাঁসফাঁস করে উঠলো। মারওয়া যদি তাকে পছন্দ না করে, তাকে কী জোর করা আদোও সম্ভব? কখনো নয়। সে দীর্ঘশ্বাস ফেলে আধঘুমে ডুবলো।
ইহরামের কাপড় বাঁধার সময় সে খানিকটা মায়ায় পড়ে গেল সাদা কাপড়ের। কাফনের রঙ। মৃত্যু! এ মুহুর্তে মৃত্যু হলে কী হবে তার? এই ছোট্ট জীবনটা কী অবলীলায় খাপছাড়া করে কাটিয়ে দিচ্ছে সে! মরে যাবে এমন করে যেন পৃথিবীর বুকে সে কোনোদিন ছিলোই না।
মারওয়ার বাবা মির্জা গালিবের কবিতার বেশ বড় রকমের একজন ভক্ত। একদিন চা খেতে গিয়ে দেখা। তিনি বললেন, “আরিব। আমরা আমাদের জীবনে কী চাই সেটা নির্ধারণ করা জরুরি। একটা ফাইনাল ডেসটিনেশন। এটার পরে ওটা চাই, এরকম খাই খাই ধরনের মনোভাব নিয়ে তুমি কক্ষনো সুখী হতে পারবে না। বুঝলে? মির্জা গালিব এ নিয়ে একটা হৃদস্পর্শী লেখা লিখেছিলেন, তুমি জানো?
পৃথিবীতে পোশাক বিহীন এসেছিলে হে গালিব!
একটি কাফনের জন্য এতো লম্বা সফর করলে!”
বাবার সঙ্গে গলায় গলায় বন্ধুত্ব রেখে তারই অগোচরে তার মেয়ের পেছন পেছন ঘোরার মতো দুমুখো বিশ্বাসঘাতকতা করেছিলো যেন সে। দ্রুত মন পাল্টাতে লাগলো অন্য কোনো বিষয়ে। মন খারাপের অতল গহ্বরে তলিয়ে যাবার আগে।
মদিনা শহরটা আসলেই মায়ার শহর। বহুদিন পর সে প্রাণখোলা সজীব নামাজের ছায়া দেখলো। দেখলো তাড়াহুড়ো করে আসা মুসল্লি। রাতের খোলা আকাশ। মিটিমিটি তারা। মসজিদের মেঝেতে সে শুয়ে থাকলো কিছুক্ষণ সিজদাবনত হয়ে। মাথা ওঠাতে ইচ্ছা করছে না। ওর খুব কান্না পাচ্ছে। সে ফুঁপিয়ে কেঁদে উঠল। মুখ গুজা অবস্থায় কেউ দেখার নেই। সে মনে মনে বলতে লাগলো, “আল্লাহ, তুমি জানো। আল্লাহ, তুমি জানো।”
ওর শরীর কাঁপছে। সে উঠে বসলো। ঝিরিঝিরি হাওয়ার সঙ্গে শুরু হলো মৃদু বৃষ্টি। সে চুপচাপ বসে রইলো। আরবীয় এক তরুণ সুপুরুষ তাকে খেজুর সাধলো। সঙ্গে এক বোতল পানি। সে হাসিমুখ করে নিলো। কোথায় যেন শুনেছিলো, উপহারে কখনো না করতে নেই। নবিজী সা: নাকি এ নিয়ম মেনে চলতেন, তিঁনি দানের জিনিস নিতেন না। নিতেন ভালোবেসে দেওয়া উপহার। সে মাথা উঁচু করে আকাশের দিকে চেয়ে রইলো নিশ্চিন্তে। ছেলেটা বসার অনুমতি চাচ্ছে। বসার পর সে অস্পষ্ট ইংরেজিতে বলল,
“Are you sad, brother? I’m not fluent in English. Gonna study in abroad next month. Wanna have a try with you..”।
বলেই হাসলো। লালচে ফর্সা গায়ের রঙ। গালে হালকা দাঁড়ি। আরিবও হাসলো। বসার ভঙ্গিতে শালীনতা এনে বলল, “I’m not fluent too! Even I’m a college drop out student.”
ছেলেটা গল্প জমাতে চাইলো। ওর চোখেমুখে শিশুসুলভ উচ্ছলতা। নাম ইব্রাহীম। ইব্রাহীম নামের সব ছেলেরাই কী এমন সুন্দর আর সাদাসিধা হয়? আরিবের প্রশ্ন জাগে। রূমী ভাইয়ের নামও তো ইব্রাহীম রূমী।
আরিব বৃষ্টিভেজা মেঝেতে গা এলিয়ে দিলো। এখন বৃষ্টি নেই।
সে জিজ্ঞেস করলো, “ইব্রাহীম? এই মসজিদ কী শুধু পূন্যবান ব্যক্তিদের জন্য? আল্লাহ যদি শুধু ভালো মানুষ বেছে নেন, আমরা কোথায় যাবো বলতে পারো?”
ইব্রাহীম তার সরল দীপ্তিময় চোখ মেলে তাকালো পেছন ফিরে, “না তো। তুমি কী শোনোনি? আল্লাহ তাওবাকারীদের বেশি ভালোবাসেন। তওবা কারা করে বলোতো? সমস্যা তো আমাদের মাঝে। আমরাই কখনো আল্লাহকে বেছে নেই না।”
আরিবের বুকে ধ্বক করে উঠলো। সহজ সরল একটা কথা। তবুও তার ভেবে দেখতে ইচ্ছা করছে না। অনুশোচনা করতে গেলে তার পাগল পাগল লাগে। তার ইব্রাহীমকে আরেকটা প্রশ্ন জিজ্ঞেস করতে ইচ্ছা করছে, “ইব্রাহীম, মানুষ কেন স্রষ্টায় বিশ্বাস করে না বলতে পারো?”
বিশ্বাসীদের দূরবস্হা তাকে প্রশ্নটি করার সাহস দিলো না।
**
মারওয়া এসএসসির জন্য জোরদার পড়াশোনা করছে। তার ঘরের মানুষ বিয়ে করে চুলোয় যাক, তার কী? সে করবে পড়াশোনা, ব্যারিস্টারি পেশায় যাওয়া যায়। মন্দ হয় না। সমস্যা হলো, যুক্তিতর্ক করতে গিয়ে আবার ব্যক্তিগত আক্রমণ করে বসলে কী হবে? উল্টোপাল্টা যুক্তি শুনে হয়ত ভরা কোর্টে উকিলের মুখে পানি ছুঁড়ে মারলো?
আচ্ছা, পরে দেখা যাবে। সে মনোযোগ দিয়ে পড়তে শুরু করলো। ইংরেজির একটা প্রেজেন্টেশন করছে, “There is 6 members in my family. I’m blessed with one sister, one sister in law, one brothers as well. They are a big foool…”
বলে একটা টান দিলো। ভালো লাগছে না। একবার জীববিজ্ঞান বই খুলে “আস্তাগফিরুল্লাহ” বলে বই বন্ধ করে দিলো। এত পাপের কাজ তার দ্বারা হবে না। আরেকবার ধরলো পদার্থবিজ্ঞান, বিকৃত মুখে বন্ধ করে দিয়ে নিজেকে নিজে বলল, “এর চেয়ে অপদার্থ থাকাই ভালো ছিলো।”
এরপর ধরলো বাংলা। বহিপীরের গল্পটা পড়ার পরই “আউজুবিল্লাহ” পড়লো। বইয়ের ভেতর দিয়ে তাহেরাকে বলল, “বুড়া হোক, মরা হোক, জামাই তো? ছিহ্ ছিহ্। ভাইগা যাওয়ার আগে ডিভোর্স দিবি না? ইদ্দতেরও তো ব্যাপার স্যাপার আছে। হাশেম, লুইচ্চা ব্যাডা।”
অর্পার ওর অতি পড়ুয়া ভাবভঙ্গি দেখে এক গ্লাস দুধ এনেছিলো, “কাকে বকছো এমন করে?”
মারওয়া মাথা নাড়িয়ে দুঃখ প্রকাশ করলো। বাংলাদেশের শিক্ষাখাতে কত বড় রকমের অযোগ্য ব্যক্তিরা বসে আছে তা বিশ্লেষণের চেষ্টা করলো। সাথে সন্দিহান কন্ঠে বলল, “ওই ঢঙ্গী কোথায়? পড়াশোনা কী ছেড়ে দিয়েছে? ফুল টাইম গৃহবধূ? নারীজাতির এ কী অবনতি! রোকেয়া তার সারাজীবন এ নারীজাতি চেয়েছিলো? একটা কাইল্লা ছেলের প্রেমে পড়ে যে জীবন জগত ভুলে যায়!”
অর্পা হেসে ফেললো। ভ্রু উঁচিয়ে খানিকটা গম্ভীর হয়ে গেল, “মারওয়া, তুমি কী জানো? পৃথিবীতে সবচেয়ে সুন্দর এবং একই সাথে সবচেয়ে কুৎসিত বিষয় হলো মানুষের কথা বলা। ‘সে মুখ খারাপ হলেও মন ভালো’ এই সে নামক মানুষেরা খুব কষ্টে থাকে। তারা পাহাড়সম কোনো উপকার এহসান আমাদের উপর করে ফেললেও তার একটা বাজে কথা মস্তিষ্ক থেকে সবকিছু ডিলেট করে দিতে সক্ষম। মানুষের ধর্ম এমনই। বিপরীতে কারো চরম দুঃসময়ে তুমি কেবল কিছু শব্দ বল, বুদ্ধি বিবেচনাবোধ খাটিয়ে, সে তোমাকে তার সারাটি জীবন মনে রাখবে। তুমি যদি তোমার কথার নিয়ন্ত্রণ নিতে পারো, বাকি সবকিছুর নিয়ন্ত্রণ নেওয়া ব্যাপার না। এর এটা কিন্তু অনেক চ্যালেঞ্জিং একটা কাজও বটে। আল্লাহ আমাদের কথা বলার নিয়ামত দিয়েছেন বলেই যে আমরা একে যা তা বলে ব্যয় করব, এটা কী কোনো যুক্তি হলো? তুমিই বলো।”
মারওয়া ভ্রুক্ষেপহীন ভাবে চেয়ার ঘুরিয়ে বসলো। এমন ভাব করলো যেন কিছু শোনেইনি। সে এবার ধরলো ইসলাম শিক্ষা বই। পড়তে শুরু করলো সূরা ইনশিরা। বারবার পড়লো, যেন মুখস্হ হয়ে যায়। অর্পা ওর কাঁধে হাত রেখে কি যেন নিরব আশ্বাস দিয়ে গেলো। এরপর চলে গেলো।
***
দুদিন বাদে রূমী মিহীকার মাকে ‘না’ করে দিলো। আর পড়াবে না। বলল, বিয়ে করেছে রিসেন্টলি। কোনো কাজে ঢুকে যাবে।
জীবনের এত জটিলতা তার ভালো লাগে না। রিক্ত শূন্য হাতে রাস্তায় নেমে সে আকাশের দিকে তাকিয়ে মনে মনে বলল, “আল্লাহ, আমি তোমার ভয়ে ভুলের আশঙ্কায় ফিরে এলাম। আমাকে এর চেয়ে উত্তম কোনো ব্যবস্হা করে দাও, প্লিজ!”
মারওয়াকে সেদিন জিজ্ঞেস করেছিল, “অর্পার ফোন কোথায়?”
সে ভীষণ হেয়ালি, “তা আমি কী জানি? তোর ধারণা, আমি তোর বউয়ের পিছে পিছে ঘুরি? তার সব খবর জানার দায় আছে আমার?”
রূমী আশ্চর্য হলো, “অর্পাকে ফোনটা দে।”
সে দুই হাঁটু একসাথ করে বসে শক্ত গলায় বলল, “পারব না। তোর বউ গাছ-পালার সেবা করছে। আমি তো শুনেছি, সে বৃক্ষকে সন্তান হিসেবে গ্রহণ করেছে। বইকে গ্রহণ করেছে সৎ মেয়ের মতো। সুযোগ পেলেই দেখি জ্ঞানার্জনে ডুবে যাচ্ছে।”
মারওয়ার সঙ্গে তর্ক করতে করতে রাত পোহায়।
মিন্টু এসে চোখ টিপল একদফা, “মাম্মা তুই তো ফেল এবারও। ওই শালায় বলসে, আমগো দুইটারে নাকি পাশ হইতে দিবো না।”
তারপর মাথা বাড়িয়ে ফিসফিস করে বলল, “চল, শালাকে মা*র্ডার কইরা ফালাই। নয়ত তোর আদুভাই হওয়া ছাড়া উপায় নাই।”
রূমীর হতাশা শুধু বাড়ে। সিজিপিএ নেমে এসেছে তিনের নিচে সে কবেই। কোর্স টিচারের সঙ্গে তাদের ব্যক্তিগত কোনো শত্রুতা নেই। একবার তিনি ক্লাসে মুসলমানদের রোজা রাখার ভুল ব্যাখ্যা দিচ্ছিলেন। বলছিলেন, হাসান হোসাইন কারবালায় পানির অভাবে মারা যান বলেই মুসলমানরা স্মৃতি রক্ষার্থে রোজা রাখে। ক্লাসের কেউ কেউ বলছিলো, “এটা ডায়েটের জন্য”। আবার কেউ বলেছিল, “গরিবদের অনাহারের কষ্ট বোঝার জন্য।”
রূমী দাঁড়িয়ে শান্ত ভাষায়ই জানালো, “স্যার, মুসলমানরা নবিজী সা: এর জীবিত থাকা অবস্থা থেকেই রোজা রাখে। নবিজী নিজেও রেখেছেন নিয়মিত। এটা স্মৃতি রক্ষার্থে না। মূলত ইবাদতের একটা অংশ। এর অনেক উপকারিতা থাকতে পারে, কিন্তু আমরা এসব ভেবে রাখি না। শুধুমাত্র আল্লাহকে ভয় করে, তাঁর আদেশ পালন করি আমরা।”
তিনি তাচ্ছিল্য নিয়ে হাসলেন, “পড়াশোনা করিয়ে এসব ধর্মান্ধ উৎপাদন হচ্ছে দেখি? এই তোমার রেজাল্ট কী?”
তখন রেজাল্ট ভালোই ছিল। এরপর শুরু হলো অবনতি। সেই কোর্সে আর পাশ করা হয় না। ইউনিভার্সিটিতেও যে লোকে ফেল করতে পারে, তা অনেকের অজানা। কতদিনে পাশ করে বেরোতে পারবে কে জানে! অর্পার নাম্বারে অসংখ্য কল আর ম্যাসেজের পর সে শেষবারের মতো একটি ম্যাসেজ লিখলো,
“Orpa, I’m feeling so down now-a-days. Can we talk for a while? How are you? I’m not that well. University life is totally a piece of hell, you know? What have I done?” (অর্পা, আমার কিছুদিন ধরে খুব খারাপ লাগছে। আমরা কী কিছুক্ষণ কথা বলতে পারি? কেমন আছ তুমি? আমি তেমন ভালো নেই। জানো? ভার্সিটি লাইফ ঠিক জাহান্নামের মতো। আমি কী করেছি?)
অর্পার ফোন যে বন্ধ.!
চলবে ~