আজকে আমার মন ভালো নাই পর্ব-১০+১১

0
309

আজকে আমার মন ভালো নাই।
নাহিদা সানজিদ

১০.
রূমী পৌঁছালো ১১ টায়। কিছু খাওয়া যাবে না, অথচ খুব ক্ষুধা পেয়েছে। প্রতিদিনের বাজেট একশ টাকা। সকালে খেলে আরো বাড়ে। সুতরাং, সচেতন ভাবেই সকালের খাবার বেশিরভাগ সময় মূলতবি রাখা হয়। কখনো চায়ের কাপে লেক্সাস বিস্কিটের ঝড় তোলা হয়, কিন্তু সবসময় নয়। ব্যাগ খুলেই প্রথমে পেলো হটপট। অর্পার কাজ হতে পারে, আবার মাও হতে পারেন। তবে মা লুকোছাপা করেন না। হটপটের ভেতরে খিচুড়ি। সকালে রুটি খেয়েছিলো যতদূর মনে পড়ে, অর্পার কাজই হবে। রূমী আনমনেই হাসলো। হটপটটা পাশে রেখে জামা কাপড় বদলে নিলো।

কিছুক্ষণ পর এলো ওর রুমমেট মিন্টু। কীভাবে যেন ভার্সিটিতে এসে তার নাম বদলে ‘মন্তুবাবা’য় রূপান্তরিত হয়েছে। মন্তুবাবা দাঁত মুখ খিঁচে কাকে যেন বিশ্রী করে গালিগালাজ করছেন, “শালারপুত, তুই আসবি না এটা আগে বললি না কেন? সাড়ে সাতটা বাজে ঘাস কাটতে উঠসি আমি?”
কাকে বলছে সে আর রূমী ভাবতে চাইলো না। মিন্টু বারবার কাকে যেন কল দিচ্ছে। ওর আবার একটা প্রেমিকাও আছে যার যার দুদিন পরপরই বিয়ে লাগে। হবে, হচ্ছে, হয়েই গেল — এভাবে চলছে রোজ। ইঞ্জিনিয়ার, ডাক্তার, বিসিএস ক্যাডারদের লম্বা লাইন তার পেছনে, এর মাঝে মিন্টু চুনোপুঁটি। তবুও কীভাবে যে প্রেমটা টিকে আছে! প্রতিদিনই একবার করে তাদের বিচ্ছেদ হয়। আর প্রতিবার ধৈর্য্য ধরে সে বিচ্ছেদের পটভূমি, উৎপত্তি, কারণ, ফলাফল শুনতে হয় রূমীকে। আবার সমাধানও দিতে হয়।

একবার রূমী বিরক্ত হয়ে বলেছিলো, “বিয়ে করে ফেল। এত কাইজ্জাকাটি দেখতে আর ভালো লাগে না।”
মিন্টুর প্রেমিকা রাজি নয়, মিন্টু নিজেও নয়। তাই বলে বিচ্ছেদেও সুখী হতে পারছে না। দুইদিন পর ওর একলা একলা লাগে, রূমীর কাঁধে হাত রেখে বলল, “ভালোবাসি, দোস্ত। ভুলব কেমনে?”
এ কোন জাতের ভালোবাসা তার জানা নেই।

এখন সে হেঁকে হেঁকে কী যেন বলছে,
— “এই যা ব্রেকআপ! ব্রেকআপ! এই পৃথিবীর আখেরি মাইয়া হইলেও তোর দিকে আমি ফিরেও তাকাবো না। এই রূমী? তুই স্বাক্ষী। খোদার কসম, ওরে যদি আমি আর ফোন দিসি।”
ফোন রাখার পর রূমী বলল, “কসম ভাঙলে কাফফারা দিতে হয়।”
মিন্টু কিছু বললো না। রাগে তার শরীর কাঁপছে, রূমী ওর পাশে বসলো, নরম গলায় বলল, “আমি বিয়ে করে ফেলেছি বন্ধু।”

মিন্টু অবিশ্বাস্য দৃষ্টিতে তাকালো। জীবনটা হিন্দি সিরিয়াল হলে ব্যাকগ্রাউন্ডে দু একটা বজ্রপাত হতে পারতো। নানান নাটকীয়তার পর ঠিক হলো আজকে তাকে খাওয়াতে হবে কোনো শানদার রেস্তোরাঁয়। সাথে সে আরেকটা কাজ করলো, জনে জনে দেখা হলেই বলতে শুরু করলো, “রূমী শালা তো কাম সাইরা ফালাইছে। শালার পুতে বিয়া করসে, আমারেও কয় নাই। চিন্তা করতে পারছোস? সবগুলা নিমকি শয়তান। এজন্যই কয়, ভার্সিটিতে বন্ধু হয় না। সব কালসাপ।”

রূমী মাঝে একবার অর্পাকে কল দিয়ে জানাতে চাইলো পৌঁছাবার খবর। কিন্তু মিন্টুই দিলো না। আলফা মেইলরা কখনো নারীর কাছে নত হয় না। রূমী নিষ্পাপ গলায় জিজ্ঞেস করলো, “আলফা মেইল মানে?”
মিন্টু খাওয়ার মাঝে প্রশ্ন করায় বিরক্ত হয়, “আলফা মেইল মানে শক্তিশালী মেইল। শালারপুত তো আবার ফেসবুকও চালাস না।”
রূমী এবার একটু রাগ হলো, “তুই সারাক্ষণ শালারপুত শালারপুত করছিস কেন? গালি দেওয়া আমার একদম পছন্দ না।”
— “গালি কখন দিলাম? শালার পুত্র। নরমাল একটা শব্দ। এটা কী গালি? কুত্তার বাচ্চা। মানে কী? কুকুর একটা বিশ্বস্ত প্রাণী। বিশ্বস্ত প্রানীর বাচ্চাও বিশ্বস্ত প্রাণী। এগুলো গালি নারে পাগলা, এগুলো ভালোবাসা।”
রূমী এবার স্বাভাবিক হলো। তার চেহারায় জন্মগত এক ধরনের সরলতা আছে। সে তরল কন্ঠে বলল, “বুঝেছি, ******।”
মিন্টু চোখ বড় বড় করলো, মারমুখো হয়ে বলল, “তুই আমাকে গালি দিলি? রূমী? কীভাবে পারলি?”
“গালি কখন দিয়েছি? ভালোবাসা প্রকাশ করলাম দোস্ত।”

**
অর্পা বোরকা হালকা উপুড় করে সাবধানে পা চালিয়ে কলেজে গেলো। ফার্স্ট ডে অ্যাট কলেজ আফটার ম্যারেজ। সবাই উৎসুক চোখে তাকিয়ে আছে। অর্পা ছাতাটা বন্ধ করে ক্লাসে গেলো। নয়না কিছু বলবে বলে ভাবছে। বিবাহ পরবর্তী সময়ে এমন নানা জনের না আগ্রহের বিষয় থাকে। অর্পা চুপচাপ বসে থাকলো। স্যার এসে কীসব ভাষণ দিলেন মাথার উপর দিয়ে গেল। রূমী পৌঁছানোর পর মাকে ফোন দিয়েছে, অর্পাকে দেয়নি। সারাদিন সে একটা ফোনের জন্য অপেক্ষা করেছিলো। রাতে দিয়ে দেখলো ফোন বন্ধ। অর্পার এত রাগ হলো! সে বিষয়টা ভুলে যাবার চেষ্টা চালালো। ক্লাসে মনোযোগ আনার সর্বোচ্চ চেষ্টা চালালো। কদিন বাদে ইনকোর্স। পড়াশোনা কিছুই হয়নি।

কে যেন বলেছিলো, স্বামী, সংসার, সন্তান এসব খানিকটা স্বার্থান্বেষী জিনিস। প্রয়োজন ফুরালে নারীকে অস্বীকার করে ফেলতে দুই মিনিটও ভাবে না। অর্পার হঠাৎ একথা কেন মনে হলো, বুঝতে পারলো না। সে মাথা থেকে সকল দুশ্চিন্তা দূর করার চেষ্টা করলো। দুটো ক্লাস শেষে আবার ফেরার বাস ধরতে হলো। বাসা থেকে বেশ খানিকটা দূরেই। যাত্রাপথে সে বাইরেই চেয়ে রইলো পুরোটুকু সময়। সে ভাবতে লাগলো, বিয়ের আগের জীবন আর পরের জীবনে তেমন কোনো পার্থক্য নেই। সবাই যার যার নিজস্ব ভবিষ্যত নিয়ে ব্যস্ত, দিনশেষে সেই একাকী জীবন। ঘরে ফেরার তাড়া নেই। কারো আলাদা পরোয়া নেই। খেলে খাও, না খেলে না খাও। কারো পরোখ করার সময় পর্যন্ত নেই। তবুও আমরা কী ভীষণ আগ্রহ নিয়ে অপেক্ষা করে থাকি কেউ একজন আসুক। সৃষ্টি থেকে সৃষ্টির এ দূরত্ব বোধহয় খোদা তা’লা নিজের জন্যই রেখেছেন। যেন তার ফিরে আসে একটু তাঁর ঘরে।

অর্পা মোবাইল ফোন অন করে কুরআন তিলাওয়াত শুনতে লাগলো,

“হে প্রশান্ত আত্মা।
তুমি ফিরে আসো তোমার রবের প্রতি সন্তুষ্টচিত্তে, সন্তোষভাজন হয়ে।
অতঃপর আমার বান্দাদের মধ্যে সামিল হয়ে যাও,
আর প্রবেশ করো আমার সৃজিত জান্নাতে।”

আকাশ মেঘলা। বাতাস কারো বাধা নিয়ম মানছে না। উড়ছে বেখেয়ালে ওড়নার ফাঁক গলে উঁকি দেয়া এক গাছি চুল, গগন হেঁকে নামছে বৃষ্টি। বর্ষা অর্পার চোখেও। কাঁদতে কাঁদতে তার হিচকি উঠে গেলো। সবাই ফিরে তাকাতেই সে নিজেকে ধাতস্হ করার চেষ্টা করলো। সে নিজেকে এতকাল শক্তিশালী নারী বলেই জানতো, কী এমন হলো তার? যে এত অল্পতেই তার কান্না পেয়ে যাচ্ছে।

***
রূমীকে মিন্টু প্রতিনিয়ত আলফা মেলের বৈশিষ্ট্য পড়াচ্ছে। তার মতে, আলফা মেল হলে মেয়েদের ভুলেও পাত্তা দেওয়া যাবে না। একটা শক্ত ইমেজ বজায় রাখতে হবে। ওদের কথায় কান দেওয়া যাবে না। কারণ, মেয়েরা আবেগী। ওদের পরামর্শ শুনলে কলসি গলায় বেঁধে পুকুরে ঝাঁপ দেওয়া ছাড়া উপায় থাকবে না। রূমী পরিশ্রান্ত গলায় বলল, “তাই বলে নিজের বউকেও ফোন দেব না? এটা কেমন কথা? আমার কোনো আলফা মেল হবার দরকার নেই। সর।”

মিন্টু মাথা নাড়িয়ে জোর গলায় নিষেধ করলো।
— “তুই বুঝতে পারছিস না বন্ধু। একেকটা সুপ্ত ফেমিনিস্ট। কাবিন ব্যবসায়ী। কাবিন ধরবে ১ কুটি, অথচ আমরা যৌতুক নিতে পারব না। এটা কেমন কথা?”

রূমীর মন বিতৃষ্ণায় ছেয়ে গেলো, “না আমার বউ কাবিন ব্যবসায়ী, না আমি কোনো যৌতুকের মতো ঘৃন্য জিনিস আশা করি। আমাদের শান্তিতে থাকতে দে। তোর ফেমিনিস্ট গালফ্রেন্ড আর তোর আলফা মেল ব্যক্তিত্ব নিয়ে আরামে সংসার কর। প্লিজ আমাদের ছেড়ে দে!”

মিন্টু শাহাদাত আঙ্গুল উঁচিয়ে বলল, “একদিন ঠিক আমাকে মনে পড়বে। শালা সিম্প কোথাকার। বউয়ের কাছে মারা খাইলে এরপর এই বন্ধুর কথা ঠিকই মনে পড়বে।”
হঠাৎ এর মাথায় কী ভূত চড়ে গেলো রূমীর মাথায় ধরছে না। মাথা প্রচন্ড ব্যথা করছে, তর্ক করার আর শক্তি নেই। সে আর কল করার সময় শক্তি কোনোটাই পেলো না। ঘুমিয়ে গেলো। মিন্টুও ঘুমাতে গেছে। রুমমেট এত সহজে বিয়ে করে এখন সারারাত প্রেমালাপ করবে এসব সহ্য করার মতো ধৈর্য্য তার নেই। ভুংভাং কথা বলে অন্যের সংসারে আগুন ধরানোর মতো কাজ করে এখন তার নিজেকে সাক্ষাৎ শয়তান বলে মনে হচ্ছে। কোন ওয়াজে যেন শুনেছিলো, স্বামী-স্ত্রীর মাঝে দ্বন্দ্ব লাগাতেই শয়তান বেশি শক্তি খরচ করে।

পরদিন ক্যাম্পাসে নতুন কলরব উঠলো। এক সিনিয়র আপু রূমীকে নিয়ে ক্রাশ অ্যান্ড কনফেশনে চিঠি দিয়েছেন। চিঠিটা মারাত্মক। ছেলেরা আফসোস করে বলছে, “সিঙ্গেল হয়ে কোনো জুনিয়র আজ অব্দি চিঠি দিলো না, শেষে কি না বিবাহিতরা পাচ্ছে?”
রূমী জানলো বিকেলের দিকে। মিন্টু তাকে ছবি দেখালো। ও বসে বসে একমনে পড়ছে, চোখে চশমা। বোঝাই যাচ্ছে দূর থেকে চুপিসারে তোলা। টিউশনে দেরী হবে ভেবে সে বেরিয়ে গেলো।

অর্পা রাতে রূমীর আইডি সার্চ করতে গিয়েই কনফেশনটা পড়লো। আইডি ঘুরে দেখলো, রূমীর আইডিতে এখনও রিলেশনশিপ স্ট্যাটাস আপডেট হয়নি। খুব সুন্দর করে লেখা ‘সিঙ্গেল’। অর্পা ভাবলো, সে বুঝি এ ছোট্ট খবরটি কাউকে জানাতে চায় না। মেয়েদের কাছে গ্রহণযোগ্যতা কমে যাবে বলে! রূমীর আইডিতে তেমন কিছু নেই। বেশ কদিন পরপর সে কিছু সুন্দর কাব্যিকধর্মী লেখা লেখে। তিনবছরের পুরোনো আইডিতে বড়জোর দশ বারোটা লেখা পাওয়া যাবে। অর্পা নিজের আইডিটা ডিএকটিভ করে ফেললো। সে শান্ত চোখে রূমীর রেখে যাওয়া বইয়ের স্তূপে তাকিয়ে আছে। উপরের তাকটায় দৃষ্টি আকর্ষণ করছে হুমায়ুন আহমেদের একটা বই, “দীঘির জলে কার ছায়া গো”। সে নিজের মন নিয়ন্ত্রণের দ্বায়িত্ব নিলো সঙ্গোপনে। এই লং ডিসট্যান্স সম্পর্কের পরিণতি নিয়ে আপাতত ভাবতে ইচ্ছা করছে না।

চলবে ~

আজকে আমার মন ভালো নাই।
নাহিদা সানজিদ।

১১.
“বৃষ্টিভেজা রাতে, আমি তোমায় নিয়ে যাবো,
যতগুলো কথা হয়নি বলা তোমাকেই বলে দেব,
হুম, হুম, হুম…….”

এই ‘হুম’ এর অর্থ হলো মন্তুবাবা লিরিক্স ভুলে গেছে। এখন সে তার নিজস্ব লিরিক্স নিয়ে আসবে। কয়েকদিন ধরে থেকে থেকে বৃষ্টি হচ্ছে। রূমী কয়েকবার অর্পাকে ফোন করার চেষ্টা করলো। ওর নাম্বার বন্ধ বলছে। মাকে জিজ্ঞেস করায় বললেন, কলেজে গেছে। সে অনেকদিন পর নিজের আইডিতে লগ ইন করলো। লাইভ ইভেন্টে শেয়ার করলো, “আলহামদুলিল্লাহ্, আল্লাহুম্মা বারিকলানা…. ”। কিন্তু অর্পাকে মেনশন করলো না। তার এমনিতেই দেখিয়ে বেড়ানো জিনিসটা পছন্দ নয়। নিজের সবকিছু আজীবন গোপন রাখতেই স্বাচ্ছন্দ্যবোধ করতো।

মিন্টুর সঙ্গে আরেক দফা তর্ক হয়েছে। ও নাকি নানা আর্টিকেল ঘাঁটাঘাঁটি করে জেনেছে মেয়েরা মূল্য দেওয়া পুরুষমানুষকে পাত্তা দেয় না। মূলত নারীজাতি নিয়ে অনেক বড় রিসার্চ করে ফেলেছে। রূমী ক্লান্ত গলায় বলল, “নারীজাতি নিয়ে এত রিসার্চের সময় আমার নাই। আমি আমার নারীরে কীভাবে চালাবো সেই চিন্তায় আছি ভাই। ওকে কিছু হাতখরচ তো প্রতিমাসে দিতে হবে। টিউশন একটায় তো পোষাবে না। ও কী এখন আমার আব্বার কাছে হাত পাতবে?”
ওর কন্ঠ করুণ শোনায়। মিন্টু হাতে তালি বাজিয়ে বলল, “দেখলি? কী বললাম আমি? এই এখন টাকা না দিয়ে দেখ। কয়দিন টিকে? মেয়েরা আসলে টাকা ছাড়া কিছু যে বোঝেনা, এবার বুঝবি।”

রূমী বুঝলো প্রাক্তনের কথা ভেবে এই ছেলে হতাশার নিম্নস্তরে পৌঁছে যাচ্ছে। সে খানিকটা হেসে ওর কাঁধে হাত রাখলো, “তোর জীবনে কখনো একজন ভালো নারীর ছোঁয়া লাগেনি বলে এই না যে সব নারীই খারাপ,একরকম। শুধু তোর মায়ের কথা ভাব, এই যথেষ্ট। নারী আর পুরুষ কখনো প্রতিপক্ষ ছিলো না, পরস্পর সহযোগী ছিলো। প্রতিযোগিতা না। শুধু শুধু মানসিক শান্তিটা নষ্ট করিস না। আল্লাহর কাছে দুআ কর যেন ভালো কারো দেখা পাস জীবনে। এসব ঝগড়াঝাঁটি ফেসবুকেই মানায়, এজন্য ফেসবুক ছেড়েছি। সব গার্বেজের আড্ডাখানা।”

মিন্টুর জবাবের অপেক্ষা না করে ওকে বেরুতে হলো। উদ্ভাসের খাতা কাটার জন্য একটা ল্যাপটপের দরকার ছিলো। টাকাটা খরচ করে ফেলেছে। এখন নিয়মিত তাকে অফিসে যেতে হয়। একটা কোচিং এ ক্লাসও নিচ্ছে। এখন আবার টিউশন। মাস শেষে অর্পার হাতে কটা টাকা দিতে পারলেই স্বস্তি। এই মেয়েটা আবার কী ধরে বসে আছে কে জানে! এক টুকরো অবসর তার নেই, অর্পা কী বুঝে নেবে না এটুকু?

**
ছাদের মেঝেতে টপ টপ করে বৃষ্টির ফোঁটা ঝরছে। একেকটি ফোঁট পানিতে পড়ার সঙ্গে সঙ্গে খানিকক্ষণের জন্য নকশা কাটে। খুব দ্রুতই আবার মিলিয়ে যায়। মারওয়া মনোযোগ দিয়ে দেখছে। ওর হাতে তরমুজ। বৃষ্টিভেজা তরমুজে কিছু সময় বাদে একেকটা কামড় বসাচ্ছে। ওর মতিগতি ঠাওর করা যাচ্ছে না। সাফা আর অর্পা খোঁজ করতে করতে চলে এলো এদিকে। তাকে থেকে হঠাৎ ওদেরও উদ্ভট এই ইচ্ছা জাগ্রত হলো। বাসায় মা একটা নতুন কাজের মেয়ে এনেছেন। ঠিক কাজের মেয়ে নয়, মেয়েটা সৎ মায়ের নিকট থেকে নির্যাতিত হচ্ছিলো। এজন্য কানিজ সাথে করে নিয়ে এসেছেন। মেয়েটা পড়তে চাইলে পড়বে, টুকটাক দেখভাল করবে বাড়ির, এই।

মেয়েটার বয়স কম। নিতান্ত বালিকা বলা চলে। মেয়েটার নাম দিলরুবা। অর্পার মনে হতে লাগলো, এত সুন্দর নাম সে বহুদিন শুনেনি। সে আদুরে গলায় ডেকে উঠলো, “রুবা। এই রুবা?”
রুবা চিলেকোঠায় উঁকি দিলো। অর্পা চমৎকার ভঙ্গিতে হেসে বলল, “আমাদের দুটো তরমুজের পিস এনে পারো? চাইলে নিজের জন্যও নিতে পারো। অসুবিধা নেই।”
রুবাও বিনিময়ে হাসলো। “ভাবী” এবং “আপামণি” দুটো সম্বোধনের মধ্য থেকে সে শেষেরটিই বেছে নিয়েছে। সরু চঞ্চল পায়ে দৌড়ে সে নিয়ে এলো তিন তিনটা কাটা তরমুজের অংশ। সবার ভাগেরটুকু বুঝিয়ে দিয়ে সে উন্মাদ পাগল কিসিমের আপাটিকে অনুসরণ করতে লাগলো।

অর্পা আর সাফাও মারওয়ার পাশাপাশি হাঁটতে লাগলো। মারওয়াকে কিছুটা বিচলিত দেখাচ্ছে। মাঝেমাঝে আকাশের দিকে তাকাচ্ছে। অর্পা উদ্বিগ্ন হলো, “তোমার কী হয়েছে মারওয়া?”
মারওয়া মলিন করে হাসলো, এত করুণ দেখালো! সাফার মনে মনে কান্না উতলে উঠলো। সে চোখভর্তি অশ্রু আটকে মারওয়ার দিকে চেয়ে আছে। যমজ বোন বলেই হয়ত মনের একটা অংশ কেমন করে জোড়া লেগে গেছে ছোট থেকে।

মারওয়া মাথা নিচু করে বলতে চাইলো, “আজকে আমার মন ভালো নেই, ভাবী। মনে হচ্ছে, কাউকে যদি বলতে পারতাম, আজকে আমার অনেক মন খারাপ। কেউ জিজ্ঞেস করতো না কারণ। শুধু পাশে বসে থাকতো। আমাকে দিতো মাথা রাখার জন্য কাঁধ। আমি ভীষণ নিশ্চিন্তে মাথা রাখতাম, ঝরঝর করে কেঁদেও ফেলতাম হয়ত। সে আমাকে জড়িয়ে ধরে থাকতো, কিন্তু কিছু বলতো না। অকারণ, অহেতুক, অর্থহীন স্বান্তনাও দিতো না। শুধু পাশে থাকতো।”
কিন্তু ও মুখে কিছুই বললো না। এই আবেগ তার ব্যক্তিত্বের সঙ্গে বেমানান। সে ভ্রু কুঁচকে বলল, “গোপনসূত্রে একটা খবর পেয়েছি, সেটা নিয়েই ভাবছি।”
সাফা স্বাভাবিক হলো, “কী খবর?”
— “তোর তো এক কালামানিকের সঙ্গে বিয়ে ঠিক হচ্ছে। শুনেছি ছেলে কুচকুচে কালো। দাঁত ছাড়া কিছুই দেখা যায় না। অন্ধকারে সমস্যায় পড়ে যাবি। সেটার সলিউশন খুঁজছি। এখনও বিয়ে করিনি তো, তাই ঠিকঠাক বুঝে উঠতে পারছি না।”
সাফা এই সত্য অগ্রাহ্য করলো আলগোছে। মারওয়ার দুষ্টুমির বাতিক ভেবে নিলো।

অর্পা প্রসঙ্গ বদলালো, “সাফা আমাকে আরিবের সব গল্প বলেছে। আমি ভাবতেই পারছি না, তুমি ওকে না করেছ! এত সুন্দর করে কীভাবে ভাবো বলোতো? অন্য কোনো মেয়ে হলে মজা নিতো কয়েকদিন। গিফট টিফট নিতো। শেষপর্যন্ত বিয়ে করতো না। কত দেখেছি! আমার খুব খারাপ লাগতো, জানো?”
মারওয়া বড়দের মতো মুখ বিরস করে ফেললো, “এসব প্রেম পিরিতির গল্প আমার সঙ্গে করবেন না। আমি আন্ডার এইটিন। এইসব কিছু বুঝি না।”
অর্পা আর সাফা এমন ভাবে হেসে উঠলো যেন কোনো কৌতুক। ওরা ভুবন কাঁপিয়ে হাসছে। মারওয়া ওদের কাছ থেকে একটু সরে গিয়ে আলাদা হাঁটতে লাগলো।

অর্পা হেঁটে আবার ওর পাশে গিয়ে দাঁড়ালো, “আচ্ছা, ধরো, আরিব এলো অনেক বছর পর। ক্যারিয়ার বানিয়ে। আবার তোমাকেই চাইলো। তখন কী তুমি ওকে বিয়ে করবে?”
মারওয়া বিরক্ত হলো। ধমকে বলল, “বিয়েই করব না। ভাইয়া নিয়ত করেছিলো, নারী জাতির ছলনায় পড়বে না। আমি নিয়ত করলাম, পুরুষজাতির ছলনায় পড়ব না। ডিসিশন ফাইনাল, মামলা ডিশমিশ।”
সাফা বিভ্রান্তি নিয়ে বলল, “কিন্তু এর পরপরই তো ভাইয়ার বিয়ে হয়ে গেছে।”
মারওয়ার বিরক্তির পারদ সীমা ছাড়ালো। তাতে এক ধরনের নাটকীয়তা বিদ্যমান। সে সাফার কানে ফিসফিসিয়ে বলল, “তাতেই তো এত ভালো বউ পেলো। নিয়তের ফল। আমি দেখেছি, যাদেরই জোর করে বিয়ে হয়, তাদের সংসার সুখের হয়।”
অর্পা ভ্রু নাচিয়ে জানার আগ্রহ প্রকাশ করলো। সাফা আরো বিভ্রান্ত হলো, “এটা যে মুনাফেকি ধরনের নিয়ত, আল্লাহ জেনে যাবেন না?”

মারওয়া জবাব দেবার জরুরত অনুভব করলো না। ও এমুহূর্তে ছাদের পাকা করা সিটে চোখ বন্ধ করে শুয়ে আছে। বৃষ্টিবিলাস। অর্পা দীর্ঘশ্বাস ফেললো। মারওয়ার মাঝের এই অদ্ভুতুড়ে ব্যাপারটা কেউ ধরতে পারে না। অনেকের ধারণা, সে মানসিকভাবে কিছুটা বিপর্যস্ত। বেশি দরকার না হলে তাই কেউ ঘাঁটায় না। কিন্তু অর্পার মনে হচ্ছে, মারওয়া সবকিছুই ইচ্ছে করেই করে। জেনেবুঝে। পাগল মানুষদের নিয়ে কারো মাথাব্যথা থাকে না, নিজেকে এই মানবারণ্যে থেকেও একলা করে রাখার অভিনব উপায়।

***
রূমী যেতে যেতে অনেকটুকু ভিজে গেলো। মিহীকা দরজা খুলে দিয়েছে। মেয়েটাকে ও তিন বছর যাবত পড়াচ্ছে। তখন ছিলো অষ্টম শ্রেণীতে। এখন কলেজ প্রথম বর্ষের ছাত্রী। সে মাথা নিচু করে প্রবেশ করলো। হাত দিয়ে ঝেঁড়ে মাথা মুছে নেওয়ার প্রচেষ্টা চালালো বৃথা। মিহীকা একটা তোয়ালে এনে দিলো। রূমী নিতে নিতে খেয়াল করলো, তার ছাত্রী টকটকে লাল রঙের লিপস্টিক লেপেছে ঠোঁটে। রঙ কড়া লাল হওয়ায় চোখে পড়েছে দ্রুত। রূমী মনোযোগ হটানোর চেষ্টা করলো। পড়াতে পড়াতে হঠাৎ মিহীকা বলে উঠলো, ”স্যার, আপনি কী জানেন? আপনার চুল বড় হলে অনেক ভালো লাগবে। আপনার মাঝে এক ধরনের হিমু হিমু ব্যাপার আছে। অবশ্য হিমু চশমা পড়তো কিনা জানিনা। শুভ্র পড়তো।”

রূমীর স্বভাবের সঙ্গে রূঢ়তা ব্যাপারটা ঠিক যায় না। তবুও সে গম্ভীর হবার চেষ্টা করলো, “মিহীকা, আপনি ডেসিমেলের অঙ্কটায় মনোযোগ দিন। কলেজে প্রথম বর্ষে অনেকে আইসিটিতে ফেল করে, জানেন? আমার এক বন্ধু, অনেক মেধাবী ছিলো। কিন্তু প্রথম সেমিস্টারে কেমেস্ট্রিতে ফেল করলো। কেমন পড়তে হবে বুঝতে পারছেন?”
রূমীর আরেকটি অভ্যাস। সে তার নারী ছাত্রীদের ‘আপনি’ করে বলে। হোক সে ক্লাস ওয়ানের ছাত্রী, তবুও এমন করে বলবে যেন তার গুরুজন। মিহীকা হেসে বললো, “আপনি করেননি,স্যার?”

রূমী খেয়াল করলো আজকে মিহীকা চুলও বাঁধে নি। অঙ্ক করার সময় বারবার তার মুখ ঢেকে ফেলছে। মায়েদের এই বয়সী মেয়েদের উপর নজরদারি করা দরকার, রূমী কি করবে ভেবে পেলো না। ছোট্ট একটা মেয়ে, এখন তার একটু একটু করে পৃথিবী চেনার বয়স। একটা ভুল পদক্ষেপ তাকে কতটা হয়রান করে দেবে তার মায়ের এতটুকু বোধ থাকা উচিত।

মিহীকা অঙ্কের মাঝে বিরতি নিয়ে বলল, “স্যার, আপনি জানেন? হিমুর কোন বিষয়টা আমার ভালো লাগেনি?”
সে উত্তরের অপেক্ষা না করে অনর্গল বলতে থাকে, “সে হলুদ পাঞ্জাবি পরে। কী বিচ্ছিরি দেখতে! আপনি নীল পাঞ্জাবি পরবেন। আপনাকে অনেক সুন্দর দেখায়। তখন মনে হতে থাকে, এই অসভ্য জগতে আপনার চেয়ে ভালো মানুষ আর একটিও নেই।”
রূমী এবার বিরক্ত হলো। বলল, “তোমার আম্মু কোথায়?”

মিহীকা খিলখিল করে হেসে উঠলো। সে কলম রেখে স্মৃতিচারণ করতে বসলো, “জানেন স্যার? আপনাকে প্রথম যখন রেখেছিলো, আমি খুব বিরক্ত হয়েছিলাম। সারাক্ষণ ভাবতাম, কী করে আপনাকে বাদ দেওয়ানো যায়। পুরুষ মানুষ একদম আমার সহ্য হতো না। কেন হতো না, সেটাও এক ইতিহাস। একদিন আমার মা নানীর অসুস্থতায় আমাকে একা রেখে চলে গেলেন। বাবাও দেশের বাইরে। আমি একা একা ঘরে বসে আছি। আপনি আসায় ভয় করতে লাগলো। মনে হলো, বাসায় তো কেউ নেই। তবুও সাহস করে দরজা খুললাম। আপনি খুব স্বাভাবিক ভঙ্গিমায় পড়ালেন। প্রতিদিনের মতো আমাকে খুকি ভেবে মজার মজার গল্প বলে হাসালেন। একবারের জন্যও খেয়াল করলেন না, আমার বাসাটা নিস্তব্ধ হয়ে আছে। এরপর চলে গেলেন। সেদিনটা আমি আমার সারাজীবনে কখনো ভুলতে পারব না। এই সাধারণ ব্যাপারটার জন্যই আপনাকে আমার আজন্ম ভালো লেগে গেলো, স্যার।”

রূমীর খুব অস্বস্তি লেগে উঠলো। সে কিছু ভেবে ওঠার আগে মিহীকা মৃদু হাসির মিশেলে বলতে লাগলো, “আজকের দিনটাও অন্যরকম, স্যার। কেন জানেন?”
রূমীর মনে হচ্ছে এই ঘর থেকে এক্ষুনি তার বেরিয়ে পড়া উচিত। মিহীকা তার নিজের প্রশ্নের সমাধান নিজেই দিলো, “আজকেও কেউ বাসায় নেই, স্যার।”
এর চেয়ে ভয়ানক কোনো পরিস্থিতি তার জীবনে সম্ভবত কখনও আসেনি।

চলবে ~

একটি উত্তর ত্যাগ

আপনার মন্তব্য লিখুন দয়া করে!
এখানে আপনার নাম লিখুন দয়া করে