আজকে আমার মন ভালো নাই।
নাহিদা সানজিদ।
৮.
সেদিন বৈশাখের চরম তাপমাত্রাকে ভেদ করে বিনা নোটিশে কালবৈশাখী আরম্ভ হলো। আকাশে সিঁদুর রাঙা মেঘের আনাগোনা। থেকে থেকে বাতাস ছুঁয়ে দিচ্ছে প্রবলভাবে। অর্পা দৌড়ে বাড়ির দরজায় দাঁড়ালো। বৃষ্টি এলে সে ঘরে বসে থাকতে পারে না। এক অদৃশ্য সম্মোহন তাকে বৃষ্টির কাছাকাছি নিয়ে আসে। চলমান বারিধারায় সে তার সকল দুঃখ উজাড় করে দিলো। সে এক বৃষ্টি থেকে আরেক বৃষ্টির আগ পর্যন্ত সকল দুঃখ যাতনা একটি খামে পুরে রাখে, মনের খামে। আর বৃষ্টি এলেই তাকে পৌঁছে দেয়। বৃষ্টি যেন তার ডাকপিয়ন।
পৃথিবীতে চার ধরনের বৃষ্টি আছে। এর মধ্যে বাংলাদেশে এর দুটো সম্ভবত দেখা যায়। এটা কোন প্রকারের বৃষ্টি অর্পা অনেক ভেবেও মনে করতে পারলো না। কোথায় যেন পড়েছিলো! অর্পা দরজা আগলেই কেবল দাঁড়িয়ে থাকলো। ভিজলো না। বৃষ্টি তার নিজ নিয়ম মেনে এক ছটাক দিলো, তবুও না দেবার মতোই। এই একটু বৃষ্টিতেই অর্পার গায়ে জ্বর চলে এলো। অথচ, সে নিজেকে সহনশীল শক্তপোক্ত নারী বলেই জানতো। সারা দুপুর একা একা সে ক্রমাগত হাঁচি দিতে থাকলো। রূমী বাইরে গেছে ট্রেনের টিকেট কাটতে। কালকে ওর যাবার পালা। বিকেলের দিকে এসেই ও অবাক হয়ে গেল, “এতটুকু সময়ের মধ্যে অসুখ বাঁধিয়ে ফেলেছো? সারাদিন তো বড় বড় কথা বলতে থাকো, যেন আমার নানী-শ্বাশুড়ি।“
একটা থার্মোমিটার দিয়ে জ্বর মেপে সে রান্নাঘরে গেলো, লবঙ্গ, এলাচ, দারুচিনির লাল চা করতে। হলে ওঠার আগে তাকে বেশ কয়েকদিন আলাদা বাসায় থাকতে হয়েছে, সঙ্গে সঙ্গে সিট পাওয়া যেত না তখন। এখনও সম্ভবত যায় না। বন্ধুরা মিলে কীভাবে কীভাবে যেন অনেক রান্নাই শিখে ফেললো। এটা সে গোপন রেখেছে। কে যেন বলেছিলো, পুরুষ মানুষের রান্না জানার দক্ষতা গোপন রাখাই ভালো। নয়ত ঘরের নারীসমাজ কথায় কথায় ভং ধরবে, বলবে, “তোমার রান্না অনেক মজা, আজ একটু রাঁধো, শরীরটা ভালো লাগছে না।”।
এটাও কোনো বড় ভাইয়ের দেওয়া উপদেশই হবে।
কিছুক্ষণ পরেই মা আসলেন, সন্দিগ্ধ চোখ। রূমী হাত খানিকটা উঁচু করে আত্মসমর্পণ করার ভঙ্গিতে বলল, “আম্মা, প্লিজ বইলো না, জীবনে তো আমাদের কিছু করে খাওয়ালি না। ওরকম সিচুয়েশন হলে খাওয়াতাম।”
কানিজ মুখ বাঁকালেন প্রথমে, এরপর হেসে ফেললেন, “বলতেই যাচ্ছিলাম, এখন সর। কত করে খাওয়াস দেখি তো।”
রুমীকে সরিয়ে চা বানানোর দ্বায়িত্ব নিলেন।
রূমী সমঝোতায় আসতে চাইলো, “মা, তোমার তো মেয়েরা আছে, সবাই আছে। অর্পার এখানে কে আছে বলো? আমিও তো কাল চলে যাব।”
কানিজ ভ্রু উঁচিয়ে অনেক কিছু বুঝে ফেলার ভাব করলেন, “ওওও। আমরা বুঝি অর্পার কেউ না।”
রুমী কিছু বললো না। কি বলা উচিত আদো বুঝতে পারছে না। কানিজ সতর্ক গলায় বললেন, “শুন আব্বু। অর্পা মনে হয় একটু রাগ, তোকে মনে হয় বলেছে। আমি আরিবের নানীকে কীভাবে না করব বুঝতে পারছিলাম না, তাই বলে দিয়েছি বেকার। এতকিছু ভেবে বলিনি, ওকে একটু বুঝিয়ে বলিস।”
রূমীকে অর্পা কিছু বলেনি। বলার মতো মেয়ে সে নয়। তবুও মায়ের কথা শুনে ভালো লাগছে। সে মাকে এক হাতে জড়িয়ে ধরে বলল, “আম্মা, তুমি জানো, তুমি কত ভালো? আমাদের জীবনে ভুলচুক বড় কোনো বিষয় না। সবচে সুন্দর বিষয়টা হলো এই ভুলটা মেনে নেওয়া, স্বীকার করে ফেলা, অনুশোচনা করা আর মাফ চেয়ে নেয়া। আর এই জিনিসটা আমি তোমার থেকে শিখেছি!”
কানিজ কোনো জবাব দিলেন না। চায়ের কাপ হাতে দিয়ে হাসলেন, “যা, বউয়ের সেবা কর গিয়ে। জীবনে তো মায়ের সেবার কথা মুখেও আনতে দেখিনি..”
**
প্রতিবেশী এক মহিলা বউ দেখতে এসেছেন। রুমী বউ কেমন পেলো, সেটাই তার মূল কৌতুহল। অর্পা এলো এলোমেলো পা ফেলে। নাকের ডগা লাল হয়ে আছে,উদভ্রান্তের মতো দৃষ্টি। সে মৃদু স্বরে সালাম করলো। ভদ্রমহিলা সালামের জবাব নিলেন। উনার মুখে অসন্তোষ প্রকাশ পাচ্ছে। বউ মনে হচ্ছে পছন্দ হয়নি। রূমী পাশে এসে দাঁড়ালো, বলল, “তুমি ঘরে গিয়ে শুয়ে থাকো, পরে একদিন কথা বলে নিও।”
অর্পা ভেতরে চলে গেলো। কানিজ কিছু মিষ্টি আর টুকটাক নাস্তা হাতে এলেন।
ভদ্রমহিলা ফিসফিস করে বললেন, “রুমী হিসেবে বউ মনে হচ্ছে একটু উজ্জ্বল কম। কী বলেন আপা?”
কানিজ কী বলবেন বুঝতে পারছেন না, “আপা, বউ স্বভাব চরিত্র দেখে এনেছি। তাছাড়া ও যথেষ্ট উজ্জ্বল। আজ অসুখ তো, তাই কালো দেখাচ্ছে হয়ত।”
রূমী মেয়েলি আলাপে থাকলো না। তার বউ কী ফেয়ার অ্যান্ড লাভলীর অ্যাড করবে নাকি যে তার উজ্জ্বল তকতকে ফর্সা মুখ থাকতে হবে। নারী হয়ে নারীকে বিশ্লেষণ করা, কেমন যেন লাগে তার কাছে। কোনো পুরুষ এই মন্তব্য করলে তাও ভালো দেখাতো। বুঝতো, তার আকর্ষণের বিষয়াদি আছে। একজন নারীর অন্য একজন পুরুষের ফর্সা বউ নিয়ে এত মাথাব্যথা কেন থাকবে? কদিন আগে সাফাকে এক বাড়ি থেকে দেখতে এলো। রুমী নিজের বোনকে এতদিন অসম্ভব রূপবতী বলেই জানতো। কিন্তু ছেলের মা আবিষ্কার করে ফেললেন, সাফার নাক বোচা, চাকমাদের মতো। এদিকে ছেলে মেয়েকে পছন্দ করে বসে আছে। রূমীকে ডেকে বলল, “ভাই, বিয়ে করলে আপনার বোনকেই করব।”
রূমী দীর্ঘশ্বাস ফেললো, এত মূল্যবান জীবন নারীকে চিনতে পার করে দেওয়ার মানেই হয় না। জীবনে আরো অনেক গুরুত্বপূর্ণ কাজ আছে।
রূমী যাবার পেছনেই মারওয়া এসে হাজির। হেঁটে হেঁটে পপকর্ণ খাচ্ছিলো, হঠাৎ ভদ্রমহিলার মাথা হাতড়ে একটা সাদা চুল নিয়ে এলো, মুখে হাত দিয়ে কৃত্রিম বিস্ময় প্রকাশ করে বলল, “আল্লাহ! আন্টি! আপনার চুল পেকে গেছে!”
ভদ্রমহিলা হকচকিয়ে গেলেন, বিব্রত মুখে বললেন, “তো কী হয়েছে?”
মারওয়া মাথা নাড়িয়ে মর্মাহত চেহারায় বলল, “এই আরকি, সাদা জিনিসও সবসময় ভালো না। এই দেখেন, আমার গায়ের রঙ ফকফকা ফর্সা। তবুও কেউ বিয়ে করতে চায় না। ছেলে বিশ্বাসই করতে চায় না, আমি সিঙ্গেল। মনে করে, এত সুন্দরী মেয়ের বয়ফ্রেন্ড নাই, এরচেয়ে মিথ্যা আর কী হতে পারে? আম্মা, তো এটা নিয়ে চিন্তায় আছে, না আম্মা?”
কানিজ রাগ রাগ চোখে চেয়ে থাকলেন। মারওয়া পাত্তা দিলো বলে মনে হলো না,সে দারুণ ভাবে হরহর করে মিথ্যা বলার গুণ নিয়ে জন্মেছে, “চিন্তা করেছি কালকে থেকে নো সানস্ক্রিন ক্যাম্পেইন শুরু করব। রোদের তাপে চেহারা কালো ছালো বানিয়ে ফেলব। জীবনে বিয়ে একটা তো দরকার। কিন্তু সমস্যা হচ্ছে, এই যে কিছু মহিলা, বিয়ের পরেরদিন বউকে রিভিউ করে। রিভিউতে ফেল মারব। ভাবীও এই ট্রিকস ফলো করে ফেল মারলো, দেখলেন না?”
ভদ্রমহিলা আগামাথা বুঝতে পারছেন না। এই মেয়ের কী মাথা খারাপ? মারওয়া মাথা নাড়িয়ে নিজেকে আরেকবার সঠিক প্রমাণের চেষ্টা করলো, “সারাজীবন ফেল করেছি পরীক্ষায়। ফেলটুস মেয়েদের জীবনে একটা সহজ সরল সমাধান হলো বিয়ে, বিয়েতেও যদি ফেল মারি, তাহলে তো জীবন অন্ধকার।”
বলতে বলতে সে ভদ্রমহিলার মাথা দ্বিতীয়বারের মতো হাতড়ে দুটো উকুন নিয়ে এলো, একটার রঙ ফ্যাকাশে, আরেকটার রঙ কুচকুচে কালো। উনার হাতের ভাঁজ খুলে তালুতে উকুন দুটো রেখে বলল, “আন্টি বলেন তো, এই উকুনটা সাদা কেন?”
“কেন?”, উনি ভয়ে ভয়েই জিজ্ঞেস করলেন। উনার ধারণা, মারওয়ার কোনো মানসিক সমস্যা আছে।
মারওয়া উত্তর করলো, “কারণ এটার রক্তশূন্যতা।”
বলে সে চলে গেলো। ভদ্রমহিলা কানিজকে জিজ্ঞেস করলেন, “আপা, মেয়েকে ডাক্তার দেখান না? লক্ষ্মণ তো ভালো না।”
***
রূমী ঘরে ফিরে দেখলো সবাই একসঙ্গে হাসাহাসি করছে কি নিয়ে। অর্পা নেই কেবল। সে আগ্রহ নিয়ে শুধালো, “ব্যাপার কী?”
মারওয়া হাই তুলল আলস ভঙ্গিতে। বলল, “কোনো ব্যাপার নাই। তোর কালা বউ নিয়ে কথা হচ্ছে।”
— “আমার বউ কালো, তোকে কে বলল?”
— “আমাদের চোখ আছে না?”
রূমী সিরিয়াস হবার ভং ধরে বলল, “তোমাদের চর্মচক্ষু আছে। মনের চোখ নেই। অবশ্য তোদের চর্মচক্ষুতেও সমস্যা হয়েছে বলে আমার ধারণা। টাকা পয়সা হলে ডাক্তার দেখিয়ে দেব।”
মারওয়া এগিয়ে এলো গোপনীয় কিছু বলবার উদ্দেশ্যে, মাথা বাড়িয়ে রূমীর কানের কাছে নিয়ে বলল, “সুন্দরী বউ রেখে চলে যাচ্ছিস, চিন্তা হচ্ছে না? পাহারা দিতে বলবি না? বলার আগে অ্যাডভান্স করে তারপর বল। ভেবে দেখব।”
রূমী ভ্রুক্ষেপহীন, “একটু আগে না বললি, আমার বউ কালো। পাহারা দিতে হবে কেন?”
সাফা হেসে মারওয়ার পক্ষ নিলো, “ধর, কেউ তোর মতো মনের চোখ দিয়ে দেখলো। বিপদ না?”
মারওয়া সাফার হাতে হাত রাখলো শব্দ করে, “এই না হলে আমার বোন?”
রূমী হেসে ফেলল।
ওদের সঙ্গে তর্ক শেষে ঘরে গিয়ে দেখলো অর্পা গভীর ঘুমে। অর্পার গায়ে একটা কাঁথা টেনে দিয়ে ওর পাশে বসে থাকলো। কালকে থেকে দুজন আবার দুই পৃথিবীর বাসিন্দা হয়ে যাবে। অপরিচিত এক জেলায় গড়তে হবে তার একাকী সংসার। সেটাকে ঠিক সংসার বলা যায় না। একটা কথা ইদানীং খুব জনপ্রিয়, “একবার ঘর ছেড়ে বের হলে আর কখনো ঘরে ফেরা হয় না। মাথার উপর কংক্রিটের ছাদ থাকে, কিন্তু কোনো ঘর থাকে না।”
অর্পা এপাশ ওপাশ করলো কিছুক্ষণ। হঠাৎ চোখ মেলে বলল, “আপনি? ঘুমাননি? এখন কয়টা বাজে?”
— “ওঠো, ন’টা। চলো, ভাত খাব।”
অর্পা উঠে বসলো, খুব সাধারণ ভাবে প্রশ্ন করলো, “আপনি কী কাল চলে যাবেন?”
রূমীর “হ্যাঁ” বলতে খুব কষ্ট লাগলো। পৃথিবীতে কিছু কথা উচ্চারণ করা কঠিন, লেখা কঠিন, ভাবাও কঠিন। তবুও সাহস করে তার মুখোমুখি হতে হয়। রূমী কিছুই বললো না। ও ব্যাগ গুছাতে শুরু করলো। তেমন কিছু নেবার নেই। দুটো শার্ট, পাঞ্জাবি আর একটা ফর্মাল স্যুট। অর্পা বেশ মনোযোগ দিয়ে দেখতে লাগলো তাকে। রূমী আচানক চোখে চোখ পড়তেই বলল, “কী দেখছো?”
— “ভাবছি।”
— “কি?”
অর্পা কপালে ভাঁজ ফেলে বলল, “ভাবছি, আমার জায়গায় যদি নীরা বা অন্য কোনো মেয়ে থাকতো, আপনি এভাবেই সেবা করতেন?”
রূমীর ভুল ভাঙলো। স্বামী বিদায়ে দুঃখ করার মতো মেয়ে অর্পা না। রূমীর ধারণা, অর্পা নীরাকে নিয়ে যতটুকু সিরিয়াস তাকে নিয়ে তার একভাগও না। সে আজ একটা উপসংহার টানলো নীরা মামলায়। ডায়েরীর পৃষ্ঠা দুটো ছিঁড়ে দুমড়েমুচড়ে ফেলে দিলো। হাত জোড় করে বলল, “একটু শান্তি দাও! আর জীবনে ডায়েরী লিখব না। আমার ঢের শিক্ষা হয়েছে।”
অর্পার কপালের ভাঁজ ঠিক হলো না। দ্বিগুন সিরিয়াস হয়ে বলল, “কাকে নিয়ে লিখবেন না বলছেন? নীরাকে নিয়ে? এখন কী অন্য কাউকে নিয়ে লিখবেন বলে ভাবছেন? কী সর্বনাশ! হিমুর সব রূপ ধারণ করতে শুরু করেছেন, এই নীরা, এই মারিয়া, এই রূপা।”
অর্পার মজা এবার ব্যর্থ হলো। রূমী রাগ করে বেরিয়ে গেলো। ওর বাড়াবাড়ি আর ভালো লাগছে না। আজকের দিনটা সে সুন্দর করে কাটাতে চেয়েছিলো। অথচ কী হলো? অর্পার কী মন বলে কিছু নেই? একটা মানুষ এত কঠিন হৃদয়ের কী করে হতে পারে? অর্পা তাকে মানাতে চাইলেও তার মন সায় দিলো না। সে ঠিক করলো, কাল ভোরে উঠেই সে বেরিয়ে যাবে। অর্পাকে জাগাবে না। থাকুক সে, আর তার শান্তিপূর্ণ একলা জীবন। ফোনও করবে না গিয়ে, নিশ্চয়ই অর্পার এতেও কিছু যায় আসবে না।
ভেবে ভেবে রূমীর মন কেবল বিষাদে তলিয়ে যেতে থাকলো। সে আবার বিয়ের প্রথমদিন থেকে ভাবতে শুরু করলো, অবাক হয়ে আবিষ্কার করলো, তার আর অর্পার কোনো গল্প নেই।
গল্প শুরু হবার আগে নীরা নামটি রেড লাইটের মতো নিষেধের দাগ টেনে বসে আছে। তবুও, কেন এত এত মন খারাপের ভার? মনের সঙ্গে যোগসূত্র নেই, এমন জিনিস নিয়ে কী আমরা মন খারাপ করি?
চলবে ~
আজকে আমার মন ভালো নাই।
নাহিদা সানজিদ।
৯.
অর্পা একটা আয়না এগিয়ে দিলো। চারকোণা ফ্রেম, সরু বক্সটা খুললেই একটা পরিস্কার আয়না চোখে পড়ে। আরেক পাশে একটা ছোট্ট চিরুনী। রুমী আয়নায় চোখ রাখলো। আয়নায় অর্পার হাসিমুখ। পৃথিবীর সবচেয়ে সুন্দর দুটি চোখ। কাজল দেয়া। রূমী তাকিয়ে থাকলো কিছুক্ষণ সেই বিশ্বাসের আয়নায়। সে এই আয়নায় কখনো দাগ পড়তে দেবে না। বিশ্বাসের আয়নায় দাগ পড়লে তা আর ঠিক হয় না। অমন অসহ্য যন্ত্রণা কখনো তার জীবনে না আসুক।
ফজরের আজানের সঙ্গে সঙ্গে রূমীর ঘুম ভাঙলো। ভোরবেলার স্বপ্ন! রূমী কিছুক্ষণ আলগোছে শুয়ে রইলো। এপাশ ওপাশ করলো। অর্পা ঘরে নেই। এত সকালে কি করছে আল্লাহ মাবুদ জানে! রূমী চোখ ডলতে ডলতে উঠে বসলো। অনিচ্ছাস্বত্তেও যেতে হবে। মাঝেমাঝে ওর মনে হয়, ঘরে বসে একটা কৃষিকাজ শুরু করলেও হতো। লোকাল কোনো ন্যাশনাল কলেজে ভর্তি হয়ে যেতো। অর্পার সঙ্গে আসতো, যেতো। সহজ সরল একটা জীবন। ইদানীং ওর মাথা সারাদিন ‘অর্পা’ ‘অর্পা’ করছে। সে মাথা ঝাঁকালো এমন ভাবে যেন ঝাঁকালেই অর্পার চিন্তা উধাও হবে।
হ্যাঙ্গার থেকে একটা সাদা পাঞ্জাবি গায়ে দিয়ে সে বেরুলো। ফজরে মসজিদে মানুষ তেমন হয় না। হাতে গোনা কয়েকজন। সামনের কাতারে অনায়াসে জায়গা পেয়ে গেলো। ইমাম সাহেব খুব সুন্দর একটা তিলাওয়াত করছেন, সূরা দ্বুহা। আয়াতগুলোর বঙ্গানুবাদ প্রাণ সঞ্চার করে,
“আপনার রব আপনাকে পরিত্যাগ করেননি,
আপনার প্রতি অসন্তুষ্টও হননি।”
“নিশ্চয়ই কষ্টের সাথে স্বস্তি আছে।”
নামাজের পর সে কিছুক্ষণ বসে রইলো ঠান্ডা মেঝেতে। ওর কিছুই ভালো লাগছে না। মন কেমন যেন অশান্ত লাগছে। কি করবে বুঝতে পারছে না। সে চুপচাপ মাথা নিচু করে বসে রইলো সেথায়। ভার্সিটিতে গেলে প্রায়ই নামাজের রুটিন এলোমেলো হয়ে যায়। রাত জেগে অ্যাসাইনমেন্ট করলে পরেরদিন আর হুঁশ থাকে না। কী এক দূর্বিষহ জীবন লাগে তখন! হঠাৎ মনে হলো কয়েকদিন শ্বাস ফেললো নিশ্চিন্তে। আল্লাহর ঘরে এসে খানিকটা বিলিয়ে দিলো যাপিত জীবনের সকল পেরেশানি।
তাকের ওপর থেকে একটা কুরআন এনে সে পড়তে শুরু করলো বাক্বারাহ থেকে। আবার কখন না কখন হাতের নাগালে আসে! অথবা এমন আকস্মিক মৃত্যু এলো আর এই ঘরের মালিকের সঙ্গে দেখা করার প্রস্তুতি থাকলো না। সব ভুলে সে এক মনে পড়তে থাকলো। কখন সুবহে সাদিকের নরম স্পর্শ বদলে সূর্যের আলো হানা দিলো খেয়াল হলো না। সে বন্ধ করে দুআ করতে শুরু করলো নিয়মতান্ত্রিক, মায়ের জন্য, বাবার জন্য, বোনেদের জন্য, দাদীর জন্য, প্রয়াত বাসিন্দাদের জন্য, আজকে সে নিয়মের মাঝে ঢুকে গেলো আরেকজন। অর্পা।
আমার মালিক অর্পাকে তাঁর চাদরে জড়িয়ে নিক, সেও ভালো থাকুক।
**
“উপন্যাস পড়ার কিছু অপকারিতা আছে। আমার ধারণা অপকারিতাই বেশি। যেমন ধরুন, উপন্যাসে নায়ক-নায়িকা দুজনের মনের কথা প্রকাশ পাচ্ছে, আপনি জানতে পারছেন, সহজেই হিসেব করতে পারছেন ভালোবাসার পরিমাণ। কিন্তু বাস্তবে আমরা তেমনটা পারি না। আমরা কেবল নিজেদের টুকুই জানি। অন্যদেরটা জানার সুযোগ হয় না। এই যেমন ধরুন, আমার ভাই। ছেলে হিসেবে বোকা না সহজ সরল আমি জানিনা। এ যুগে এসে কাউকে এত ভ্যাবলা হতে দেখিনি।
সে আমায় এসে আজ বলছে, ‘মারু, বোন। তুই আমার বোন হলেও ভাইয়ের চেয়ে কম যাস না। তোর সাহসকে আমি সমীহ করি। নারী সবসময় নরম থাকলে লোকে সুযোগ নেয়। তুই অর্পাকে দেখে রাখিস, ও তো এ জায়গায় নতুন। কোনো সমস্যা হলে তো তোরা ছাড়া আর কেউ নেই। ওর খোঁজখবর রাখিস।’
খাওয়ার টেবিলে গিয়ে দেখি আরেক ঢং শুরু হয়েছে। কোনো কথা বলছে না। ভাবী এত কষ্ট করে নাস্তা বানালো, সে নির্লিপ্ত ভঙ্গিতে খেয়ে চলেছে। নাটক! এত নাটক দেখে আর পারি না। জামাই বউয়ের নাটক দেখার জন্য আমাদের রাখা হয়েছে, দর্শক। বিয়ে সংসার এসব জিনিস আমার মাথায় ধরে না। কদিন আগেও বিয়ে করবে না বলে মরে যাচ্ছিলো। এখন দরদ দেখাতে এসেছে! এসব নাটক হবে আমি আগে থেকেই জানতাম। ভাগ্যিশ নিজের পার্সোনাল ডায়েরীতে লিখছি, নয়ত এসব ডিরেক্টর, ফিরেক্টর, লেখক-ফেখকের দিন আরো আগেই শেষ হতো। ওদের বউরা ভাতে মরবে বলে কাউকে জানাইনি। সমশের হয়ে কী যে এক বিপদে আছি!”
মারওয়া খাওয়ার টেবিল থেকে ফিরে কিছুক্ষণ মেজাজ খারাপ করে বসে থাকলো। ডায়েরি লেখার পর সে একমনে অন্যকিছু ভাবতে বসলো। আরিব হম্বিতম্বি করে গেছে। ও নাকি দুমাসের মধ্যেই কিছু করে দেখাবে। কানিজ কী করে তাকে বেকার বলবেন তখন দেখবে। মারওয়ার ইচ্ছা করছিলো ভেংচি কেটে আসে। তবুও নিজেকে সংযত করেছে। সে ভেবেচিন্তে আরিবকে একটা চিরকুট লিখলো, ঠান্ডা মাথায়। জীবন থেকে আরিব নামক অধ্যায়টি দ্রুত বন্ধ করা দরকার, পথ অনেক দূর!
***
সকাল সকাল হুলুস্থুল পড়ে গেছে। বাড়ির ছেলে চলে যাবে। অর্পা ভোরেই শ্বাশুড়িকে সাহায্য করতে এসেছিলো। রূমীকে কি বলে “সরি” জানাবে সে ভেবে পেলো না। রূমী নাশতা খেলো নিরবে। একটা শব্দও বাড়তি বললো না। অর্পাও কিছু বলার মতো খুঁজে পেলো না। ও শুধু দুচোখ মেলে দেখতেই থাকলো। মনে মনে মনে অনেককিছু সাজিয়েও বলতে পারলো না কিছুই ঠিকঠাক। অর্পা ভাবলো, “থাকুক। আমাকে না বলে কীভাবে যায় দেখব”।
রূমী শেষপর্যন্ত অর্পার সঙ্গে কথা বললো না। শুধু যাবার আগে বলল, “যাই”। অর্পা সংশোধন করে দিলো, “বলতে হয়, আসি। যাই বলা ভালো না। আম্মা বলে।”
রূমী কিছু বললো না। ওর বাবা রিকশা দাঁড় করিয়েছেন। এক্ষুনি যেতে হবে। দাদী, মা সবাই দরজা আগলে দাঁড়িয়ে আছেন। মা বরাবরের মতো আঁচল মুখে চেপে রেখেছেন। চোখে পানি টলমল করছে। প্রতিবার নিয়ম করে কাঁদার অর্থ রূমী খুঁজে পায় না। মায়ের ভালোবাসার অর্থ খুঁজতেও নেই। সে সবার থেকে বিদায় নিয়ে বেরুলো।
হঠাৎ অর্পা খালি পায়ে ছুটে গেলো। পেছন থেকে ডাকলো না। মেয়েরা কিছু কুসংস্কার না চাইতেও মানে। পাশে গিয়ে বলল, “দাঁড়ান!”
সত্যি সত্যি একটা আয়না এগিয়ে দিলো সে। সবুজরঙের ফ্রেম। অন্যপাশে সেঁটে রাখা ছোট্ট একটা চিরুনী। কিন্তু বাস্তবে অর্পার চোখে কাজল নেই। আয়নায় পড়ছে ওর আলুথালু প্রতিবিম্ব। অগোছালো করে খোঁপা করে রাখা চুল। অপর্যাপ্ত ঘুমের দরুন দেবে যাওয়া ক্লান্ত চোখ। রূমী অবাক হয়ে চেয়ে রইলো।
হর্ণের শব্দে তাড়া দিলেন বাবা। ওকে উঠে বসতে হলো। এত আপনজনের মাঝে কি বা বলতে পারতো ও? হঠাৎ পরিচিত গন্ডি পেরিয়ে চলে এলো দৃষ্টিসীমানার বাইরে। আয়নাটা মুখের সামনে ধরে সে অর্পাকে দেখতে চাইলো, বারবার ঘুরে ফিরে কেবল নিজের প্রতিচ্ছবি ভেসে আসলো। কী আশ্চর্য! একটু আগের চিত্রটাকে কী ধারণ করে রাখা যেতো না? এই আয়নার আর মহত্ত্বটা রইলো কই?
****
আরিব হাতে হাতে চিঠি পেয়ে বেশ আগ্রহ ভরে খুলে দেখলো। আদতে তা কয়েক লাইনের চিরকুট। মারওয়া তার চেনা খোলস ভেঙে অন্য কন্ঠে লিখেছে। আরিবের মন ভেঙে গেলো। এত সুন্দর করে মানুষকে ‘না’ বলতে পারার ক্ষমতা নিয়ে জন্মেছে মেয়েটা! আহারে! এই এক জীবনে বোধহয় আমার তাকে পাওয়া হলো না। আমার রুবি রায় নাকি বেলা বোস? আরিব কয়েকবার পড়লো। মারওয়া লিখেছে,
“আরিব শুন! আমি যা করেছি ভালো করিনি, তুইও কোনো পূন্যের কাজ করিস নি।
— Arib, do you really know, what love is?
সেদিন তুই আমাকে মাওলানা রূমীর একটা উক্তি বললি, মনে আছে?
আমি আমার প্রশ্নের জবাবটা উনার উক্তি দিয়েই দিচ্ছি,
Love is when Allah says to you,
‘I have created everything for you..’
And you say,
‘I have left everything for you…’
তুই আমাকে ছেড়ে দে। আর কখনো আসিস না, তোকে কেউ অসম্মান করবে না কখনো। একজন মানুষের জীবনে অনেক কিছু করার থাকে, মানুষ তার স্বপ্নের সমান বড়। তোর স্বপ্ন কেন একজন নারীর কাছে আটকে থাকবে? জীবনে একদিন অনেক বড় হয়ে যখন ভাববি, তখন এটা হাস্যকর অতীত ছাড়া কিছু মনে হবে না।”
বারবার পড়তে পড়তে আরিবের চিরকুটটা বেশ ভালোমতন মুখস্হ হয়ে গেলো। এমন হলো, সে দিনে একবার করে পড়ে। কিন্তু সেই পরিচিত রাস্তায় তার দেখা আর মেলে না। রাস্তার পরিচিত কুকুরগুলো তাকে মনে করলেও সে জানে দুনিয়া উল্টে গেলেও সে পাহাড়ের নামে নাম মেয়েটি তাকে কখনো স্মরণ করবে না। ওর ভিসা হয়, পাসপোর্ট হয়, বাবাই করে দেন। সে আর না করে না। হঠাৎ একটা উর্দু লেখার অনুবাদ করে,
এ কী ভালোবাসা? নাকি মৃত্যুর ফেরেশতা?
যেই পেলো, তাকেই মেরে ফেললো!
ফেসবুকের শেষ স্ট্যাটাসটি দিয়েই সে পাড়ি জমালো বিদেশের বুকে। আর কবে দেশ তাকে ডাকবে, সে হদিস তার জানা নেই। আপাতত অচেনা জগতে থিতু হবার দায় বইতে হবে দীর্ঘদিন। এর ফাঁকে যদি সব ভুলে যাওয়া যায়!
চলবে ~