আজকে আমার মন ভালো নাই পর্ব-৬+৭

0
99

আজকে আমার মন ভালো নাই।
নাহিদা সানজিদ

৬.
মারওয়া ভেবেচিন্তে একটা সিদ্ধান্ত নিলো। এভাবে চলা যায় না। একটা ছেলে দিনের পর দিন তার পিছু করছে এটা দুজনের জন্যই অসম্মানের। আজ আরিব এক কোণায় দাঁড়িয়ে। মনে হচ্ছে দূর থেকে অনুসরণের সন্ধি আঁটছে। আঙ্গুল দিয়ে ইশারায় ডেকে বলল, “চল, তোর সঙ্গে আমার কথা আছে।”
আরিব ভ্যাবাচ্যাকা খেলো। মারওয়া বিপদজনক মেয়ে। কখন কী করে বসে ঠিক নেই। হয়ত দেখা গেলো মাঝরাস্তায় চিৎকার সবাইকে ডেকে ইভটিজিং এর মামলায় ফাঁসিয়ে দিলো। আবার, ওকে না করতেও মন টানছে না। প্রেমিক হবার নানাবিধ বিপদ আছে। সে ভয়ে ভয়ে গেলো। ওরা গেলো স্কুলের সামনের একটা ছোটখাটো কফিশপে। এখানে ছেলে মেয়ে একসাথে বসা যায় না যদি না বৈধ সম্পর্ক থাকে। স্কুল-কলেজকে প্রেম পরিণয় মুক্ত রাখার অভিপ্রায়েই এই নিয়ম। মারওয়া ওকে নোটখাতা বের করে দিয়ে বলল, “তুই যা, আমি আসছি।”

এরপর দুটো ঠান্ডা কোল্ড ড্রিংকসের বোতল নিয়ে ভেতরে প্রবেশ করলো। আরেকটা খাতায় হাবিজাবি লিখতে শুরু করে বলল, “আমি কী বলছি শুন?”
আরিব আগ্রহী চোখে তাকালো, “হ্যাঁ বল।”
“তুই আমার সঙ্গে হুদাই হেঁটে কী মজা পাস?”
আরিব কাঁচুমাচু করলো, “বলা যাবে না।”
“তুই যদি আমাকে নূন্যতম সম্মান করে থাকিস, আর এসব করিস না।”
“তাহলে কী করব?”
মারওয়া অবাক হয়ে বলল, “কী করবি মানে? তোর কোনো কাজ নেই? পড়াশোনা নেই?”
“সেসব তো অন্যসময়ও করা যাবে।”
মারওয়ার ইচ্ছা করছে এসব খাতাটাতা ওর মাথায় ছুঁড়ে উঠে চলে যেতে। নিজেকে সামলে নিয়ে বলল, “তুই বুঝতে পারছিস না, এগুলো হলো শয়তানি ওসওয়াসা। প্রেম মানুষকে অন্ধ করে দেয়। তোর মনে হচ্ছে, তুই দেখতে পাচ্ছিস, আসলে তা না। তুই এখন অন্ধ।”
“আমি অন্ধ?”, আরিব অবাক হলো।
“হ্যাঁ, শয়তান তোকে ফুসলাচ্ছে। আমার সঙ্গে যদি তোর প্রেম হয়, দেখবি কিছুদিন পর আর ভালোলাগে না। আমি অনেক কেস দেখেছি। শয়তানকে তো জিততে দেওয়া যায় না। আমাকে ভুলে যা।”
“কেস দেখেছিস মানে? তুই কী উকিল?”
এ মুহুর্তে এ ছেলের মাথা ফাটিয়ে দিতে পারলে ভালো লাগতো।

“আচ্ছা, অনেকের তো বিয়ের ক-বছর পর বউকেও ভালো লাগে না। সেটা তাহলে কী?” আরিব আরেকবার কৌতূহলী হয়ে উঠলো।
”সেটা বিয়ের পরের শয়তান। এটা প্রি-ওয়েডিং শয়তান। জীবনের প্রতি পদে পদে শয়তান, তোর তো ব্যাপারটা বুঝতে হবে, নাকি? অন্ধ চোখটা ভালো করে মেলে দেখ, তোর বউ তোকে তুই-তুকারি করছে এটা কী তোর ভালো লাগবে বল?”
আরিব বোঝার চেষ্টা করলো না, কপালে ভাঁজ ফেলে বলল, “সেদিন একজন মাওলানা একটা উক্তি দেখলাম কোথায় যেন, তোর ভাইয়ের নামে নাম — Love is the sea where intellect drowns (ভালোবাসা হলো এমন একটি সমুদ্র যেখানে বুদ্ধিমত্তা লোপ পায়।)।”
মারওয়া বিরক্ত গলায় বলল, “একজন মাওলানার কথা তোর ভুলভাল কাজে লাগালে তো হবে না। যত্রতত্র ময়লা ফেলার মতো প্রেমে পড়ে বসে থাকলে তো সমস্যা।”

ওদের যুক্তিতর্কের শেষ নেই। মারওয়া বুঝতে পারলো সে ভয়ংকর একটা পাপ করেছে এই ছেলেকে বোঝাতে চেয়ে। মাথার গরম আর সূর্যের গরমে টিকতে পারলো না বেশিক্ষণ, আঙ্গুল উঁচিয়ে শাসালো, “আমি আজকেই আব্বাকে বলব, আমাকে যেন কালকের মধ্যে বিয়া দেয়। তখন আমি দেখব, তুই অন্যের বউয়ের পেছনে কীভাবে ঘুরিস।”
ওর ধারণা ছিলো, এতটুকু ছেলেকে কোনো পরিবার বিয়ে দিতে উৎসাহিত তো হবেই না বরং ঘর ছাড়া করবে। একটা শিক্ষা হবে। কিন্তু ওর ধারণা ওকেই একটা শিক্ষা দিয়ে গেলো।

***
আরিব পরিবারের একমাত্র ছেলে। সঙ্গে আছে কয়েক বছরের ছোট একটা বোন। বাবা প্রবাসী। মা গৃহিণী। নানীও তাদের সঙ্গেই থাকেন। বাসায় গিয়ে সে সবার প্রথমে ধরলো, নানীকে। নানী ছাড়া জীবনে আসলেই তেমন গতি নেই। বাজার থেকে মাত্র আনা পান আর সুপারির পুঁটলিটা রেখে নানীর গা ঘেঁষে বসলো। নতুন কোনো আবদার পাড়ার পূর্বাভাস। আবহাওয়া অফিসের মতো মানুষের আবহাওয়া বোঝারও কিছু লক্ষ্মণ আছে। চট করে কাজের কথা বলবে না। একটু রঙঢঙ করবে। শুরু হলো আরিবের রঙঢঙ পর্ব,
“নানী, দেখি কন তো, আমার জন্ম হইছে যে কতবছর?”
নানী পান পাতায় তর্জনী দিয়ে চুন ছোঁয়ালেন,
“এইতো, সেদিনই না জন্ম হইলো তোর? ইন্দুরের বাচ্চার মতো এক বিঘত শরীল।”
উনি হাত দিয়ে মেপে দেখালেন। আরিব কিছুক্ষণ থম মেরে বসে রইলো। তারপর অনুভূতিহীন গলায় বলল, “নানী, সেদিন না। আঠারো বছর হয়ে গেছে। এমন ভাবে কইলেন যেন আমার বয়স এখন কয়েকমাস।”
নানী সন্দিহান গলায় শুধালেন, “তো কি হইসে?”
আরিব আহ্লাদী হবার চেষ্টা করলো। পা টিপে দিতে দিতে বলল, “আচ্ছা নানী, আপনার বিয়ে কত বছর বয়সে হয়েছিলো?”
“এই হইবো দশ এগারো।”
এবার জায়গামতোন কথোপকথন পৌঁছেছে। ভ্রু উঁচিয়ে বলল, “এইতো। আপনাদের সময় তো ভালো ছিলো। যায় দিন ভালো আসে দিন খারাপ। বিয়ে শাদী একটা হওয়া দরকার, তাই না? ধরেন, প্রেম পিরিতি করলাম, গুনাহ্ হইলো আপনাদের। বিরাট সমস্যা।”
“বিয়া কইরা বউরে খাওয়াবি কী?”
“কেন আমার বউ কী ডাইনি নাকি? আচ্ছা, আজ থেকে আমি অর্ধেক প্লেট ভাত খাবো।”
নাতির ধান্ধা বুঝতে অভিজ্ঞ নানীর বেশি সময় লাগলো না। পান চিবুতে চিবুতে সন্ধানী চোখে বললেন, “মাইয়াটা কে?”
আরিব মাথা নিচু করে মিটিমিটি হাসতে লাগলো।

***
সকাল সকাল বাড়ি বয়ে আসা এই বৃদ্ধার মতলব বুঝতে পারছে না মারওয়া। এসে ঘুরে ঘুরে পুরো বাড়ি দেখছেন। যেন পরীক্ষার খাতা। তাকে মার্কিং করতে দেওয়া হয়েছে। এরপর চশমা খানিকটা উপরে তুলে সন্দিহান চোখে বললেন, “তোমার নাম মারওয়া?”
মারওয়া দুপাশে মাথা নাড়ালো না সূচক, “না তো। আমার নাম সখিনা। এই বাড়িত কাম করি।”
কথায় বিশুদ্ধ গ্রাম্য টান। বৃদ্ধা সরল মনে বিশ্বাস করে নিলেন। এক হাতে সরিয়ে ভেতরে প্রবেশ করলেন। মারওয়া অভিজ্ঞ গোয়েন্দার মতো রহস্যের গন্ধ শুঁকলো। কী হতে পারে?

কিছুক্ষণ পরপরই বেরিয়ে এলো আসল কাহিনী। ভদ্রমহিলা বিবাহের প্রস্তাব দিতে এসেছেন মারওয়ার জন্য। এ বাড়িতে তার বড় একটা বোন আছে এ খবর তিনি জানতেন না। কানিজ চোখমুখ অন্ধকার করে বললেন, “আমার বড় মেয়ে এখনও অবিবাহিতা। তাকে ফেলে ছোটজনকে বিয়ে কেন দেব? তাছাড়া ও এখনও ছোট। এসব বিষয়ে ভাবছি না।”
ভদ্রমহিলা একবার মারওয়াকে দেখতে চাইলেন। হঠাৎ অনাকাঙ্ক্ষিতভাবে সামনে পড়ে গেলো সাফা। সে বিব্রত হলো অপরিচিত একজন নারীর সূক্ষ্ম দৃষ্টি দেখে। যেন সে কোনো ধাতব বস্তু, জহুরি চোখ দিয়ে হীরা, স্বর্ণ, তামা আলাদা করার চেষ্টা করে যাচ্ছেন।

তিনি বেফাঁস কিছু বলে ফেলার আগেই কানিজ সতর্ক গলায় পরিচয় করিয়ে দিলেন, “এ আমার বড় মেয়ে, সাফা। মা, সালাম দাও নানুকে?”
সাফা সালাম করলো। কী সুন্দর মিষ্টি একটা মেয়ে! তিনি বড় মেয়েটাকেই বেশ পছন্দ করে ফেললেন। নাতির পছন্দের উপর ভরসা হলো না। তবুও দেখতে চাচ্ছেন এক নজর। মারওয়া ঘরে ঢুকলো চিৎকার করতে করতে,
— “আম্মা তুমি মেজোকে বের করে দিলা কেন? ও ছোট মানুষ। এতকিছু বোঝে? একটু না হয় ঘরই ময়লা করলো। তোমার সবকিছুতেই বাড়াবাড়ি।”
সঙ্গে সঙ্গে নানী এবং না হওয়া নাতবউ চোখ মেলালো, মারওয়ার হাতে তার মেজো বিড়াল। দ্বিতীয় দেখায় মেয়েটাকে ধুরন্ধর ব্যতীত কিছু মনে হলো না। কত বড় মিথ্যাবাদী!
মারওয়া হাত জোড় করে আমতা আমতা করলো, “আরে আমার নাম সখিনাই। দাদী ডাকে, জিজ্ঞেস করেন? আর আম্মা? তিনি আমাকে মেয়ে কম কামের বেটি বেশি মনে করেন, না আম্মা?”
সে পিটপিট করে চোখের পাতা ফেলে মাকে বোঝানোর চেষ্টা করলো। কানিজ গরম চোখে তাকিয়ে আছেন, বৃদ্ধা বিস্ময়ে নির্বাক।

চলবে ~

আজকে আমার মন ভালো নাই।
নাহিদা সানজিদ।

৭.
“আচ্ছা, অর্পা? তুমি কখনো কাউকে ভালোবাসো নি? প্রেম করো নি?”

কোনো স্বামী স্ত্রীদেরকে এ কথা জিজ্ঞেস করে না। করলেও করে বিয়ের আগে। নিশ্চিত হবার জন্য। যদি পাছে আবার বিয়ের দিন গহনাসহ পালিয়ে যায়? অথবা, কোনো ছেলের সঙ্গে গভীর কোনো সম্পর্ক থাকলো যাতে করে স্ত্রী হবার মর্যাদা হারিয়ে ফেলেছে। রুমির এমন কোনো ব্যাপার নেই। তবুও সে প্রশ্নটা করলো কৌতুহলে। মনে হলো বুকের ভেতর একটা মৌমাছি কামড়ে ধরে আছে। অর্পা যদি বলে “হ্যাঁ” তবে সে হুল ফুটিয়ে ফেলবে বুকের মধ্যিখানে। অর্পা হেসে ফেললো, “কেন? ভাবছেন, আমারটা জানতে পারলে সমান সমান। আপনাকে আর ক্ষেপাতে পারবো না?”
রুমি মাথা নাড়ালো দুদিকে। বলল, “না, এমনি। মানুষের গল্প শুনতে ভালোই লাগে।”

অর্পা দুটো গ্লাসে ওয়ানটাইম কফির প্যাকেট ছিলে দিলো। চিনি পানি দিয়ে কিছুক্ষণ নেড়ে গরম দুধ ঢাললো তাতে। হালকা ধোঁয়া উপরে ভেসে যাচ্ছে। চমৎকার ঘ্রাণ। এক কাপ রুমির দিকে এগিয়ে দিয়ে ব্যালকনির চেয়ারটায় বসলো। ধীরে সুস্থে চুমুক দিয়ে বলল, “কখনো কাউকে ভালো লাগেনি তা বলবো না। আমরা তো মানুষ, অনেক ভুলও করে ফেলি। তবে আমার ভালোলাগাকে কখনো সিরিয়েসলি নেইনি। আমি সবসময় ভাবতাম, যদি প্রেম করি, শেষপর্যন্ত বিয়ে না হয়, একটা বিপদে পড়ে যাবো। না স্বামীর হক রক্ষা করলাম, না প্রেমিককে দেওয়া ভালোবাসার কোনো মূল্য। টোটালি ইউজলেস। আমার প্রিয় সাবজেক্ট অর্থনীতি তো। ওভাবে ভাবতে ভাবতে অভ্যাস হয়ে গেছে। একবার একটা ছেলে খুব পাগলামি করলো। একদিন কোথা থেকে নম্বর জোগাড় করে ম্যাসেজ দিয়ে ফেললো। আমি রিপ্লাই করলাম, এতকিছু ভাবিনি। সে এমন ভাবে কথা বলতে লাগলো যেন আমি কোনো দেবী, প্রতিমা। এত মর্যাদা হজম হলো না। পরদিনই ব্ল্যাকলিস্টে ফেলে ভাবলাম, আমার দ্বারা এসব হচ্ছে না। আমি জনে জনে ঘোষণা করে দিলাম, আমি ওয়াইফ ম্যাটেরিয়াল। বিয়ে করব।”

শেষের কথাটি বলে সে বাঁধভাঙা হাসিতে মত্ত হলো। অন্ধকারে তার মুখ স্পষ্ট নয়। রুমি ভ্রু নাচিয়ে বলল, “হাসছো কেন? এখন তোমার কী মনে হচ্ছে।”
অর্পা ঠোঁট ওল্টালো, “কিছু মনে হচ্ছে না। সবই স্বাভাবিক। আমি কাউকে জীবন মরণ এক করে দিয়ে ভালোবাসায় বিশ্বাসী না। এসব আমার পছন্দ না।”
রুমি মেয়েটার সঙ্গে কথা বলে আর অবাক হয়, “এত হিসাব নিকাশ করে ভালোবাসা যায় নাকি?”
“হিসাব নিকাশ করিনি, এগুলো থিউরি। যেমন ধরুন, বই? আপনি হুমায়ুন আহমেদের কঠিন ভক্ত, তাই না?”

রুমি একবার তার হুমায়ুন সংগ্রহের দিকে তাকালো। ঘরের একপাশ দখল করে আছে কেবল হিমু এবং মিসির আলী। সে হ্যাঁ সূচক মাথা নাড়লো। অর্পা গরাদের ফাঁকে চাঁদ দেখছে। কয়েকদিন যাবত চাঁদ তার সর্বোচ্চ জোছনা ঢেলে দেবার চেষ্টা করছেন। অদ্ভুত ভালো লাগে তখন। মনে হতে থাকে, এখন নিরুদ্দেশ বেরিয়ে যেতে পারলে ভালো লাগতো। অর্পা ইচ্ছার কথা বলে না, মুখে বলে অন্যকথা, “প্রথমবার আমি হুমায়ুন আহমেদের বই পড়লাম ক্লাস নাইনে। অপেক্ষা। পড়া শেষ করে যে বন্ধু থেকে ধার করে এনেছিলাম, তাকে বললাম, এত বিচ্ছিরি বই নিয়ে হৈচৈ এর কী আছে?”

রুমি আশ্চর্য হলো। বইটা অতটাও বিচ্ছিরি নয়, বরংচ একেবারেই নয়। সে কেবল শুধালো, “তুমি তো বই পড়ো না।”
অর্পা বরাবরের মতোই হেসে মাথা নাড়ালো। রুমি এতদিনে একটা ব্যাপার খেয়াল করেছে। অর্পা কথায় কথায় হাসে। হাসির কথা নয়, এমন কথাতেও হেসে হেসে কাত হয়। অথচ মাঝেমাঝে এত গম্ভীর আর অদ্ভুত কথা বলে যেন এ মেয়েকে বোঝার মতো কোনো জ্ঞানী বর্তমান পৃথিবীতে নেই। সে বলল, “হ্যাঁ। খুবই কম। যে কটা পড়েছি, সময় কাটছিলো না বলে, দায়ে পড়ে। তাও আবার ফিকশন। ফিকশনের মধ্যেও বাছবিচার করেছি, সহজ লেখা আর হ্যাপি এন্ডিং বই। স্যাড এন্ডিং বই আমি কখনো পড়তাম না। যত ভালোই হোক। অপেক্ষা ছিলো প্রথম বই, তাই বুঝতে পারিনি।”
“কী বলো? স্যাড এন্ডিং পড়লে সমস্যা কী? কেঁদে ফেলো তাই?”
অর্পা এবার শব্দ করেই হেসে ফেললো। অনেকক্ষণ। রুমি ধৈর্য ধরে দেখতে লাগলো। বউয়ের জন্য এতটুকু ত্যাগ স্বীকার করতে পারবে না?

অর্পা বহুকষ্টে হাসি থামিয়ে বলল, “ঠিক তা না। স্যাড এন্ডিং পড়লে আমার লেখকের উপর রাগ হয়। মনে হয় ইচ্ছা করে আমার অনুভূতি নিয়ে খেলেছেন তিনি। আগে তো আমি ধরেই নিতাম, স্যাড এন্ডিং দেওয়া হয় মার্কেটিং এর জন্য। সবাই পড়ে বলবে, কান্না পেয়েছে। তারপর অন্যরা হুড়মুড়িয়ে পড়বে, কী এমন আছে তা দেখার জন্য। মূলত মনে হতো, লেখকই এখানে ভিলেন। খুব খারাপ একজন মানুষ।”
এবার রুমিই হাসলো। এভাবে কখনো ভাবা হয়নি। সে কফি শেষ করে কাপটা টেবিলে রাখলো, “স্যাড এন্ডিং-ও একটা উপভোগের বিষয়। আমার তো মনে হয়, বেশিরভাগ সুন্দর বই-ই স্যাড এন্ডিং।”
অর্পা শরীরের ভার দেয়ালের উপর ছেড়ে দিলো। হুহু করে ঠান্ডা বাতাস বইছে। বারান্দাটা আরেকটু বড় হলেই সে এখানে একটা দোলনা বিছাতো। বড়সড়। যেন রুমিরও জায়গা হয়। আর এই দ্বিপাক্ষিক বিপরীত সব চিন্তাভাবনার আলাপ আলোচনা আরো দীর্ঘ হতে পারে।

সে দীর্ঘশ্বাস ফেলে প্রথমবারের মতো রুমির নাম সম্বোধন করলো, “ইব্রাহীম সাহেব! অন্যের কাল্পনিক দুঃখ যাপনের মতো সময় নেই। ব্যক্তিজীবনে কত দুঃখ নিয়ে আমাদের বসবাস! কত বাস্তব দুঃখের ভান্ডার, একেকটা কষ্টের সমুদ্র আমাদের ঘিরে আছে! উপন্যাসে ডুবে থাকলে তাদের আর অনুভব করার সময় থাকে না।”
রুমি দ্বিমত পোষণ করলো, “মাঝেমাঝে উপন্যাস আমাদের ভালোবাসতেও শেখায়। তবে তোমার কথাও ফেলে দেবার মতোন না। অন্যরকম করে ভাবো তুমি। খুব অবাক হয়েছি।”

অর্পা তা প্রশংসা হিসেবে নিলো না। সে রুমিকে একটা কথা বলেনি। সে জীবনে কখনো কাঁচের চুড়ি পরেনি। সেই কবে! ষোড়শী জীবনে, প্রথম প্রেমে পড়ার ঋতুতেই সে প্রতিজ্ঞা করলো, তার প্রথম কাঁচের চুড়ি নেবে বিয়ের পর। এমন কি সে কোনো কাজে ছেলেদের ব্যবহার করা বন্ধ করে দিলো। রক্তের সম্পর্ক নেই, শুধুমাত্র মেয়ে হবার দরুন উপকৃত হবার বাসনা মাথা থেকে ঝেড়ে ফেললো। মেয়েরা যখন নরম সুরে ছেলেদের দিয়ে বিভিন্ন কাজ করিয়ে নিতো, সে হয়ে গেলো একেবারে আলাদা এক পৃথিবী।

এমনটা সে কেন করেছে আজও জানা নেই। তার অভিধানে ছিলো, “আমি মেয়ে হিসেবে যে সম্মান বিপরীত পক্ষ থেকে আশা করি, আমি ঠিক তেমন করেই প্রতিটি সম্মানযোগ্য ছেলেদের সম্মান করে যাবো। তাদেরকে কোনো কাজে ব্যবহার করব না, খুব বেশি প্রয়োজন হলে সাহায্য চাইবো।”
অর্পার মনে মনে এমন আস্ত এক সংবিধান আছে যা সে কখনো কাউকে বলে না। রুমিকেও বলবে না, যদি না সে তার তেমন কোনো বন্ধু হতে পারে। সে চায়, রুমি তাকে ভাগ্যবতীদের তালিকায় অন্তর্ভুক্ত করুক, তারপর নিজেও জানুক সে কতোটা ভাগ্যবান।

**
“উদোর পিন্ডি বুধোর ঘাড়ে” বলে বাংলায় একটা কথা আছে। সেই বুধোটা হতে যাচ্ছে সাফা। কানিজ দুশ্চিন্তায় শেষ হয়ে যাচ্ছেন। লোকে এখন বড় মেয়েকে ফেলে ছোট মেয়েকে দেখতে আসছে। এরচেয়ে অসম্মানজনক বিষয় আর কী হতে পারে? বড়মেয়েটার মনের খেয়াল রাখতে হবে না? এই মনের খেয়াল রাখার অজুহাতে নিয়ে সাফার বিয়ে নিয়ে আগ্রহী হলেন। একসাথে দুইবোনকে ঘরে রাখাটা পাপ সমতূল্য হয়ে দাঁড়াচ্ছে। লোকে, একজনকে দেখতে এসে অন্যজনকে পছন্দ করে চলে যাবে, বোনে বোনে সম্পর্ক নষ্ট হবে। তিনি দ্রুত বিষয়টি স্বামী এবং শ্বাশুড়ির সঙ্গে আলোচনা করলেন। সাফা এর কিছু সম্পর্কে অবগত নয়।

মারওয়া এক পায়ের ওপর আরেক পা তুলে ক্রমাগত নাচিয়ে যাচ্ছে। ওর হাতে সুজি। কি যেন একমনে ভেবে যাচ্ছে। সাফা এগিয়ে এলো ধীর পায়ে। যেন একটু জোরে হাঁটলেই জমিন ব্যথা পাবে। ওর পাশে বসলো নিঃশব্দে, “আরিব ভাইকে না করে দিবি?”
মারওয়া ভ্রু কুঁচকে তাকালো, “তোর ধারণা, ওকে বিয়ের করার জন্য আমি দোপাট্টা সামনে ফেলে বসে আছি? আসলেই বলব কবুল?”
“আব্বু আম্মু যদি জোর করে?”, সাফা উদ্বিগ্ন হলো।
মারওয়া হাই তুলে বলল, “কুরবানীর গরু পাইসে নাকি? মেয়ের সম্মতি ছাড়া যে বিবাহ হয় না, সে ফতোয়া স্মরণ করায় দিবো।”
তার পরপরই কুটিল চোখে তাকিয়ে ফিসফিসিয়ে বলল, “সবচে বড় কথা, বড় মেয়ের আগে তো ছোট মেয়ের বিয়ে হয় না।“
সাফার মুখ মুহুর্তে অমাবস্যার রূপ ধারণ করলো। নকল কবিরাজের ভবিষ্যৎ বাণী পেয়ে তার বুকের ঢিপঢিপ বাড়তে লাগলো। চোখ ছলছল করে উঠলো। মারওয়া সহানুভূতি প্রদর্শনের নিয়ম ভুলে হেসে হেসে খাওয়া শেষ করলো।

এদিকে আরিবের নানী অনিচ্ছা স্বত্তেও মারওয়ার জন্য বিয়ের কথা বললেন। তারা কোনোভাবেই রাজি হলো না। কেবলমাত্র নাতির মনের অবস্থা বুঝে পরপর চারবার বিভিন্ন অজুহাতে তাদের বাড়িতে বিষয়টি উত্থাপন করলেন। মারওয়ার মা প্রতিবারই যত্ন করে ‘না’ করছেন। শেষে না পেরে কারণ হিসেবে দেখালেন, “বেকার ছেলের কাছে মেয়ে কেন দেব?”
অর্পা পাশেই ছিলো। সে কিছুই বললো না। জগতের নানা নিয়ম আমরা নিজেদের বেলায় পাল্টে ফেলতে পছন্দ করি। সে বিশেষ গুরুত্ব সহকারে দেখলো না।
বৃদ্ধা সমঝোতায় আসতে চাইলেন, “আচ্ছা আংটি পড়ানো থাক। ও কিছু একটা করলে তখন আমরা মেয়ে উঠিয়ে নেব।”
কানিজ বিব্রত মুখে সময় চাইলেন। অর্পা পাশেই ছিলো খেয়াল করেননি। কানিজ নিজেকে যুক্তি দিলেন, “আমার ছেলে তো রাস্তায় চড়ে বেড়ানো ছিলো না। ভদ্র ঘরের ভালো ছেলে।”
তবুও মনে খচখচানিটা থেকেই যায়। অর্পা কী তাহলে উপার্জন করা কোনো পুরুষের স্বচ্ছল ঘরণী হতে পারতো না? কি জানি! আমরা নিজেদের লাভের বেলায় হিসেবী না হলেও ক্ষতির বেলায় পাই পাই করে হিসেব বুঝে নেই। খোদা তা’লা তো এমনি এমনি আমাদের অকৃতজ্ঞ বলেননি।

চলবে ~

একটি উত্তর ত্যাগ

আপনার মন্তব্য লিখুন দয়া করে!
এখানে আপনার নাম লিখুন দয়া করে