আজকে আমার মন ভালো নাই পর্ব-০৫

0
297

আজকে আমার মন ভালো নাই
নাহিদা সানজিদ

৫.
সাফার দাদী আজ আবার নতুন করে তার বিয়ের দিনের গল্প বলবেন। প্রতিবার গল্প থেকে একটা করে নতুন তথ্য উদঘাটন করা যায়। এবারের বলার উদ্দেশ্য হলো, অর্পা। দাদী-শ্বাশুরির বিয়ের গল্প না জেনে এতদিন আছে, সে এক বিস্ময়। মারওয়া বিরস মুখে বসে আছে। একই গল্প আর কতবার শুনতে ইচ্ছা করে?
কিন্তু অর্পা বেশ আগ্রহ নিয়ে শুনতে লাগলো। দাদীর মাথায় তেল ডলে দিচ্ছে সাফা,
“তারপর কী হলো শুনো, বউ। বিয়ে হলো, কিন্তু শ্বাশুড়ি আর দেখতে পারে না। শুধু কামের খুঁত ধরে। চিনি কম, লবন বেশি। সকালবেলা এক গামলা পানিভাত। এবার ভর্তা বাঁটো। পাতা কুড়াও, ওগুলো দিয়ে রান্না। লাকড়ি ধরতে দিতো না।”

অর্পা সহানুভূতির স্বরে বলল, “এসব করে কী পেতো?”
রুমি এলো একটা আপেল হাতে। কামড় বসিয়ে দিয়ে বলল, “এসব হলো মেয়েলি সালতানাতের মতো। উনার শ্বাশুড়ি উনার সঙ্গে যা করেছেন, উনিও শ্বাশুড়ি হয়ে তাই করবেন এরকম নিয়তের ফসল। আমাদের ছেলেদের মধ্যে এত প্যাঁচ নাই।”
“তুই বলতে চাস আমি তোর মায়েদের উপর অত্যাচার করেছি? এই দিলি আমার ভালোবাসার মূল্য? তুই আমার বড় নাতি। কত তোর নষ্ট কাঁথা ধুয়েছি, মাথায় রাখিনি উকুনের ভয়ে, মাটিতে রাখিনি পিঁপড়ার ভয়ে।” দাদীর প্রায় কান্না করে দেবার দশা।

গৃহযুদ্ধ নামার সন্ধিক্ষণ। রুমি দ্রুত স্বীকারোক্তি দিয়ে বলল, “কী বলো দাদী। আমি তো আগের যুগের কথা বলেছি। তোমার মতো ভালো শ্বাশুড়ি হয় নাকি? আমি হলে তো একটা অ্যাওয়ার্ড রাখতাম, লাখে একজন এমন শ্বাশুড়ি ভাগ্য করে পায়।”
দাদীকে দেখে মনে হলো তিনি সন্তুষ্ট। ফিসফিস করে বললেন, “তবুও তোর মায়ের কাছে আমি খারাপ। আমার মনে প্যাঁচ। আমি বেশি কথা বলি।”
আরেকদফা হৃদয়বিদারক কাহিনী শোনার আগেই রুমির ডাক পড়লো। মাকে মনে মনে ধন্যবাদ দিলো সে। ঝামেলায় পড়ে গেলো অর্পা। শ্বাশুড়ির পক্ষ নেবে নাকি আপাতত দাদী শ্বাশুড়িকে স্বান্তনা দেবে এ নিয়ে দ্বিধায় পড়ে গেলো।

**
— “রুমি? বাবা। তোর নতুন বউ। একটু ঘুরে টুরে আসবি। এসব কী আমার শিখিয়ে দিতে হবে? আমরাও তো একসময় নতুন বউ ছিলাম। ঘুরতে ইচ্ছা করতো পারতাম না, এখন সব আছে, কিন্তু ইচ্ছা আর করে না। সময় নষ্ট করিস না। যা কোথাও নিয়ে বউটাকে ঘুরিয়ে আন।”
কানিজ ছেলেকে চুপিচুপি সাংসারিক উপদেশ দিলেন। বড় ছেলেটা নেহাৎ বোকা, মনে হয় বুদ্ধি সুদ্ধি তেমন ওর মাথায় নেই। সব কী আর বলে বলে করানো যায়?

রুমি ভাবছে ওর কাছে তেমন পয়সা কড়ি নেই। আজকাল রিকশা ভাড়া দিতে গেলেও মনে হয় কিডনি একটা বিক্রি করে আসি। সে অস্বস্তি নিয়ে বলল, “কোথায় যাবো? আমার কাছে তো টাকা নেই।”
মা কত কি ভেবে বসে আছেন। এদিকে অর্পা? মুখ থেকে সুন্দর একটা কথাও বের হয় না, যেন সে পরপুরুষের সামনে বসে আছে। কুরআনের আয়াত পালন করছে, “তোমরা পরপুরুষের সঙ্গে মিষ্টি সুরে কথা বোলো না।”
মা ওর পিঠে আলতো হাতে চড় দিয়ে বললেন, “তোকে কী লন্ডন নিয়ে যেতে বলছি নাকি? আশেপাশে ঘুরিয়ে নিয়ে আসবি। যখন টাকা হবে তখন দূরে কোথাও যাবি। স্বামীর সঙ্গে লন্ডনে যাওয়া যা, বাড়ির পাশের পুকুর দেখতে যাওয়াও তা।”
রুমি শেষবাক্যটার মর্মার্থ উদ্ধার করতে পারলো না।

অর্পাকে গিয়ে বলল, “যাও, রেডি হও। তোমার কী কেনাকাটা আছে, সব করে আসি।”
অর্পার স্মৃতিতে কোনো কেনাকাটার কথা মাথায় আসছে না। কিছু লাগবে বলে তো সে জানায়নি। তবুও স্বামীর আদেশ অমান্য করতে নেই। সে তৈরি হলো। যাওয়ার সময় শ্বাশুড়িকে পা ধরে সালাম করতে নিলো ভদ্রতাবশত। তিনি থামিয়ে দিয়ে এক হাতে জড়িয়ে ধরে বললেন, “আল্লাহ ছাড়া কারো সামনে মাথা নত করতে নেই মা।”

***
রুমি বের হয়ে একটা সিএনজি ভাড়া করলো। রিকশা ভাড়া বেশি চাইবে। ওর কাছে আছে ভার্সিটি থেকে আসার সময় টিউশন ফি পাওয়া কিছু টাকা। দ্রব্যমূল্যের উর্ধ্বগতির জামানায় এই পরিমাণটা খুব স্বল্প। বিলাসিতায় ব্যয় করা যাবে না। সে বলল,
— “কোথায় যেতে চাও? আমাদের এদিকে আসলে ঘোরার জায়গা কম। নদীর পাড়ে যেতে পারো। রেস্টুরেন্টে বসতে পারো। নয়ত বইয়ের দোকানে ঘুরতে পারো।”
অর্পা বাইরে তাকিয়ে বলল, “বইয়ের দোকানে যাবো।”
রুমি চমকিত হলো, “তুমি বই পড়ো?”
“না। আমি কখনো বইয়ের দোকানেই যাইনি।”
সঙ্গে সঙ্গে চমকের পারদ ঋণাত্মক হয়ে হতাশায় পরিণত হলো, “তাহলে কেন যাবে?”
“কখনো যাইনি, তাই।” অর্পার সহজ উত্তর।

ওরা কয়েকটা বইয়ের দোকান ঘুরলো। এবার বইমেলায় প্রকাশিত নতুন একটা বই এসেছে। তানভীর ফুয়াদ রুমির ”শায়েরীনামা”। লেখকের গল্পটা খুব মর্মান্তিক। অর্পা অনলাইনে দেখেছিলো। সঙ্গে আরেকটা বই নিলো, জাভেদ হুসেনের অনুবাদ, “মাওলানা রুমির কবিতা”। এখন একসঙ্গে তিনজন রুমি আছে ওর সাথে। বেশ মজার একটা ব্যাপার। রুমি ভ্রু উঁচিয়ে কেবল দেখলো, কিছুই বললো না। রুমি টাকা পে করার আগেই অর্পা হাজারখানেক টাকার একটা নোট এগিয়ে দিলো দোকানিকে। রুমি অবাক হলো, “তুমি টাকা কোথায় পেলে?”
অর্পা ঠোঁট টিপে হাসলো।
“আসার সময় সবাইকে সালাম করেছিলাম, সালামি পেয়েছি। জীবনের প্রথম হালাল ডেটের আয়।”
রুমি না হেসে পারলো না। কী অদ্ভুত কথা!

এরপর ওরা নদীর পাড়েই চলে গেলো। অর্পা কিছুক্ষণ হাঁটার পর ভাবুক গলায় বলল, “আচ্ছা, বুঝলাম না। সবাই এই পানি দেখতে এত টাকা খরচ করে কেন আসে? পানি ঢেউ দিচ্ছে, এটা এত দেখার কী আছে?”
রুমি হতভম্ব হয়ে গেলো। আজ পর্যন্ত কাউকে সে একথা বলতে শুনেনি। ও ভালো করে জানে, এখন সে কিছু বললেই অর্পা পাল্টা জবাব দেবে যা হবে প্রথমটার চেয়ে জটিল এবং অদ্ভুত-তর। দেখা গেলো, ওকে ফেলে রাগ করে বাসায় চলে যেতে ইচ্ছা করলো।

নিজেকে সামলে নিয়ে একটা টেবিল ভাড়া করলো। উপরে কাপড়ের ছাতা ঝুলছে। নদী থেকে বয়ে আসা হাওয়ায় তা উড়ে যাবার জোগাড়। কিছু খাবার অর্ডার করে রুমি কৌতুহলী গলায় বলল, “তুমি বই না পড়লে কিনলে কেন?”
“একজনকে দেবার জন্য কিনেছি। গিফট।”
অর্পা নদীর দিকে তাকিয়ে কি যেন ভাবছে। রুমি একটু এগিয়ে এসে নরম গলায় বলল, “কিছু মনে না করলে বলা যাবে কার জন্য?”
“একটা ছেলের জন্য।”
আবার মেজাজ গরম করে দিচ্ছে মেয়েটা। গম্ভীর হয়ে গেলো সে,
“ছেলেটা কে?”
অর্পা ঠোঁট উল্টালো, সচেতন গলায় জানালো,
”আছে একজন। নীরাকে নিয়ে প্রতিদিন ডায়েরী লেখে আরকি।”
রুমি কথা বলার ভাষা হারিয়ে ফেললো। এই মেয়ে কী সত্যি সত্যি তার বউ? কীভাবে সম্ভব? অর্পা ঠোঁট টিপে হাসছে।

চলবে ~

একটি উত্তর ত্যাগ

আপনার মন্তব্য লিখুন দয়া করে!
এখানে আপনার নাম লিখুন দয়া করে