আজকে আমার মন ভালো নাই পর্ব-০৪

0
255

আজকে আমার মন ভালো নাই।
নাহিদা সানজিদ

৪.
“হিমুর হাতে কয়েকটি নীল পদ্ম” পড়ে রুমির আরেক দফা মেজাজ খারাপ হলো। সারা জীবন টো টো করে ঘুরে বেড়ানো মায়া বর্জন করা হিমু সাহেবও প্রেমে পড়ে যাবেন যাবেন ভাব। আরেকটু হলেই চোখ থেকে দুফোঁটা চোখের জল পড়ে যাওয়ার সমূহ সম্ভাবনা ছিলো। পড়ে শেষ করে বইটা টেবিলে ছুঁড়ে কাঁথা মুড়ি দিয়ে শুয়ে রইলো চুপচাপ।
আমাদের সবার কাছে নাকি জন্মলগ্ন থেকে কিছু নীলপদ্ম দেওয়া হয়। সম্ভবত পাঁচটি। এই নীলপদ্মগুলো ভালোবাসার মানুষকে দিতে হয়। আর কেউ যদি তার সবটুকু পদ্মফুল কাউকে দিয়ে দেয়, তার নিজের বলতে কিছুই থাকে না। কাউকে আর ভালোবাসা যায় না।

উপন্যাসটির মূলভাবের সঙ্গে দ্বন্দ্ব করতে ইচ্ছা করছে না। থেকে থেকে আকাশে গুড়ুম গুড়ুম ডাক হচ্ছে। বৃষ্টি আসার সম্ভাবনা। আচ্ছা, নীরাকে কী সে সব পদ্মফুল দিয়ে ফেলেছিলো? অর্পার জন্য অবশিষ্ট কী নেই? এমন কোনো নিয়ম নেই যাতে সব পদ্ম ফেরত এনে সঠিক মানুষকে দিয়ে দেওয়া যায়? আমরা সবসময় ভুলভাল মানুষকে পদ্ম বিলিয়ে বসি। অথচ উচিত ছিলো পদ্ম জমিয়ে রাখা। চট করে যাকে তাকে পদ্ম বিলিয়ে দেওয়া ভালো কিছু অবশ্যই নয়।

নীরার স্মৃতি দিনদিন আবছা হয়ে যাচ্ছে। শেষ দেখা হয়েছিলো দু বছর আগে। এখন কেমন আছে কে জানে। জানার আগ্রহ অবশ্য হচ্ছে না। কিন্তু অর্পা ভীষণ বিরক্ত করছে। বিচ্ছিরি স্মৃতি মানুষকে বারবার মনে করিয়ে দেবার মতো নৃশংসতা আর নেই। আচ্ছা, অর্পা কী ভাবছে নীরার সঙ্গে ওর গভীর কোনো সম্পর্ক ছিল? মেয়েরা হয়ত একটু আগ বাড়িয়ে ভাবতে পছন্দ করে। ওর ছুটি বেশিদিন নেই। ক’দিন বাদেই চিরচেনা ঘর ছেড়ে ওর হলের দিকে ছুটতে হবে। ইঞ্জিনিয়ারিং নামক প্রেশার কুকারে মাথা দিয়ে জীবন বাটনা বাটায় বাটার মতো করে পিষে ফেলতে হবে। অর্পাকে কী তখন আর পাওয়া যাবে? মেয়েটা এত বোকা!

মাওলানা রুমির একটা উক্তি কোথায় যেন পড়েছিলো,
“Life is a balance of holding on and letting go”।
(জীবন হলো ধরে রাখা আর যেতে দেওয়ার মধ্যকার একটি ভারসাম্য।)
যেতে দিয়েছিলো নীরাকে, এখন কী ধরে রাখার সময় না?

**
সাফা-মারওয়ার টেস্ট পরীক্ষার রেজাল্ট বেরিয়েছিলো। সাফা হাঁটুতে মুখ গুজে বসে আছে। হিচকি উঠাতে উঠাতে বলল, “ভোররাতের স্বপ্ন সত্যি হয়। দেখলি?”
মারওয়া প্রথমে ভয় পেয়েছিলো। ভেবেছিলো, সে একাই ফেল করেছে। পরে সবার খবর শুনে ওর মন চাঙ্গা হয়ে উঠলো। একসাথে সবাই ডাব্বা মারলে তেমন গায়ে লাগে না। ওদের পাশ করিয়ে না দিলে ফাইনালে কেউই বসতে পারবে না। স্কুলের লস। ওদের কী?
সে পান চিবুতে চিবুতে বলল, “কানের সামনে ভ্যান ভ্যান করিস না। এক বছরের ছোট তোর, তবুও তোর সঙ্গে পড়ছি। বাবাকে বলব, ব্রেইনে ধরছে না। প্রিম্যাচিউর ব্রেইন।”

সাফা উদ্বিগ্ন গলায় বলল, “তাহলে আমি কী বলব?”
মারওয়া দুই পাটির দাঁত দেখিয়ে রহস্যময় ভঙ্গিতে হাসলো, “বলবি, বাবা পড়াশোনা আমার জন্য নয়। ইয়া আবি, পড়াশোনা নামক অলীক বস্তু আমার মাথায় ঢুকছে না। আপনি আমাকে বিবাহ দিয়ে দিন। তুই বলতে না পারলে আমি বলব।”
সাফা রাগ রাগ চোখে চেয়ে রইলো, ”আমার সঙ্গে ফাজলামো করবি না। সবসময় ফাজলামো ভালো লাগে না।”
মারওয়া অবাক হয়ে বলল, “ফাজলামো কখন করেছি? তুই অঙ্ক পারিস না, ইংরেজি বলতে তোতলাস। বিজ্ঞান তোর মাথায় ঢোকে না। ইতিহাস তোর মনে থাকে না। তুই শুধু শুধু ঢং দেখিয়ে পড়বি কেন?”
এরকম নিষ্ঠুর সত্য কেবল এ বাড়ির ছোট মেয়েটির পক্ষেই বলা সম্ভব। সাফার চোখে পানি এসে গেলো।

রাতে বাবা খাবারের পর দুজনকে ডাকলেন। মারওয়া নয়ছয় করে বুঝিয়ে ছাড়লো। বলল, “সবাই-তো ফেল করেছে। আমরা একা না। দোষটা আসলে স্যারের। উনি প্রশ্নে কিছু একটা গড়বড় করেছেন। আমরা বাচ্চামানুষ, এতকিছু কী মাথায় ঢোকে?”
মা জহুরি চোখে তাকালেন, “যে নিজেকে বাচ্চা দাবি করে, সে বাচ্চা না।”
মা বাবার সঙ্গে সে তেমন তর্ক করে না। চুপ থাকলো। এবার সাফার জবাবদিহির পালা। সে কিছু না বলে ঝরঝর করে কেঁদে ফেললো। বাবা প্রশ্রয় দিতে চাইলেও মা শক্ত নজরে তাকিয়ে বললেন, “শুধু ম্যাট্রিকটা দেখবো। যদি উল্টাপাল্টা দেখি, বিয়ে শাদীর জন্য তৈরি হয়ে যেও।”
সাফার কান্নার গতি বাড়লো। সে কিছুতেই বিয়ে করবে না। মারওয়া স্বান্তনার সুরে বলল, “থাক, বেশিরভাগ মেয়েরই অমতে বিয়ে হয়। অমতে বিয়ের সাকসেস রেট বেশি, আমার পরিসংখ্যান বলছে। নামাজ পড়ে পড়ে একটা ভালো জামাই চাইবি, সূরা ফুরকানের ৭৪ নম্বর আয়াত পড়বি। বিবাহ নবীর সুন্নত, ক্ষেত্রবিশেষে ফরজ।”
পুরো রাত ধরে মারওয়ার লাগামহীন জবান চলতে লাগলো। বেশ কয়েকটি গল্প শুনালো যাদের অমতে বিয়ে হয়েছিলো কিন্তু এখন সুখে আছে। যেন ওকে দ্বায়িত্ব দেওয়া হয়েছে বোনকে বিয়ের জন্য মানসিকভাবে প্রস্তুত করার।

***
সকাল সকাল ধবধবে সাদা মাঝারি আকারের একটি বিড়াল অর্পার শাড়ির আঁচল ধরে দুষ্টুমি করছে। যেন এটা একটা খেলার যন্ত্র। অর্পা প্রথমে ভয় পেলেও এরপর সহজ হয়ে গেলো। দুই পাহাড়ি নামের বোনদের আজ খোঁজখবর নেই। রাতে বকা খেয়ে সোজা হয়ে গিয়েছে মনে হচ্ছে। চিৎকার চেঁচামেচি নেই কোনো। অন্যদিনগুলোতে, “আম্মা, আমার হিজাব কই? পিন কই? বই কই? খাতা কই? কলম কই?” বলে বলে কান ঝাঁঝরা করে ফেলে। কানিজও বকতে থাকেন অবিরত। এই অত্যাচারের জন্য ঘরে কারো অ্যালার্মের প্রয়োজন পড়ে না। তবে অর্পার সঙ্গে তারা আগ বাড়িয়ে কথা বলেনি আর। অর্পা ভাবলো, এভাবে চলে না। একটু আধটু বন্ধু্ত্ব বোধহয় থাকা দরকার।

রুমি ফজর পড়ে আবার ঘুমাচ্ছে। মনে হচ্ছে চিন্তিত কিছু নিয়ে। চিন্তার গ্রাস থেকে বাঁচতে সারাদিন ঘুমাচ্ছে। অর্পা কাঁটামুকুটের গাছটা সাবধানে শেকড়সহ টেনে ওঠালো। একটা টবে মাটি ভর্তি করে ব্যালকনিতে এনে রাখলো। গাছের পুনর্বাসন শেষ করে পানি ছিটিয়ে দিলো। বিভিন্ন আর্টিকেল পড়ে গাছটা সম্পর্কে জানলো। এ নামের কোনো গাছ আছে সে এটাই জানতো না।

অর্পা মনে মনে দোয়া করলো গাছটা যেন বাঁচে। সবার হাতে নাকি গাছ ভালো জন্মায় না। কিছু কিছু মানুষ আছেন যাদের হাতে সবকিছুই হয়। যেমন, রুমির দাদী। যাই রোপণ করবেন ফলন দেয়। ব্যাপারটা জেনেছে ওর শ্বাশুড়ি মায়ের কাছ থেকে। অর্পা ভাবলো, ঠিকঠাক মতো ভালো না বাসলে বৃক্ষও হয়ত বাঁচে না। ছোটবেলা থেকে ওর মধ্যে স্বভাবজাত বিশেষ কোনো বৃক্ষপ্রেম ছিলো না। এজন্যই ভয়টা করছে। ওর শ্বাশুড়িকে হঠাৎ একটা প্রশ্ন করতে মন চাইলো, “আচ্ছা মা, ধরুন আমি গাছটাকে ভালোবেসে যত্ন করছি যে আমাকে দিয়েছে তার কথা ভেবে। তাহলে কী বাঁচবে?”
নিয়তে গড়বড় হলে গাছটা মরে যাবে এই ভয়েই সে কাটিয়ে দিলো পরবর্তী এক মাস।

চলবে ~
(কপি করা নিষেধ।)

একটি উত্তর ত্যাগ

আপনার মন্তব্য লিখুন দয়া করে!
এখানে আপনার নাম লিখুন দয়া করে