আজকে আমার মন ভালো নাই পর্ব-০৩

0
279

আজকে আমার মন ভালো নাই।
নাহিদা সানজিদ

৩.
বাসর রাতে বউদের নাকি কিছু উপহার দিতে হয়। নতুন জামানার নিয়ম। আগের জামানায় সম্ভবত মোহরানা পরিশোধ করা হতো। এখন আর তা করা হয় না। দেনমোহর হলো একটি সৌজন্য লিপি। লেখার জন্য লেখে। কখনো বিয়ে ভেঙে যাবার জোগাড় হলে ঝগড়া করার টপিক পাওয়া যায়। ছেলে বলবে, “লোভী, কাবিন ব্যবসায়ী”। মেয়ে বলবে, “তুই একটা ছোটলোক।”
রুমি সেসব পর্যন্ত গেলো না। তার দেনমোহর দশহাজার এক টাকা। অনেক কষ্টে সে ভাংতি এক টাকাটা খুঁজে পেলো। আজকাল কেউ এক টাকা রাখেনা। কিন্তু প্রথম প্রতিশ্রুতিতে গড়িমসি করা সুপুরুষের লক্ষ্মণ নয়।

সঙ্গে কিনলো একটা একটা কাঁটামুকুটের গাছ। ইংরেজিতে যাকে বলা হয়, A Crown of Thorns। গাছটা সচরাচর এ বাজারে দেখা যায় না। এক বন্ধু থেকে জোরাজুরি করে কিনে নিলো। এ টাকাগুলো জমিয়েছিলো সে একটা ল্যাপটপ কিনবে বলে। এখন মনে হচ্ছে, ল্যাপটপ কেনার আগে বউয়ের পাওনা পরিশোধ করা বেশি জরুরি। আচ্ছা, অর্পা কী গাছটা পেয়ে হতাশ হবে?
এই যদি হঠাৎ, নারীমহলে বাসররাতে কী পেয়েছো বলে কথার আসর জমে, তখন কারো হীরার আংটি, প্লাটিনামের নাকফুল, স্বর্নের বালা বাহারি উত্তরের মাঝে অর্পা কী বলতে পারবে? সে পেয়েছিলো, একটি কাঁটামুকুট গাছ। দেখতে সুন্দর অথচ কী বিষধর! চাইলেই ছুঁয়ে ফেলা যায় না, সাবধানে ধরতে হয়?

রুমি তেমন কিছু ভাবলো না আর। বাসায় ফিরে দেখলো, ভয়াবহ একটা কান্ড ঘটেছে। অর্পা তার ডায়েরী পড়ে ফেলেছে। কোনো এক কুখ্যাত সালে নীরাকে নিয়ে লেখা প্রেমকাব্য, রচনা। খুব বেশি কিছু লেখা নেই তাতে। দু এক পাতার গল্প। সে ইতিহাস রোমন্থন না হয় আরেকদিন করা যাবে।
শেষে সুনীলের কবিতা জুড়ে দেওয়া :

“এই হাত ছুঁয়েছে নীরার মুখ
আমি কি এ হাতে কোনো পাপ করতে পারি ?
শেষ বিকেলের সেই ঝুল বারান্দায়
তার মুখে পড়েছিল দুর্দান্ত সাহসী এক আলো
যেন এক টেলিগ্রাম, মুহূর্তে উন্মুক্ত করে
নীরার সুষমা
চোখে ও ভুরুতে মেশা হাসি, নাকি অভ্রবিন্দু ?
তখন সে যুবতীকে খুকি বলে ডাকতে ইচ্ছে হয়–
আমি ডান হাত তুলি, পুরুষ পাঞ্জার দিকে
মনে মনে বলি,
যোগ্য হও, যোগ্য হয়ে ওঠো–
ছুঁয়ে দিই নীরার চিবুক
এই হাত ছুঁয়েছে নীরার মুখ
আমি কি এ হাতে আর কোনোদিন
পাপ করতে পারি ?
এই ওষ্ঠ বলেছে নীরাকে , ভালোবাসি–
এই ওষ্ঠে আর কোনো মিথ্যে কি মানায়?”

সে ঘরে ঢোকামাত্রই চমকে উঠলো। চমকালো না অর্পা। সে মনোযোগ দিয়ে একের পর এক পাতা উল্টে যাচ্ছে যেন প্রিয় কোনো উপন্যাস। কারো দিকে মনোযোগ দেবার ফুরসত পর্যন্ত নেই। মুহুর্তেই রুমির মনে জন্ম নেওয়া সকল অনুভূতির অকালমৃত্যু হলো। বিয়ে হয়েছে বলে কী প্রাইভেসি থাকবে না? নিজের কোনো নিজস্ব অনুভূতি? হাতের কাঁটামুকুটের গাছটা শব্দ করে টেবিলে রাখলো সে। অর্পা শান্ত চোখে তাকালো। রুমি গম্ভীর গলায় বলল,
— “আপনি আমার ডায়েরীতে হাত দিলেন কেন?”
অর্পা ভীষণ সাধারণ সুরে বলল, “তাহলে কে দেবে? নীরা?”
রুমি ঢোক গিললো, কিছু বললো না।
কিন্তু অর্পার কথারা হারতে ভুলে গেলো,
— “বাহ্! নীরার মুখও ধরা হয়েছে?”
সঙ্গে আরো একটা বাক্য যোগ করলো যা লিখে ফেললে কলমেরও গুনাহ্ হবে বলে ওর ধারণা। আঁৎকে উঠে ওর পানে একবার চাইলো। কী বিশ্রী কথা বলছে মেয়েটা! অথচ কালকে এই মেয়েটাকেই পৃথিবীর সবচেয়ে সহজ সরল মেয়ে বলে মনে হচ্ছিলো। এজন্য নারী ছলনায় সে দ্বিতীয়বার জড়াতে চায়নি। দাঁত চিবিয়ে চিবিয়ে বলল,
— “এখানে ওষ্ঠে কথা বলার কথা বলা হয়েছে। ইউ হ্যাভ অ্যা ডার্টি মাইন্ড.!”
অর্পা অবাক হওয়ার চেষ্টা করলো, “আই হ্যাভ অ্যা ডার্টি মাইন্ড? ইউ হ্যাভ দ্য পিউরেস্ট সৌল অ্যাজ ওয়াটার, হুঁ?”
রুমি বুঝতে পারছে না অর্পা সব বাড়িয়ে বাড়িয়ে বলছে কেন? এই সমস্যা থেকে উত্তরণের উপায় কী? বিয়ের পরদিনই এতসব হতে হলো?

**
রুমির মা কোনো এক মহিলা মক্তবে নতুন করে শুদ্ধ কুরআন পাঠের নিয়ম কানুন শেখা শুরু করেছেন। যাকে দেখছেন, তাকেই ডেকে বলছেন, “দেখি আলিফ বা তা বল?”
এই গ্যাড়াকলে প্রথমে পড়লো রুমির বাবা। স্বামীর বাহু টিপে দিতে দিতে আদুরে গলায় বললেন,
— “দেখি আলিফ বা তা বলুন তো?”
আব্দুর রহমান সাহেব বলতে লাগলেন অনর্গল। কানিজ দ্রুত থামিয়ে বললেন, “ছা হবে না। ث উচ্চারণ করতে হবে আলতো করে। জিব্বা উপরের পাটির দাঁতের আগায় লাগিয়ে। সা….”
এরপর ز(যা) উচ্চারণের সময় বললেন, “যাহ্! যাহ্!”
রুমির বাবা ভয় পেলেন স্ত্রী তুই তোকারি শুরু করলেন কি না ভেবে। পরে বুঝলেন, উচ্চারণ শেখাচ্ছে। এমনভাবে তাড়িয়ে দিয়ে ‘যাহ্’ ‘যাহ্’ বলতে হবে যেন ঝিঁঝি পোকার আওয়াজ হয়। তিনি ধীর গতিতে বললেন,
— “একটু সময় নিয়ে ভালোমতো শেখো, তারপর শেখাও।”
স্ত্রীগণ যে কোনোকিছু শেখেন না, কেবল শেখান — এই অভিজ্ঞতা তিনি ভুলতে বসেছিলেন। তাই আপাতত তার পুনঃপাঠ সেশন চলবে।

***
— “তুই এভাবে নেড়িকুত্তার মতো আমার পেছন পেছন আসিস কেন?”
আরিব চোখ বড় বড় করে বলল, “তুই আমাকে নেড়িকুত্তা বলছিস?”
মারওয়ার ভাবভঙ্গি একেবারে স্বাভাবিক, “তুই ছাড়া তো আর কোনো কুত্তা চোখে পড়ছে না।”
আরিবকে আশাহত করে দিয়ে মারওয়া দ্রুত পায়ে স্কুলের দিকে এগিয়ে গেলো। সেভেন এইট থেকে এই ছেলে তার পেছন পেছন ঘুরছে। যেন বর্ডিগার্ডের দ্বায়িত্ব নিয়েছে। পাহাড়া দেয় রাস্তায় নিজের স্বজাতি কুকুর আবার আক্রমণ করে বসে কি না।
— “আমি তোর বয়সে বড়, এটা জানিস?”
— “তো কী করব? বয়সে বড় হলেই হয় না, চরিত্র হাঁটুর নিচে।”
— “তুই এভাবে বলতে পারলি! আমি চরিত্রহীনের মতো কী করলাম? আর তুই আমাকে তুই তোকারি করবি না।”
মারওয়া চোখ মুখ কুঁচকে ভেংচি কাটলো,
— “ওরে রে, তুই তোকারি করব না। আপনি আজ্ঞে করব? তোর বয়স কত?”
আরিব ঢোক গিলে বলল, “কেন? আঠারো।”
মারওয়া আঙ্গুল উঁচিয়ে ভাষণ দেওয়ার মতো করে বলল, “এই তো, এখনও প্রি-ম্যাচিউর বেবি। এই বয়সে পড়াশোনা করতে হয় বৎস, কুকুরিপনা করতে হয় না। কোনো বয়সেই করতে হয় না। তুই তো গোটা পুরুষজাতির মান ইজ্জত ডুবিয়ে দিচ্ছিস!”

আর কিছু বলার সুযোগ না দিয়ে সে দৌড়ে স্কুলের ফটক পেরিয়ে চলে গেলো। আজ ওদের টেস্ট পরীক্ষার রেজাল্ট। সাফা ক্লাসে বসে সবার পানির বোতল শেষ করছে, আর কাঁদো কাঁদো গলায় বলছে, “প্লিজ দে। আমি কল থেকে পুরিয়ে আনবো আবার।”
ভোররাতে সে স্বপ্ন দেখলো গণিতে ফেল করেছে। টেস্টে ফেল করলে তো ফাইনালে বসা যাবে না। কী অপমানজনক একটা ব্যাপার হবে!

মারওয়া এলো হেলেদুলে। ও প্রথম ক্লাস করেনি। বাংলা ম্যাডাম এসেই ধমক দিলেন,
— “এই মেয়ে? স্ট্যান্ড আপ!”
মারওয়া নির্ভয়ে দাঁড়ালো। ম্যাম বললেন,
— “দূর থেকে দেখলাম তুমি এখন এসেছ। এখন বলো, এটা কী স্কুলে আসার সময়? কী এমন কাজ করছিলে যে তোমার চল্লিশ মিনিট লেট হলো?”
মারওয়া চোখেমুখে কৃত্রিম আবেগ নিয়ে এলো জাদুবলে, “ম্যাম, আমার সেজো বিড়ালের খুব অসুখ। পরপর চারটা বেড়াল হাসপাতালে ভর্তি। দেখে এলাম। কী বলব ম্যাডাম! এত দুশ্চিন্তা হয়, রাতে ঘুমাতে পারি না।”

ক্লাসের সবাই খিলখিল করে হেসে ফেলল। ওর বিদ্যালয়ে একটা সুন্দর নাম আছে। ক্যাট’স মাদার, বিড়ালের জননী। ম্যাডাম ডাস্টার দিয়ে টেবিলে পরপর দুটো বাড়ি দিয়ে বললেন, “এই একদম চুপ!”
এরপর একপলক ওর পানে চেয়ে বললেন, “আর কিছু?”
মারওয়া হেসে মাথা নাড়লো উপরনিচ। বলল, “আমার সাত নম্বর বিড়ালের মেয়ের বাচ্চা হয়েছে ম্যাম। আমি নানী হয়েছি, আপনি বড় নানী।”
“গেট আউট! গেট আ-উ-ট।”
শেষবার বললেন ধীর গতিতে স্পষ্ট উচ্চারণে। বোঝা যাচ্ছে অবস্থা সঙ্গিন। মারওয়া বিনাবাক্য ব্যয় করে বেরুলো। দুজন মিলে বের হলে মজা হতো। একা একা কী করবে ভেবে খারাপ লাগছে। আজকাল সত্য কথার ভাত নেই। ওর পকেটেও একটা বেড়ালছানা আছে। বোরকার পকেট বড় হওয়ায় সাথে করে নিয়ে এসেছে। বসে বসে ওর সঙ্গে নিজমনে কথা চালাচালি করতে লাগলো।

ক্লাস শেষে সবাই বিড়ালটা নিয়ে হুড়োহুড়ি শুরু করলো। কোলে নেওয়ার আবদারে মারওয়া বিরস মুখে কেবল চেয়ে রইলো। এরপরই ওর প্রিয় বান্ধবী বিড়ালটা উপহার হিসেবে চাইলো। ‘না’ করা যায় না। আবার বাচ্চাটা ওর সঙ্গে থাকবে না ভাবতেই বুক খালি হয়ে যাচ্ছে। কী করবে এখনও কিছু ঠিক করেনি। স্কুল থেকে পালিয়ে যাওয়ার সময় দেখলো কিছু ছেলে শরবত বিলি করছে। প্রথম দেখায় ভেবেছিলো বিক্রি হচ্ছে। আরিব ওর পেছনে এসে দাঁড়ালো, “খাবি? কিনে দেই?”
মারওয়া মুখ নিচু করে থুতু দিয়ে একটু সরে দাঁড়ালো, “তোর এত মনে চাইলে তুই খা। পুরা এলাকাবাসীকে বিলা। আমার সঙ্গে ঢং দেখাতে আসিস না।”
রাগ করে হাঁটতে শুরু করে ডলিকে বলে গেলো, “যা। বিড়ালটা তোর।”
যাওয়ার পথেই ওর রাগ কমে গেলো। সে বিড়ালটার জন্য হুহু করে কাঁদতে লাগলো। আরিব বিস্মিত হবার মাত্রা ছাড়িয়ে ফেলেছে, “একটা বিলাইয়ের জন্য এত কান্না? আর আমি তো মানুষ। এত খারাপ লাগছে তো দিলি কেন?”

****
“অর্পা, তুমি কী কষ্ট করে মশারিটা টাঙিয়ে দিতে পারো?
”না, নীরা আছে না?”
”খুব ক্ষুধা লেগেছে। একটা ডিম ভেজে দিতে পারো?”
“নীরাকে বলেন।”
“একটু সরো।”
“নীরাকে বলেন।”
“লাইট টা অফ করো।”
“নীরাকে বলেন।”

রুমি অতিষ্ঠ হয়ে বললল, “নীরা এবার অফ যাও।”
অর্পা নাটকীয়ভাবে মুখ হা করে চেয়ে রইলো।
— “বাহ্ নীরা.? আমি নীরা?”
রুমি আমতা আমতা করতে শুরু করলো,
— “তোমার দোষ! সারাক্ষণ কী নীরা নীরা ক্যাচাল শুরু করেছে, ভুলে মুখে চলে এসেছে।”
অর্পা অনেক কিছু বুঝে ফেলার ভান করে বলল,
“মানুষের মনে যা মুখেও তো তাই হবে। সবই বুঝি।”
“মেয়েমানুষ একটু বেশি বেশি বুঝে, এটাই সমস্যা।”
“নীরা মনে হয় একটু কম বুঝতো।”
রুমির একবার ইচ্ছা করলো দেয়ালে মাথা ঠুকতে ঠুকতে মরে যেতে। একবার বিষয়টাতো বুঝতে চাইবে। না, সে কিছু শুনতেই রাজি না। কেবল ফরফর করে বলতে রাজি। নীরা নীরা করে জপ করতে রাজি।

”যতবার নীরা নীরা করছো ততবার ‘আস্তাগফিরুল্লাহ – সুবহানাল্লাহ’ পড়লেও সওয়াব পেতে।”
“নীরাকে নিয়ে ডায়েরী না লিখে কোনো কাজ করতে, তাহলে এতদিন ফকির থাকতে না।”
রুমি বিরক্ত হয়ে “হিমুর হাতে কয়েকটি নীল পদ্ম” পড়তে শুরু করলো। ওর হিমু হওয়ার শপথ ভঙ্গ করাটাই অভিশাপ ছিলো। সে এবার হিমু হয়ে যাবে। বিবাহিত ব্যাচেলর হিমু।

চলবে ~

একটি উত্তর ত্যাগ

আপনার মন্তব্য লিখুন দয়া করে!
এখানে আপনার নাম লিখুন দয়া করে