আজকে আমার মন ভালো নাই
নাহিদা সানজিদ
২.
রুমির বিয়ের দিন বাসর ঘরে এসেই লজ্জাজনক একটা ব্যাপার ঘটলো। বিয়ে বাড়িতে হঠাৎ ভারী ভোজের দরুন বেচারার পেটের অবস্থা নাজেহাল হয়ে উঠলো। বারবার ওয়াশরুমে আসা যাওয়া করতে করতে একেবারে সেখানেই ঘর করে নিলো। লজ্জায় আর বের হওয়ার নাম নিলো না। বাসরঘরে বসে আছে তার সদ্য বিবাহিতা স্ত্রী। নাম অর্পা। এত সুন্দর নাম সে অনেকদিন শোনেনি। তবুও তার মুখ থেকে শোনেনি, বিয়েতে কাজী সাহেব যখন কনের নাম উল্লেখ করেছিলেন তখন শুনেছিলো। অর্পা মাঝে একবার শুধু আড়ষ্ট গলায় বলেছে, “আপনার কী খুব খারাপ লাগছে?”
রুমি কিছু বলতে পারলো না। চুপচাপ থাকতে থাকতে তার এই দশা হয়েছে। অপরিচিত মেয়েদের সঙ্গে কথা বলতে বুক কেঁপে ওঠে। বারবার মনে হয় উল্টাপাল্টা উত্তর হয়ে যাচ্ছে। আবার ভেবেচিন্তে বলতে গেলে অনেক দেরী হয়ে যায়। পরিবেশ অস্বস্তিকর হয়ে ওঠে। ভাবতে ভাবতে আর বলা হলো না। প্রকৃতি আবার নিয়ম ভঙ্গ করে ডাক দিলো তাকে।
অর্পা অনেকক্ষণ অপেক্ষার পর স্বামীকে ফিরতে না দেখে ওঠার চেষ্টা করলো। ভারী শাড়ি নিয়ে ওর হাঁটতে ভীষণ কষ্ট হচ্ছে। কোমড়ে কালসিটে দাগ পড়ে গেছে। শাড়ির কুচিগুলোও এলোমেলো। বিছানার টি-টেবিলে এক গ্লাস দুধ ঢেকে রাখা। খাওয়া হবে কি না জানা নেই। আধ পুরোনো একটা ড্রেসিং টেবিলের সামনে দাঁড়িয়ে অর্পা গহনাগুলো খুলতে লাগলো। সেজেগুজে কারো সামনে যেতে তার কেমন যেন আড়ষ্টতা কাজ করে। ঘরের সামনে লাগোয়া বেসিনে কড়া লাল লিপস্টিক ধুয়ে সে দুই পাহাড়ি নামের বোনদের খুঁজতে বেরুলো। মারওয়া দরজা ধরে উচ্চ আওয়াজে কথা কাটাকাটি করছে। তাদের খুঁজে পেতে তাই বেগ পোহাতে হলো না। অর্পা হালকা স্বরে তার নাম ধরে ডাকলো,
— “মারওয়া!”
মারওয়া ঘাড় ঘুরিয়ে এক পলক দেখলো। চাপা স্বরে বোনকে বলল, “কী ম্যানারলেস মেয়েটা! স্বামী ফেলে এদিকে চলে এসেছে। বাসর ঘর থেকে কেউ বেরোয়?”
দূর থেকে তার কুটিল শব্দমালা অর্পা শুনতে পেলো না। সাফা চোখ গরম করে বলল, “তুই তো মনে হয় বাসর ঘরের ম্যানার্সের উপর পিএইচডি নিয়ে এসেছিস। বই লিখবি বলে ভাবছিস, ‘বাসর ঘরের আদব’, তাই না?”
মারওয়া তার স্বভাবসুলভ ঠোঁট বাঁকালো। নতুন ভাবির জন্য তাদের ঘর থেকে একটা ড্রেসিং টেবিল সরিয়ে বাবা ভাইয়ের ঘরে সেট করেছেন। কী সাংঘাতিক ব্যাপার! আসতে না আসতেই সবকিছুতে ভাগ!
অর্পা এগিয়ে এসে বলল, “উনার মনে হচ্ছে শরীর খারাপ। ওয়াশরুম থেকে বের হচ্ছেন না। তোমাদের কাছে ঔষধ হবে? কিছু মনে করো না, তুমি করে বলছি।”
নিচের ঠোঁট জিভ দিয়ে ভেজালো অস্বস্তিতে। এই অচেনা পরিবেশে অচেনা মানুষের সঙ্গে মেপে মেপে কথা বলতে বলতেই বোধহয় জীবন কাবার হবে। মনে মনে প্রতিটি বাক্য সাজিয়ে বলার চেষ্টা করছে সে। কখন কী ভুল ধরে ফেলে!
সাফা উদ্বিগ্ন চোখে তাকাতেই মারওয়া ফিক করে হেসে ফেললো। অন্য দিকে তাকিয়ে বলল, “এটা ওর আজন্ম রোগ। একটু ওলট পালট নিয়ম হলেই মহাশয়ের বাথরুম প্রেম বেড়ে যায়। এবার যত তাড়াতাড়ি মানিয়ে নেওয়া যায়!”
নববধূ হিসেবে তার বিরক্ত হবার কথা। কিন্তু সে হলো না। মারওয়ার কথায়ও কিছু মনে করলো না। কিছু কিছু মেয়ে ধরেই নেয় ভাইয়ের বউরা অমানুষ কিসিমের হয়। এদের মাথায় ওঠাতে নেই। মাথায় ওঠালে নাকি সংসার চিবিয়ে খায়। অর্পা সাফাকে উদ্দেশ্য করে বলল, “আমাকে ঔষধের কৌটা দিতে পারবে? আমি খুঁজে নিচ্ছি ঔষধ।”
কৌটা হাতে নিজের ঘরে ফিরে গেলো অর্পা। শান্ত চোখের চাহুনি, মার্জিত বলার ভঙ্গিতে সাফা মুগ্ধ চোখে কিছুক্ষণ চেয়ে থাকলো। তারপর একটা বালিশ নিয়ে মারওয়ার দিকে ছুঁড়ে মারলো।
— “তোর মতো অসভ্য মেয়ে আমি আর দেখিনি। বয়সে তোর কত বড়! এরকম ঢং দেখালি কেন?”
মারওয়া বালিশ হাতে ভেঙিয়ে বলল, “তোমাকে তুমি করে বলছি, কিছু মনে করো না।”
**
আজ আকাশে চাঁদ নেই। ঠান্ডা মৃদু মৃদু হাওয়া প্রবাহমান। রুমির ঘরের সঙ্গে আছে লাগোয়া একটি ছোট্ট বারান্দা। এর আয়তন এতটাই সংকীর্ণ যে দুজন একসঙ্গে দাঁড়ানো যায় না। বড়জোর গুটিশুটি মেরে বসা যাবে, কিন্তু আরামদায়ক হবে না। অর্পা ঘরের ভেতরে থাকা বাথরুমের দরজা বাইরে থেকে আটকে শাড়ি পালটে ফেললো। গাঢ় নীল রঙের একটা শাড়ি। সোনালী রঙা ব্লাউজ আর শাড়ির পাড়। অর্পা চেয়েছিলো এই শাড়ি পরেই সে বিয়ে করবে। কিন্তু সবার চাওয়া পাওয়ার উপর প্রাধান্য পেলো না সে ইচ্ছা। ব্যালকনির গরাদ বেয়ে বেপরোয়া ভাবে বেয়ে উঠছে মানিপ্ল্যান্টের ডগা। একটা পাতা চোখ মেলবে মেলবে ভাব। বেকার মানুষের ঘরে মানিপ্ল্যান্ট থাকার পেছনে অন্ধ কুসংস্কারও থাকতে পারে।
অর্পা মাঝেমাঝে অবাক হয়। তার মামা কী করে একজন বেকার পুরুষের হাতে মেয়ে তুলে দেবার সাহস করলেন? অর্পার বড় ভাই যখন তেড়ে এসে বলল, “এই শালার পুতের ঘরে বিয়ে দেবো না। খচ্চর লোকেরা জুতা পর্যন্ত পাঠায়নি কনের সাজের সঙ্গে। কী ছোটলোক! আজকাল কে বেকারের ঘরে বিয়া দেয়!”
মামা দার্শনিকের মতো ভাবুক গলায় বললেন, “একটা বেকার ছেলে ঠিক কতদিন পর্যন্ত বেকার থাকবে! কিছু না কিছু তো করবেই। বউয়ের দ্বায়িত্ব পরিবার তুলে দিলে আরো আগে করবে। এটা তো আর পালিয়ে বিয়ে না যে দায় দ্বায়িত্ব নাই। আমরা তো মাথার উপরে আছি। পরিবর্তন আমাদেরই করতে হবে, সমাজটা উচ্ছন্নে যাচ্ছেরে বেটা।”
অর্পার ভাই বিরক্তিতে মুখ বিকৃত করে ফেলল, ”সমাজ সংস্কার করার জন্য আপনি আমার বইনরেই পাইলেন?”
মামা উত্তর করেন না। বাবা চাকরি হারিয়েছেন বছর কয়েক হচ্ছে। বিয়েটা মামার খরচে হচ্ছে, বাবা কিছু বলার সাহস খুঁজে পাননা। অর্পা না করে না আর।
বেশ অনেকটা সময় কেটে যাওয়ার পর রুমি বের হলো। ওর মনটা তেতো হয়ে আছে। সদ্য বিয়ে করা বউয়ের সামনে তার সম্মান বলতে বোধহয় কিছু থাকলো না। অর্পা পেছন ফিরে তাকালো। বাতাসের তীব্রতা ধীরে ধীরে বাড়ছে। অর্পা ধীর পায়ে এগিয়ে এসে বলল, “আসসালামু আলাইকুম।”
রুমি চোখ তুলেও তাকালো না। একমনে পায়ের দিকে তাকিয়ে জবাব নিলো অস্বস্তির সুরে। অর্পার হঠাৎ হাসি পেয়ে যাচ্ছে, সে মাথার ঘোমটাটা আরো একটু টেনে যথাসম্ভব লাজুক গলায় বলল, “পা ধরে সালাম করতে হবে?”
রুমি আৎকে উঠে “না, না” পা লুকানোর চেষ্টা করলো। অর্পা হাসি আটকে রাখতে পারলো না। মুখে আঁচল চেপে হাসতে লাগলো অনবরত। ওর শরীর হাসির ভারে কাঁপছে। রুমি তাকাতে চেয়েও তাকালো না। ওর কেমন যেন লজ্জা লজ্জা করছে। কৈশর থেকে নারীসঙ্গ পরিহার করতে করতে এক ধরনের বৈরাগ্য হানা দিয়েছে মনে। অর্পা ওকে পানি আর ঔষধ এগিয়ে দিয়ে বলল, “আমি কিছু মনে করিনি। বিয়েটা অনেক লম্বা একটা জার্নি। যদি ইমেজ বজায় রাখতে যাই, তাহলে বিয়ে করা উচিত না। আমি চেয়ারে, সোফায়, গাড়ির সিটে পা নিচে রাখতে পারি না। দুপায়ে আসন দিয়ে বসে থাকি। মাংসের তারকারি খেতে গেলে চোখ নাক দিয়ে অনবরত পানি পড়ে। মুখ হা করে ঘুমাই। চোখ হালকা খোলা থাকে। আম্মা বলে, কাউয়া ঘুম। এগুলোতে ইমেজ কীভাবে ধরে রাখবো বলেন?
মানুষ হিসেবে একেবারে নরমাল বিষয়।”
রুমি “কাউয়া ঘুম” এর নাম শুনে হেসে ফেললো। সেই সঙ্গে অর্পার কথা শুনে মুগ্ধও হলো।
কথা বাড়ার আগেই দরজা জানালা শব্দ করে বন্ধ হয়ে গেলো। ঝড় শুরু হচ্ছে। বহুদিন একটানা গরমের পর একটু স্বস্তির বৃষ্টি। অর্পা একহাতে দরজা টেনে ধরে চোখ বন্ধ করে বাতাসের ঘ্রাণ নিচ্ছে। ওর খোপাটা নেই। চুল খোলা। বিয়ের সময় করে দেওয়া মাথার অগ্রভাগের দুপাশে চিকন করে দেওয়া খেঁজুর বেণী। বিয়ের সাজটাও হালকা ছিলো। এখন আরো হালকা হয়ে দারুণ দেখাচ্ছে। পরনের নীল শাড়িতে ওকে বেহেশতী হুরের মতো লাগছে। রুমি কখনো হুর দেখেনি, তাই উপমাটা বেমানান। হাতের এলোমেলো সংখ্যার চুড়ির তাল বৃষ্টির সুরের সঙ্গে মিশে অন্যরকম সঙ্গীত সৃষ্টি করছে। রুমির হঠাৎ সৈয়দ মুজতবা আলীর লেখা “শবনম” এর কথা মনে পড়ছে।
“আমার বিরহে তুমি অভ্যস্ত হয়ে যেওনা!”
আর লতিফুল ইসলাম শিবলীর লেখা “আসমান”।
“তুমি আমার আসমান!”
***
রুমিদের বাড়িটা দোতলা। বাড়ির সামনে পেছনে পর্যাপ্ত উঠান। পেছনে নানা রকম গাছে সুশোভিত বাগান। এক মুহুর্তের জন্য জমিদার বাড়ি বলে ভ্রম হয়। নিচতলায় ভাড়া থাকে মানুষ। এ জায়গাটা গ্রাম শহরের মাঝামাঝি। মানুষের মাঝেও আধুনিকতা, গ্রামীণ জীবনাচার সমান সমান ভাবে বিদ্যমান। এ যেমন চিন্তাভাবনায় যথেষ্ট আধুনিক হওয়া স্বত্তেও রুমির দাদী রুমির দরজায় কান পেতে আছেন। কান পেতে ঠিক কী শোনার চেষ্টায় আছেন তাও এক রহস্য বই কি। মারওয়া এই রহস্য উদ্ধার করতে এগিয়ে এসে নিজের কানটাও পাতলো। কিছু শোনা যাচ্ছে না। দাদীকে ভ্রু নাচিয়ে ইশারায় “কী?” জিজ্ঞেস করলো। দাদীও ভ্রু নাচালেন।
এ বাড়িতে সকলে ফজরের সঙ্গে ওঠে। রুমির দাদাজান মৃত্যুর আগ পর্যন্ত এ নিয়ম করে গেছেন। একবার তো রুমিকে ঘুমন্ত অবস্থায় বিছানা থেকে ফেলে দিলেন ঘুম ভাঙছিলো না বলে। মেয়েদের ক্ষেত্রে কিছুটা ছাড় জোটে। সাফা হঠাৎ হাভাতের মতো উঠে বসলো। স্বপ্নে দেখলো, অঙ্কের স্যার ধমকে ধমকে বলছেন, “বোর্ডে আয়, অঙ্কটা করে দেখা দেখি।”
সাফা বুকে থুতু দিয়ে খানিকটা ধাতস্থ হওয়ার চেষ্টা করলো। বাবা বলেছিলো দুঃস্বপ্ন দেখলে ”আউজুবিল্লাহ” পড়ে থুতু দিয়ে পাশ ফিরে ঘুমাতে হয়।
এটা কী কোনো দুঃস্বপ্ন ছিলো? দুঃস্বপ্নই তো!
মারওয়াকে ঘটনা খুলে বলতেই বিকট আওয়াজে হাসতে শুরু করলো। মেয়েরা নাকি ভাবে, বোন থাকলে সুখ দুঃখের গল্প করা যায়। কতজনকে হাহুতাশ করতে দেখেছে! এ কোন পিশাচ জাতের প্রাণী যে হেসে হেসে সমবেদনা জানায়?
সে রাতের প্রচন্ড ঝড়ে ওদের বাড়ির গেটের উপর লাগানো দুটো মাটির বিমানের একটি খালে পড়ে গেলো। বাবা শখ করে লাগিয়েছিলেন এ দুটি। মাঝখানে মাটির ছাউনি দিয়ে ছোট্ট ঘর। ঘরটা অবশ্য কবরস্হানের মতো দেখাচ্ছে। আগে বের হলেই মারওয়াকে উত্যক্ত করতে কিছু ছেলে বলতো, “কীরে তোর দাদার কবর নাকি?”
মারওয়া জুতা হাতে নিয়ে পেছন পেছন ছুটে যেতো। সেদিনগুলোর মতো আজও ধ্বংসাবশেষের উপর নিষ্ঠুর হাতির মতো পা ফেলে পাড়ার দুষ্ট ছেলেরা হেঁকে হেঁকে সংবাদ পড়তে লাগলো, “রুমির প্রাইভেট জেট বিমানটি নববধূসহ বাংলাদেশের উপর দিয়ে আসার কালে দূর্ঘটনায় বিধ্বস্ত হয়েছে। আমরা তাদের আত্মার মাগফিরত কামনা করি।”
চলবে ~