আজকে আমার মন ভালো নাই পর্ব-১৬ এবং শেষ পর্ব

0
378

আজকে আমার মন ভালো নাই।।
নাহিদা সানজিদ।।
১৬.
তুমি হিম কুয়াশায়, দিন ধোঁয়াশায় বর্ষা মুখোর ক্ষণে,
এসো ফুল হয়ে দুল, দোল দুলোনি,
তুমুল রতি রনে।

সকাল থেকে ফোনের প্লেলিস্টে এই গানটা বাজছে। বাজনা ছাড়া লোকটার গলায় গানটা বেশ ভালো লাগছে। খালি গলায় এ যুগে এত সুন্দর কেউ গাইতে পারে সাফার জানা ছিলো না। আজ সাফার বিয়ে। সেও গুনগুন করে গানটা গাওয়ার চেষ্টা করে যাচ্ছে। এরমধ্যে জহির একবার কল করেছে, মা এসে ফোনটা দিয়ে গেছেন। হামলে পড়ে ফোনটা ধরলো ওর কিছু বান্ধবী। তারা মূলত দুষ্টুমি করতে চেয়েছিল। দুষ্ট গলায় বলল,
— “হ্যালো।“
সঙ্গে সঙ্গে ফোনটা কেটে গেলো। ওরা বলার ভাষা হারিয়ে ফেললো। এর কিছুক্ষণ পর আবার কল এলো, ধরলো সাফা, “হ্যালো, আসসালামু আলাইকুম?”
— “ওয়ালাইকুমুস সালাম। আমরা আপনার জিনিসপত্র এখনই পাঠিয়ে দিতে চাচ্ছি। নামাজ পড়ে যেতে যেতে তো দেরী হবে। আপনাদের সাজতে তো একটু সময় লাগে।”
সাফা বলল, “আচ্ছা।”
এরপর কৌতুহলী গলায় জিজ্ঞেস করল, “তখন ফোন কাটলেন কেন?”
জহির স্বাভাবিকভাবেই বলল, “এমনি। কল করেছি আপনাকে। আরেকজনের সাথে কথা কেন বলব?”
সাফা হেসে ফেললো। ভাবী মনোযোগ দিয়ে মেহেদী দিয়ে দিচ্ছেন। একটু পরপর রান্নাঘরেও উঁকি দিয়ে আসছেন। রূমীও ব্যস্ত মেহমান তদারকি করতে। কাকে সশরীরে দাওয়াত করা হয়নি বলে গাল ফুলিয়ে বসে আছেন, তার হেস্তনেস্ত করতে।

মারওয়া হেঁটে বেড়াচ্ছে খোলা চুলে। মাঝে মাঝে প্রেতাত্মা বলে ভ্রম হয়। দুনিয়াবি কোনো বিষয়ে আপাতত তার কোনোরূপ আগ্রহ নেই। অর্পা সবাইকে মেকআপের লেসন দিচ্ছে, “এখনকার অধিকাংশ মেয়েদের মেকআপ করার নিয়ম জানা নেই। ওরা মনে করে সাদা আটা ময়দার একটা চামড়া উপরে বসিয়ে দিলেই হয়। মেকআপ করতে হয় ত্বকের রঙের সঙ্গে মিলিয়ে। তোমার গায়ের রঙ ব্রাউন হতে পারে। তুমি তার সঙ্গে মিলিয়ে শেড ব্যবহার করবে। এই জোর করে চেহারা বদলে ফেলাটা আমার রীতিমতো রেসিজম লাগে, বুঝলে?”
সাফাকে ঘরোয়াভাবে সাজানো হলো। লাল জামদানি শাড়ি, জর্জেটের ওড়না মাথার উপর টানা। মনে হচ্ছে ছোট্ট একটা পরী বসে আছে। রূমী এসে দেখে বলল, “অর্পা, মনে হচ্ছে আমরা পুতুল বিয়ে খেলছি। পিচ্চি বরবউ খেলার কনে।”
হাসতে গিয়েও ওর মন খারাপ হয়ে গেলো।

কানিজ আজ ব্যস্ততম মানুষদের একজন। আব্দুর রহমান সাহেব ব্যস্ত হবার ভান করছেন ঠিকই, কিন্তু তিনি আদতে ব্যস্ত নন। সবার সঙ্গে হাত মিলিয়ে জোরপূর্বক একটা হাসি দিচ্ছেন। বরপক্ষ এলো খুব তাড়াতাড়িই। বর সাহেবও খুব বেশি দেরি করলেন। এক পাল ছেলেপেলে বাড়ির ফটক আগলে দাঁড়িয়ে থাকলো। লাখ টাকার নিচে নাকি ভেতরে যেতে দেবে না। বেশ কিছুক্ষণ গাল বাজানোর পর তারা পাঁচ হাজারে মানলো। বরের সঙ্গের বন্ধুরা ক্রমাগত গান গেয়ে চলেছে,
“আঙ্গো দিগের হেতি,
রাইনতো জানে ইছা মাছ আর হাইন্না কচুর লতি…”
নোয়াখালীর গান। একদল আবার টেবিলের উপর হাত দিয়ে তালি বাজাচ্ছে। অন্দরমহলের নারীদের হাসির শব্দও শোনা যাচ্ছে। কথা কি হচ্ছে না হচ্ছে তাতেই সকলে একসাথে হেসে উঠছে জোরে।

প্রিয়া গম্ভীর মুখে বসে। ওর সঙ্গে মিন্টুর একটু আগেই তুমুল ঝগড়া হয়েছে। মেয়েরা বেশ আগ্রহের সঙ্গে তাদের প্রেমের গল্প শুনতে চাইছে। প্রিয়া রাগ রাগ গলায় বলল, “সবসময় ছেলেরা কেন বিয়ে করতে আসে? এবার থেকে উচিত মেয়েদের গিয়ে বিয়ে করা। এত অসমতা মানা যায়?”
মিন্টু তাকে কলে বলছে, “ওরে বাবা! আর?”
সে ইদানীং ভদ্র। অযথা তর্ক করে না। প্রিয়া ফুঁসে উঠলো, “জামাই খাওয়া বলে যে রাক্ষসের খাবারের আয়োজন। মেয়েদের জন্য শ্বশুরবাড়িতে কী হয়?”
“হয় না? বউভাত।” মিন্টুর সরল উত্তর।
“সে তো একদিন।”
মিন্টু শ্বান্তনার সুরে বলল, “আচ্ছা,যাও। তোমাকে এবার নিয়ে উঠানখাসি জবাই দেব।”
প্রিশা মেনে গেলো। কিন্তু পরে খেয়াল হলো উঠানখাসি কী জিনিস! পুরো ঘরে কেউ জবাব দিতে পারলো না।

মারওয়া গম্ভীর মুখে চেয়ে আছে। অবাক হবার ভং ধরে বলল, “কী রে! তুই এমন হে হে করে হাসছিস! দুই মিনিট পর বাবার বাড়ি ছেড়ে যাবি, এখনি এত হাহা হিহি। ব্যাপারটা কী? তোর ওই লোক বান মেরেছে নাকি তো বুঝতে পারছি না।”
সাফা আয়নায় বারবার তার মুখ দেখছে। কেমন অন্যরকম লাগছে। দাদী তার দীর্ঘদিনের বিবাহিত জীবন থেকে কিছু উপদেশ দেবার চেষ্টা করছেন। মাঝেমাঝে এমন সব কথা বলছেন কানে কানে, যে তার কান লাল হয়ে যাচ্ছে। কিছুক্ষণের মাঝে হঠাৎ হুজুর এসে কবুল শুনতে চাইলেন। সাফা মারওয়ার হাত শক্ত করে ধরে রাখলো। মারওয়ার বুক ধুকপুক করছে। তবুও সে ধমক দিয়ে বলল, “কবুল বলার আছে বলবি, পরে ফাঁকে দিয়ে আরেকজন এসে কবুল বলে দিলো। তুই তো আবার কালামানিককে ছাড়া বাঁচবি না।”
সুষ্ঠুভাবে বিয়ে সম্পন্ন হলো। বর কনেকে একসাথে বসিয়ে আয়না ধরা হলো সামনে, ছোট ছোট বাচ্চারা পাশ ঘেঁষে দাঁড়িয়ে আছে। ওরা আয়নায় চোখে চোখ মেলাতে লজ্জা পাচ্ছে। এত মানুষ সামনে দাঁড়িয়ে!

মারওয়া একটা রুবা কানে কানে কি যেন বলল। রুবা হাত নাড়িয়ে সকলের সামনে গিয়ে বলল, “Stop guys. এই আয়নাটা সম্ভবত মঙ্গলগ্রহ। কারণ এতে দুটো চাঁদ দেখা যাচ্ছে।”
সবাই হেসে উঠলো “ওওওও” শব্দ করে।
জহিরের সঙ্গের ওরা বসার ঘরে বসে গানটা গেয়েই যাচ্ছে। সাফা ফিসফিস করে বলল, “গানের লাইনগুলোর মানে কী?”
জহির মাথা নিচু করে হাসলো।
“প্রমিত ভাষার মতো নোয়াখালীর ভাষায়ও তিনটা সর্বনাম আছে। হেতি , হেতনে, হিজ্জা। হেতনে বলা হয় অনেক সম্মান করে। হেতি বলা হয় সে’ অর্থে। হিজ্জা বলা হয় তুই অর্থে। ওরা আপনার কথা বলছে, মানে আমাদের দিকের সে, অর্থাৎ ওদের ভাবী বা আমার বউ। রাঁধতে জানে ছোট চিংড়ী মাছ আর পানিকচুর লতি। কিছুটা এরকম। প্রশংসা করে আরকি।”
সাফা ভ্রু উঁচিয়ে বোঝার চেষ্টা করলো, “আর উঠানখাসি মানে?”
“কুকুর।”

মিন্টু আপাতত নয় নম্বর বিপদ সংকেতের আওতায়। রূমী ওকে লুকিয়ে রেখেছে। মিন্টু মাঝেমাঝে ওকে ফোন করে আবহাওয়ার সংবাদ জানতে চাইছে। প্রিয়া কোমড়ে হাত দিয়ে বলছে, “তোকে কুত্তা খাওয়াবো, কুকুর না তোরই কিমা বানাবো।”
“স্বামীর সঙ্গে এভাবে কথা বলা ঠিক? কোরান হাদীস পড়ো, বউ।”
“শুধু নিজের ফায়দার বেলায় কোরান হাদীসের কথা মনে আসে?”

**
শ্বশুরবাড়ি ছিমছাম। কাঁদতে কাঁদতে গাড়িতে ঘুমিয়ে গিয়েছিলো সে। অর্পাও তার কান্না দেখে কেঁদে ফেলল। রূমীকে তো দেখাই যায়নি। মারওয়াকেও না। নতুন জায়গায় এসে ওর সব অপরিচিত লাগছে। শ্বশুরালয়ে এসে প্রথম পড়লো শ্বাশুড়ির সামনে, “হায় আল্লাহ! মেয়েটার কী অবস্থা। দেখি সর সর।”
জহিরকে সরিয়ে দিয়ে সাফার গহনা খুলে দিলেন তিনি। সুতি একটা শাড়িও পরিয়ে দিলেন। এরপর বিছানা করে দিয়ে বললেন, “ঘুমাও, মা। কেউ আসবে না এখানে।”
সাফাকে পুতুল বউয়ের মতো ঘুম পাড়িয়ে তিনি বাইরে এলেন। এসে অবাক হয়ে দেখলেন ছেলে সেজেগুজে ঠায় বসে আছে। অসহায় গলায় বলছে, “আম্মা, আমার বউ কই?”
— “বউ কই মানে? বউ ঘুমাচ্ছে। ছোট্ট একটা মেয়ে। তোকে ভয় পাবে।”
জহির অবিশ্বাস্য দৃষ্টিতে তাকালো, “আম্মা, আমি তোমার ছেলে। উনি আমার বউ।”
— “উনি উনি করছিস কেন? তোর কথা শুনে মনে হচ্ছে মেয়েটা বুড়া মহিলা।”
জহির কিছু বললো না। লজিং হিসেবে ছোটবেলায় তাদের বাড়িতে এক হুজুর ছিলেন। তিনি স্ত্রীকে আপনি করে বলতেন। কিশোর মনে কি যে গেঁথে গিয়েছিলো তখন। ওয়াদা করে ফেলেছিলো আপনি করে বলবে ভবিষ্যৎ স্ত্রীকে।

সাফা সত্যিই ঘুমিয়ে গেছে। ওর মতো বোকা মেয়ে এই পৃথিবীতে আছে কিনা সন্দেহ। জহির মন খারাপ করে বারান্দায় বসে রইলো। মস্ত বড় থালার মতো চাঁদ। এত ভালো লাগছে দেখতে। ধ্যাত! ঘরে চাঁদ রেখেও পরের চাঁদ দেখতে হচ্ছে। বিরক্তিকর। অন্ধকারে হাঁটার শব্দ হচ্ছে। সাফা চোখ কচলে কিছুক্ষণ থম মেরে দাঁড়িয়ে রইল, “আমার বিয়ে হয়ে গেছে?”
জহির কি বলবে ভেবে পেলো না। সাফা গরাদে হাত রেখে অবাক গলায় বলল, “আরে! কী সুন্দর চাঁদ! চলেন আমরা বাইরে যাই?”
রাত একটায় বাইরে! তবুও সদ্য বিবাহিত রমণীর নাকের উপর জ্বলজ্বল করে জ্বলতে থাকা নাকফুলের দিকে চেয়ে মানা করে গেলো না। ওরা সত্যিই বেরুলো। ঠান্ডা ঝিরিঝিরি হাওয়া বইছে। সাফা হাঁটছে নেচে নেচে। ওর চুড়িগুলো টুংটাং করে বাজছে। সে গুনগুন করছে সকাল থেকে শোনা সেই গান, “তুমি ফজর হলে আলতো করে ভেঙে দিও ঘুম…”
জহির ওর হাত মুঠোয় টেনে নিয়ে বলল, “এভাবে লাফিয়ে লাফিয়ে হাঁটলে যাওয়ার সময় খোঁড়া বউ নিয়ে যেতে হবে। এরপর না আমাকে বলবে বালিকা বউ নিয়ে কোন দুঃসাহসে আমি বের হলাম। আমাকে তো অপহরণের মামলা দেওয়া উচিত।”
সাফা হেসে উঠলো।

সে নিবিষ্ট মনে কি যেন ভাবছে। জহির বলল, “কী ভাবছেন?”
ও খেয়ালই করলো না ওকে আপনি করে বলা হচ্ছে। সে ভাবুক গলায় বলল, “আমরা যখন তিনজন একসাথে ঘুমাতাম? ভাবী, আমি, মারওয়া? তখন ভাবী আমাকে বলেছিলো, কেউ যদি কারো ভালোটুকু জানে, তাহলে সে তার প্রেমে পড়ার সম্ভাবনা প্রবল। আবার কেউ যদি কারো শুধু খারাপ টুকু দেখে, তাহলে মনে হয়ে এর চেয়ে জঘন্য মানুষ এ পৃথিবীতে নেই! আর আমাদের ভালো খারাপ মিলিয়ে যারা আমাদের সাথে থাকে, তারাই কেবল আপন মানুষ। ভালোবাসার মানুষ হতে পারে।”
জহির মাথা নাড়িয়ে বলল, “সুন্দরই বলেছেন তিনি। বেশ থটফুল।”
সাফা হঠাৎ জহিরের চোখে চোখ রাখলো। জহিরের বুক ধ্বক করে উঠলো। কী সুন্দর চোখ! শুভ্র ভেজা হাসনাহেনার মতো পবিত্র যার দৃষ্টি! তার মিষ্টি কন্ঠ গানের মতো বাজে, “আমি চাই আপনিও আমার তেমন কোনো আপন মানুষ হয়ে যান।”
জহির মনে মনে কেবল ভাবতে লাগলো, কোন সে পূন্য আমি করেছি যে জন্য আল্লাহ এমন কাউকে মিলিয়ে দিলেন!

***
“আজ আমি আমার শেষ ডায়েরীর শেষ দিনলিপিটি লিখছি। মাঝে কতকি ঘটে গেলো! কিছু টুকে রাখা হয়েছে, কিছু হয়নি। কিছু কিছু বিষয় এত সংক্ষিপ্ত করে লিখেছি, এখন পৃষ্ঠা উল্টে মনে করার চেষ্টা করলে বোধ হয় ব্যর্থ হবো। এ ডায়েরী আমার বৃষ্টি সমান চঞ্চলতার নিরব স্বাক্ষী। আমাকে আমার হয়ে বড় হতে দেওয়া সবচে ভালো সঙ্গী। কিন্তু এক ডায়েরী আর কত দিন? অষ্টাদশে পা দেওয়া আমার এই পাঁচ বছরের পুরোনো ডায়েরীটা অবশেষে আয়ুর শেষপর্যায়ে পৌঁছুলো।

আরিব এসেছে। সে গল্পের গুরুত্বপূর্ণ কোনো ব্যক্তি নয়। তবুও জোর করে ঢুকতে চাওয়ায় তাকে নিয়ে অনিচ্ছা স্বত্তেও লিখতে হয়। আরিবকে যদি আমি এখন বিয়ে করে ফেলি, তখন একটি জটিল সমস্যায় পড়ে যাবো। সবাই মনে করবে, আমাদের বহুবছরের প্রেম ছিলো। লোকমুখে এতটুকু গল্প যখন রঙচঙ মাখিয়ে উপন্যাস রূপে আমার ছেলেমেয়ে শুনবে, তখন তাদের কাছে দেখানোর মতো মুখ আমি খুঁজে পাবো না। আরিবের সঙ্গে কোনোকালেই আমার কোনো প্রেম ছিল না। তবুও জোর করে এই অপবাদ স্বেচ্ছায় তুলে নেওয়া কী ঠিক হবে?

আবার না করে দিলেও আমি বিপদে পড়ে যাব। সবাই আঙ্গুল আমার দিকে তাক করে বসে থাকবে। একটা মেয়ের জন্য যখন একটা ছেলে উপার্জনক্ষম হয়ে আসে, পরিবারকে মানিয়ে নেয়, তখন স্বভাবতই সে ছেলের প্রতি সকলের একটা মায়া কাজ করে। ছেলেদের ভালোবাসার মূল প্রকাশ সম্ভবত দ্বায়িত্ববোধে। যাহোক, আমি সে নিয়ে একেবারেই কৌতুহলী নই।

আমি আরিবকে একটা প্রশ্ন করব বলে ঠিক করেছি। ঠিক প্রশ্ন নয়, উদ্দীপক। প্রশ্নটা করবে সে। তার প্রশ্নটা যদি আমার মনমতো হয়, তবে আমি এসবকিছু না ভেবেই বিয়েটা করব। আর মনমতো না হলে যতদিন মনমতো উত্তর কারো থেকে না পাচ্ছি, ততদিন বিয়েই করব না।”

আরিব এলো উপরে। ছেলেটা খুব খুশি। চোখে মুখে বাড়তি আনন্দ উপচে পড়ছে। এখন বর্ষাকাল। হুটহাট বৃষ্টি ঝরে। আকাশে মেঘের ভয়ংকর গর্জন। মারওয়া মন খারাপ করে জানালার দিকে তাকিয়ে আছে। ও অভিনয় করবে বলে ভেবেছিলো। কিন্তু এখন সত্যি সত্যি মন খারাপ লাগছে। আরিব উদ্বিগ্ন গলায় বলল, “কী হয়েছে?”
— “আজকে আমার মন ভালো নাই। আপনি কী অন্য কোনোদিন আসতে পারেন? তখন কথা বলব।”
আরিব মাথা দুলিয়ে চলে যাবে বলেই ভাবছিলো। হঠাৎ একবার পেছন ফিরে বলল, “কেন মন খারাপ জানতে পারি?”
মারওয়া না করলো। জানতে পারবে না। অনেকদিন পর হঠাৎ ‘তুই’ করে বলতে ওর ভালো লাগছে না। আরিব মাথা হেলিয়ে সিঁড়ির কয়েক ধাপ পার করে আবার ফিরে এলো। বলল, “খুব বেশি মন খারাপ হলে সবচেয়ে প্রিয় কাজটি করা যেতে পারে। আমি সবসময় ঘুরে বেড়াই পছন্দের জায়গাগুলোতে। পরে মনে হয়, আরে! আমার তো মন খারাপ ছিলো।”
অবান্তর একটি পরামর্শ মনে হলো মারওয়ার। সে বিরক্তি চ শব্দ করে বলল, “আপনি যান তো। মেয়েদের মন খারাপ আর মুডসুয়িং এত পাত্তা দিতে হয় না।”
আরিব চলে গেলো। সারাদিন সে ব্যাপারটা নিয়ে ভাবতে লাগলো। রাত দশটায় সে মারওয়ার নাম্বারে একটা ম্যাসেজ করলো, “তোমার কথাটা নিয়ে আমি সারাদিন ভেবেছি। একটা কথায় তুমি নিজেই নিজেকে ছোট করলে। তোমার প্রশ্নের উত্তর আমি পেয়েছি।”

“প্রশ্ন এবং উত্তরটা আমি গোপন করেই রাখছি। ডায়েরীতে যাপিত জীবনের সব গল্প লিখে রাখতে নেই। দূর্বলতা বাড়ে। আমাদের প্রতিটি স্মৃতি লিখে রাখবার জন্য যে কেরামান কাতেবীন ভর করে আছে কাঁধে। একপাক্ষিক বিবৃতি দিয়ে এই ডায়েরীটি এখান সমাপ্ত হলো। আরিবের সঙ্গে আমার বিয়েটা হয়েছিলো। ভাববেন না, টাকা হয়েছে বলেই বিয়েটা করেছি। সৌদি আরবে যে এখন স্বর্ণের খনি পাওয়া যায় না, তা সবাই জানে। আমি বিয়ে করেছি উত্তরের দায়ে। বেচারাকে কথা দিয়েছিলাম উত্তর ঠিকঠাক পেলে আমি রাজি হব। ওর আমার “আপনি আজ্ঞে” করা হজম হচ্ছে না। এজন্য তুই তুকারি শুরু করেছি আবার। এবার বিশ্বাস হয়েছে।”

কোনো শ্রাবণের দিনে মারওয়ার দাদী মারা গেলেন। বুকের ভেতর উপচে উঠা কান্না নিয়ে সে ছাদে দাঁড়িয়ে রইলো। আরিব ওর পাশে দাঁড়ালো বিনা বাক্য ব্যয়ে। কোনো অযাচিত স্বান্তনা ছুঁড়তে গেলো না। মারওয়াকে সে প্রথমবারের মতো কাঁদতে দেখলো। আলতো হাতে জড়িয়ে ধরে রাখা ছাড়া সে কিছুই করতে পারলো না। মারওয়ার মনে পড়ে গেলো সেদিনের বৃষ্টিবিলাসের স্বপ্নটার কথা। খোদা তা’লা আমাদের জীবনে কিছু দেন আর কিছু কেড়ে নেন। তকদীরের মতো সুস্পষ্ট সত্য আমরা মানতে পারি না। তবুও পেছন ফিরে তাকালে মনে হয়, “আল্লাহ যা করেন ভালোর জন্য। আমরা তাঁর কাছ থেকে এসেছি, আর তাঁর নিকটই আমার প্রত্যাবর্তন।”
বাতাসে মন খারাপের ঘ্রাণ। আজকে আমার মন ভালো নাই, আজকে আমার মন ভালো নাই, খবরের নিঃশব্দ বিজ্ঞপ্তি শহর জুড়ে। গল্পটি এখানে সমাপ্ত করা ছাড়া উপায় নেই। মারওয়া ডায়েরীর শেষ পাতায় দাগ টেনে লিখলো, “And the story of my sweet sixteen ends here…”।

পরিশিষ্ট :
বিশ্ব গাধা দিবসে অর্পা তার স্বামীকে মেনশন দিয়ে লিখলো, “কিছু মনে করবেন না। কেন জানি আপনার কথাই স্মরণে আসলো প্রথমে।”
এক ঝাঁক হাহা পড়েছে। রূমী দেখলো, কিছু বললো না। এমনিতেই কালভাদ্রে ফেসবুকে আসে, তাও অর্পার জ্বালায় শান্তি নেই। সে নাকি বিয়ে করেছে কেবল পোস্টে মেনশন দেওয়ার জন্য। বিয়ের আগে মেনশন দেওয়ার মানুষের অভাববোধ হতো।

সাফা নতুন নতুন নোয়াখালীর ভাষার শেখার চেষ্টা করছে। ঘোমটা টেনে লাজুক পায়ে হেঁটে এসে সে জহিরের কানে কানে বলল, “আঁই আন্নেরে বালোবাসি। এক্কেরে জান জান হরান দি। হাছা কইর।”
জহির অদ্ভুত স্বরের এই কথা শুনে হাসতে হাসতে কাত হচ্ছে। এই ছেলের হাসি এত সুন্দর!

অনেকদিন পর মারওয়া তার ডিএক্টিভেট প্রোফাইলটা ওপেন করলো। “Marو Rahman updated her profile picture” শিরোনামের পোস্টটি ছাড়া বর্তমানে কোনো পোস্ট মজুদ নেই। তার কাছে ফেসবুকে অলস অলস লাগে। এত রোবোটিক জীবন তার পছন্দ না। সে মূলত ফেসবুকে এসেছে রিলেশনশিপ স্ট্যাটাস বদলাতে। অকারণেই তার এই ইচ্ছাটা করছে। সে গট ম্যারিড স্ট্যাটাস দিয়ে ক্যাপশনে লিখলো : “যার কাছ থেকে শয়তানি ওসওয়াসা ভেবে পালাতাম, এখন সওয়াবের আশায় তার পা টিপে দিতে হয়।”

আরিব সেখানে মন্তব্য করেছে, “কখন পা টিপে দিয়েছিস? কত বড় অপবাদ পাবলিক প্লেসে!”
মারওয়া প্রতুত্তরে লিখলো, “টাইপিং মিস্টেক হয়েছে। ওটা পা’ এর জায়গায় গলা’ হবে।”

সমাপ্ত।

একটি উত্তর ত্যাগ

আপনার মন্তব্য লিখুন দয়া করে!
এখানে আপনার নাম লিখুন দয়া করে