আগুনের দিন ৮ ও ৯
‘ময়না একটু শুনে যা?’
‘কী বলবা? ওই দেখো সাব্বির দাঁড়ায় আছে। ব্যাটাপোলার সাথে কথা কইতেছি দাঁড়ায় দাঁড়ায়, এইটা দেখলে, মায়রে গিয়া নালিশ দেবে আর আমার বাড়ির বাইর হওয়া বন্ধ হয়ে যাবে। যাও তো?’
‘আচ্ছা, যা গিয়া। এইটা নিয়া যা!’
একটা কাগজের টুকরো ঢিলের মতো ছুঁড়ে মারে শফিক। সেটা ময়নার পায়ের কাছে পড়ে। ময়না পায়ের স্যান্ডেল ঠিক করছে এমনভাব করে সেটা হাতের মুঠোয় পুরে নেয়। জিজ্ঞাসা করে ‘কী এইটা?’
‘বুঝিস না যেন। ন্যাদা কুঁদি!’
ময়না আর কিছু বলে না। দাঁড়িয়ে দাঁড়িয়ে শফিকের সাথে কথা বলাটা ওকে ঝামেলায় ফেলতে পারে। সুমনের সাথে সম্পর্কের মিলনাত্মক পরিণতি পেতে ও অনেকটা পরিকল্পনা করে রেখেছে। ভালো মেয়ে হয়ে থাকতে হবে, সংসারের কাজ শিখে নিতে হবে আর সুমনকেও নিজের পায়ে দাঁড়াতে হবে। এভাবে ছেলেদের সাথে কথা বলা অবস্থায় কারো চোখে একেবারেই পড়া যাবে না। মাঠ থেকে শুকনো কাপড় তুলে, ঝেঁড়ে ঝেঁড়ে নিশার হাতে দিয়ে দুজনে মিলে বাড়িতে ঢুকে গেল। অনেকটা জায়গা জুড়ে নিশার দাদাবাড়ি। সীমানা ধরে সারি সারি নারিকেল গাছ, কাঁঠালবাগান, সুপারি বাগান, মেহগনি গাছের বাগান, সবরকম ফলগাছ – কাঠগাছের বাগান, মস্ত পুকুর। বাড়িতে ঢুকেই একপাশে ওর দাদার কবর। তারপর বড় একটা বাঁশঝাড় আর কাঁঠালবাগান। কাঁঠালবাগানের নিচে অনেকগুলো কাঠের লগ ফেলে রাখা হয়েছে নতুন ঘরের জানালা-দরজা বানানোর জন্য। এখন সেগুলোতে বসে আড্ডা দেওয়ার জন্য বেশ জায়গা। ময়না একটা লগের উপর বসে নিশাকেও বসতে ইশারা করল। ওড়নায় গিঁট দিয়ে বেঁধে রাখা কাঁচা তেঁতুলের টুকরোয় কামড় দিয়ে, শফিকের দেওয়া কাগজের টুকরোটা খুলে ভুঁরু কুঁচকে ফেলল। দুইটুকরো কাগজ। দুটোই পড়ল। তারপর টুকরো দুটো ভাঁজ করে বুকের ভেতর চালান করে দিলো। নিশার দিকে তাকিয়ে বলল ‘প্রেমপত্র বুজছ, প্রেমের চিঠি?’
নিশা উত্তর দিলো না। হাসল একটু। এইজন্যই সুমন এসেছিল।
‘আজকাল কেউ চিঠিফিঠি দিয়ে প্রেম করে না। টুং করে একখান মেসেজ লিখে দেয়। তুমি মোবাইল কিনো না ক্যান?’
‘মা দেয় না। আর আমার লাগেও না।’
‘তুমি ইন্টারনেট চালাও না?’
‘ল্যাপটপে চালাই। মাঝে মাঝে।’
‘ফেসবুক চালাও না? মেসেঞ্জার? ইমো?’
‘ফেসবুক একাউন্ট আছে কিন্তু লগইন করা হয় না তেমন।’
‘আল্লাহ কী কও। কোন দুনিয়ায় বসত করো তুমি? আমি তো ইউটিউবে সিনেমা না দেখলে ঘুমই আসি না।’
‘আচ্ছা ময়না, তুমি কত সুন্দর করে কথা বলতে পারো, কিন্তু সবসময় বল না কেন?’
‘ধুর ধুর! অতো শুদ্ধ ভাষায় নাটকের মতো কথা কইতে জুত হয় না। স্টাইল করে কথা কই মাঝে মাঝে, সবসময় কওয়া যায়? বিরানি তুমি একবেলা মজা পাইবা, পরের ওক্তে ঠিকই ভাত চাইয়া খাইবা। বুঝছ?’
‘হুম।’
‘আচ্ছা নিশা, শহরের ছেলেমেয়েরা তো অনেক চালু, মানে এডভান্স আরকী, তুমি প্রেম করো না?’
‘আরেহ না।’ লজ্জা পায় নিশা।
‘সত্য? কেউ প্রস্তাব দেয়নাই কোনোদিন?’
নিশা উত্তর করে না। ময়না আবার বলে ‘কেমন ছেলে তোমার পছন্দ? শিক্ষিত নাকি সুন্দর? বড়লোক? স্মার্ট?’
নিশা হেসে ফেলল। এভাবে চিন্তা করে কেউ ভালোবাসে? ভালোবাসা তো কবিতার মতো অনুভূতি। সেটা চেপে গিয়ে বলল ‘আমি এসব ভাবিনি, ময়না।’
‘ভাববা না ক্যান? ধরো, এইরকম একখান চিঠিফিঠি আইজ যদি কেউ তোমারে দেয়?’
‘যাহ।’
‘না। সত্য কইতাছি। কী করবা কও।’
‘এইসব কী কথা বলো?’
‘আরে কও না?’
‘সত্যি বলছি, আমি এইসব ভাবিনি কখনো।’
‘তাইলে ভাবো এটটু?’
‘মানে?’ নিশা বুঝতে পারে না ময়নার হেঁয়ালিপূর্ণ কথা।
‘মানে? মানে হচ্ছে, তোমার জন্য চিঠি আসছে।’
‘অসম্ভব!’ বিড়বিড় করে নিশা।’
‘হয় রে। সত্যি কইতেছি। শফিক ভাই তোমারে পছন্দ করে। তোমার সাথে রিলেশন করতে চায়।’
নিশা অবাক হয়ে তাকিয়ে থাকে ময়নার দিকে, কথা বলতে ভুলে যায়। ময়না একটা কাগজের টুকরো নিশার হাতে দেয়। নিশা ভয় পেয়ে আঁতকে ওঠে। গরম কয়লা হাতে পড়েছে এমনভাবে ছুঁড়ে ফেলে দেয় কাগজটা। তারপর ময়নাকে বলে ‘অসম্ভব ময়না। আমি এটা নেবো না!’
‘কেন?’
‘এইগুলো ঠিক না। ভালো না।’
‘আচ্ছা, ভালো না লাগলে রিলেশন করবা না। কেউ কি জোর খাটাইতেছে? একটু দেখো কী লিখছে? তুমি এত ভয় পাও কেন? কেউ জানবে না।’
‘না।’
‘আরেহ পড়তে তো দোষ নাই। আমি কবো তুমি চিঠি পড় নাই।’
নিশা ভয়ে ভয়ে চিঠিটা খুলল। খুলেই ওর মনটা তেতো হয়ে গেলো। সস্তা বাংলা গান আর ভুল বানানে লেখা চিরকুট।
“প্রাণের প্রিয়া,
জীবনে প্রথম যারে, লেগেছে ভাল
যে আমার এই বুকে, প্রাণের-ই আলো
সে আর কেউ নয়, শুধু যে তুমি
বলছি তোমায় গানে গানে
এ বুকে কান পেতে শোন
এ হৃদয় কি বলে হায়
বন্ধ হয়ে যাবে চিরতরে
তোমাকে যদি হারায়
এ চোখে চোখ রেখে দেখো
কি বলে চোখ ইশারায়
অন্ধ হয়ে যাবে চিরতরে
তোমাকে যদি হারায়।
ইতি
তোমারই শফিক”
হাতের ভেতর মুঠ করে ফেলে নিশা কাগজটা।
‘কী? কী করবা?’ ময়না নিশার উত্তর জানতে চায় কিন্তু ওর ভয়ার্ত মুখের দিকে তাকিয়ে নিজেকে সংবরণ করে নেয়। নিশার হাত ধরে বলে ‘বাদ দাও৷ বাড়িত চলো।’
ময়না খুবই বুদ্ধিমতি। ও জানে মায়ের অত্যন্ত কড়াশাসনে বড় হওয়া নিশার জন্য এসব বিষয় একটু সময়সাপেক্ষ। সময়টুকু দেয় ও নিশাকে। নিশার বা শফিকের ব্যাপারে এতটা আগ্রহ ও দেখাত না একেবারেই যদি না আরেকটুকরো কাগজে শফিক, ময়না আর সুমনের সম্পর্কে সাহায্য করবে এই প্রতিশ্রুতি দিতো। দুই পরিবারের সম্মতিতে সুমনের বউ হওয়া ছাড়া ওর আর কারো কোনো বিষয়েই আগ্রহ নেই।
****
‘তোমার আর কী, তোমার ময়নার যে গায়ের রঙ আর যে চেহারা তাতে রাজপুত্র আসবে মেয়ে সেধে নিতে। আর আমি পেটে ধরেছি দুটো কালির পুতুল। তায় নাকচোখেরও ঢঙ নেই। মেথরেও তো ঘুরে তাকাবে না।’
‘এইগুলা কী বলেন বড়ভাবি? নিশা আপনার যে লক্ষি মেয়ে!’
‘ছাড়ো! কীভাবে পার করব, এই চিন্তায় নিজের কোনো সখ-আহ্লাদ করলাম না কোনোদিন, শুধু টাকা জমাও, মেয়ে বিয়ের খরচ।’
‘আপনার নিশা, ঊষা তো পড়াশোনায়ও ভালো খুব।’
‘তাতে কী? পড়াশুনা গোণে কে? সেই বিয়ে তো দিতেই হবে, গাঁট গাঁট টাকা খরচ করে। এমন পোড়াকাঠের মতো দেখতে যে, আটদশলাখের কমে মেয়ে পার করতে পারব না।’
‘বাবাহ এত টাকা?’
‘এতো শুধু গয়না আর ফার্নিচার দেবো। বিয়ের খরচ তো আলাদা।’
‘ওরেহ বাবা।’ রেজিনার বড় বড় গালগল্প পোষায় না ছোটোবউয়ের। সে নিজের মেয়েকে তাড়া দেয় ‘ওই ময়না কাপড় তুলতে গিয়ে হাওয়া হয়ে গেছিস? তোর চাচি আসছে কখন, ঘর খুইলা দে, আমার হাতে তো গোবর লাগা।’
ছোটোবউ চুলার জ্বালানি বানাতে গোবর দিয়ে বোড়ে বানাচ্ছে। নিশা মায়ের কন্ঠ শুনে আনন্দে এখানে এসে দাঁড়িয়েছে অনেক্ক্ষণ আগে। রেজিনার কথা শুনে চুপ হয়ে গেছে। রেজিনার অভ্যাস আছে, নিজের টাকাপয়সার গল্প করার প্রয়োজনে মেয়েদের সম্পর্কে কটুক্তি করতে তার আটকায় না। আজকে নিশার খুব কষ্ট হলো। গায়ের রঙ আর চেহারা নিয়ে এমনিতেই হীনমন্যতায় ভোগে, তার উপর রেজিনার বাজে কথায় ওর অভিমান হলো।
আসলেই তো সত্যি কথা, ও কুৎসিত দেখতে তাই ওকে কেউ পছন্দ করে না। জীবনে বারবার, বহুবার, বহুজনের মুখে এই কথা শুনেছে ও। প্রতিবারই সংকুচিত হয়ে গেছে। ও বোঝে না, কালো হওয়াতে ওর দায় কী? ও যদি নিজে নিজেকে তৈরি করত তো পৃথিবীর সবচেয়ে সুন্দর মেয়ে করেই পৃথিবীতে আসত। যেখানে ওর হাত নেই সেখানে ওর দায় কেন?
এতদিন কষ্টগুলো বুকে পাথরচাপা দিয়ে রাখত, আজ জেদের মতো হলো। হাতের মুঠোয় দলামোচড়া করে রাখা কাগজটার প্রতি তীব্র আকর্ষণ তৈরি হলো। বিপরীত লিঙ্গের প্রতি স্বাভাবিক যে আকর্ষণ, মুখচোরা নিশা নিজের কাছেই গোপন করে রেখে এসেছে এতদিন আজ সেটা মেলে দিতে ইচ্ছে করল। দাদীর ভাঙা ঘরের ফাঁকফোঁকর দিয়ে গোধুলির যে আলো নেমে যাচ্ছে, তার মাঝে ভুল বানানের সস্তা সেই চিঠিখানা মেলে ধরল নিশা। আর বড় ভালো লাগল ওর। অজানা শিহরণে বুক কাঁপতে থাকল। কারো চোখে নিজেকে প্রেয়সী জানতে পেরে, সাদা কাগজে আঁকা কালো অক্ষরগুলো প্রিয় উঠতে লাগল।
আগুনের দিন ৯।
রেজিনা আসে নিশার কাছে। মাকে দেখে নিশার মন লাফিয়ে ওঠে। জড়িয়ে ধরতে ইচ্ছে করে মাকে। রেজিনারও ইচ্ছে করে মেয়েকে জড়িয়ে ধরে আদর করতে। কিন্তু এসব ন্যাকামিতে অভ্যাস নেই, অনভ্যস্ততায় কেউ কাউকে ভালোবাসার কথা বলতে পারে না। কন্যাকে স্নেহ দেওয়ার পরিবর্তে আরও খানিক তিক্ততা দিয়ে বসেন তিনি। কেউ যেন না শোনে এমনভাবে বলেন ‘পাড়ায় পাড়ায় ঘুরে, বাপের মানসম্মান সব রাস্তায় রেখে দাও নাই তো?’
নিশা চুপ করে থাকে।
‘যে চালু ওই ময়না। ওর সাথে মিলে কোনো সর্বনাশ করো নাই তো?’
‘আম্মু?’
‘উহ! আম্মু? যেই না চ্যালাকাঠের মতো চেহারা, ওই মুখ নিয়ে ঘরে বসে থাকতে হয়। এমন করে নাচতে নাচতে দাদির সাথে দৌঁড় দিতে হয় না!’
এসব কথা শোনায় অভ্যাস আছে নিশার। তবুও আজকে বারবার অভিমান হচ্ছে। চোখ ভিজে গেল আবারও।
*****
‘নিশা, ঘুমাইছ?’ ফিসফিস করে ময়না।
‘ও নিশা?’
দুবার ডাকার পরে নিশা আর চুপ করে থাকতে পারে না, সাড়া দেয়।
‘কী হইছে বলো?’
‘কী করবা কইলা না? আমারে চাইরবার ফোন দিছে শফিক ভাই।
নিশার বুক ঢিপঢিপ করছে। ময়না যে সম্বোধন পালটে ‘শফিইক্যা’ থেকে ‘শফিক ভাই’ করে ফেলেছে, তা আর খেয়াল করল না।
‘কী কবো, শফিক ভাইরে? কও তো?’
‘আমার ভয় লাগে ময়না।’
‘সে সবারই ভয় লাগে।’
‘আম্মু জানলে জানে মেরে ফেলবে।’
‘কেউ প্রেম করছে আর বাপ-মা মাইনা নিছে, এমন হইতে কোনোদিন দেখছ নাকি শুনছ? সেইটা না, শফিক ভাইরে পছন্দ কীনা সেইটা বলো?’
নিশা চুপ করে থাকে। আসলেই কি শফিককে ওর পছন্দ? এই প্রথম কেউ নিশাকে পছন্দ করেছে, প্রিয়া বলে চিঠি লিখেছে। নিশা উপেক্ষা করে কী করে? এত অবহেলা পেয়েছে যে মুখশ্রীর জন্য, সেই মুখটাকে কেউ ভালোবাসে জানলেও তো মরে যাওয়ার মতো সুখ লাগে।
নিশা কিছু বলল না তবুও। ভীরু মনের কথাটা মুখে আনতে পারল না।
ময়নাই বলল ‘তোমার ফোন নাম্বার চাইতেছে। দেবো?’
নিশা উত্তর না করলে ময়না কায়দা করল ‘দিলাম কিন্তু। না কওনাই কিন্তু। বইতে পড়ছ না, মৌনতা সম্মতির লক্ষণ?’
‘আমার কোনো ফোন নাই, ময়না। এই কথাটা তুমিও জানো।’
‘চাচিরটাই দিলাম!’
‘তুমি কি পাগল হয়ে গেছো?’
‘ধুরো! তুমি তো প্রাচিনকাল থেকে টাইমমেশিনে কইরা এই সময়ে আইসা পড়ছো! মোবাইল নাই! কেউ বিশ্বাস যাইবো। শফিক ভাই ভাবতেছে, আমি না জানি মিছা কথা কই!’
গরমের ভেতরও নিশা কাঁথা টেনে মুখে চাপা দিলো। ময়না হেসে কন্ঠ আরও নামিয়ে বলল ‘শফিক ভাইর নাকি রাতের ঘুমটুম সব শেষ! শুধু তোমারেই নাকি চোখের সামনে দেখতেছে। পোলার মাথাডা তো পুরাই খাইয়া ফেলছ, নিশা!’
নিশার বুকের ভেতর কেমন একটা সুখের মতো জ্বালা করে, চিনচিন করে শব্দ হয়।
‘নিশা? এইটা নেও?’
আবার এক টুকরো কাগজ নিশার হাতে গুঁজে দেয় ময়না। ও কেঁপে ওঠে। বুক কাঁপতে থাকে। পা ভারী হয়ে আসে। রেজিনা আছে এখন এখানে। কোনোভাবে টের পেয়ে গেলে নিশার কপালে সর্বনাশ আছে। ওর খুব পানির পিপাসা পেল। শুকনো ঢোক গিলে বলল ‘এক গ্লাস পানি দিতে পারবে, ময়না?’
‘উঁহু। এত রাতে দরজা খুলে পানি আনতে পারব না।’
‘ভয়ে গলা শুকিয়ে গেছে আমার।’
‘এত ভয় পাও তুমি, বড়চাচিরে?’
‘ভয়?’ অসহায় তাকায় নিশা। একটু হাসার চেষ্টা করে। ও চেনে নিজের মাকে। মেয়েরা বড় হয়েছে, তাদের আলাদা ব্যাক্তিত্ব আছে, আলাদা সত্ত্বা আছে, আত্মসম্মানবোধ আছে এসব থিওরি রেজিনার সিলেবাসের বাইরের চ্যাপ্টার। বাচ্চাদের ভুল কথা বা ভুল পায়ে জুতো পরা নিয়ে সবাই যেমিন সবার সামনেই মজা করে, তেমনি নিশা বা উষাকে নিয়েও রেজিনা সবার সামনে মজা করে। লজ্জায় এতটুকুন হয়ে মাটির সাথে মিশে যায় ওরা কিন্তু রেজিনার একটুও অনুতাপ হয় না। মা তো, মায়েরা কিছু বললে কি তাতে অপমান হয়?
নিশা কাগজের ভাঁজ খুলল। কালচে খয়েরিটাইপ রঙের কালিতে লেখা চিঠি একটা। সেই আগের মতোই ভুল বানানা, সস্তা সিনেমার ডায়লগ।
‘ও আমার প্রিয়া।
আমার আঁধার রাতের আলো, আমার শূন্য আকাশের চাঁদ। মরুভূমির বুকে এক পশলা বৃষ্টি হয়ে এসেছ তুমি আমার জীবনে। তোমাকে ভেবেভেবেই সারাদিন আর রাত গুলিয়ে একাকার হয়ে যাচ্ছে আমার।
তুমি কেন আমার চিঠির উত্তর দিচ্ছ না? আমাকে কি তোমার পছন্দ না? তুমি পাশে থাকলে আমি অনেক বড় কেউ হবো, দেখে নিও। সব পারব আমি, পরীক্ষা করে দেখো, সব পারব। এই যে রক্ত দিয়ে লিখে দিলাম প্রেমের কথা। আর আমার হাত আর হৃদয় রক্তাক্ত করে লিখেছি তোমার নাম। হাতেও, হৃদয়েও …’
ইতি
তোমার প্রেম
রক্ত দিয়ে লেখা চিঠি? অরুচিকর একটা ব্যাপার। নিশার মন খারাপ হয়ে গেল। ছুঁড়ে ফেলে দিতে চাইল কাগজটুকু। কিন্তু কী মনে করে ফেলল না। উদ্যত হাত নামিয়ে নিয়ে চিরকুটটা ময়নার দেখানো পদ্ধতিতে অন্তর্বাসের ভেতর ঢুকিয়ে রাখল।
একটু বাদেই ময়না আবার কাছাকাছি সরে এলো। ‘ও নিশা, কিছু যে কইলা না!’
‘ময়না, আমি কিন্তু তোমাকে মানা করছি, এইসব চিঠিটিটি আমাকে আর দিও না। আমার ভালো লাগছে না।’
ময়নার মুখ কালো হয়ে গেল। শফিক প্রমিজ করেছে, চেয়ারম্যানের ছেলেকে ধরে সুমনকে সরকারি দলের স্থানীয় কমিটির একটা বড়পদ দেওয়ায় দেবে। সেটা হলে তো সুমনের জন্য ময়নাকে চাইতে আসার পথ অনেক বেশি সুগম হয়ে যাবে। একটু আগে অন্ধকারের ভেতর সুমন আর শফিক এসেছিল এই চিঠিটা দিতে। ময়না একা একা আগানবাগান পেরিয়ে গিয়েছিল। শফিক বলেছিল ‘খালি লাইনডা করায়ে দে ময়না। তোর আর সুমনের লাইন একদম ক্লিয়ার করে দেবো।’
‘পারবা?’
‘পারব না ক্যান? শফিকের ক্ষমতা তুই জানিস না কিছুই।’
‘তা নিজের জন্য করো না কেন?’
‘এইসব আমার জন্য না ময়না। এইসব ছোটোমোটো কাজ আমার জন্য না। আমি বিরাট কাজ করব। সবাই একনামে চিনবি!’
‘হুহ! তা বিরাট কিছু হওয়ার পরেই আইতি নিশার সাথে লাইন করতে! ভাদাইম্মা কোনখানকার!’ মনে মনে গালাগাল করেছিল ময়না শফিককে।
ময়না আবার ডাকল নিশাকে ‘কেন পছন্দ না শফিক ভাইরে?’
‘এইসব কথা বাদ দাও, ময়না।’
‘দেখতে কী সুন্দর কও তো! জমিজাতির অভাব নাই কিন্তু। পড়াশোনাও করছে। বিএ পাশ দেছে। চাকরি করতে চাইলেই পারবে। কিন্তু বড়ছেলে তো। বাড়ি ছাড়লে কেমনে হবে? তা তুমি কইলে সবই করবে।’
‘আমি কেন বলব?’
‘তুমিই তো বলবা এখন। তোমার কথাও শুধু শুনবে। যা বলবা তাই করবে। তুমি বলবা চাকরি করতে।’
‘আমি বলব না ময়না’ রেগে যায় নিশা।
তবুও ময়না বলে ‘ইশ, ব্লেড দিয়ে হাত কাটছে নিশা। তোমার নাম লেখছে। কী পাগল যে হইছে তোমার জন্য!’
‘সত্যিই হাত কেটেছে? ছিঃ!’
‘ছিঃ কও কেন? ভালোবাসে তোমারে। সব ভালো শফিক ভাইয়ের। শুধু বিড়িখোর। তয় বলছে, একবার তুমি হ্যাঁ বললে আর সিগারেট ছুঁয়ে দেখবে না।’
‘ঘুমাও ময়না। মা শুনতে পাবে।’
‘তুমি একটু ভাবো নিশা। আমরা কাছাকাছি থাকব, বিয়ের পরে। তোমার একাএকা লাগবে না।’
‘তুমি বিয়ে পর্যন্ত চলে গিয়েছ?’
‘ভাবতে কি টাকা লাগে নাকি? হিহিহি’ খিলখিল করে ওঠে ময়না। ‘বিয়ের কথা তো আমি সবসময়ই ভাবি। তুমি ভাবো না?’
‘বিয়ে ছাড়াও ভাববার মতো অনেককিছু আছে ময়না। ঊষা কী বলে জানো? মানুষের মেরুদণ্ডের শক্তি হাত হয়ে আসে। আমরা কাজ করি, পরিশ্রম করি, আমাদের আয় টাকা হয়ে আমাদের হাতে আসে। সেই টাকা আমাদের ইচ্ছে, স্বপ্ন, বাস্তব, বর্তমান আর ভবিষ্যৎ শক্তিশালী করে দেয়।’
‘অনেক কঠিন কথা। জীবন এত কঠিন না। সহজ করে ভাবলেই সব সহজ।’
‘হয়তো’ ময়নার কথাটা মনে ধরে নিশার।
*****
‘ছাদও দিয়া দিছে?’ নতুন বাড়ির সামনে দাঁড়িয়ে উষ্মা প্রকাশ করছিল রেজিনা৷ ‘আর আমি শুধু মেয়ের বিয়ের টাকা জোগাও, মেয়েবিয়ের টাকা জোগাও। এই করতে করতে কিছুই হলো না। দুইটা মেয়ে দিছে আল্লাহ, চেহারা একেবারে বাপের গুষ্ঠির মতো। কিন্তু সেই গুষ্ঠির কেউ তো ভার নেবে না। আমার আর আমার বাপভাইরই মরতে হবে মেয়ে পার করার খরচ জোগাইতে গিয়ে।’
‘এমন করে কও ক্যান বউ। মাইয়া বড় হইছে না? মনে দুখ লাগবে। কালোই ভালো। কী সুন্দর মুখ আমার নিশার!’
‘হ্যাঁ। সুন্দর মুখ আগে মনে ছিলো না? কালো ছেলের বিয়ে দেওয়ার সময় ফর্সা মেয়ে খুঁজলেন কেন তখন?’
‘এইসব পুরান কথা বাদ দেও, বউ?’
‘হ্যাঁ। পুরান কথা। কী বলেছিলেন মনে আছে? বীজ যেমন তেমন বাচ্চা হবে। এখন ফর্সা বীজে এমন কালো বাচ্চা কীভাবে হলো? এই দুই মেয়ের চিন্তায় আমার আর ছাদ দেওয়া হলো না!’
‘এরাও অনেক কষ্ট করে বউ। খেয়ে না খেয়ে বিল্ডিং বানছে।’
‘এমন করে বলেন যেন আমি রাণির মতো সিংহাসনে বসে থাকি?’
‘কেন তোমার হাইস্কুলে পড়া পোলারেই তো হোন্ডা কিনে দিছো! এইটার দরকার ছিলো কোনো?’
‘ওইটাই যে চোখে লাগবে তা জানতাম ঠিক। ওর মামাবাড়ি থেকে দিয়েছে, আপনার ছেলের কোনো টাকা খরচ হয়নি। ছেলে সখ করছে, তাদের মামারা মিটাইছে, আপনাদের চোখ পোড়ায় কেন?’
‘না বউ, সেই কথা বলিনি। সখের কথা তুমি না বললে তারা তো জানত না। এইসব সব সখই এরা চাপা দিয়ে ঘরটা তুলছে। ইদেচান্দে কাপড়ও নেয় না কোনো বউ।’
‘এইগুলা সত্যি না। ময়না যে একেকটা ড্রেস পরে, আমার দুইমেয়েরে কখনো হাত খুলে দেইনাই ওইরকম। আপনার ছেলের সংসারে যত কষ্ট করি সেটা আপনি কখনো স্বীকার করেন না’ বলতে বলতেই রেজিনার চোখ গেল নিশার দিকে। ময়নার সাথে পুকুরে গোসল করার জন্য নেমেছে। ঘাটলা বাঁধানো। অনেকগুলো সিঁড়ি নেমে গেছে। বর্ষাকালে সবগুলো ধাপই পানিতে ডুবে থাকে, এখন একেবারে শেষের ধাপটা শুধু পানির নিচে। সেটার উপরে বসে কোমর ভিজিয়ে পানি ছিটিয়ে জলকেলি করছে নিশা, ময়না, আরজিনা, সীমা। রেজিনার মেজার গরম ছিলো, এবারে সবটা ঢাললেন নিশার উপর।
‘নিশা? তুই পুকুরে নামছিস? জংলী কোথাকার?’
‘আম্মু প্রতিদিন তো পুকুরেই গোসল করেছি’ হঠাৎ করে বুঝে পায় না নিশা সমস্যাটা কোথায়?
‘উঠে আয়। অসভ্য মেয়ে। পচা পানিতে গোসল করছিস আবার বলে প্রতিদিন করেছি।’
এতদিন একসাথে থাকা বান্ধবীদের সামনে এমন অপমানিত হয়ে নিশার পা আর নড়ছিল না। ও চুপ করে থাকল।
‘এখনো আসলি না? উঠে আয়?’
‘আম্মু আরেকটু প্লিজ! গোসল প্রায় শেষ।’
‘ছিঃ একদম গাঁইয়া হয়ে গিয়েছিস। এত পড়াশুনা করিয়ে কী লাভ হলো? একটা ভ্যানওয়ালা ডেকে বিয়ে দিয়ে দিই!’
‘আম্মু?’
‘আয় কিন্তু। নইলে খুব খারাপ হবে।’
‘উইঠা আসো বু। মা রাগ হইছে, উইঠা আসো। তুমি কলে গিয়া গুসল করো?’ নিশার দাদী এগিয়ে আসে তাড়াতাড়ি করে।
নিশা উঠে কলে গিয়ে রাগেরাগে পানি চাপে আর মাথায় ঢালতে থাকে ঝুপঝুপ করে। রাগের কারণে অন্তর্বাসের ভেতর লুকিয়ে রাখা চিরকুটটার কথা ভুলে, শরীরে টাওয়েল পেঁচিয়ে ভেজা কাপড় খুলতেই পড়বি তো পড় একেবারে মালির ঘাড়ে, ঝুপ করে আধাভেজা কাগজখানি রেজিনার পায়ের কাছেই পড়ল…
চলবে…
আফসানা আশা