আগুনের দিন পর্ব-৬+৭

0
444

আগুনের দিন ৬ ও ৭।

১০.
নিশা টক খাবার তেমন একটা পছন্দ করে না। ও বসে বসে ময়নার কাজ দেখতে থাকল। ময়না বাঁহাতে ধরে কট করে এক একটা কামড় বসাচ্ছে কাঁচা তেঁতুলে আর চোখমুখ কুঁচকে শরীর ঝাড়া দিচ্ছে – নিশার জিভেও জল চলে আসছে। বঁটি দিয়ে বিঁচিটুকু আঁচরে ফেলে পাটায় মিহি করে বাঁটল ময়না, তারপরে লবণ আর কাঁচামরিচ বেঁটে নিলো, ধনেপাতাও বাঁটল, কাঁচাতেঁতুলের সবুজ রঙ আরও গাঢ় হলো। একটু সর্ষের তেল আর সামান্য চিনি ছিটিয়ে ফিনিশিং দিলো। কলাপাতা কেটে এনে আগে থেকেই ছিঁড়ে ভাগ করে রাখা আছে। নিশা ধরতে থাকল আর ময়না এক এক ভাগে তেঁতুলভর্তা রাখতে থাকল।

‘শোনো নিশা, তুমি এইখান দিয়া নড়বা না। কাউরে হাতও দিতে দিবা না। আমি এক দৌঁড়ে কান্তা, বাশার ভাই আর সীমারে দিআসতাছি।’

‘কেউ খেতে চাইলে আমি কী বলব?’

‘দিবা না!’

‘আমি কাউকে আটকাতে পারব না।’

‘আচ্ছা আমি সরায় রাইখা যাইতাছি। তুমি আমার কথা বলবা। বলবা ময়না মানা করছে। আমি একমিনিটে যাব আর আসব। কান্তারে বাড়িত্তে বাইরাইতে দেয় না। চুরি কইরাই তো গেল রাইতে। আর বাশার ভাই যে আয়োজন করে যাত্রা দেখায়া নিয়া আইলো, হেরে এটটু না দিলে হয়?’

বলতে বলতেই দুই হাতে ভাঁজ করা কলাপাতার মোচা নিয়ে দৌঁড় দিলো ময়না। করিৎকর্মা মেয়ে, ভাবল নিশা। গতকাল যাত্রা দেখতে যাওয়ার উদ্দেশ্য শুধুমাত্র যাত্রা দেখা ছিলো না এটা এখন পরিস্কার ওর কাছে। সেখানে সুমনকেও দেখেছিল ও, কিন্তু তখন বোঝেনি কিছু। এসবকিছু বাশার বা কান্তারাও সবাই জানে।

দীর্ঘশ্বাস ফেলল নিশা। ওরা দুইবোনই শুধু হাজাররকম শাসনের বেড়াজালে আটকে থাকে। এই করা যাবে না, সেই করা যাবে না, কলেজ ছুটির পরে কোথাও যাওয়া যাবে না, রাতে কোথাও যাওয়া? বাপরে বাপ! এমনকি বান্ধবিরা কেউ ফোন করলেও রেজিনার হাজারটা প্রশ্নের উত্তর হয়ে আসতে হয়! ময়নাকে খুব হিংসা হতে থাকে নিশার। অত চটপটে মেয়ে আর কী সুন্দর দেখতে! নিশা কালো, অনেক কালো। রেজিনার গায়ের রঙ পায়নি দুবোনের কেউই। দুজনেই মইন সাহেবের মতো হয়েছে। রেজিনার খেদ যায় না তাই। কটু কথা শোনাতেই থাকেন নিশা আর ঊষাকে। ঊষা অতটা পাত্তা দেয় না কিন্তু রেজিনা যখন ‘ওই কালি? ওই মা কালি?’ বলে ডেকে ওঠে নিশার বড় বড় দুই চোখ ছলছল করে ওঠে। ঊষা অনেক বুঝদার। ও সুন্দর করে বোঝায় নিশাকে ‘বুবু, কাটতে ধারও লাগে ভারও লাগে। আমাদের ধার নেই, আমরা ভারে কাটব।’

ঊষা কোমর বেঁধে নিজের ভার বাড়াতে পড়াশোনা করে আর নিশাও তাই। বইখাতা, স্কুল আর কলেজ ছাড়া যে জগতটা তার সাথে নিশা-ঊষার পরিচয় হয়নি। আজকে বয়সে অনেক ছোটো ময়নাকে একটা অন্য পৃথিবীতে চলতে দেখে তাই নিশার লোভ হয়, ময়নাকে ঈর্ষা হতে থাকে।

সত্যি সত্যি এক দেড় মিনিটের মাথায় চলে এলো ময়না। অনেক চঞ্চল হলেও কাজেকর্মে নিপুণা ও। পরিবেশন করাটাও ভালো গৃহিনীর মতো বোঝে। বাড়ির সবাইকে সামান্য তেঁতুল দিয়ে খুশি করে দেওয়ার উপায়ও জানে। তারপর নিশাকে নিয়ে বা
বাধানো পুকুরঘাটে গিয়ে বসল। কলাপাতার কোণের নিচের সরু ফাঁকা দিয়ে রসটুকু চোঁচোঁ করে টানতে নিশাকেও শিখিয়ে দিলো। দুজনে ঘাটে পা দোলাতে দোলাতে টক, ঝাল, মিষ্টি স্বাদের রসটুকু টেনে চোখ বন্ধ করে হেসে ফেলল। সবাইকে দ্রুত আপন করে নিতে পারে ময়না।

ময়নার বাবা বিল্ডিং এর কাজ শেষ করে ফেলেছে প্রায়। আশিভাগ কাজ হয়ে গেছে। ছাদ ঢালাই হয়েছে। জানালা, দরজা লেগেছে। বাইরের প্লাস্টার বসেছে। ভেতরের প্লাস্টার হয়ে রঙের কাজ হলেই নতুন ঘরে ওঠা যাবে। দুইবোনে গোসল সেরে সেই ঘরের সামনের সিঁড়িতে বসে বসে গল্প করতে করতে বাড়ির সামনে হৈহল্লা করে ভ্যান থামতে দেখল। নিশা উঁকি মেরে দেখল, বিরাট ডেগ লাল সালু কাপড়ে মোড়ানো। চার পাঁচটা ভ্যান। নিশার মেজচাচার ছেলে শান্ত দৌঁড়ে ঘরে ঘরে গিয়ে বড় বোল নিয়ে আসছে। সেই বোল ভ্যানের কাছে নিলে একজন পাতিল থেকে খাবার বেড়ে বোল ভরে দিচ্ছে। সেগুলো নিয়ে শান্ত আবার ঘরে ঘরে পৌঁছে দিচ্ছে। আজকে দুপুরে বাড়ির মেয়েদের খাবার চেয়ারম্যানের বাড়ি থেকে এসেছে। গরুর মাংস দিয়ে মোটা চাল-ডালের খিচুড়ি। নিশা এরকম ঘটনা আগে কখনো দেখেনি, খুব মনোযোগ দিয়ে দেখছে। এই গ্রামে বিভিন্ন উৎসব আয়োজন, মিলাদ মাহফিলে এরকম আয়োজন প্রচলিত আছে। গ্রামবাসি সবাই চাঁদা দিয়ে প্রায়ই একবেলার খাবার একসাথে খায়; টাকা দিতে না পারলে ঘরের চাল, ডাল দিয়ে হলেও শামিল হয়। এবারের আয়োজন পুরোটাই চেয়ারম্যানের খরচে।

শুকনো সুপারিপাতা আর কলাপাতা ঝুলিয়ে দিয়ে বাড়ির সীমানায় মেয়েবউদের পর্দার ব্যবস্থা করা আছে। রাস্তা থেকে সহজে নজর পড়ে না বাড়ির ভেতরটা। ভেতর থেকে নজর করলে আবার রাস্তাটা পরিস্কার দেখা যায়। সেই পাতার গেট ঠেলে শফিককে ভেতরে ঢুকতে দেখল নিশা। লুঙ্গিটা কোচা দিয়ে হাঁটুর উপরে ওঠানো। গায়ে একটা স্যান্ডো গেঞ্জি। মেদহীন শরীরের টানটান পেশিগুলো একেবারে উন্মুক্ত হয়ে আছে। ফর্সা ত্বকে ফোঁটা ফোঁটা ঘাম চিকচিক করছে শিশিরবিন্দুর মতো। একঢাল মসৃণ কালোচুলের ডালা মাথায় নিয়ে শফিক দাদিকে ডাকতে থাকে ‘ও দাদি? কই গেলা? পানি খাব। একটু পানি খাওয়াও।’

দাদি উঠানেই ছিলো। মুরগির জন্য ভুষি মাখছে সকালের ভাতের ফ্যান দিয়ে। গলা উঁচিয়ে বলল ‘আমার হাতজোড়া ভাই। দাঁড়াও ময়নারে কইতেছি।’ দাদি গলার স্বর আরও উঁচু বলল ‘ওই ময়না? শফিকরে এক গ্লাস পানি খাওয়া। খালি পানি আনিস না যেন আবার? দুইটা বিস্কুট দিস সাথে।’

গলা নামিয়ে শফিককে জিজ্ঞাসা করলেন ‘কীরে, কী বুঝতেছিস? জিতব ইউনুস্যা এইবার?’

‘কী যে কও দাদি? যে খরচ যাইতেছে? পানির মতো খরচ করতেছে। যেই লোকটা বাড়ির পরে যাইতেছে, ধামাভইরা ধান দিয়ে দিতেছে। খাওন লওনের তো কম নাইই নাই। আর কেডায় জিতব? কলিম বখশি? হুহ, চা পানি ছাড়া হের খরচ কই?এইযে সাতদিনে সাতটা গরু নামাইলাম। তাও বাছা বাছা ষাঁড়গরু। কোনো ফাঁকি নাই।’

‘কয় মণ গোস্ত হইছেরে আজকে, শফিক?’

‘চার মণ দাদি। ছোটো ছিলো গরুটা। কিন্তু মাংস নামছে জবর। চর্বি নাই।’

‘রানতেছে কেডা? শুক্কুরের পোলা?’

‘হয়। বিল্লাল কাকায়ই রানছে। হের মতো আছে নাকি কেউ আর? ঘ্রাণ যা ছুটছে, সাতগ্রামে চাউর হইছে, বেতলাতে আজকে ডেগ চড়ছে।’

‘হ। ভালো বাসনাই তো পাইতেছি। ও শফিক তোর মায় কেমন আছে? বেগুন ক্ষেত নাকি পোকায় ধরছে?’

দাদির গল্প বলার মুড দেখে শফিক রাস্তার দিকে হাঁক দিলো ‘ওই শাহিন্যা, তোরা আগাইতে থাক, আমি আসতেছি।’ বলে পায়ে ভর দিয়ে বসল নিশার দাদির পাশে।

‘আর কইয়ো না দাদি? ওষুধ ছিটাইতে দুইদিন দেরি হইছে, একটা বেগুনও পাইলাম না পোকায় কাটতে বাকি রাখছে। পুরা লস গেল এইবার।’

‘কয়খান জমিতে বেগুন লাগাইছিলি?’

‘পুরা আটখান দাদি?’

‘আয় হায় কস কী? বড় ক্ষতি হইলো তো?’

‘হয়। লাখের উপরে গেল। আব্বা তো ক্ষেইপে থাকে সারাদিন। এখন ক্ষেপলে আমরার কী করার আছে?’

‘তুই চাকরিবাকরি কিছু করবি না?’

‘পরের মাহেনদারি করব আমি? কী কও না কও দাদি?’

‘তাইলে চলবি কেমনে? তর বাপের ওই জমিগুলাই তো আছে?’

‘ওইয়া খাইয়া শেষ করতে পারব?’

‘ক্যান বইন বিয়া দিবি না? তাতে খরচ আছে না? কতখান জমি বেঁচতে হয় তখন দেখিস? আর তুই বিয়া বইবিনা? টুকটুইক্যা বউ আনবি না। হেরে রাঙা শাড়ি পিন্দাবি না? টাকা লাগব না?’

‘ধুরো দাদি, জ্ঞান দিও না। বইলাম পানি খাওয়াবা বইলা, তুমিও সেই ফাওপ্যাঁচাল নিয়া বইলা? যাইগা।’

এদিক ওদিক তাকিয়ে হাঁক দিলো শফিক ‘ওই ময়না, পানি কি খাওয়াইবি? পুকুর কাইটা পানি আনতেছিস নাকি?’

ময়না একটা কাচের গ্লাসে পানি আর একটা পিরিচে চার পিস বিস্কিট এনে শফিকের সামনে মুখ ভেংচি দেয়। শফিক বিস্কিটের পিরিচটা হাতে নিয়ে একপিস মুখে নিয়ে হাঁটতে হাঁটতে ময়নাদের ঘরের সামনে এসে দাঁড়িয়ে বলল ‘দাদি, মারুফ কাকার বাড়ির কাজ তো শেষ। যা কাজ আছে দুই চার সপ্তাহেই তো শেষ হয়ে যাবে।’

‘হয়, নবীন মিস্ত্রী একটু তাড়া দিয়ে কাজ করলে তো এতোদিনেই হয়ে যাইত।’ দাদির কন্ঠে উষ্মা!

শফিক একটু দিয়ে ঘরের ভিতর তাকিয়ে বলে ‘ভালো ডিজাইন দেছে তো কাকা? রান্নাঘর, বাথরুম সব বাড়ির ভেতর দিয়েছে?’

‘হয় হয়, চারখান শোয়ার ঘর, বসার ঘর, খাওয়ার ঘর, দুইখান বাথরুম, রান্নাঘর সব আছে। আর কিছু? তাড়াতাড়ি গেলাসটা নিয়া আমারে উদ্ধার করো তো?’ ময়নার মেজাজ খারাপ হলো।

‘তুই বড় অস্থির ময়না। দেখ, নিশার কাছ থেকে শেখ। শহরের মেয়েরা কেমন চুপচাপ থাকে? মেয়েমানুষ এইরকম শান্ত থাকলে কত ভালো লাগে। একদম নদীর মতো শান্ত কিন্তু বুকের ভেতর সমুদ্রের মতো তুফান তোলে।’

পরের কথাগুলো আস্তে করে বলল শফিক, বসে থাকা নিশার দিকে একটু ঝুঁকে এসে।

তারপর নিশার কানের কাছে ফিসফিস করে বলল “কৃষ্ণকলি আমি তারেই বলি, কালো তারে বলে গাঁয়ের লোক।
কালো? তা সে যতই কালো হোক, দেখেছি তার কালো হরিণ‐
চোখ।”

নিশার সারা শরীর ঝিমঝিম করে উঠল!

আগুনের দিন ৭।

১১.
কালো আর অসুন্দর শুনতে শুনতে বাইশ বছর কেটে গেছে নিশার। কখনো কেউ মুগ্ধ চোখে তাকায়নি, ভালোবেসে চায়নি। আজকে শফিকের চোখে ভালো লাগা দেখে নিশা একেবারে অস্থির হয়ে গেল। এমন পরিস্থিতি কখনো আসেনি ওর জীবনে। শঙ্কা আর আনন্দ একসাথে ছুঁয়ে যাওয়া অনুভূতি ওকে পাগল করে দিতে থাকল। কিন্তু এ যে কাউকে বলার না। সামান্য একটা কবিতা শুনিয়েছে ওকে শফিক। তাতেই এতকিছু ভেবে নিলো ও? কিন্তু এই সামান্যটুকুই যে নিশার কাছে কতখানি অসামান্য তা কাউকে বলে বোঝানোর মতো না। ও কাউকে বোঝানোর সেই চেষ্টাটাও করল না। নিজেও ভুলে থাকতে চাইল। কিন্তু বারেবারে অভদ্র, অসভ্য আর ইতর শফিকের আবৃত্তি করা কবিতাটার প্রতিটি অক্ষর ওর কানে ভেসে ভেসে আসতে লাগল, শফিকের উদোম পায়ের দৃপ্ত চলার ভঙ্গি ওকে মোহাবিষ্ট করে দিতে থাকল। প্রেমে পড়ল নিশা। কিন্তু সেই প্রেম নিজের মনে নিজেই স্বীকার করবে এমন সাহসই ওর নেই।

চৈত্র মাসের রাতের আকাশ মেঘে ছেয়ে আছে। নতুন ঘরে উঠবে বলে এই আশ্রয়গুলো যে বসবাসের অযোগ্য হয়ে গেছে সেদিকে কারো নজর নেই। টিনের বেড়া খুলে গেছে অনেক জায়গায়, জঙ ধরে ভেঙে গেছে। ভাঙা টিনের বেড়ার ছোটো ছোটো ফাঁক দিয়ে আকাশের কিয়দংশ দেখা যাচ্ছে। মেঘে ঢাকা ঘুটঘুটে আকাশ। সেদিকে তাকিয়ে নিশার মনে পড়ল, অমাবস্যা বলে ডাকে ওকে অনেকেই। কেউ বলত নিগ্রো। কেউ কালি বলে ডাকত। প্রথম প্রথম খারাপ লাগত। কান্না পেতো। পরে ধাতে সয়ে গেছে। আজ অনেকদিন পরে শরীর নিংড়ে কান্না পেলো ওর। ফুলে ফুলে কাঁদতে থাকল। ময়না ফোনে কথা বলছিল সেইরকম নিঃশব্দেই। নিশা কাঁদছে টের পেয়ে বলল ‘ও নিশা? কানতাছো? কাকির কথা মনে হইছে? কথা কইবা? রিং দিয়া দেবো?’

ময়নার ফোন দিয়েই রেজিনাকে প্রতিদিনের খুঁটিনাটি তথ্য দিতে হয় নিশার। ও মাথাটা উঁচুনিচু করে সায় দিলো। মাঝরাতে ময়নার ফোন পেয়ে রেজিনা বিস্মিত হলেন, ভয় পেয়ে গেলেন।

‘ময়না?’

‘হয় কাকি। আসসালামু আলাইকুম।’

‘ওয়ালাইকুম আসসালাম। কী হইছে ময়না? কোনো সমস্যা? নিশা কই?’

‘নিশা কানতাছে কাকি। নেন কথা কন।’

নিশা ফোনটা নিয়ে ফুঁপিয়ে ওঠে ‘আম্মু ভালো লাগে না। আমি বাড়ি যাব।’

‘যাওয়ার জন্য তো ম্যালা লাফালাফি করছিস, এখন ভালো লাগে না কেন? মা তো খারাপ, দজ্জাল, অত্যাচার করে শুধু ; এখন কান্না পায় কেন? মা ছাড়া কোথাও গেলে কদর পাওয়া যায় না, সেইটা বুঝছিস?’

‘আম্মু?’ নিশার ফোঁপানি কমে না।

‘কী করব আমি? কে নিয়ে আসবে তোরে? আছে কেউ? সেই তোর বাপের গিয়ে নিয়ে আসতে হবে। স্কুল ছেড়ে সে যাবে কীভাবে? ছুটি ম্যানেজ করতে হবে না? কান্দিস না, ঘুমা?’

ফোনটা রেখে আবারও অন্ধকারে চোখ পেতে ঘুমিয়ে যায় নিশা। অন্ধকার রাতের মতো কালো বলে ওর নাম দিয়েছিল নিশা। রাতের আরেক নাম নিশি।

১২.
চৈত্রের দুপুরগুলো অসহ্য হয়ে থাকে। কটকটে রোদের সাথে গরমের তীব্রতাও এতো বেশি যে মানুষের সাথেসাথে প্রকৃতিও হাঁপাচ্ছে। ময়নাদের বাড়ির সামনে বিশাল মাঠ। আগে ইটভাটা ছিলো এখানে। এখন পরিত্যক্ত। ইটভাটার জন্য মাটি এনে স্তুপ করে রাখা হতো, উঁচু হতে হতে ছোটোখাটো একটা পাহাড়ে রূপ নিয়েছে সেটা। সেই পাহাড়ের পাশেই ইটভাটার প্রয়োজনে পানি সরবরাহের জন্য কাটা পুকুর। পেছনে বেঁতফলের বাগান। বেঁতের ঝোপ নিচু হয়ে মিশে গেছে জংলামতো জায়গায়। জংলার পানি ঘন সবুজ দেখা যায়। জংলা পার হয়েই বাঁশবাগান। ছোটো বাঁশের সাঁকো দেখা যায় একটা। নিশার মনে হয় বেড়ানোর জন্য জায়গাটা খুব সুন্দর। মাঠ পেরিয়ে হালকা বাতাস ছুঁয়ে যাচ্ছে ওদের। ময়না, কান্তা, সীমা সবাই আছে এখানে। ময়না এক এক খন্ড করে কাঁচা তেঁতুল ধরিয়ে দিয়েছে সবার হাতে। সেই তেঁতুলে কামড় বসাতে বসাতে গল্প করছে সবাই। গল্পের বিষয়বস্তু একই। প্রেম আর বয়ফ্রেন্ড। সবারই ঝুলি ভরা প্রেমের গল্প; হাত ধরা আর চুমুর ফ্যান্টাসি। সেইসব গল্প কখনো কখনো আরও ভয়াবহ মোড় নিতে থাকে৷

দুপুরের রোদ নিভে গিয়ে বিকেলের নরম ছায়া পড়তে শুরু করলেই সীমা বলে ওঠে, ‘চলো মালোপাড়ায় যাই।’

‘ক্যান?’

‘যাত্রার নায়িকার নাম সুন্দরী। সে আজকে সন্ধ্যায় জনিগো বাড়িতে গান শুনাইবে।’

‘সন্ধ্যার সময় মা বাড়িত্তে বাইর হইতে দেবে?’ ময়না নাকচ করে দেয় কান্তার প্রস্তাব।

‘এইজন্যই তো এখন যাব। নায়িকারে দেইখাই চলে আসব।’

‘তোর ভাই যাইবে?’ কান্তার আগ্রহ সাহেবের প্রতি। সীমাও জানে সাহেব-কান্তার প্রেমের গল্প। অনেকসময় সংবাদ আদান-প্রদানের ডাকপিয়ন সেই হয়।

নিশারও আগ্রহ জাগে। নিষিদ্ধ আগ্রহ। গোপন কিন্তু অদম্য।
জনি মানে জোনাকি। শফিকের বোন।

থারটিন থেকে নাইনটিন – নাম্বারগুলোর শেষে টিন সিলেবলটুকু আছে তাই এদেরকে বলে টিনএইজ। বাংলায় কৈশোরকাল। এডোলসেন্স পিরিয়ড। বয়ঃসন্ধি। শৈশব ছেড়ে তারুণ্যের পথে এগিয়ে যেতে নতুন জ্ঞান, নতুন অভিজ্ঞতা, নতুন অনুভব, নতুন শিক্ষা। মস্ত এক রঙিন চশমা এঁটে যায় অনভিজ্ঞ, অনভ্যস্ত চোখে। ভুল, বেঠিক কিছুও বড় সুন্দর দেখায়। শরীর আর মনের এই পরম্পরা কী ব্যাকরণের বেঁধে দেওয়া ‘টিন’ শব্দটাতে আটকে থাকে? নবজাতককে স্তন চুষে দুগ্ধ খাওয়ার কথা কেউ যেমন শিখিয়ে দেয় না, বেসিক ইন্সটিংকট তাকে বেঁচে থাকার তাগিদেই খাদ্যগ্রহনের উপায় জানিয়ে দেয় তেমনি নিজের অস্তিত্ব পৃথিবীর বুকে বাঁচিয়ে রাখতেই বিপরীত লিঙ্গের প্রতি আকৃষ্ট হয় মানুষ, বয়সন্ধিতে। এই আবেগ কেউ চাইলেই আটকে রাখতে পারে না, কেউ থামিয়ে দিতে পারে না, হয়তো সুপ্ত আগ্নেয়গিরির মতো দমিয়ে রাখে। দমিয়ে রাখা এই আগ্রহ বাইশের কৈশোর ছেড়ে না যাওয়া তরুণী নিশাকে কুপোকাত করে ফেলল। শফিকের চোখে নিশা অন্য কিছু একটা পড়ে ফেলেছে যা ওকে আটশো কোটি মানুষের তাবৎ দুনিয়া থেকে আলাদা করে দিয়েছে, নিশার দৃষ্টিতে।

‘নারে মা যাইতে দেবে না। পলায়েও যাইতে পারব না। মাঠ ভরা কাপড়। শুকায়ে মচমচা হয়ে আছে।
এইগুলা নিয়ে, গোছায়ে রাখা লাগবে। খড়ি নাড়ছিলাম উঠোন ভরে। সেইগুলো রান্নাঘরে মাচায় উঠায় দিতে হবে। দাদির হাঁসগুলা বড় খারাপ। খোপে ওঠে না। সেইগুলারে খুঁজে খুঁজে খোপে ভরা লাগবে।’

‘আর সুমইন্যার সাথে প্রেমও তো করা লাগবে?’ সীমা মুখ বাঁকায়। সীমার আগ্রহ অন্যজায়গায়। মালোপাড়ায় ঢোকার আগেই মক্তব পড়ে। মক্তবের ছোটোহুজুরের চোখে চোখ পড়লেই কেমন অদ্ভুত লাগে ওর। হুজুর মক্তবের ভেতরে থাকলে, তাকে দেখা যায় না, তবুও ওই রাস্তায় হেঁটে আসতে ভালো লাগে ওর। ময়নার উপর রাগ হলো ওর। ওকে খুব অহংকারী আর স্বার্থপর মনে হলো। ‘নিজের বেলায় ষোলোআনা, হুহ।’ মনে মনেই বলে ও। ‘কেন তোর জন্য যে আমি ধানসেদ্ধ কাজ বাদ দিয়ে সুমইন্যার দোকানে খাতা কিনতে যাই?’

কিন্তু মুখে কিছু বলে না। ছোটোহুজুরের প্রতি এই টান এরা টের পেলে হাসিঠাট্টায় পাগল করে দেবে৷ আর এটা হওয়ারও নয় ভালো করেই জানে সীমা। বছর ঘুরতে না ঘুরতেই হয়তো অন্য কোথাও বিয়ে হয়ে যাবে ওর। এই পছন্দের কথা কাউকে কোনোদিন বলার সুযোগও পাবে না।
উদাস হলো সীমা।

সূর্যটা গড়াতে গড়াতে একেবারে সাগরের বাগানের পেছনে চলে গেছে। পুরো মাঠজুড়ে ছায়া নেমে এসেছে। মাঠগুলোতে ফসল বোনার জন্য চাষ দেওয়া হয়েছে। একবার চাষ দেওয়া শেষ। বেশ ভালোরকম বৃষ্টি হয়ে মাটি নরম হলে আরেকবার চাষ দিয়ে বীজ বপন করা হবে। মাটি এবড়োখেবড়ো হয়ে আছে। আল ধরে না হাঁটলে, হাঁটতে কষ্ট হয়।

‘ময়না ওইটা তোর সুমইন্যা না?’ ময়না, নিশা, আর কান্তা, সীমার কথায় ঘুরে তাকায় মাঠের পাশের পুকুরটার দিকে।
আসলেই তো সুমন। সাথে শফিক। সুমনকে পিঠে চড়িয়েছে শফিক। দুইপা এসেই আবার নামিয়ে দিয়ে নিজে সুমনের কাঁধে চড়ার চেষ্টা করছে। ওই চারটে মেয়ে ছাড়া অন্য কোনো কেউ দেখলেই বুঝে যেত, ছেলেদুটো লোকের মনোযোগ আকর্ষণের চেষ্টায় ব্যস্ত। কিন্তু এখানে লোক তো ওই চারটে মেয়েই শুধু।
ময়না চোখ সরু করে ফেলল। সুমনকে ওর অনেকবার বারণ করা আছে, ময়নাদের বাড়ির ত্রিসীমানায়ও যেন ওকে দেখা না যায়।
শফিকের হাভভাবও ওর ভালো লাগছে না৷ বয়সে কত বড় ওদের চেয়ে, কিন্তু ছেলেছোকড়াদের মতো আচরণ করছে। ময়না চকিতে নিশার দিকে তাকাল। নিশার গালের দুপাশের সলজ্জ আভা ওর চোখে পড়ে গেল।

শফিক আর সুমন খোঁচাখুঁচি করতে করতে ওদের কাছে এসে গেল।

‘কীরে এখন কি দিনেদুপুরে মাঠের মধ্যে তোরা প্রেম করবি? এইটা কি শহরের পার্ক?’ সীমার ঠেস দেওয়া মন্তব্যর উত্তর করল শফিক ‘সমস্যা কী তোর? আমরা গ্রামে থাকি বলে শহরের মতো প্রেম করতে পারব না? নাকি শহরের মানুষের সাথেও প্রেম করতে পারব না? কম কী আমরা শহরের মানুষের চাইতে?’ সিগারেটের শলায় ম্যাচলাইট দিয়ে আগুন দিলো বলতে বলতেই। তারপর দু’আঙ্গুলে চেপে ধরে ঠোঁটে লাগিয়ে মস্ত জোরে বাতাস টেনে নিয়ে তার চেয়েও জোরে ধোঁয়া ছাড়ল।

সিগারেটের ধোঁয়া নিশার অসহ্য লাগে। মাথা ঘুরে ওঠে, বমি বমিও লাগে। ও চোখমুখ কুঁচকে নাকে ওড়নার আঁচলচাপা দেয়। মেজাজও খারাপ হয়। এত সুন্দর একটা ছেলে, কেন সিগারেটে ঠোঁট পোড়ায়? নিশা মনে মনে ভাবে ও যদি ওই ছেলেটার নিজের কেউ হতো তো সিগারেটটা টেনে ফেলে দিত।

‘এইখানে কেন এসেছ? তোমাকে মানা করেছি না?’ চড়া গলা ধরে ময়না, সুমনকে উদ্দেশ্য করে।

‘না, শফিক ভাই বলল ওদের বাড়িতে যাত্রার নায়িকা আসছে আজকে। তোমরা গেলে ভ্যান পাঠায়ে দেই?’ হঠাৎ আক্রমণে বিপর্যস্ত হয় সুমন।

‘না। নিশা আসো বাড়ি যাই।’ বলেই নিশার হাত ধরে হনহন করে মাঠের আল ধরে হাঁটতে শুরু করে ময়না।

চলবে….
আফসানা আশা

একটি উত্তর ত্যাগ

আপনার মন্তব্য লিখুন দয়া করে!
এখানে আপনার নাম লিখুন দয়া করে