আগুনের দিন পর্ব-৪+৫

0
398

আগুনের দিন ৪ ও ৫

৮.
নিশার ঘুম ভাঙল একঝাঁক মুরগির কককক আর হাঁসের প্যাকপ্যাক শব্দে। ওর দাদির পালা হাসমুরগির পালকে খাবার দেওয়ার সময় শব্দে কান পাতা দায়। নিশা চোখ কচলে বাইরে এলো। গনগনে রোদ বাইরে। চোখ ধরে যাচ্ছে। ময়নাকে দেখা যাচ্ছে না। সকাল থেকেই ময়না খুব ব্যস্ত থাকে। ওর মাকে সব কাজে সাহায্য করতে হয়। সকালের ধোয়ামোছা, তারপর সবার খাবার বেড়ে ঘরে ঘরে পৌঁছে দেওয়া – কেউ কেউ রান্নাঘরের দাওয়ায় মাদুর পেতে খেতে বসে কিন্তু উঠোন মাড়িয়ে কেউ আবার আসতেও চায় না। পুরুষ লোকেদের খাবার যার যার ঘরে দিয়ে আসতে হয়। ঘর বলতে সব মাটির মেঝে আর বেড়ার দেওয়াল, মাথার উপর গোলের ছাউনি। তাতেও ময়নার কাজ শেষ হয় না। এরপরে দুপুরের রান্নার কুটনো কোটা, বাটনা বাঁটা সব ওকেই করে দিতে হয়। মাঝে মাঝে ভাতটা গড় দেওয়া, ডালটা বাগাড় দেওয়ার কাজও করতে হয়। মোটকথা বেলা গড়িয়ে বিকেল হওয়ার আগে ময়নার ফুরসত নেই। এই সময়টা তাই নিশার খুব বিরক্ত আর একঘেয়ে লাগে। ও ময়নার পাশে বসে থাকে কিছুক্ষণ দাদির সাথে গল্প করে একটু – দাদিও তার হাস মুরগি, গরুর দেখাশোনায় ব্যস্ত। প্রতিবেশি রিমা, কান্তা, আরজিনারও একই রকম ব্যস্ততা। আর রাতে লুকিয়ে বাশার আর সাহেবের সাথে যাত্রা দেখতে যাওয়া যতটা সহজ হয়েছে দিনের বেলায় তাদের সাথে কথা বলা, পাশাপাশি দাঁড়ানো ততটাই কঠিন। মা সাথে আসেনি বলে নিশার উপর কড়াকড়িও বেশি।

সকালের খাবারে কমন থাকে আলুভর্তা। মাটির চুলার পিঠে মরিচ রেখে মুচমুচে করে রাখা হয়। সকালের ভাত রান্নাশেষে চুলার আগুন নিভিয়ে সেই গনগনে কয়লার উপর, নারকেল পাতার শলায় গেঁথে মরিচপোড়া দেওয়া হয়। মিহি কাটা পেয়াজ, অল্প রসুনকুঁচি, ঝাঁঝওয়ালা সর্ষের তেল আর লবণের সাথে হালকা করে হলুদগুঁড়ো দেওয়া হয় আলুভর্তার সাথে। চেনা ভর্তার রঙ পালটে যায়, ভিন্ন ফ্লেভার আসে আর স্বাদটাও অন্যরকম হয়ে যায়। বেশ ভালোই লাগে নিশার। আর এর সাথে দাদির মুরগির খোপ থেকে বের করা টাটকা ডিমভাজি। বড় এক বোলে কেজিখানেক আলুর ভর্তা করা হয়। ময়না পেয়াজ আর রসুন কেটে সুন্দর করে সাজিয়ে রেখেছে। ছোটোবউ মরিচ পোড়াচ্ছে আর বিড়বিড় করে যাচ্ছে। গতরাতে নিশার দাদির বাতব্যথাটা বেড়েছিল। রাত জেগে তার পা টিপে দিতে গিয়ে ছোটোবউয়ের আর ঘুম হয়নি। সে নিশাকে দেখে কাষ্ঠহাসি দিয়ে বলল ‘তোমার মা তো সব আমাদের ঘাড়ে দিয়ে শহরে গিয়ে রাণির মতো থাকে। কী আরামেই না আছে সে, তাই না, নিশা?’

নিশা উত্তর দেয় না। ও জানে এসব আক্ষেপের উত্তর করতে হয় না। ময়না ওকে ডেকে একটা পিঁড়ি এগিয়ে দেয় বসার জন্য ‘বসো। আজকে কাজ নাই বেশি। বাড়ির পুরুষ লোকেরা সবাই আজকে পার্টি অফিসে খাবে। আর আমাদের জন্য খাবার নিয়ে আসবে। রান্না হবে না, দুপুরের জন্য। আজকে আমরা মালোপাড়ায় যাব, তেঁতুল আনতে।’

‘পার্টি অফিসে কেন?’

‘আল্লাহ, তুমি শোনো নাই? এইযে যাত্রাপালার আসর বসছে, একী শুধু চেয়ারম্যানের মেয়ের বিয়ের জন্য? বিয়া তো কবেই শেষ। ইইউনিয়ন পরিষদ ইলেকশন না সামনে? তালাচাবি মার্কার লোক হেভি খাওয়াইতেছে সবাইরে। প্রতিদিনই গরু মারতেছে। আজকে আমাদের এইদিকে খাওন দেবে। পুরুষ লোকেরা গিয়ে খেয়ে আসবে। আর মেয়েদের খাবার বাড়িতে বাড়িতে পাঠায়ে দেবে।’

‘আমাদের বাড়ির সবাই কি তালাচাবি মার্কার ভোটার?’

‘তা তো জানি নে। তবে দাওয়াত সবারই। অনেক টাকা ঢালতেছে ইউনুস চেয়ারম্যান। আগে তার বাবা চেয়ারম্যান ছিলো, তারপর তার ভাই। সেও দুইবার চেয়ারম্যানি করছে। আগেরবার শুধু হাইরে গেছিলো। তাই এইবার জেততেই হবে তার। আমাদের বাড়ির সামনের রাস্তাটা পাকা করে দেবে বলেছে।’

‘বাঃ! ভালো হবে তো। যে কাদা হয় বৃষ্টিতে।’

‘করলে হয়। আব্বা কয় ভোটের পরে আর ফস করে না!’

‘মানে কী এর?’

‘হিহিহি। এর মানে শুনলে হাইসেই মরে যাবা। আগে যখন কোকাকোলা, সেভেনাপ নতুন নতুন আসছে এই দেশে, নির্বাচনের আগে এক নেতা ভোটারকে কোক খাওয়ায়োতো। প্রত্যেকদিনই। বোতলটা খুললেই ফস করে উঠত। এইরকম করে ভোটার লোকটা তো মজা পেয়ে গেল। সে প্রতিদিনই নেতার কাছে যায়, আলাপসালাপ করে আর একটা করে কোল্ড ড্রিংকস খেয়ে আসে। তো ভোট শেষ হলো। ভোটের পরেরদিনও লোকটা গেছে নেতার কাছে, অভ্যাসমতো। নেতার চাকর একটা বোতল দিয়েছে, যেমন প্রতিদিন দেয়। কিন্তু এইদিন বোতল খুললেই আর গ্যাস বেরোনোর ফস করে ওঠা শব্দটা বেরোলো না। লোকটা জিজ্ঞাসা করতেই নেতা জানালো, ভোটের পরে আর ফস করে না! হিহিহি!’

‘ফস করল না কেন?’

‘আরে বোকা, ভোটের পরে তো আর কোল্ড ড্রিংকস দেয় নাই। বোতলে পানি ভরে দেছে। হিহিহি!’

নিশাও একচোট হাসল ময়নার সাথে। মজার গল্প৷

সব কাজ শেষ করে ময়না নিশাকে নিয়ে তেঁতুল আনতে মালোপাড়ার দিকে চলল।

ময়না দেখতে সুন্দর। নিশা কালো বলে যে খেদ আছে ওর মনে তা আরও বেড়ে যায় ময়নাকে দেখলে। আর গ্রামে থেকেও এত সুন্দর করে সাজে যে নিশার অবাক লাগে। নিশা নিজে পারে না আর সাজগোঁজে ওর আগ্রহও কম। ক্লাস এইটের ক্লাসপার্টিতে সখ করে আম্মুর লিপস্টিক লাগিয়েছিল ঠোঁটে। রেজিনা দেখে বলেছিল ‘কয়লার গাড়িতে আগুন!’ চাপা স্বভাবের নিশার রুচি হয়নি আর কোনোদিন ঠোঁট রাঙানোর।

ময়না পালাজ্জো সালোয়ার আর শর্ট কামিজ পড়েছে। ওড়নাটা একদিকে লম্বা হয়ে মাটি ছুঁয়েছে। দেখে মনে হতে পারে এলোমেলো হয়ে আছে, কিন্তু ও ওভাবেই পিনআপ করেছে ওড়না। মাথার সুন্দর চুলগুলোকে চুড়ো করে বেঁধে, দুইগাছি আবার চোখের উপর ছড়িয়ে দিয়েছে। হালকা কাজল আর লিপলাইনারে আঁকা ঠোঁট। কী সুন্দর দেখাচ্ছে। নিশার মনে কেমন খচখচ করে, একটু হয়তো জ্বলুনি। নিজে কালো বলে আজীবন কটু কথা শুনে আসার অভিমানও!

তেঁতুল পাড়তে আসার জন্য যে এই সাজ না ময়নার সেটা নিশা অনুধাবন করল একটু বাদেই। মালোপাড়ায় যাওয়ার পরিবর্তে ময়না ওকে নিয়ে এসেছে বাজারের কিছু আগের ফ্লেক্সিলোড, বিকাশের দোকানে। দোকানে ঢোকার আগেই ময়না আমূল বদলে গেল, আঞ্চলিক ভাষা আর শুদ্ধ বাংলার খিচুড়ি করে কথা বলা মেয়েটা স্মার্ট বাংলায় নিশাকে বলল ‘নিশা, আমরা যে এখানে এসেছি, এই কথাটা তুমি কাউকে বোলো না, প্লিইইইজ!’

দোকানটাতে কিছু বইপত্রও আছে৷ টেক্সট, গল্প-উপন্যাস। ময়না সেগুলো নাড়াচাড়া করতে লাগল আর নিচু স্বরে দোকানের ছেলেটার সাথে কথা বলতে লাগল। ময়নার গালের লাল রঙ আর ছেলেটার চোখের ঢুলুঢুলু ভাব দেখে অনেক কিছুই বুঝে গেল ও। ছোটচাচি যেভাবে নিশার মায়ের শহরে থাকে, সুযোগ সুবিধা পাওয়া, ছেলেমেয়েদের শহুরে স্টাইলে মানুষ করার অভিযোগ করতে থাকেন তা একেবারেই সত্যি না। শুধু ভালো স্কুলে পড়া বাদে অনেক কিছু থেকেই নিশারা দুই বোন পিছিয়ে, গ্রামে থাকা ময়নার থেকে। অনেক কান্নাকাটি, আহ্লাদ করে একটা সেকেন্ডহ্যান্ড ল্যাপটপ আদায় করেছে ওরা মইনুল ইসলামের কাছ থেকে, নিজেদের কয়েকবছরের ইদি আর টিউশনির টাকাগুলোও দিতে হয়েছে সাথে, অথচ ময়নার হাতে ট্রেন্ডি স্মার্টফোনে, তাতে ডাটাপ্যাকেজ থাকে সবসময়ই। অনলাইনে অর্ডার করে হালফ্যাশনের জামা, রূপচর্চার সামগ্রী আনিয়ে নেয় ময়না, যেগুলোর নামও হয়তো শোনেনি নিশা।

নিশা বিরক্ত হচ্ছে। আধাঘন্টার বেশি এই মিহিকন্ঠের প্রেমালাপ চলছে। দুইহাত দূরে দাঁড়িয়েও একটা কথা কানে আসছে না নিশার। এতো আস্তে কেউ কথা বলে কীভাবে আর তার কথা অন্যজন বুঝছেই বা কীভাবে? বিরক্তির সাথে সাথে ও বিস্মিতও হচ্ছে ময়নার সাহস আর স্পর্ধা দেখে। বোঝাই যাচ্ছে ও প্রায়ই আসে এই দোকানে। ধরা পড়ার ভয় নেই ওর? যদি কেউ দেখে ফেলে? নিশার বুক ঢিপঢিপও শুরু হয়ে যায়।

থাই গ্লাসের স্লাইডডোর টেনে দেওয়া ছিলো, ফস করে টেনে একটা ছেলে ঢুকল। গ্যাবার্ডিনের ছয় পকেটের মোবাইল প্যান্ট হাওয়াই শার্টের সাথে মিসম্যাচ চটি স্যান্ডেল। ধুলোমাখা পায়ে ধপধপ করে ছেলেটি ঢুকে বলতে লাগল ‘ওই সুমইন্যা ফ্লেক্সি দিস নাই ক্যান? আধাঘন্টার উপরে হয়ে গেছে।’

সুমন মানে ময়নার বয়ফ্রেন্ড ছেলেটি তাড়াতাড়ি করে বলল ‘ভাই এইযে দিয়ে দিছি।’

নিশা চিনল ছেলেটাকে। আগেরদিন যাত্রায় সখি সাজা ছেলেটা যে পরে নিশার সাথে কুৎসিত ব্যবহার করেছিল। দিনের আলোয় ছেলেটাকে দেখে নিশার ধারণা পাল্টালো। ছেলেটা সুদর্শন, হেসে ফেললে দারুণ দেখায়! আর চোখদুটো খুব, খুব, খুব সুন্দর। পুরুষালী এমন মিষ্টি চেহারা আগে কখনো দেখেছে কীনা নিশা মনে করতে পারে না!

আগুনের দিন ৫।

৯.
‘ওই সুমইন্যা, এইটা বুঝি শালী? ভালো তো শহরের শালীও পেয়ে গেছিস। তা আমরা বড় ভাই যারা সিংগেল আছি, তাদের জন্যও একটু কিছু কর? শালী তো সুন্দর আছে?’ ছেলেটা একদম নিশার চোখে চোখ রেখে বলল। অদ্ভুত অনুভূতি হলো নিশার, চোখ ফিরিয়ে নিলো।

‘শফিইক্যা, ও নরম মেয়ে। একদম বিরক্ত করবি না।’ ময়না চোখ পাকিয়ে শাসায় শফিককে। সুমন তাড়াতাড়ি মোবাইল বের করে বাটন টিপতে টিপতে বলে, ‘শফিক ভাই, এইযে ফ্লেক্সি দিয়ে দিছি। তুমি একটু পরে আসো। এদের এখনই বিদায় দিচ্ছি।’

‘তাড়াই দিতাছিস? শুধু তোর শহুরে শালীর প্রশংসাই তো করলাম। ইংরেজিতে বলে কমপ্লিমেন্ট। একা একাই প্রেম করবি? ভাইদেরকে একটু ভাবি খুঁজে দিবি না? যাক, না দিলে নাই…’ মন খারাপের ভঙ্গিতে বলতে বলতে শফিক গান ধরল ‘নদীর জল ঘোলা ভালোওওও…. জাতের মেয়ে কালোই আলোওওওও!’

লজ্জাই পেলো নিশা। ঈষৎ লাল হয়ে মুখটা বেগুনি রঙ নিলো।

সুমন কৈফিয়ত দেওয়ার ভঙ্গিতে বলল ‘নিশা আপু, তুমি কিছু মনে কোরো না। শফিক ভাই একটু মুখ আলগা কিন্তু ভালো ছেলে। কী সুন্দর অভিনয় করে। কবিতা পড়ে। শিক্ষিত কিন্তু। বিএসসি পাশ।’

হলোইবা! নিশার তাতে কী? কী বিশ্রী করে গতরাতে ধমকেছিল ওকে!

‘চা খাবা নিশা আপু?’

‘না না, কিছু খাব না।’ সুমনের অফার ফিরিয়ে দেয় নিশা।’

‘খাবে না কেন? খেয়ে দেখো? এইখানের মালাই চা খুব মজা, খেয়েই দেখো না!’ নিশাকে বলে ময়না সুমনকে বলে ‘বেশি করে মালাই দেয় যেন। স্পেশাল।’

সুমন একমিনিটের মাথায় চায়ের অর্ডার দিয়ে ফেরত আসে। ওদের গল্প, হাসি, চোখে চোখে চাওয়া, টেবিলের নিচে দিয়ে হাত ধরাধরি খুঁনসুটি চলতে থাকে। সাত আট মিনিটের মাথায় একটা বাচ্চাছেলে ছোটো ছোটো গ্লাসে করে চা দিয়ে যায়। চায়ে চুমুক দিয়ে নিশা বোঝে, এমন আহামরি কিছু না।চা শুধুই একটা বাহানা। আরেকটু সময় এখানে থাকা আর নিশাকে ব্যস্ত রাখার বাহানা মাত্র।

১০
‘ও নিশা তুমি কি কাউরে কয়ে দিবা?’

‘না।’

‘সত্যি কচ্ছ?’

‘হ্যাঁ।’

‘আল্লার কিরা? মাথায় হাত দিয়ে কও?’

‘ময়না, তুই ভালো করেই জানিস আমি কাউকে বলব না। নাহলে তুই আমাকে নিয়ে এখানে আসতি না।’

‘অনেকদিন ওর সাথে দেখা করতে পারি না। রাগ করে ও। মা তো আমাকে বাজারে তো আসতেই দেয় না। আজকে তোমারে সাথে নিয়ে আইছি বলে কিছু কবে না।’

‘এইটা আমার খারাপ লেগেছে ময়না। কোনো সমস্যা হবে না, বিশ্বাস করো? সুমনের দোকানটা দাঁড়ায় গেলেই বিয়ের প্রস্তাব দেবে ওরা।’

‘দিলেই ভালো!’ অনাগ্রহের সাথেই শুভেচ্ছা জানায় নিশা। খুব মন খারাপ হয়েছে ওর। এতগুলো বসন্ত চলে গেছে জীবন থেকে। বয়সে ছোটো কতজনকে দেখে প্রেম করতে। ক্লাসমেট বা বান্ধবীদের প্রপোজ করার জন্য কতজন ওকেই মিডিয়া বানিয়েছে। বোন হয়েছে কতজনের, একসময় তো জাতীয় বোন খেতাব লেগে গিয়েছিল ওর সাথে! যে কেউই ওর কোনো বান্ধবীর সাথে সম্পর্ক করতে চেয়েছে, সেই আগে ওকে বোন ডেকে রাস্তাটা সহজ করেছে। কিন্তু ওর জীবনে কখনো প্রেম আসেনি। কখনো কেউ মুগ্ধ চোখে চায়নি। একে নিজের গায়ের রঙ নিয়ে হীনমন্যতায় ভোগে। তারউপর বন্ধু, আত্মীয়, প্রতিবেশি এমনকী রেজিনার বিদ্রুপেও ও আরও গুটিয়ে থাকে। বয়সে অনেক ছোটো ময়নাকে প্রেম করতে দেখে তাই খুব হিংসা হচ্ছে ওর।

মন থেকে হিংসাত্মক ভাবনাগুলো জোর করেই সরিয়ে দিলো ও। ময়নাকে বলল ‘তেঁতুল নিবি না? বাড়ি গিয়ে কী বলবি?’

‘হয়, হয়? মনে করায়ে দিলা। থ্যাঙ্কিউ নিশা। আসলে কতদিন পরে ওর সাথে দেখা হলো, সব ভুলে গেছিলাম!’

‘তুই রাতে দাদির সাথে ঘুমাস কি সুমনের সাথে ফোনে কথা বলার জন্যই?’

‘হয়। বুড়ি তো কানে শোনে না। আর শোয়ার সাথে সাথেই ঘুমায় যায়।’

মালোপাড়ায় ঢোকার মুখে পরিত্যক্ত কূয়ার পাশে এক চিলতে মাঠ। গরু চড়ে। বিকেলে ছেলেরা ক্রিকেট খেলে। এই মাঠ পার হতে সেকেন্ড ত্রিশ লাগে। তারপরেই ঝাঁকড়া তেঁতুল গাছ। এখনো পাকেনি। কাঁচা কাঁচা তেতুল ঝুলছে। কী মোটা মোটা তেঁতুল? আর এত বেশি ধরেছে যে পাতা দেখা যাচ্ছে না। গাছ ঝুঁকেও এসেছে খানিক। একটু লাফ দিয়ে একটা ডাল ধরল ময়না আর ঝাঁকি দিতেই টপটপ করে কতগুলো তেঁতুল পড়ল। সেগুলো ওড়নার কোচড়ে ঝুলিয়ে, কয়েকটা তেঁতুলপাতা ছিঁড়ে নিলো ময়না। কিছু মাতা নিজের মুখে পুরল আর কিছু নিশাকে দিলো। খুব মজা লাগল নিশার। হালকা টকটক। একটু মিষ্টি মিষ্টি। তেঁতুলের মতো অত কড়া না টকস্বাদটা। নিশার মনে হলো মানুষ তেঁতুল গাছে পাতা কেন রাখে? গাছটা ওর হলে ও সব পাতা পেড়ে, বেটে ভর্তা করে খেয়ে ফেলত!

বাড়ি যাওয়ার পথ ধরতেই ময়না বলল, ‘জনিগো বাড়ি বিলাতি ধইনাপাতা আছে। চলো নিয়ে আসি। তেঁতুলভর্তায় দিলে কী যে ঘ্রাণ হবে? আংগুল চাটতেই থাকবা!’

‘চাইলেই দেবে?’

‘কেন দেবে না? ব্যাপক হইছে তো?’

জোনাকির নাম ছোটো করে জনি। শফিক, শহীদ, জোনাকি আর সোনাই চার ভাইবোন। জোনাকি, ময়নার বন্ধু। বেশ ভাব দুজনের। ময়না ‘জনি, ও জনি? আছিস?’ বলে ডাকতে ডাকতে বাড়ি ঢুকল। বাড়িটা খুব সুন্দর। গেরস্ত বাড়ি। সব ফসল হয়। টিনের চাল দেওয়া সুন্দর সুন্দর অনেকগুলো ঘর। সব ঘরেই কাঠের ছাদ করা আছে ফসল রাখার জন্য। উঠানে সারাবছর ধান শুকানো হয়। কখনো মরিচ, কখনো হলুদ নাড়া থাকে। উঠোনের চারিদিকে ঘর। ঘরগুলোর সামনে সিমেন্টঢালা বসার জায়গা। সেখানে আচারের বয়ম রোদ পোহাচ্ছে। ময়না একটা বয়ম তুলে হাত ঢুকিয়ে দিয়ে আচার বের করে আনল। ‘খাবা নিশা? জনির মা যে সুন্দর বরইয়ের আচার বানায়? খেয়ে দেখ?’

‘না। তুমি হাত ধোও নাই!’

‘ধুরো! হাত ধুইতে গেলে জনির মা টের পেয়ে যাবে না? ক্যাক্যা শুরু করবে আইসে?’

‘এটাতো চুরি?’

‘জনি জানে।’

‘হুহ!’ মুখ ভার করে রইল নিশা। কতশত অন্যায় কাজ একদিনে করে ময়না? ওর ভয় করে না? গতকাল রাতে চুরি করে যাত্রা দেখতে গেল, নিশাকেও জোর করে নিয়ে গেল। দাদিকে লুকিয়ে যেতে কী অপরাধী মনে হচ্ছিল নিশার, নিজেকে নিজের!

পুরুষেরা কেউ বাড়ি নেই, মহিলারা হয়তো রান্নাঘরে ব্যস্ত। ময়না আরও দুবার ডাক দিলো ‘জনি? ওই হারামজাদি, মরছিস নাকি?’

ময়নার ডাক জোনাকির কানপর্যন্ত যাওয়ার আগেই বাদামীরঙা একটা বেশ নাদুসনুদুস কুকুর জিভ বের করতে করতে ছুটে এলো আর ঘেউঘেউ শুরু করে দিলো। নিশার খুব কুকুরে ভয়। ও লাফ দিয়ে একটা ঘরের দাওয়ায় উঠে গেল আর চিৎকার করে কাঁদতে থাকল। নিশা যত জোরে কাঁদে, কুকুরটা তত জোরে ঘেউঘেউ করে! মিনিট দুয়ের মধ্যে লোক জড়ো হয়ে গেলো আর শফিক কুকুরটাকে ডাক-তে ডাকতে গলায় হাত দিয়ে টেনে নিলো ‘এই, এই প্রেমা? থাম, থাম? আতুউউউ। এই প্রেমা? থাম, মা?’

নিশা স্তম্ভিত হয়ে কুকুর আর কুকুরের মালিকের কথোপকথন শুনতে লাগল।

ময়না হাত ধরে টানল নিশার ‘এত ডাকতেছি, তোমারতো একেবারেই হুঁশ নাই। এত ভীতু তুমি? আল্লাহ গো! বলতেছি এইডা পালা কুকুর, কামড়াবে না। তুমি শোনোই না। আসো?’ ওদের বয়সী একটা মেয়ের দিকে তাকিয়ে বলল ‘ওই জনির বাচ্চা? কই মরতে গেছিলি? ডাকতে ডাকতে জান শেষ?’

‘আজকে মেজবান না?’

‘তগো কী?’

‘চেয়ারম্যান কাকায় তো সব আমাগো উপরেই দিছে? মশলা বানাইলাম, গুস্ত বানাইলাম। তুই আইছিস ক্যান?’

‘আইরে পারব না?’

‘সেইডা কইনাই। ক্যান আইছিস জিগাইছি!’

‘ধইন্যাপাতা দিবি?’

‘হ। আস্তে ক? মা শুনলে রাগ করব। কান্তাগো গরু অদ্দেক পাতা সাফ কইরা দিয়া গেছে। তুই বাইরে যা, আমি চটপট কয়ডা পাতা ছিঁড়া আনতাছি?’

ময়না আর নিশা বাড়ির বাইরে এলে জোনাকিও হাতের মুঠোয় ধনেপাতা এনে ময়নার কোচরে ফেলে দিলো। ‘কী করবিরে পাতা দিয়া?’

‘তেঁতুলভর্তা খাব?’

‘আমারে দিয়া যাইস?’

‘এতো দূরে আবার আসব? সোনাইরে পাঠাইস?’

‘সোনাইরে মা যাইতে দেবে না। রান্না চড়ছে। একটু পরে ভাই বাড়ি বাড়ি দিতে যাইবে। ভাইর হাতে দিয়া দিস তখন?’

‘আচ্ছা।’

১০

‘এটাই কী ওই শফিকদের বাড়ি?’

‘হয়। সুন্দর না বাড়িটা? এলাকায় এতবড় বাড়ি আর কারো নাই। চেয়ারম্যান কাকার বাড়িও এতবড় না।’

‘ওরা কয় ভাইবোন?’

‘চাইরজন। শফিইক্যা, শহীদে, জনি আর সনি। শফিইক্যা বড় পোলা বলেইতো অত বাইড়!’

শফিকের উল্লেখে অকারণেই নিশার গাল লাল হয়ে গেলো। ও অস্ফুটে বলল ‘আর ওই কুকুরটা?’

‘ওইটা শফিইক্যার কুত্তা। নিজের চাইতে বেশি যত্ন করে ও কুত্তাডারে। যে খাবার দেয়, বাপরে বাপ! সপ্তায় দুই কেজি গরুর গুস্ত কেনে ওই কুত্তাডার জন্য।’

‘কুকুরটার নাম কী? কী নামে যেন ডাকছিল…?

হাসতে হাসতে নিশার গায়ে ঢলে পড়ে ময়না। ‘ওরে ঢঙ ওই কুত্তা নিয়া? কুত্তার নাম হইল প্রেমা! বুঝছ প্রেমা?’
হাসির দমকে কথা ঢাকা পড়ে যায় ময়নার। বহুকষ্টে হাসি থামিয়ে বলে ‘ওই শফিইক্যা নিজের নাম দেছে প্রেম; আর ওর বউয়ের নাম বলে প্রিয়া! আর ওই কুত্তাডা হইলো ওর মেয়ে, কুত্তার নাম নিজের নামে মিলায়ে রাখছে প্রেমা!

হাসতে হাসতে তেঁতুল, তেঁতুলপাতা, ধনেপাতা কোচর থেকে ফেলে দেয় ময়না। সেগুলো দুজন মিলে খুঁটে তুলে আবার হাসতে থাকে। ‘কুত্তার নাম প্রেমা! হিহিহি!…’

নিশাও হাসতে থাকে প্রাণখুলে।

চলবে..
আফসানা আশা

একটি উত্তর ত্যাগ

আপনার মন্তব্য লিখুন দয়া করে!
এখানে আপনার নাম লিখুন দয়া করে