আগুনের দিন ১১ ও ১২
শেষ পর্ব
নিশা একটা ঘোরের ভেতর ছিল। পরবর্তী ঘটনাপ্রবাহ ওর সেই ঘোর আরও বাড়িয়ে দিলো।
নিশার মেজকাকার ছেলে শান্ত বাড়ির বাইরে শফিকসহ আরও দুইজনকে ঘোরাফেরা করতে রেজিনাকে এসে জানাল গোপনে।
মেয়ের বদনাম ছড়ানোতে তার নিজেরই ভূমিকা অনেক বেশি, ঠান্ডা মাথায় চিন্তা করে রেজিনা বুঝে দেখল। মেয়েদের নামি জায়গায় পাত্রস্থ করার স্বপ্ন রেজিনার মাথায়। শফিকের কোনো আয় রোজগারের ব্যবস্থা নেই। সম্পত্তির কথা যেটা শোনা যায় সেটা ফাঁকা। যে জমিগুলো শফিকের বাবা দেখাশোনা করে তাতে শরীক আছে সাতঘর। এখন সব আয় শফিকরা ভোগ করলেও কোনো না কোনোদিন তো শরীক সম্পত্তি বুঝিয়েই দেওয়া লাগবে।
নিশার ছোটোকাকা মারুফ শফিককে জিজ্ঞেস করলেন ‘এতরাইতে বাড়ির সামনে কী করিস, শফিক?’
নিশ্চুপ শফিকের হয়ে উত্তর দেয় আকবর ‘এমনেই কাকা। কী একটা গরম পড়ছে না, তাই রাস্তা দিয়ে হাঁটতেছি।’
‘আমার তো তা মনে হইলো না।’
রেজিনার আর সহ্য হলো না। অধীর হয়ে বলে উঠলেন, ‘নিশার কাছে চিঠি কে দিছো? তুমি?’
কেউই কোনো উত্তর করল না।
‘কাল সকালে আমরা বাড়ি চলে যাচ্ছি। আর কোনোদিন কোনোভাবে আমার মেয়ের সাথে কোনোরকম যোগাযোগ করার চেষ্টা করবা না। আমার মেয়েটা অনেক নরম। ওর মনে আর কোনো কষ্ট হতে আমি দেবো না।
শফিক বিস্মিত হয়ে তাকিয়ে থাকে।
রেজিনা ওর দিকে তাকিয়ে দাঁতে দাঁত চেপে বলে, ‘তোমরা হলে খোঁয়ারের মোরগ। খোঁয়ার থেকে বের হও সকালে, সন্ধ্যেবেলায় সেই খোঁয়ারেই ঢোকো। এদিক ওদিক পরের ধানক্ষেতে মুখ দেওয়া কেন বাপু? যেমন যোগ্যতা তেমন মেয়েকে চিঠি দিতে পারো না? তোমার ওই চিঠিতে এত বানান ভুল তত ভুল তো আমার মেয়ে সারাজীবন পরীক্ষার খাতায়ও করেনি।’
শফিক মাথা নিচু করে সবটা হজম করে নিলেও, নিশা কাল সকালে চলে যাবে, এই সংবাদটা ওর বুকে জ্বালা ধরিয়ে দিলো। ও অপেক্ষা করতে পারত, নিশার মুখ থেকে কোনো একটা আশ্বাস পেলে ও ঠিক অপেক্ষা করে থাকতে পারত কিন্তু এখন যেন আর সেটা সম্ভবই না।
*****
মস্ত এক পরিকল্পনা করল শফিক। সেটা জহির আর আকবরকে বলতেই ওরা অবাক হয়, ‘কী কও? সত্যি সত্যি বিয়া করবা?’
‘না, করব না তো করব কী?’ শফিককে চিন্তিত দেখায়।
‘এইডা কেমন হইলো? প্রেম করা দূরের কথা, মাইয়ার সাথে কথাই তো বলতে পারলা না। আমি কিছুই বুঝতেছি না।’
‘বোঝা না বোঝার কিছু নাই। এখন পিছায়ে আসলে ভাইয়ের মানসম্মান থাকবে? সবাই বলবে না, ভাই ভয় খাইছে? ভাইয়ের পাওয়ার নাই?’ আকবরের কথায় আরও চিন্তিত দেখায় শফিককে।
‘যাই বলো, এইটা কেমন? থানা পুলিশ হতে পারে। মারামারিও লাগতে পারে!’ জহির ফুট কাটে।
‘লাগবে না? মাইয়ার মা আদর করে ডাকবে, আসো আমার মেয়ের সাথে প্রেম করো?’ জহির ভেংচি কাটে।
‘আরে তোরা থাম? হইছে তো হইছে। নিশারে আমার পছন্দ হইছে, বিয়া করবো। কাজ শেষ৷ হইছে, হবে একটু ঝামেলা। সমস্যা কী?’
‘সত্যিই ভাই। এত পছন্দ হইছে তোমার? কেমনে?’ আকবর আগ্রহ নিয়ে প্রশ্ন করে।
‘ওই, কেমনে মানে কী? তোগো ভাবি হবে। সামলায় কথা বল!’
জহির খিলখিল করে হাসে ‘ভাই বড় গাছে নাও বানছে! বুঝস না ক্যান আকবইরা? রূপ ধুইয়া পানি খাবে? রূপ তো অন্দরে থাকে। ভাই টাকার বিছানাত ঘুমাইবে, ভার্শন থ্রি চালাইবে! ভুউউম ভুউউম!’
‘বাজে কথা কইস না। যা যা ভাগ তোরা, আমি সবাইরে ডাকি। রাত পোহাবার আগেই রেডি থাকতে হবে।’
‘ভাই তুমি শিওর? ভাইবা দেখো কিন্তু!’
‘এখন আর ভাবাভাবির কিছু নাই। চ্যালেঞ্জ দিলো আমারে নিশার মা। শফিকরে না চিনেই চ্যালেঞ্জ দিলো। ভাবছে আমি ভয় খাবো। ভয় খেয়ে পিছিয়ে যাবো। এখন পিছায়ে আসার কোনো সুযোগ নাই। ফসকাইলে মানুষ মাইজ্ঞা বলবে।’
‘সেইটা বলুক, মেয়েটারে কি আসলেই পছন্দ তোমার? নাকি ঢিল ছুঁড়ছিলা শুধু?’
‘আবার বাজে কথা বলিস। নিশারে আমার পছন্দ। জোর করতেছি এইটা হতে পারে, কিন্তু ওরে আমি সত্যিই মন দিছি। ভালোবাসছি।’
‘একদম সিনেমার মতো ভালোবাসা দেখি, ভাই? আয় হায় ভাই, তুমি তো একদম ফিল্মের হিরোদের মতো কথা কচ্ছ!’
আকবরের কথায় শফিকের বুকের ছাতি আরও একহাত ফুলে ওঠে!
*****
নিশা কেঁদেকেঁদে চোখ ফুলিয়ে ফেলেছে। বিনাকারণে এত কটু কথা শোনার চেয়ে মরে যাওয়াও ভালো। এখন ওর মরে যেতেই ইচ্ছে করছে। রেজিনাকে ভালোমতো চেনা আছে ওর, প্রতিদিন অন্তত একবার করে নিশাকে এই ঘটনার খোঁটা দেবে সে। এই তো একটু আগেই বলে গেল ‘কী রুচি তোর নিশা? প্রিয়া? ছিঃ! সাধে কি আমি বলি, শকুন উপরে থাকলেও নজর থাকে নিচের দিকে।’
আবার ঘুরে এসে ব্যাঙ্গ করে যাচ্ছে ‘ও প্রিয়া, প্রিয়া রে? এখন থেকে তোকে আমি প্রিয়া বলে ডাকব। ঠিক আছে?’
নিশা বুঝে গেছে, সামনের দিনগুলো অসহ্য হতে যাচ্ছে ওর জন্য!
ব্যাগ গুছিয়ে সবার কাছে থেকে বিদায় নিয়ে তেমাথা পর্যন্ত যেতে যেতেই নিশাদের রিকশাভ্যানটা পথে আটকালো শফিক।
‘এই ছেলে কী সমস্যা?’ রেজিনা ঝাড়ি দিয়ে উঠল।
‘নিশা যাইতে পারবে না!’
‘তোমার কথায়?’
‘শুধু আমার কথা না, নিশাও এইটা চায়! ওরে জিজ্ঞাসা করেন?’
রেজিনা চোখ উঁচু করে তাকাল মেয়ের দিকে, ‘তাই? তুই এইটা চাস? উত্তর দে? বল, না বল?’
থাপ্পড় খেয়েও চুপ করে থাকল নিশা।
রেজিনা বুঝে গেল মেয়েও এটাই চাইছে।
চার পাঁচটা ছেলে ঘিরে ধরেছে ওদের ভ্যানটাকে। রেজিনা উপায় না পেয়ে বলল,
‘তোমার বাপেরে দিয়ে বিয়ের প্রস্তাব দিতে পারবা?’
*****
‘এইগুলো মনে হয় ইমিটিশন, নাকি নাতবউ?’ মহিলাটা নিশার মুখের অনেকখানি কাছে এসে একটা একটা গয়না পরখ করে দেখছে আর কথা বলছে। পানখাওয়া গাল থেকে থুতু ছিটকে এসে নিশার সারামুখ ভরে যাচ্ছে।
নিশা উত্তর দেওয়ার আগেই শফিকের মা বলে উঠলেন ‘না, কইলো তো সবই সোনা। মেমোবিলও সাথে দিয়ে দেছে।’
‘ওরে বাবা!’ ঠোঁট উল্টালো মধ্যবয়সী মহিলাটা। তারপর ফার্নিচারগুলো দেখতে থাকল আর খুঁত খুঁজতে থাকল ‘নারে নাতবউ, ভালো ঠকানি ঠকছিস তো, এইগুলো একটাও সেগুনকাঠ না। সব আকাশীকাঠ। দুইপাঁচবছরেই ঘুনে খাইবো।’
একটু ঘুরে এসে বলল ‘ফিরিজও আনছে বউ?’ বিস্ময় ঝরে পড়া গলা সামলে নিয়ে বলল ‘আমাগো বাড়ির শাহজাহানের বউ আরও বড় ফিরিজ আনছে। আর কী ঢক সেই ফিরিজের, আয়না লাগে না, মুখ দেখা যায় চকচকা।’
‘হু’ আস্তে করে উত্তর দিলো শফিকের মা৷ ছেলের বউ হিসেবে নিশাকে তার একেবারেই পছন্দ না। নিতান্তই ছেলের জেদের কাছে হেরে গিয়েছেন। এই গয়না আর ফার্নিচারগুলোই তার স্বান্তনা। তাতেও দোষ ধরায় তার মেজাজ খারাপ হয়ে গেছে৷
বয়স্কা মহিলাটা এবার কথা ঘোরালেন ‘কইস কী আলেয়া , এত জিনিস দেছে? সব বউর বাপেই দেছে? খাট, সোকেস, আলমারি, ওয়াড্রুপ, টিবি সব? সত্যই? বউর বাপে কী রাজা নাকি? তোগো গ্রামেরই পোলা নাকি শুনছি?’
‘হয় খালা। তারা শহরের বড় মানুষ সত্যই।’
‘কী কইস। এমন আচানক লাগে। কী দেইখা তোর পোলারে এত জিনিস দিলো?’
এইবার মেজাজ হারালেন শফিকের মা ‘তাগো মাইয়ারও তো তেমন শ্রী কিছু নাই। ওই চেহারা পার করতে এমন বহুৎ কিছু দেয়াথোয়া লাগে। একখান গাড়িও তো দেওয়া উচিত শফিকরে।’
‘দিবো কইছে?’
‘কয়নাই৷ শফিকের অনেক শখ একখান গাড়ির। আমরাই দিতাম। পোলার বিয়া দিয়া এখন হাতটান। এখন বউই বলবে তার স্বামীর শখের কতা। আমাগো কী, যা থাকবে তার আর তার স্বামীরই থাকবে। মেয়ে যা বুইঝা আনতে পারে।’
বয়স্ক মহিলাটা সম্পর্কে শফিকের মায়ের খালা হন, ভাগ্নির কথার জোর আরও বাড়াতে বললেন ‘হয় হয় আনবো না তো কী! আনবে। নইলে ওই চেহারা নিয়ে স্বামীরে বানবে ক্যামনে!’
নিশা মনে মনে শফিককে খুঁজতে থাকল। বিয়েবাড়ির ঝামেলায় অনেক রাত হয়েছে, এইঘরে নিশাকে বসিয়ে রেখে কোথায় চলে গেছে শফিক, ও থাকলে অন্তত জবাব দিতো এইসব বিশ্রী আলোচনার।
কিন্তু জবাব এলো ঊষার কাছ থেকে। নিশাকে চুপিচুপি বলল ‘বুবু, হাউ ডু ইউ উইল গেট ফিট ইন দিজ? দিজ উইমেন আর রিয়েলি স্যাভেজ।’
‘প্লিজ ঊষা, স্টপ ইট!’
‘ইউ কান্ট সারভাইভ হেয়ার, আই ক্যান ফোরসি ইট!’
‘শফিক লাভস মি!’
‘হুহ! হি ইজ দ্য মেইন কালপ্রিট। আ প্রিটেন্ডার, ইমপোসটার!’
‘প্লিজ, ঊষা!’ ফিসফিস করে বলে নিশা।
‘শান্ত, মাহিন আছে এখনো। ওদের সাথে করে আমি দাদির কাছে চলে যাচ্ছি। তোর এই দারুণ শশুরবাড়িতে থাকার কোনো ইচ্ছেই নেই আমার!’
যাওয়ার আগে আবার এসে নিশার কানের কাছে মুখ নিয়ে বলে ‘পড়াশুনা কি ছেড়ে দিচ্ছিস বুবু?’
‘না তো! কেন বললি এইকথা?’
‘এরা তোকে পড়তে দেবে বলে মনে হচ্ছে না। চাকরিবাকরি করা তো অনেক দূর! যৌতুকের টাকায় ঘর সাজাবে কিন্তু বাড়ির বৌ চাকরি করলে ইজ্জতশেষ – এরা সেই দলের মানুষ!’
‘শফিক সব সামলে নেবে।’
‘তোকে বলেছে সে?’
‘না আমি জানি। আমার মন জানে। ও আমাকে ভালোবাসে ঊষা।’
ঊষাও আর তর্ক করল না। বয়সের চাইতে বুদ্ধি বেশি ওর। ও তাকিয়ে বড়বোনের আনন্দ ঢলঢল মুখ দেখতে থাকল। ওর খুব বলতে ইচ্ছে করল ‘মন বলে কিছু নাই বুবু। সব মস্তিশকের ছোট খুপরিটাকে থাকে। ওইখানে দুইরকম তথ্য, অনুভূতি তৈরি হয়। যেটা ইললজ্যিকায়াল ইনফরমেশন, আমরা জানি সেটা লজিক্যাল না, জেনেও সেটাকে মনের দোহাই দিয়ে আমরা যাস্টিফাই করার চেষ্টা করি!’
আজকে বাসররাত নিশার। শফিকের। নিশা অনেক অপেক্ষা করে আছে, শফিকের জন্য। শফিক এলো একটু রাত করে। নিশার জন্য দুটো গোলাপ নিয়ে এসেছে। লালগোলাপ। ওদের বাজারে পাওয়া যায় না। পাশের গ্রামে অজিত কুমার নামে এক লোকের বাগান আছে গোলাপের। সেখানে লোক পাঠিয়ে আনতে দেরি হয়েছে।
গোলাপের সুরভিতে ঘরের দমবন্ধ পরিবেশ আর নিশার মনের সমস্ত বন্ধ অলিগলি একসাথে খুলে গেল। ভীষণ আহ্লাদে পরিপূর্ণ হলো নতুন দাম্পত্য। এত ভালোবাসাও অপেক্ষা করেছিল ওর জন্য, এত সুখ – অবাক হলো নিশা!
এক জীবনে মনে হয় আর চাওয়ার কিছু নেই ওর, সুখী দাম্পত্যের ক্লান্তিতে বিলীন হতে হতে মনে হলো নিশার!
১২.
‘এইগুলো কী রান্না করছ মা? ভাত না জাউ?’
নিশা প্রমাদ গোণে। শফিকের মা না, ভাত রান্না করেছে নিশা। এই বাড়ির নিয়ম ফজরের ওয়াক্ত শুরু হওয়ার আগে ঘুম থেকে উঠে, অযুগোসল করে ভাত রাঁধতে হয়। বেলা শুরু হওয়ার আগেই বাড়ির পুরুষেরা ভাত খেয়ে নেয়। তারপর তারা মাঠে চলে যায়। কৃষিভিত্তি গ্রামবাংলায় এই প্রচলন নাকি আবহমান কাল থেকে। সোনালি রোদে ঝিকিমিকি করার আগেই, পেটপুরে ভাত খেয়ে, কৃষক ক্ষেতে চলে যেত – গামছায় বেধে সানকিভরা নুন আর পানিদেওয়া ভাত, কাঁচা পেঁয়াজ, মরিচ নিয়ে। দুপুর পর্যন্ত কাজ করে, কোনো এক ছায়ায় বসে সেই পান্তায় পেট ভরিয়ে, খানিক জিরিয়ে তারা আবার কাজ করত। বিকেলের দিকে দুটো কুঁচোচিংড়ি নইলে জালে টানা জ্যান্ত মাছ নিয়ে বাড়ি ফিরলে আবার রাতের রান্নার আয়োজনে বসত বউঝিরা। হাটবার ছাড়া বড় মাছ বা মাংসের জোগান পাওয়া যেত না, তাই গাছের কলাটা, মুলোটা দিয়েই দিন পার হয়ে যেত। সেই সময় আর নেই, কৃষকের সেইদিন নেই, হাটবাজার এখন রাস্তার মোড়ে পৌঁছে গেছে। কিন্তু কিছু কিছু বাড়িতে এখনও ওইসব নিয়ম মেনে চলে। শফিকদের বাড়িতেও সেইরকম৷ সকালে আর রাতের খাবারই প্রধান। দুপুরে কোনোরকম ভাতেভর্তার ব্যবস্থা।
রেজিনার কড়া শাসনে, নিশাদেরও অভ্যাস সকালে ঘুম থেকে ওঠা। ছটা বা সাতটায় ঘুম ভাঙত নিশার, তারপর হাতমুখে পানি না দিয়েই পড়তে বসা। কিন্তু সেই ঘুম ভাঙা আর এই ভোরভেলায় উঠে দশবারোজনের ভাত লাকড়ির চুলায় রান্না করা এক কথা নয়। আজ একটু ঘুমের ঢুলুঢুলু হয়েছিল চোখদুটো, বসে থেকে চোখ লেগে এসেছিল, তাতেই ভাত বেশিসেদ্ধ হয়ে গিয়েছে। শফিক ভাতের থালায় লাথি মেরে উঠে চলে গেল।
শাশুড়ি বলে উঠল ‘ভাত হইবো ঝরঝরা, একটার গায় আরেকটা লাগবে না আবার চাইলের মাইঝও থাকা চলব না। ভাত রানতে হবে যত্ন দিয়া। একটু চোখের আড়াল করবা, একটু অযত্ন করবা, একটু তাড়াহুড়া তো শেষ! হয় চাইল নইলে জাউ! বউ আনছি ঘরে, যেমন সুরত তেমনি কামকাজ। সংসারে একটা টাকা দেওয়া নেই, গণ্ডেপিণ্ডে গেলার কামেই আছে শুধু!’
শফিক ভালোবাসে নিশাকে, তাই সব সহ্য করে নেয় নিশা। কিন্তু এই খাওয়ার খোঁটা বড় কষ্ট দেয় ওকে। শফিককে বড় আদর করে কোনো একটা কাজ করার কথা বলে ও। তাতেই শফিক একেবারে ছ্যাৎ করে ওঠে। ‘না খাইয়া থাকো তুমি? ল্যাঙটা থাকো? এত চাহিদা কেন? আমাকে চাকরি করতে বলছ? আমি করব চাকরি? পরের মাহেনদারি? চাকর হবো, আমি শফিক?’
নিশা বোঝাতে চেষ্টা করে ‘কোনো কাজই ছোটো না শফিক। আর চাকরি করলেই তাকে চাকর বলে না।’
‘এই বিদ্যা তোমার? চাকরি যে করে তাকেই চাকর বলে। চাকর – চাকরি, সোজা হিসাব তো! বিএপাশ করলে বুঝতে।’
নিজের শিক্ষা জাহির করতে যায় না নিশা, আস্তে করে বলে ‘কিন্তু বেকার থাকা কি ভালো?’
‘মা কিছু বলছে, না? ভাইবো না। ভালো একটা লাইন পাইছি। ধরতে পারলেই লাখ লাখ টাকা। এখন আসো তো, আমার নিশিরাণি, নিশির রাণি, কাছে আসো, আদর করে দাও আমাকে।’
শফিকের সামর্থ্যবান বাহুতে মুখ লুকাতে লুকাতে নিশা ভাবে, সত্যিই তো এই এতখানি ভালোবাসা পাওয়ার পরেও এত কীসের চাহিদা ওর!
*****
শফিকের দুইবোন নিশার বয়সীই, ওরা বাড়ির মেয়ে বলে জামা, সালোয়ার পরায় বাধা না থাকলেও বাড়ির বউ হিসেবে নিশার শাড়ি পরা বাধ্যতামূলক। শাড়ি সামলাতে ওস্তাদ এখন নিশা। আরও আরও কাজে ওস্তাদ না হতে পারলেও সবকিছুই করতে হয় ওকে। ধান সিদ্ধ করা, চাল ঝাড়া, হাত পুড়িয়ে মরিচ পরিস্কার করা, মাছ কাটা, রান্না – গেরস্তবাড়ির সব কাজ।
সব পারলেও গোবরের ঘুঁটে দিতে একেবারেই রুচি হয় না ওর। জনি আর সনি টিটকারি করে তখন, গান করে ‘বড়লোকের বেটি লোওওও!’
নিশা চেষ্টা করে হাতে হাতে দ্রুত কাজ করে দিতে। কিন্তু শাশুড়ির মনমতো হয় না। সবকিছুতে দোষ ধরা পড়ে। ‘আলুর চুকলা এর মোটা করে ফালাইলা ক্যান? আমি কী রাজার হাতিশাল খুইলে বসছি?’
‘রুটি গোল হয় না ক্যামনে? মায় শিখায়নাই? জামাই নিয়া ভরসন্ধ্যায় দরজা দিতে তো ঠিকই শিখাইছে।’
‘জামাকাপড়ে এত সাবান মাখানি কীসের। অল্প একটু গুঁড়ো নিয়ে ভালো করে খেচে খেচে কাপড় ধুতে হবে। সাবান তোমার বাপে দিয়ে যায় না। দুইটা মানুষ বসায়ে খাওয়াচ্ছি। একটু তো রহম করো!’
প্রতিদিন খাওয়ার খোঁটা নিশার অভ্যাস হতে চায় না কিছুতেই। শফিককেও কিছু বলা যায় না। চেষ্টা তো করেই শফিক! একটা সেলুন দেওয়ার আগ্রহ খুব। নাপিত পাওয়া গেছে। খুব ভালো কাজ জানে। বাজারের উপর ভালো জায়গায় দোকান বসিয়ে, ডেকোরেশনও সুন্দর করতে পারলে আর ঠেকায় কে? বুড়োনাপতে সমাদ্দারের দিন শেষ। শফিককে আর পায় কে তখন?
মাল্টিপারপাস সমবায় সমিতিরও এখন চালু ব্যবসা। তিন পার্সেন্ট হাতে জমা টাকার ঋণের উপর পনেরো পার্সেন্ট সুদ। লোকের টাকা দিয়েই ব্যবসা, লোকে টাকা জমা রাখবে, সেই টাকা লোন নেবে, সেই লোনের সুদ নিয়ে শফিক মালামাল।
শহরে একটা রেডিমেড গার্মেন্টসের দোকানও দেওয়া যায়। মোবাইল আর মোবাইল এক্সেসরিজেরও বিরাট ব্যবসা এখন।
এত এত ব্যবসার আইডিয়া ঘুমাতে দেয় না শফিককে। অল্প পরিশ্রমে অনেক টাকা আয় করার কত কত কায়দা জানা আছে ওর!
কিন্তু সবকিছুর আগে সিনেমায় যেতে হবে। সিনেমার নায়ক হতে হবে৷ শফিকের চেহারা যেকোনো নায়কের চাইতে ভালো, এই কথা সবাই বলে। আর একটিং তো ও জানেই। মালোপাড়ার তাপস, এফডিসির পাশেই এক রেস্টুরেন্টে চাকরি করে। পরিচালক মালেক আফসারি নাকি প্রায়ই ওখানে আসে। তার ড্রাইভারের সাথে তাপসের ভালো খাতির আছে। একটা লাইন ও করে দিতে পারবে। তবে কিছু টাকা লাগবে। বাবার কাছ থেকে এই টাকাটা বের করা যাচ্ছে না। কোথা থেকে বের হবে, সারাবছরের এতবড় পরিবার আর সমাজ নিয়ে চলার খরচ সব আসে জমির বিভিন্ন ফসল থেকে। জমি আছে প্রচুর কিন্তু শরিকও তো অনেক। সবাই জমিটাই দেখে। এই জমিগুলো কতগুলো মানুষের অন্নসংস্থান যোগায় তা দেখে না। শফিকদের ভাগে কতটুকু সম্পত্তি তার আয়ে ভালো খেয়েপরে চলা যায় শুধু। জনি, সনির বিয়ে দিতে হলেও জমি বেচা লাগবে। রফিকের পড়াশোনার জন্যও গতবছর তামাকের ক্ষেত বেচা লেগেছে দুইখান। তাই তো শফিকের বাবা সারাদিন খিটমিট করে, ছেলেরা এখনো ইনকাম করছে না কেন?
শফিক দুএকবার ভেবেছে নিশাকে বলবে ওর বাবার কাছ থেকে কিছু টাকা এনে দিতে। কিন্তু বিয়েটাই হয়েছে এক অদ্ভুতরকমভাবে। নিশার মা নিজে বিয়ের কথা বলেছিল শফিককে, নিশার বাবার অমতেই। শফিক শর্তমত, বাবাকে দিয়ে বিয়ের প্রস্তাব দিয়েছিল। তিনদিনের মাথাতেই বিয়ের আয়োজন করে ফেলে রেজিনা। মইন সাহেব এসে সব দেখে রেগে গিয়েছিলেন, লোকমুখে শফিক শুনেছে মেরেছেনও নাকি তিনি নিশার মাকে। সে ওইরকম দজ্জাল মহিলার ওইরকম শাস্তিই হওয়া উচিত, শফিক খুশি হয়েছে মনে মনে। নিশার দাদির হস্তক্ষেপে বিয়েটা নিয়ে মইন সাহেব আর ঝামেলা করেননি, অলংকার, ফার্নিচার সবই দিয়েছেন নিশাকে। কিন্তু নিশার মা আবার পল্টি খেয়েছে। নিশার সাথে সম্পর্কছেদ করেছে। নিশার নিজের পছন্দের ছেলের সাথে বিয়ে, এই বিয়ে তিনি মেনে নিয়েছেন কিন্তু নিশার সাথে তার আর কোনো সম্পর্ক থাকবে না। নিশাকে আর ঘরে নেবেন না তিনি। বিয়ে, বউ পেলেও শ্বশুরবাড়ি আর পাওয়া হয়নি শফিকের। আর নিশার মাও মিথ্যা হুমকি দেয়নি, সত্যি সত্যিই সে আর যোগাযোগ করেনি নিশার সাথে। ঊষা, মাহিন, নিশার বাবা ফোন করে খোঁজ নেয়, কিন্তু মহিলা অতি পাষান।
নিশাকে টাকার দরকারের কথা বলতে গিয়েও শফিক থেমে যায় তাই। এই বিয়েটার আসলেই ওর কোনো দরকার ছিল না মনে হয়। সাততাড়াতাড়ি বিয়ে, শ্বশুরবাড়ি নিলো না একবারও জামাইকে, একটা মটরসাইকেলের শখ ছিলো তাও মিটলো না। বেকার বলে আগে খোঁটা শুনলেও মা আড়াল করে নিতো, এখন শফিকের মা নিজেই ছেলের উপার্জনে অক্ষমতা নিয়ে কথা শোনান। নিশাকেই শোনান কথা, কিন্তু তা শফিকের কানে এসেও ঢোকে।
নিশাকে ভালোবাসে শফিক। এটা সেটা কিনে দিতে ইচ্ছে করে। নতুন বউকে উপহার দিতে ইচ্ছে করে।অথচ প্রয়োজনীয় জিনিস আনতেই বাবার কাছে হাত পাততে হয়। নিজের অক্ষমতা স্বীকার করে না ও, তাই ভালোবাসা ভারী পড়ে যায়। পরিস্থিতিতে পড়ে এখন মনে হয়, বিয়েটা না করলেই ভালো হতো।
*****
পড়াশোনাটাও করা দরকার, নিশার মনে হয় এখন। সব কাজ সেরে দুপুরে খাওয়ার পর ও দাদীর কাছে যায়। এইবাড়িতে কোনো না কোনো কাজে ডাক পড়ে যায়। হয়তো শ্বশুরের কাছে কেউ এসেছে, চা করে দিতে হবে। ডাক পড়বে ‘বড় বৌ?’
রান্না শেষে ভাতের হাড়ি চুলার পাশেই রাখা ছিলো, কুকুরে মুখ দিলো কীনা। ‘বড় বৌ? ভুলুক দিয়ে দেখো তো?’
‘মুরগির ছাওগুলারে বেজিতে নিলো নাকি?’
‘দুইটা চাইল ভাজো, বৌ? নারকেল কোরায়ে দেও সাথে।’
সনি এসে বলবে ‘ভাবি মাথায় তেল লাগায়ে দিতে পারবা?’ তো আরেকজন বলবে ‘কলেজের জামা ইস্ত্রি করে দিছো?’
অথৈ সংসারে নিশা খাবি খেতে থাকে। তাই দাদির কাছে গিয়ে বসে কিছুক্ষণ। ঘন্টাখানেক বইখাতা নাড়াচাড়া করে। ভর্তিপরীক্ষা তো দিতে হবে। পাবলিক বিশ্ববিদ্যালয়ে পড়ার কত স্বপ্ন। কোচিং করা হলো না। এখন পড়াও হচ্ছে না! তবু একটু চেষ্টা করে ও।
মাঝেমাঝে বিকেল পেরিয়ে সন্ধ্যে নেমে যায়। মাগরিবের আযান পড়ে যায়। একা একা ফিরতে গেলে, রাস্তার দুইপাশের গাছের মাথার অন্ধকার আর বাগানের মাঝে নেমে আসা অন্ধকার থেকে ভুত পেত্নি সব নেমে আসে। শফিক নিতে আসে তখন ওকে। বাড়ির ভেতর ঢোকে না ও। বাইরে থেকে নিশাকে ডাকে। নিশার নাম ধরে ডাকে না। ‘প্রিয়া’ বলে ঠিক দুবার ডাকে। ডাকটা কানে আসতেই নিশার কানলাল হয়ে ওঠে। কিছুক্ষণের জন্য কানে অন্য কোনো শব্দ ঢোকে না। সব পাওয়া আর না পাওয়া মিলিয়ে যেতে থাকে চোখের সামনে। অনভ্যস্ততায় গৃহস্থ চাষীবাড়িতে সারাদিনের পরিশ্রমের মূল্য হাতের মুঠোয় ধরা দেয় যেন…
উড়তে উড়তে এসে শফিকের হাত ধরে ও। দুজনে অর্জুন গাছের নিচে দিয়ে হেঁটে যায়। কখনো চাঁদের আলোয় একটু বসে। পাশ দিয়ে কেউ যাওয়ার সময় পরিচয় জানতে চায়। শফিক সলজ্জ হেসে জানায় ‘আমি কাকা, শফিক। আর আমার বউ।’
আফসানা আশা
প্রিয় পাঠক আগুনের দিনের সমাপ্তি এখানেই। আমরা ভেবে নিই নিশা সুখী হয়েছে।