আগুনের দিন – ১০
‘এই চিঠি কোথায় পেয়েছিস? কে দিয়েছে তোকে’ কাগজটাতে চোখ বুলিয়েই জিজ্ঞাসা করল রেজিনা।
হঠাৎ করে উত্তর এলো না নিশার কাছ থেকে। ও থতমত খেয়ে চুপ করে থাকল।
‘বল? কার চিঠি? কে লিখেছে?’
‘ময়নার চিঠি, মা। ময়নাকে একজন দিয়েছে’ মরিয়া হয়ে জবাব দিলো নিশা। ‘তুমি কাউকে বোলো না, মা, ওর মা তাহলে ওকে খুব বকবে।’
‘ময়নার চিঠি তোর কাছে কেন’ নিশার উত্তরে সন্তুষ্ট না রেজিনা।
‘আমাকে দেখতে দিয়েছিল। তারপর আমার কাছেই রেখেছি। তুমি কাউকে বোলো না মা।’
‘এসব করতেই গ্রামে এসেছ, বুঝেছি আমি। আমার সারাজীবন বেগার খেটেই গেল। তোমাদের মানুষ বানাতে পারলাম না। আমি এখনই সবাইকে বলব।’
‘আম্মু প্লিজ। প্লিজ আম্মু। আমি রিকোয়েস্ট করছি তোমাকে। প্লিজ!’
রেজিনা নিশাকে কোনো উত্তর না দিয়ে মাথায় পানি ঢেলে গোসল করতে শুরু করল। টিউবওয়েলের চাতাল বেয়ে ইট বসানো পানির নালা দিয়ে সরসর করে পানি চলে যাচ্ছে। নিশারও সবকিছু সেই পানির সাথে তীব্রস্রোতে ভেসে যাচ্ছে মনে হলো ওর। ভয় পেয়ে তাড়াতাড়ি করে সরে এলো নিশা। দুচোখ হন্যে হয়ে ময়নাকে খুঁজছে।
ময়না গোসল করে এসে চুল ঝাড়ছে। নিশা হন্তদন্ত হয়ে ওকে চেপে ধরল ‘ময়না, বিপদ হয়েছে।’
‘কী? কী করছ তুমি আবার?’
‘মা চিঠিটা পেয়ে গেছে’ কাচুমাচু হয়ে বলল নিশা।
‘কোনটা? কেমনে পাইলো? কই রাখছিলা তুমি?’
‘ময়না, প্লিজ। মা জিজ্ঞেস করলে তুমি বলবা ওটা তোমার চিঠি।’
‘আমার চিঠি মানে?’
‘মানে, কেউ তোমাকে লিখেছে।’
‘কে? কে লিখেছে?’
‘সুমনের কথাই বলবা।’
‘অসম্ভব’ নিজের এতদিনের গোছানো পরিকল্পনা চোখের সামনে মাঠে মারা যেতে দেখল ময়না। সুমনের নামটা প্রকাশ্যে এসে গেলে ওর মহাসর্বনাশ। প্রায় বেকার ছেলের সাথে ময়নাকে কেউ বিয়ে তো দেবেই না, উলটো এমন কিছু হবে যাতে সুমনের নামও আর কোনোদিন মুখে আনার জো থাকবে না। ‘একটা চিঠি সামলায়ে রাখতে পারো না, তোমার দায় আমি নেবো কেন? এইটা পারব না নিশা।’
ততক্ষণে বাড়ির ভেতর তুলকালাম করে নিয়েছেন রেজিনা। সোমত্ত মেয়েকে নিয়ে এসে সামলে রাখতে পারেনি বলে শাশুড়ী, দেবর, জা সবাইকে দোষারোপ করলেন। সবাইকে চিঠির টুকরোটা খুলে জোরে জোরে পড়ে শোনালেন। লজ্জায় নিশা দশহাত মাটির নিচে চলে যাচ্ছে যেন।
রেজিনা মইন সাহেবকে ফোনে গালাগাল করে বাড়ি মাথায় করে নিলেন, ‘এই প্ল্যানে তুমিও আছ? তোমার মা কারসাজি করে মেয়ে নিয়ে গ্রামে এলো, এইখানে তারে নিয়ে এই ষড়যন্ত্র তুমিই করিয়েছ? এইজন্যই তো বলি, মেয়ে আমার কখনো অনুমতি ছাড়া চোখের পলক ফেলে না, আজ এতবড় কাহিনি কীভাবে ঘটিয়ে ফেলল?’
‘সামান্য একটা ব্যাপার নিয়ে তুমি অনেক দূর চলে গেছ। এইবয়সে এইরকম চিঠিফিঠি আসেই। মেয়েরাও দেয়। কয়েকদিন যেতেযেতেই সব ভুলে যাবে।’
রেজিনাও জানে তা। কিন্তু তার যে ফেসলস হলো সেটাই সে হজম করে উঠতে পারছে না। নিজের সন্তান লালনপালন নিয়ে তার অহংকার ছিলো সেটা আজকে গুঁড়িয়ে গেছে, আর তাও যাদের তিনি শত্রুপক্ষ মনে করেন সেই দেবর, জা, শাশুড়ীর সামনে। একটা এসপার ওসপার করতেই হবে।
‘শোনো নিশার আব্বু, এই ব্যাপারে একটা কথাও আমি শুনব না।’
‘কী করবে তুমি? এত বাড়াবাড়ি করছ কোন সাহসে? আমি নেই তাই?’
ফোনটা কেটে দিলেন রেজিনা, তারপর বাতাসী বেগমকে ফোন করলেন।
‘হ্যালো বাতাসী আপা?’
‘হ্যাঁ আপা বলো?’
‘কেমন আছ?’
‘আছি ভালো। কুশল জিগাইতে ফোন দিছো?’
‘না ঠিক তাও না। ওই যে তুমি একটা প্রস্তাব এনেছিলে, নিশার জন্য। আমি ওর আব্বুর সাথে কথা বলছিলাম। ভেবে দেখলাম, মেয়ে বিয়ে তো দেবোই, তো বছরদুই আগে দিলেই বা সমস্যা কী?’
‘এই তো লাইনে আসছ।’
‘কিন্তু আমরা একটু খোঁজখবর নেব’
‘সে ঠিক আছে। কিন্তু সেইদিক তো তুমি খেদায়ে দিলা। তারা এখন ছেলের বিয়ে অন্য কোথাও ঠিক করছে কীনা কইতে পারি না। আমি কথা বইলে তোমারে জানাচ্ছি।’
‘আচ্ছা। ফোন দিও তাড়াতাড়ি। আমারও তো গোছগাছ আছে। কিছু নেবে না বললেই কিছু দেবো না, তা তো না।’
‘আচ্ছা, এই আধাঘন্টা একঘন্টার ভেতর ফোন দিচ্ছি আমি।’
নিশা চুপ করে দাঁড়িয়ে ছিলো, রেজিনার কথা শেষ হতেই পা জড়িয়ে ধরল। ‘আম্মু আমি কিছু করিনি৷ কোনো অন্যায় করিনি।’
‘করোনি। সুযোগ পাওনি তাই। সুযোগ পেলে অবশ্যই করতে। কিন্তু তুমি কবে সুযোগ পাবে আর আমার মুখে চুনকালি লাগাবে সেইপর্যন্ত তো তোমাকে সময় দিতে পারব না, মা।’
‘আম্মু আমাকে মাফ করে দাও প্লিজ।’
নিশার দাদি চুপ করে থাকতে পারলেন না আর এগিয়ে এলেন, ‘আহা, নিশার মা৷ করো কী? একটা না হয় ভুল মেয়ে করেছেই, তাই বলে বাপ-মা হয়ে তাকে শাস্তি দেওয়াও কিন্তু আমাগো কাজ না, আমরা শোধরাই দিতে পারি।’
‘তো কী করব? ওই যাত্রার নটির সাথে নিশারে বিয়ে দেবো? কথায় আছে না, শকুন উপরে থাকলেও নজর থাকে নিচের দিকে। যেমন গুষ্টি তেমনিই তো হবে মেয়ে। যতই ভালো শিক্ষা-দীক্ষা দিই না কেন, নজর তো ছোটোলোকের দিকেই থাকবে।’
বারবার বংশ তুলে কথা বললেও কেউ প্রতিবাদ করল না, রেজিনা ক্ষেপে আছে বুঝতে পেরে। আর নিশার দাদিও দায় অস্বীকার করতে পারছেন না, নাতনিকে রেজিনার অসম্মতিতে নিজের সাথে এনেছিলেন বলে। আরও খেয়াল রাখা উচিত ছিলো তার। তবুও বিয়ে দেওয়া খুব খারাপ হবে ভেবে বললেন ‘তাই বলে চিনপরিচয় নাই এমন পোলার সাথে মেয়ে বিয়ে দিয়ে দিবা?’
‘হ্যাঁ দেবো। চেনাজানা লাগবে কেন? আমার বিয়ের সময় আপনার ছেলের সাথে চেনাজানা ছিলো? আপনার বিয়ের সময় ছিলো? নাকি দিন পাল্টাইছে, এখন শুয়ে দেখে চেনাজানা করা লাগবে? কীরে নিশা ওই যাত্রার নটির সাথে শোয়াটোয়া হয়ে গেছে নাকি শুয়ে দেখবি? কী শেখাইছে এইকয়দিনে এরা?’
ঘৃণায় নিশার বুক ভারী হয়ে আসলো। এই বাড়ির লোকদেরকে নিচ দেখিয়ে নিজেকে উঁচু করতে গিয়ে নিজেকে কতটা ছোটো করল রেজিনা আর নিশাকে কতটা অসম্মান আর হীনতা দিলো তা একবারও ভেবে দেখল না।
নিশা ফুলে ফুলে কাঁদতে থাকল আর নিজের মৃত্যুকামনা করতে থাকল। কিন্তু মরণ কি এত সহজে আসে কারো কাছে?
কাঁদতে কাঁদতে ক্লান্ত হয়ে ঘুমিয়ে পড়ল নিশা।
*****
‘নিশা ও নিশা?’ ময়না ধাক্কা দিয়ে ডাকল নিশাকে।
নিশার রাগ হয়েছে ময়নার উপরে। ও ইচ্ছা করলেই এই খারাপ অবস্থায় পড়তে হতো না নিশাকে। শুধু নিশার মাকে বললেই হতো, যে চিঠিটা ময়নার। মা তাহলে লুকিয়ে যেত ব্যাপারটা। আর ময়নারই তো দোষ সবটা। ও কেন চিঠি নিয়ে এলো? নিশা কি বলেছিল ওকে কারও চিঠি এনে দিতে? কারো সাথে প্রেম করিয়ে দিতে?
‘তুমি রাগ করছ, নিশা’ প্রশ্নের উত্তর না পেয়ে ময়না নিজেই বলতে থাকল ‘আমি কী করতাম নিশা, কও। আমার নামে চিঠি এই কথা শুনলে আমারে তো আজই পার করতো। কানা-ল্যাংড়া বিচার করত না। সুমনের সাথে বিয়ে না হইলে আমি মইরা যাব নিশা। নিজের প্রাণ বাঁচাইতে গিয়া, আমি তোমারে বাঁচাইতে পারলাম না’ তবুও নিশার দিক থেকে সাড়া এলো না।
ময়না আবার বলল ‘বাতাসী খালা ফোন দিছে। কোন পোলার সাথে বিয়ের কথা হইছিল তোমার, হ্যারা নাকি প্রস্তুত। পরশুদিনই আসবে। কালই বড়চাচি তোমারে নিয়ে যাবেগা।’
নিশা নিথর হয়ে শুধু চোখের কোল ভিজিয়ে কাঁদতে থাকল।
‘এইটা কোনো বিয়া? এইভাবে বিয়া দেওন যায়? এরচাইতে মইরা যাওয়াও ভালো নিশা।’ নিশার মাথায় হাত বুলালো ময়না। খুব যত্ন করে চোখের পানি মুছে দিলো। ‘কাইন্দো না। বোন না তুমি আমার। কাইন্দো না। শফিক ভাই রাস্তায় দাঁড়ায়ে আছে।’
লাফ দিয়ে উঠল নিশা। ‘কে? কে দাঁড়িয়ে আছে?’
‘শফিক ভাই। এইসব ঘটনা হ্যারে কইছি আমি। সে খুব কষ্ট পাইতেছে। তোমার সাথে একবার কথা বলতে চায়।’
‘খবরদার ময়না। আমি কারো সাথে কোনো কথা বলব না।’
‘আমি বলছি নিশা। সেইকথা সব বলছি আমি। সে যেন আর তোমারে বিরক্ত না করে, সেইসব বলছি। কিন্তু মানতেছে না। রাস্তার মাথায় দাঁড়ায়েই আছে। তুমি নিজে না বললে সে এখান থেকে যাবে না।’
‘আমি বলব না ময়না। তুমি যাও এখান থেকে।’
ময়না ফোন লাউড স্পিকারে রাখে। নিশা শুনতে চায় না, কিন্তু কানে ঠিকই পৌঁছে যায়। শফিক কাঁদছে। নিশার বুকে মোচড় দিয়ে ওঠে। হৃদয় নামের রক্তসঞ্চালক যন্ত্রটা হয়তো অকেজো যায় একটুখানি সময়ের জন্য।
‘নিশা, আমার প্রিয়া। তুমি আমার প্রথম ভালোবাসা। তোমার অন্য কোথাই বিয়ে হতে পারে না। আমি মরে যাবো নিশা, একদম মরে যাবো। মরে যাবো একেবারে৷’
এপাশে নিশা কাঁদতে থাকে।
‘প্রিয়া? আমি দাঁড়িয়ে আছি। তুমি আসো। সব ছেড়ে চলে আসো। আমি তোমাকে রাণি বানিয়ে রাখব। এভাবে আমাকে ছেড়ে চলে গেলে আমি বাঁচব না। অন্য কারো সাথে তোমার বিয়ে হবে, এইকথা যখন ময়না বলেছে, তখনই তো মরে গিয়েছি আমি।’
নিশা ফোঁপাতে থাকে।
‘আমি জানি তুমি সব শুনছ। আমি অপেক্ষা করে আছি প্রিয়া। তুমি নিজেকে জিজ্ঞাসা করো, আমাকে ভালোবাসো কীনা, মন কী উত্তর দেয় দেখো? চোখ বন্ধ করে ভাবো, আমার মুখই কল্পনায় আসবে, দেখো? আর তখনই কিন্তু সব ছেড়ে আমার কাছে চলে আসবে তুমি।’
একটু আগে নিশার মরে যেতে ইচ্ছে করছিল, এখন মনে হলো, বেশ তো, মরে গিয়ে মরার পরে যদি আরেকটা জীবন পাওয়া যায়, ক্ষতি কী? আর সেই জীবনের হাতছানি যদি এমন সুন্দর হয়? এমন ভালোবেসে কেউ যদি একটা নতুন জীবনের দরজা খুলে দেয়, তবে সেই জীবনটা একবার বেঁচে দেখাই যায়!
তারপর হাতের উপর মাথা রেখে চুপ করে রইল।
চলবে…