আগন্তুক পর্ব-০৩

0
2

#আগন্তুক
#তৃতীয়_পর্ব
#মৌসুমী_হাজরা

বিশ্বজিৎ-এর দেওয়া ঠিকানায় গাড়ি নিয়ে পৌঁছালো আর্য। আগে থেকেই বিশ্বজিৎ-এর কাছে জেনে নিয়েছে, এইসময় অন্তরা থাকবে কিনা।
গাড়ি এসে বাড়ির কাছে থামতেই সামনেই কিছু আন্টিরা বসে গল্প করছেন, গাড়ি দাঁড়াতে দেখেই চুপ করে তাকিয়ে থাকলেন তাঁরা। আর্য মনে মনে ভাবলো, অন্তরার সাথে অন্তরার মতো করেই মিশতে হবে। এই তিনবার দেখাতেই আর্যর মনে হয়, সে অন্তরাকে পুরোটা চিনে নিয়েছে। এতটাও কঠিনও ছিল না যদিও। অন্তরার বাচ্চাদের মতো হাবভাব, কথাবার্তা। তবে পরোপকারীও, আবার কঠোর আর জেদি।
কিছুক্ষণ ভেবে নিয়ে গাড়ি থেকে নেমে ফোনটা বের করে অন্তরাকে ফোন করলো আর্য।
এদিকে আন্টিরা নিজেদের মধ্যে কি যেন বলাবলি করছিলেন।

ল্যাপটপ নিয়ে কাজ করছিল অন্তরা। আননোন নাম্বার থেকে ফোন আসতে একটু অবাকই হয়েছিল। যে পরিস্থিতিতে সে এখন আছে, তাতে গুটিকয়েক মানুষ ছাড়া আর কেউই খোঁজ রাখে না। তারমধ্যে চার্চের ফাদার আর কয়েকজন বন্ধুর রোজ ফোন আসে। কখনো সখনো কাস্টমার ফোন করে ফটোশুটের জন্য। তবে এখন বেশ ক ষ্ট হয় অন্তরার। সময়ের সাথে সাথে পেটও বেড়েছে, সন্তানের নড়াচড়া ভালোই অনুভব করতে পারে। অন্তরার এখন অনেক কাজ, সন্তানকে জন্ম দেওয়ার পর ভালো ভাবে বড় করতে হবে। তাকে মানুষের মতো মানুষ গড়ে তুলতে হবে। এখন আর মন খা’রাপ হয় না। সুমনের উপর কোনো রা গ নেই অন্তরার। সুমন হয়তো এইসবের জন্য প্রস্তুত নয়। তবে অন্তরা কিছুতেই এই বাচ্চা ন ষ্ট করতে পারবে না, তাই তো জীবনের ঝুঁকি আছে জেনেও, তাকে পৃথিবীর আলো দেখাবে বলে সিন্ধান্ত নিয়েছে। ফাদারকে বারবার বলেছে, আমি যদি না থাকি, তুমি আমার মতই আমার সন্তানকে বড় করবে।

আরও একবার ফোনটা বেজে উঠতেই সম্বিৎ ফিরলো অন্তরার। আবারও সেই আননোন নাম্বার থেকে ফোন। ফোন রিসিভ করতেই, ওই প্রান্ত থেকে একজন বললো, একবার ব্যালকনিতে আসতে পারবেন ম্যাডাম? একটু দরকার ছিল।
অন্তরা কিছু বলার আগেই ফোনটা ডিসকানেক্ট হয়ে গেল। অন্তরা বেশ অবাক হল। ল্যাপটপটা বিছানায় রেখে, ব্যালকনিতে গেল অন্তরা। নীচে ডক্টর আর্যকে দেখে বেশ অবাক হয়ে গেল। আর্য হাসি মুখে হাত নাড়লো। অন্তরার চোখ গেল এবার পাশে বসে থাকা আন্টিদের দিকে। এমনিতেই তাঁদের এখন হট টপিক অন্তরা। অন্তরার গর্ভে কার বাচ্চা আছে, এই নিয়ে তাঁদের চিন্তার শেষ নেই। এই অবস্থায় ডক্টর আর্যকে দেখে তাঁদের টপিকে আরও স্পাইসি মশলা এড করা যাবে। এই ভেবেই অন্তরা হেসে বললো, কী ব্যাপার ডক্টর আর্য, আপনি আমার প্রেমে পড়লেন নাকি? আজ একেবারে বাড়ি অব্দি চলে এলেন।
আর্য হেসে বললো, কী করবো বলুন, আপনাকে দেখার পর রাতের ঘুম উড়ে গেছে। দিনরাত শুধু আপনার কথা ভেবে ভেবে পাগল হয়ে যাচ্ছি। এই রোগের ট্রিটমেন্ট এবার আপনাকেই করতে হবে।
অন্তরা হো হো করে হেসে বললো, কিন্তু ডক্টর তো আপনি।
আর্য বললো, ডক্টর নিজের ট্রিটমেন্ট নিজে করতে পারবে না।
দুজনে কিছুক্ষণ একে অপরের দিকে চেয়ে রইলো। তারপর আর্য বললো, দরজাটা খুলবেন, একটু কথা ছিল। অন্তরা হাসি মুখে বললো, আসুন।
আন্টিরা কিছুই বুঝতে পারলেন না। অবাক হয়ে চেয়ে রইলেন। এদিকে আর্য একবার তাঁদের দিকে তাকিয়ে চশমাটা খুলে অন্তরার বাড়ির দরজার কাছে গেল।
অন্তরা ধীরে ধীরে নীচে নামার সময় ভাবলো, ডক্টর আর্য কীভাবে তার ঠিকানা পেল? এতদূর যখন এসেছেন, নিশ্চয় তিনি অন্তরার ব্যাপারে সবটুকু জেনে গেছেন। কিন্তু উনি কেন এমন করছেন? কী উদ্দেশ্য ওনার?

অন্তরা দরজাটা খুলতেই আর্য বললো, দুকাপ চা বানা তাড়াতাড়ি।
অন্তরা অবাক হয়ে বললো, দু কাপ?
আর্য বললো, হ্যাঁ দু কাপ, তোর আর আমার। সেদিন আমাকে আসতে বলে নিজে বেপাত্তা। আচ্ছা চল ছাড়, আমি বানাচ্ছি। কিচেনটা কোন দিকে? অন্তরা তখনও অবাক হয়ে তাকিয়ে আছে আর্যর দিকে। আর্য আবারও বললো, কিচেনটা কোনদিকে? অন্তরা হাতের ইশারা করে বোঝালো, মুখে কিছু বললো না। আর্য বললো, ওকে তুই চুপ করে এখানে বস, আমি চা বানিয়ে নিয়ে আসছি। আর হ্যাঁ মুখটা বন্ধ কর, নয়তো মাছি ঢুকে যাবে।

আর্য চা বানাতে গেল। অন্তরা নিজেকে চিমটি কে টে দেখলো, এইসব সত্যি নাকি স্বপ্ন।
কিছুক্ষণের মধ্যেই আর্য চা বানিয়ে নিয়ে এসে বসলো অন্তরার কাছে। অন্তরাকে এক কাপ চা দিয়ে বললো, দেখ তো কেমন বানিয়েছি। চিনি দিই নি। এইসময় তোর চিনি খাওয়া ঠিক নয়।
অন্তরা আর্যর দিকে তাকিয়ে বললো, কেন করছেন এমন?
আর্য অন্তরার কথায় পাত্তা না দিয়ে বললো, কাল সকালের দিকে নিতে আসবো, ডক্টর অরুন্ধতীর কাছে নিয়ে যাব চেক আপের জন্য। পালাবার চেষ্টা করিস না, যেখানে যাবি, সেখান থেকে খুঁজে তোকে বের করবো।

অন্তরা হাউহাউ করে কেঁ দে উঠলো। আর্য, অন্তরার আরও একটু কাছে গিয়ে বসলো। তারপর বললো, আমি বিশ্বজিৎ-এর কাছে গিয়েছিলাম। ওখান থেকেই তোর ঠিকানা আর ফোন নাম্বার পেয়েছি। আমি ওর কাছে সবটা জেনেছি। আমি তোকে জাজ করছি না অন্তরা। তুই যে ডিসিশনটা নিয়েছিস, সেটা আমি রেসপেক্ট করছি। তবে তোকে বুঝতে হবে, সব পুরুষ এক নয়। তোর আর কোথাও পালাবার পথ নেই। আমি তোকে ছাড়ছি না। তোর এই জার্নিটাতে আমাকে সাথে নিবি? আমি জানি না, আমি কেন এমন করছি? এমন তো পাগলামি আমি কোনোদিন করিনি। এই যে হঠাৎ একজন অপরিচিতকে এতটাই কাছের মনে হচ্ছে যে, আমি সোজা আপনি থেকে তুই করে বলছি। আমি জানি তুই ভীষণ স্ট্রং, তোর কাউকে প্রয়োজন নেই। তবুও আমি তোর পাশে থাকতে চাই। তোর এই জার্নিটা আরও সুন্দর করে তুলতে চাই। আমাকে রাখবি প্লিজ?
অন্তরা কান্না ভেজা গলায় ধীরে ধীরে বললো, রাখবো। যে কোনো বাহানায়, এই ছেড়ে যাওয়ার যুগে, কেউ থাকতে চাইলে তাকে ফিরিয়ে দিতে নেই। এটা আমাকে ফাদার বলেছেন। দুজনেই হাসছে। এই সুন্দর মুহুর্ত দেখার মতো কেউ নেই। তবুও সাক্ষী থাকলো এই বিকেল, এই চায়ের কাপদুটো।

চা শেষ করেই আর্য বললো, চল রেডি হয়ে নে, একটু ঘুরে আসি।
এই প্রথম অন্তরা আর নিজেকে আটকে রাখতে পারলো না, আর্যর কাছে যেন নিজেকে মেলে ধরলো। আর্য কাপদুটো নিয়ে বেসিনে গিয়ে বললো, একদম আঁটোসাঁটো ড্রেস পরবি না, ঢিলেঢালা কিছু পরিস, যেটাতে তুই আর বাবু দুজনেই কম্ফোর্টেবল ফিল করবি।
অন্তরা রেডি হয়ে এসে বললো, চলো, আজ আমাকে ফুচকা খাওয়াবে? অনেকদিন খাই নি।

অন্তরার হাসিমুখটা দেখে কিছুক্ষণ আর্য তাকিয়ে থাকলো। যেন একটা গাছ বৃষ্টির জল পেয়ে সবুজ আর সতেজ হয়েছে। আর্য মনে মনে ভাবলো, এই মেয়েটা অনেক কিছু একা সামলেছে, এবার ওর দুনিয়ার সব আনন্দ, সুখ দেখার পালা। ওকে আর ক ষ্ট পেতে দেওয়া যাবে না।
অন্তরার হাতটা ধরে গাড়ির কাছে নিয়ে গেল আর্য। আন্টিদের নজর তখনও ওদের দিকে। আর্য সেদিকে আর না তাকিয়ে, গাড়ি স্টার্ট করে বেরিয়ে গেল। গাড়ির স্পিড একদম কম। অন্তরা সেটা বুঝতে পারলো। তারপর নীরবতা ভে ঙে অন্তরা বললো, তুমি তো আমার জন্য ব’দনাম হয়ে গেলে ওই আন্টিদের কাছে। আর্য হেসে বললো, তা হলে হবো। কি করি বল, তোর মতো বন্ধুর জন্য এইটুকু সহ্য আমি করে নেব।
কথাটা বলা মাত্রই দুজনে আবার হেসে উঠলো।

এইভাবেই কে টে গেল আরও কয়েকটা দিন। এই কটা দিনে আর্য আর অন্তরার বন্ধুত্ব আরও গভীর হয়েছে। অন্তরা এইটুকু বুঝতে পেরেছে, আর্য কোনো স্বার্থ ছাড়াই তার জীবনে এসেছে। ডক্টর অরুন্ধতী, অন্তরার চেক আপের পর আর্যকে জানালেন, বেবি ঠিক আছে। কিন্তু অন্তরার ওভারিতে যে টিউমার আছে, সেটা নিয়ে ভ য় থেকেই যায়।
আর্য বললো, সেরকম হলে ওভারি বাদও তো দেওয়া যাবে বেবি হওয়ার পর।
অরুন্ধতী বললেন, রিস্ক আছে, ব্লি ডিং এর পরিমাণ বেড়ে গেলে, তখন কিছু করা যাবে না।
আপাতত এখন ওকে খুব সাবধানে থাকতে হবে। সব থেকে বড় কথা ওকে হাসিখুশি রাখতে হবে। কিন্তু ওর ব্যাপারে যেটুকু শুনলাম, তাতে ওকে একা থাকতে হয়। এইসময় মোটেই ওকে একা রাখা যাবে না। এতদিন সেভাবে ও কোনো চেক আপ বা ট্রিটমেন্টের মধ্যে ছিল না। যদি প্রথম থেকে ব্যাপারটা ধরা পড়তো, তবুও আমি যথাসাধ্য চেষ্টা করতাম। এখন চান্স অনেকটাই কম। আমাদের ডক্টরদের অনেক ব’দনাম হয়, কিন্তু পেশেন্ট যদি প্রথম থেকে রোগের ট্রিটমেন্ট না করায়, তাহলে অনেক সময় আমাদের হাতে কিছুই করার থাকে না। তবে আমি সবরকম চেষ্টা করবো অন্তরার জন্য। আমি আরও সিনিয়র ডক্টরদের সাথেও কথা বলবো।

কিছুক্ষণ পর বিশ্বজিৎ-এর ফোন এল আর্যর ফোনে। ফোনে বিশ্বজিৎ-এর কথা শুনে ভ য় পেয়ে গেল। অরুন্ধতী শুধু এইটুকু বুঝতে পারলেন, অন্তরা বাথরুমে পড়ে গেছে।

পরের পর্বে সমাপ্ত…

ভুলত্রুটি মার্জনীয় 🙏

একটি উত্তর ত্যাগ

আপনার মন্তব্য লিখুন দয়া করে!
এখানে আপনার নাম লিখুন দয়া করে