আক্কাস মামা আমার শ্বাশুরীর মামাতো ভাই। কিন্ত আমার শ্বাশুরী এবং তার পরিবারের উপর তার প্রভাব অপরিসীম। তিনি হচ্ছেন সেই পরিবারের “সকল কাজের কাজী”। যেকোন সমস্যায় আমার শ্বাশুরী তাকে তলব করেন এবং সেই সমস্যার সমাধান হয়ে যায়, যদিও ওনাকে আমার বেশি পছন্দ নয়। সবজান্তা, বেশি বুঝি টাইপের লোক। আমার ধারনা, সকল ধরনের দালালি টাইপের কাজ করেই তিনি ঢাকায় দুইটা বাড়ি করেছেন, যদিও জিগ্গেস করলে বলে এক্সপোর্ট-ইমপোর্টের ব্যবসা। এর মানে আমার কাছে ” ইধারকা মাল ওধার” করা।
আমার শ্বশুর বেশ কিছুদিন ধরেই অসুস্হ, কাশি ভাল হচ্ছে না। বউকে নিয়ে শ্বশুরবাড়ি এসেছি তাঁকে দেখতে। শ্বাশুরী আজকে খুব ভাল মুডে আছেন, আক্কাস মামা আসবেন, আর চিন্তা নেই। বিকেলের দিকে হুড়মুড় করে তিনি আসলেন।
– কি হইছে, আপা? দুলাভাইয়ের কি হইছে?
– আরে গত একমাস ধরে কাশি, এর মধ্যেই চারজন ডাক্তার দেখিয়েছি, কত ঔষধ চেন্জ করলাম কিন্ত কাশি তো যাচ্ছে না!
– ধুর্। এসব ডাক্তার কি কোন চিকিৎসা করে? ওরা তো খালি টেষ্ট করে আর কোম্পানির সাথে চুক্তি অনুযায়ী ঔষধ লেখে, রোগী ওদের কাছে টাকা বানানোর মেশিন।
আমি নিজেও ডাক্তার, এই ধরনের কথাবার্তা মেজাজটা খারাপ করে দিচ্ছে কিন্ত কিছু বলতে পারছি না, এই লোককে কিছু বলা মানে আরো অপমান হওয়া। আমার বউ তাড়াতাড়ি প্রসঙ্গ চেন্জ করল।
– মামা, এখন কি করব? দেশের বাইরে নেব?
– কুছ পড়োয়া নেহি! এই কাশির ঔষধ আমিই জানি। আপা, শোন। তুলসি পাতা কিনতে পাওয়া যায় বাজারে। আধা কেজি তুলসি পাতা কিনবা। তারপর প্রতিদিন রাতে দুইগ্লাস পানিতে তুলসি পাতা ভিজাইয়া ফ্রিজে রাখবা। সকালে খালি পেটে দুলাভাইকে দুইগ্লাস তুলসি পাতার রস খাওয়াবা এক সপ্তাহ। কাশি বাপ্-বাপ্ কইরা পালাইব।
– কিন্ত মামা, এই ঠান্ডার মধ্যে সকালে এই ফ্রিজের পানি খাওয়ালে তো অবস্হা আরও খারাপ হবে। আমি না বলে আর থাকতে পারলাম না।
তাচ্ছিল্য ভরা একটা চাহনি দিয়ে আক্কাস মামা আমাকে বললেন,
– জামাই, তুমি তো সাইন্সের ছাত্র। বলতো মাইনাসে মাইনাসে কি হয়?
– প্লাস!
– ঠিক। দুলাভাইয়ের বেলাতেও তাই হবে। আপা, কালকে থেকে শুরু কর, আমি আগামি শুক্রবারে আবার আসব। দেখবা পুরা সুস্হ দুলাভাইয়ের সাথে চা কেমনে খাই! হা হা হা।
পরের শুক্রবার। শ্বশুরের চিকিৎসায় ” আক্কাস থেরাপির” এক সপ্তাহ। শ্বশুরের অবস্হা আরও খারাপ হয়েছে। কাশির সাথে জ্বর আর পেট খারাপও হয়ে গেছে। গলা ব্যাথায় লোকটা কথাই বলতে পারছে না।কিন্ত আমার শ্বাশুরী আক্কাস মামা না আসলে কিছুই করবেন না।
– কি হইছে, আপা? দুলাভাইয়ের কি হইছে?
– দেখনা, তুলসি পাতার রসও তো কাজ করতেছে না।
– বুজছি, দুলাভাইয়ের চিকিৎসায় চেন্জ করা লাগবে।
– কি করব?
– কুছ পড়োয়া নেহি। শোন, একমুঠ কালোজিরা নিবা, সেটারে ভাল করে বাটবা। বাটা কালোজিরার সাথে এক চামচ মধু, একটা শুকনা মরিচ আর একটু লেবুর রস মিশাইয়া সকালে আর রাতে খাওয়াবা। জ্বর, কাশি সব বাপ্ বাপ্ কইরা পালাইব। হা হা হা।
নতুন আক্কাস থেরাপি মেজাজ খারাপ করে দিচ্ছিল কিন্ত শ্বাশুরী তার “পীরের” কথার বাইরে কিছুই শুনবেন না। সেদিন রাত থেকেই থেরাপি শুরু হয়ে গেল। দুইদিন পরেই শ্বাশুরী কাঁদতে কাঁদতে ফোন করলেন, শ্বশুর সেন্সলেস হয়ে গেছেন। আমরা হাসপাতালে নিয়ে আসতেই ডাক্তার বললেন, গ্লুকোজ লেভেল অস্বাভাবিক বেড়ে গেছে, ইলেক্ট্রোলাইট ইমব্যালান্স, রোগী কোমায় চলে গেছে। আইসিইউতে রাখলেও তেমন কিছু করার নেই এখন, সব ভাগ্যের উপর। বউ- শ্বাশুরী দুইজনেই কান্নাকাটি করছে। এইসময় আবার আক্কাস মামা আসলেন হসপিটালে।
– কি হইছে, আপা? দুলাভাইয়ের কি হইছে?
– ডাক্তাররা আশা ছেড়ে দিছেন। কাঁদতে কাঁদতে শ্বাশুরী বললেন।
– কুছ পড়োয়া নেহি। আমি ট্রাক খবর দিয়ে রাখছি, বললেই চলে আসবে। কবরস্হানে একটা ভাল জায়গায় কবর খোড়ার ব্যবস্হা করতেছি। লাশ দাফন যত তাড়াতাড়ি করা যায় ততই ভাল!