‘আকাশ তীরে আপন সুর’
|পর্ব ১০(শেষাংশ)|
লাবিবা ওয়াহিদ
নির্মল ফিরলো পরেরদিন। নুহাশ সাহেব এদিকে সিদ্ধান্ত নিয়ে ফেলেছেন প্রণয়ার বিয়ে দিবেন। এ কথা শোনার পর থেকে প্রণয়ার খাওয়া-দাওয়া প্রায় বন্ধ। সারাক্ষণ সে কান্নাই করে যাচ্ছে। সে বিয়ে করবে না, ফাহিমাকে বারবার বলেছে বাবাকে বোঝাতে। কিন্তু ফাহিমা মেয়েকে এই পর্যায়ে বিয়ের ব্যাপারে বোঝাতে লাগলেন। তাঁর নিজেরও মনে হয় না নুহাশ সাহেব ভুল সিদ্ধান্ত নিয়েছেন। বরং মেয়েকে বাঁচাতে এর চাইতে ভালো উপায় হতেই পারে না।
কান্নারত প্রণয়া উঠোনে দাঁড়িয়ে ছিল। মজিব হাতে রাইফেল নিয়ে প্রণয়াকে কঠিন নজরদারিতে রেখেছে। নির্মল প্রণয়াকে দেখে এগিয়ে আসে। প্রণয়া নির্মলকে দেখে যেন প্রাণ ফিরে পেলো। সে আড়ালে চোখ-মুখ ভালো করে মুছে নেয়। নির্মল প্রণয়াকে দেখে বলল,
–“আজ ভার্সিটি যাননি?”
প্রণয়া নাক টেনে নেতিবাচক মাথা নাড়ায়। প্রণয়াকে চুপসে যেতে দেখে নির্মল অবাক হলো। কিছু কী হয়েছে? নির্মল প্রশ্ন মনে দমিয়ে রাখল না। অস্থিরচিত্তে প্রশ্ন করলো,
–“কী হয়েছে প্রণয়া? সব ঠিক আছে তো?”
প্রণয়া এবার মাথা তুলে তাকায়। তার ফোলা চেহারা দেখে নির্মল ঘাবড়ে যায়। প্রণয়া নাক টেনে গলায় সামান্য ভয়-ডর ছাড়াই বলল,
–“আপনি যদি কখনো জানেন আমি আপনাকে ভালোবেসে ফেলেছি, সেটা আপনি কীভাবে নিবেন নির্মল সাহেব?”
নির্মলকে নির্বাক হওয়ার জন্য বুঝি এই কথাগুলোই যথেষ্ট ছিল। নির্মল একই স্থানে শক্ত হয়ে দাঁড়িয়ে চেয়ে থাকে প্রণয়ার দিকে। নির্মল অস্ফুট স্বরে বলল,
–“এটা কী করে সম্ভব?”
–“মন-ভালোবাসার ওপর কোনো মানুষের হাত থাকে না।”
–“ভালোবাসা হওয়ার আগেই সেটা নিয়ন্ত্রণ করার সাধ্যি মানুষের আছে।”
প্রণয়া হাসল এ কথা শুনে।
–“এর মানে আমাকে এড়িয়ে যেতে চাচ্ছেন?”
–“তুমি যা বলছ তা শুনে এড়িয়ে যাওয়াটাই যে স্বাভাবিক, প্রণয়া।”
নির্মল নিজের অজান্তেই “তুমি” সম্বোধনে চলে এসেছে। যা শুনে প্রণয়া আবারও হাসলো।
–“আমি তো ভুল কিছু বলিনি। আমাকে ভালোবাসলে কী হয়? আমি কী এতই খারাপ?”
–“তুমি আমার ধরা-ছোয়ার বাইরের একজন। যাকে নিয়ে কখনো কিছু ভাবিইনি তাকে কীভাবে ভালোবাসা সম্ভব?”
–“কেন সম্ভব হতে পারে না?”
নির্মল চুপসে যায় কিছুক্ষণের জন্য। ফোঁস করে নিঃশ্বাস ফেলে বলল,
–“তোমাকে ভালোবাসা মানে নুহাশ চাচার বিশ্বাস ভাঙা। যে আমার বিপদে পাশে দাঁড়িয়েছে তার বিশ্বাস ভঙ্গ আমি কী করে করি?”
প্রণয়ার অধর থেকে হাসি সরলো না। সে হঠাৎ বলল,
–“আমার বিয়ে হতে যাচ্ছে নির্মল সাহেব। আর আপনাকে জ্বালাতন করব না।”
নির্মল চোখ তুলে তাকালো প্রণয়ার দিকে। প্রণয়ার বলা কথাগুলো কেন যেন বুকের বা পাশটায় দমকা ধাক্কা দিল। প্রণয়া চলে যেতে নিলেও থেমে যায়। পিছে ফিরে বলল,
–“আপনি মিথ্যা বলতে কাঁচা নির্মল সাহেব। আপনার চোখ জোড়া আপনার গোপন কথা ফাঁস করে দিয়েছে। আপনার চোখের সামনেই আমি আরেকজনের বউ হবো, চ্যালেঞ্জ করে গেলাম।”
প্রণয়া হনহন করে চলে গেল ভেতরে। আর নির্মল সেখানেই স্থির হয়ে দাঁড়িয়ে রইলো। আহত চোখে চেয়ে রইলো প্রণয়ার যাওয়ার পানে। তার এত বুক ফাটছে কেন? সেও কী তবে নিজের অজান্তে আবেগে পা দিয়ে ফেলল? দিলেই বা কী? প্রণয়া এবং তার মধ্যে বিস্তর ফারাক। স্ট্যাটাস, টাকা-পয়সা সব দিক থেকেই। প্রণয়ার মতো আদরের দুলালীকে সে কোন মুখে নিজের ভাঙা ঘরের জন্য চাইবে? সেই মুখ নির্মলের না কখনো ছিল, আর না এখন আছে।
নির্মল এক সপ্তাহের মাঝেই নুহাশ সাহেবের বাজারের কাছাকাছি যেই জমিটা ছিল সেটার সব কাগজ-পত্র ঠিক রেখে বায়না করার পরপর কিনে নেয়। ওই জমিটাও চা বাগানের মাঝামাঝিতে। জমিতে একটা ভাঙাচোরা ঘর আছে। সেটাকে ভেঙে সুন্দর মতন টিনের দুই রুম হয়ে যাবে। নির্মল পরিকল্পনা মাফিক সব গুছিয়ে ফেলে। টাকা এখনো হাতে ভালো রকমই আছে। সেটা দিয়ে টিনসেট ঘর তোলা অসম্ভব হবে না। তাই চিন্তা করল তিন-চার মাস পরেই সে এখানে বাড়ির কাজটা ধরে ফেলবে।
জমির জন্য দৌড়-ঝাপের মাঝে প্রণয়াকে সে একদিনও দেখেনি। প্রণয়া যেন তার থেকে পালিয়ে বেড়াচ্ছে। একে তো প্রণয়া ওরকম এক বিদঘুটে চ্যালেঞ্জ করে গেছে তার উপর সেদিন থেকেই নজর সীমানায় বাইরে রয়েছে। নির্মল যেন ভেতরে ভেতরে কেমন অস্থিরতায় ভুগছে।
নুহাশ সাহেব অনেকদিন যাবৎ একটা চিন্তা-ভাবনায় আছেন। সেটা এখনো কারো কাছে প্রকাশ করেননি, আবার করারও সৎ সুযোগ তিনি পাচ্ছেন না। এই সিদ্ধান্তটা তার নিজেরই। প্রণয়ার বিয়ে সম্পর্কে। এজন্য সে একদিন দাওয়াত করল নির্মল এবং নীলুফাকে তাদের বাড়ি। সেই দাওয়াতে এতদিন গা ঢেকে থাকা প্রণয়ার না চাইতেও নির্মলের সামনে আসতে হয়। প্রণয়াকে দেখে নির্মল যেন স্বস্তি পায়।
প্রণয়া আড়াল থেকে প্রতিদিনই নির্মলকে দেখেছে, যা নির্মল ধরতে পারেনি। প্রণয়া অনেকটা ইচ্ছাকৃতই এই কাজগুলো করেছে যাতে নির্মল তার ভেতরকার অনুভূতি বোঝার সময় পায়। একা প্রণয়া আর কত পাগলামি করবে? এবার নাহয় নির্মল বুঝুক, প্রণয়ে বিরহের ব্যথা।
সবাই একই সাথে খাবার খেতে বসল। প্রণয়া নিজ থেকে নির্মলের পাতে খাবার দেয়। নির্মল প্রণয়ার দিকে তাকাতেই প্রণয়া যেন চোখের ভাষায় বোঝালো,
–“একদিন এভাবে ভালোবাসায় ঋনি করে দিয়েছিলেন। আজ আমি ঋন মিটিয়ে দিলাম, শোধবোধ।”
খাওয়া-দাওয়ার পর্ব সারতেই নুহাশ সাহেব নির্মল এবং নীলুফাকে নিয়ে বাইরে বসলেন। স্বভাবসুলভ দাঁত খুঁচিয়ে নুহাশ সাহেব গলা খাঁকারি দিলেন। পরপর নীলুফারের উদ্দেশে বললেন,
–“ভাবী, আপনি অনুমতি দিলে একটা কথা বলতাম।”
–“এভাবে বলে লজ্জা দিবেন না ভাইজান। কী বলতে চান বলুন, অনুমতির কী আছে?”
ফাহিমা প্রণয়াকে নিয়ে আড়ালে দাঁড়িয়ে আছেন। প্রণয়া চলে যেতে চেয়েছিল কয়েকবার, কিন্তু ফাহিমা তাকে জোর করে থামিয়ে রেখেছেন। ফাহিমা হয়তো আন্দাজ করতে পারছেন নুহাশ সাহেব কী বলতে চাইছেন। এজন্য ফাহিমা প্রণয়াকেও সঙ্গে ধরে রেখেছেন।
নুহাশ সাহেব কিছুটা ইতঃস্তত হয়ে বললেন,
–“দেখেন, আপা। আমি নির্মলকে কখনো নিজের ছেলের চাইতে কম ভাবিনি। তাই এই বিপদে হয়তো নির্মলই আমায় সমাধান দিতে পারবে।”
–“কিসের সমাধান ভাই? বুঝলাম না।”
–“জানি আমি নিয়মের বাইরে চলে যাচ্ছি, তবুও বলছি.. আপনার আপত্তি না থাকলে নির্মলের সাথে আমি প্রণয়ার বিয়ে দিতে চাচ্ছি।”
এ কথা শুনে নির্মল, নীলুফা উভয়েই বিস্মিত। প্রণয়াও তার জায়গায় স্থির হয়ে যায় বাবার মুখে এমন এক কথা শুনে। সে কী স্বপ্ন দেখছে? নীলুফা অস্ফুট স্বরে বললেন,
–“কিন্তু ভাই..”
–“আমি আপনাদের আর্থিক পরিস্থিতি নিয়ে চিন্তিত নই ভাবী। এমন নির্মল লাখে একটা। নির্মলকে যতবারই দেখি ওর বাবার প্রতিচ্ছবি দেখতে পেতাম। এছাড়াও সে যথেষ্ট দায়িত্বশীল একজন ছেলে। একজন বাবা তার মেয়ের ভালোর জন্য সব করতে পারে। আপনাদের মতো করে ভালো আমার মেয়েকে কেউ রাখতে পারবে না। ভালোবাসার মতো সুখ অন্যের কাছে পাইনি আমি, যতটা আপনাদের দেখে পাই। আমাকে খালি হাতে ফিরিয়ে দিবেন না ভাবী। আমার একমাত্র মেয়েকে নির্মলের হাতে তুলে দিয়ে নির্ভার হতে চাই।”
নীলুফা বললেন,
–“প্রণয়া মা আমার ঘরে নির্মলের বউ হয়ে আসবে এটা আমার জন্য পরম সৌভাগ্যের ব্যাপার ভাইজান। আমার এতে আপত্তি নেই, তবে বিয়ে যেহেতু ছেলে-মেয়ের, তাদের মত আছে কি না সেটা জেনে নিন। প্রণয়া কী আমার ছোটো ভিটেতে থাকতে পারবে?”
ফাহিমা এই পর্যায়ে বেরিয়ে এলেন। হাসি-মুখে বললেন,
–“সেসব নিয়ে চিন্তা করবেন না আপা। আমার মেয়েটা বরাবরই ভালোবাসার কাঙাল। কেউ তাকে একটু ভালোবাসা দিলে সে সব পরিস্থিতিতে তাদের ঢাল হয়ে যায়। নির্মল বাবা, তুমি রাজি তো?”
নির্মল এতে বেশি কিছু বলল না। শুধু বলল,
–“জি চাচী। আপনাদের সিদ্ধান্ত আমার ভালোর জন্যই।”
নুহাশ সাহেব স্ব-গলায় “আলহামদুলিল্লাহ” বলে উঠলেন। প্রণয়া বহুদিন পর ভেতরে প্রশান্তি অনুভব করল। খুব খুশি সে, খুব। আল্লাহ’র নিকট বুকভরে শুকুরিয়া জ্ঞাপন করল।
বিয়ে এক সপ্তাহ পর। ঘরোয়া ভাবেই বিয়েটা সম্পন্ন হবে, কোনোরকম আয়োজন ছাড়াই। নির্মল বলেছে প্রণয়াকে সে এক কাপড়েই ঘরে তুলতে চায়। প্রণয়ার নিজেই অমূল্য রত্ন, যাকে নুহাশ সাহেব তার হাতে তুলে দিচ্ছেন। এর চাইতে বেশি কিছু নির্মলের চাওয়া নেই। একটি সুতাও সে প্রণয়ার সঙ্গে নিতে রাজি নয়। দেনমোহরের ব্যাপারেও নির্মল জানায়,
–“আমি আমার সামর্থ্য অনুসারে দেনমোহর নির্ধারণ করতে চাই চাচা।”
নুহাশ সাহেব রাজি হলেন। নির্মল যেন মুগ্ধতায় আটকে ফেলেছে তাঁকে। কী বিচক্ষণ বুদ্ধির প্রমাণ দিচ্ছে সে। প্রণয়া আসলেই বিয়েতে অমত করেনি। সে নীরবে শুধু সবটা মেনে নিয়েছে।
বিয়ের আগে নুহাশ সাহেব আনোয়ারের পাট চুকিয়ে নিলেন। কঠিন মামলা দিয়েছেন আনোয়ারকে। এছাড়া ওসি নুহাশ সাহেবের পরিচিত। তাই তাকে ভালো ভাবেই বললেন যাতে করে আনোয়ার সহজে জেল থেকে ছাড়া না পায়।
বিয়ের আগেরদিন ঘরোয়া ভাবে কয়েকজন মিলে প্রণয়ার গায়ে হলুদ ছুঁইয়ে দেয়। পিয়াসাও এসেছে প্রণয়ার হলুদে। পিয়াসা মিষ্টি হেসে বলল,
–“যাক, অবশেষে নির্মল দাদার বউ হতে চলেছ তুমি!”
প্রণয়া হাসলো। হেসে বলল,
–“ভাগ্যিস তুমি সেদিন এসে জাদুকর সাহেবকে সব বলে দিতে বললে। না মানলে রাগও দেখাতে বললে। জায়গামতো লেগে গিয়েছে তোমার বুদ্ধি। আর মাঝখান দিয়ে বাবাও সবটা গুছিয়ে দিলেন।”
–“ভাগ্য তোমাদের একসঙ্গে জুড়ে ছিল বলেই এমনটা হয়েছে প্রণয়া। সেসব কথা ছাড়ো, তোমায় হলুদ মাখাই আসো!”
বিয়েটা খুব সুন্দর, সাদা-মাটা ভাবে হয়ে যায়। প্লাবন তো সেই খুশি নির্মলকে দুলাভাই হিসেবে পেয়ে। সে একাই সবাইকে বলে বেড়াচ্ছে,
–“নির্মল ভাইয়া আমার দুলাভাই, আমাকে রোজ চিপস খাওয়াবে। আমার সাথে খেলবে, ঘুরতে নিয়ে যাবে, কী মজা!”
———————-
নির্মলের ঘরে বউ সেজে বসে আছে প্রণয়া। বিয়ে উপলক্ষ্যে নির্মল বেশ কিছু ফার্ণিচার কিনে ঘর ভরে ফেলেছে। যাতে করে বউ এসে খালি ঘর না দেখে। প্রণয়া হেসে ফেলে নির্মলের এই কাজে। প্রণয়া একমনে চেয়ে রইলো হাত জুড়ে থাকা মেহেদীর দিকে। এই মেহেদী একমাত্র নির্মলের নামে।
এমন সময়ই নির্মল ঘরে প্রবেশ করে। প্রণয়া নড়েচড়ে বসল। নির্মল নিঃশব্দে গিয়ে প্রণয়ার পাশে বসল। স্ত্রী রূপে প্রণয়ার দিকে মুগ্ধ চোখে চেয়ে আওড়াল,
–“চ্যালেঞ্জ দিয়ে কী লাভ হলো? বউ তো শেষমেষ আমারই হলে। চ্যালেঞ্জ করে হেরে গেলে।”
প্রণয়া লজ্জায় আড়ষ্ট হয়ে রইলো। মুখ ফুটে কিছু বলতে চেয়েও বলল না। নির্মল একটা স্বর্ণের আংটি বের করল। প্রণয়ার হাত ছুঁয়ে নিজের হাতে আগলে সেটা তার অনামিকায় পরিয়ে দিল। প্রণয়া নির্মলের স্পর্শ পেল এই প্রথম। প্রথম স্পর্শে সে কিছুটা শিউরে উঠল। প্রণয়ার কেঁপে ওঠা নির্মল টের পেয়ে আলতো হেসে বলল,
–“আমার সামান্য হাত ধরায় এমন লজ্জা, ভালোবাসি বলতে গিয়ে লজ্জা করেনি?”
প্রণয়া মাথা নিচু করে গলা খাদে নামিয়ে বলল,
–“আমি তো তাও বলেছি, আপনি তো বলেননি।”
–“বলতে হবে?”
প্রণয়া জবাব দিল না। এর মাঝে হুট করে কারেন্ট চলে গেল। ঘর এবার ঘুটঘুটে অন্ধকার হয়ে গেল। প্রণয়া চমকে এদিক ওদিক তাকাতেই গালে উষ্ণ স্পর্শ পেল। পরপর কপালেও সেই একই স্পর্শ। প্রণয়া নিঃশ্বাস বন্ধ করে শক্ত হয়ে বসে রইলো। নড়াচড়ার শক্তিটুকু সে হারিয়ে ফেলেছে যেন। কানের কাছে উষ্ণ নিঃশ্বাস পড়তেই প্রণয়ার পিলে চমকে ওঠে। থরথর করে কম্পিত প্রণয়া সরে যেতে চাইলে নির্মল তাকে টেনে একই জায়গায় বসিয়ে দেয়। নির্মল ঘোরের মধ্যে আওড়াল,
–“ভালোবাসি তোমাকে, বউ। জানা নেই কীভাবে, কবে তোমাতে হৃদয় হারিয়ে বসলাম। তবে আমার সবটা জুড়ে শুধু তুমি-ই আছ, থাকবে। তোমাকে ঘিরে আমার সুন্দর জীবনের সূচনা হলো। আগলে রেখো আমাকে।”
বেশ কিছুটা সময় কেটে যায় তাদের ঘনিষ্ঠ অবস্থায়। তখনো কারেন্টের দেখা নেই। প্রণয়া এবার মুখ খুলল,
–“শুনুন?”
–“শুনছি, প্রণয়া।”
–“পাটি আছে?”
–“আছে, কেন?”
–“লাগবে।”
–“এখনই?”
–“হুঁ।”
প্রণয়া পাটি নিয়ে বাইরের উঠোনে এলো। এখন গভীর রাত। বাইরে বেশ ঠান্ডা হাওয়া বইছে। প্রণয়া উঠোনে পাটিটা বিছিয়ে দিল। নির্মল ফোনের ফ্ল্যাশ জ্বালিয়ে কিছুটা দূরেই দাঁড়িয়ে আছে। সে এখনো ধরতে পারছে না, প্রণয়া ঠিক কী করতে চাইছে? প্রশ্নও করেনি সে, প্রণয়াকে নিজ ইচ্ছেতে ছেড়ে দেয়। প্রণয়া পাটিতে বসে বলল,
–“আসুন।”
নির্মল পাটিতে গিয়ে বসল। প্রণয়া আকাশের পানে চেয়ে পাটিতে সোজা হয়ে শুয়ে পড়ল। নির্মলও তাকে অনুসরণ করল। প্রণয়া দেখছে আকাশ আর নির্মল দেখছে প্রণয়াকে। তা বুঝতে পেরে প্রণয়া বলল,
–“চাঁদের দিকে তাকান। মস্ত বড়ো চাঁদ উঠেছে আকাশে, কত কাছাকাছি লাগছে।”
নির্মল ভ্রু কুচকে বলল,
–“তাই তো দেখছি।”
–“আমার দিকে তাকিয়ে থাকতে তো বলিনি, বলেছি আকাশের চাঁদ দেখতে।”
–“আকাশের চাঁদ তো অনেক দেখেছি, এবার আমার ঘরের চাঁদকে দেখতে দাও।”
এ কথায় প্রণয়া লজ্জা পেল। প্রসঙ্গ বদলে বলল,
–“আমাদের দেখা কিন্তু এই আলো-আঁধারিতেই হয়েছিল, মনে আছে?”
–“হুঁ, প্রথম দেখাতেই আমাকে চোর বানিয়ে দিয়েছিলে। ভুলব কেমন করে?”
নির্মলের কথায় প্রণয়া হেসে ফেলল।
–“চোর তো আপনি অবশ্যই। প্রণয়াকে তার নিজের থেকে চুরি করেছেন।”
–“কিছু চুরি যদি ভালো থাকার কারণ হয় তাহলে আমি চোর-ই ভালো। তোমায় চুরি করেছি বলেই তো আজ তুমি আমার পাশে।”
–“আপনি কী জানেন, আপনি প্রণয়ার ‘জাদুকর সাহেব’?”
নির্মল গভীর নজরে তাকাল প্রণয়ার দিকে। প্রণয়া সেই নজরে নজর মেলাতে পারল না। আকাশ পানে নজর ঘুরালো। কিছুক্ষণ অতিবাহিত হতেই প্রণয়া আনমনে বলল,
–“আপনি গান জানেন?”
–“হুঁ, শুনতে চাও?”
প্রণয়া মাথা নাড়ায়। নির্মল এক হাতে প্রণয়াকে আগলে নিয়ে আকাশের তীরে চেয়ে আপন সুরে গান ধরলো,
“জীবন এত সুখের হলো
আমার পাশে, তুমি আছ তাই
এক জীবনে, এর চেয়ে বেশি
আমার যে আর চাওয়ার কিছু নাই।
তোমার আমার ভালোবাসা শেষ হওয়ার নয়
শুধু তোমায় কাছে চায় এ-ই হৃদয়।
ওগো তোমায় নিয়ে আমি পাড়ি দিয়ে
যেতে চাই সুখের-ই দেশে হারিয়ে।”
—সমাপ্ত।