‘আকাশ তীরে আপন সুর’
|পর্ব ০৮|
লাবিবা ওয়াহিদ
নীলুফার সময়গুলো কাটে প্রায় একা একাই। শুয়ে, বসে, হাঁটা-চলা করে, ফাহিমার সাথে এভাবেই। বাসার সামনে হাঁটার জন্য জায়গা আছে। এখানে পায়চারী করলেই মন ফুরফুরে হয়ে যায়। তবুও এই একাকিত্বে স্বামী, সন্তানকে খুব মনে পড়ে। না চাইতেও আনমনে স্মৃতিচারণ করতে শুরু করে দেয় অতীত জীবনের। সোনালি দিনগুলো ভাবতে গিয়ে আপনমনেই হেসে উঠেন তিনি। নিজের সেই বাড়ি, সংসার সব তার মাথায় নাড়া দিয়ে ওঠে। সারাজীবন এক জায়গায় কাটিয়ে জায়গা বদলে তিনি খুব একটা খুশি হয়েছেন তেমনটাও নয়। অধিকাংশ নারীরাই চায় তার শেষ জীবনটা ভালোবাসার মানুষটার স্মৃতি নিয়ে তার বাড়িতে কাটাতে। তেমন চাওয়াটা নীলুফারও ছিল কিন্তু ভাগ্য তাঁর সহায় ছিল না।
নীলুফার চুলোয় রান্না বসিয়ে আনমনেই ভাবছিলেন সেসব। হঠাৎ পেছন থেকে মেয়েলি গলা শুনে পেছন ফিরে তাকাল। প্রণয়া দাঁড়িয়ে আছে রান্নাঘরের দরজায়। তাকে দেখে নীলুফার মুখের হাসি চওড়া হলো।
–“আরে, প্রণয়া মা। এসো এসো।”
প্রণয়া ত্রস্ত পায়ে ভেতরে আসল। চুলোর কাছে-পিঠেই আরেকটা মোড়া ছিল। সেটা নিজের পাশে রেখে প্রণয়াকে বসতে ইশারা করলেন। প্রণয়াও হেসে বসে পড়ল। সময়টা এখন দুপুর।
প্রণয়া বসতে বসতে বলল,
–“প্রায় একাই থাকেন এখানে, তাই ভাবলাম আপনাকে একটু সময় দেওয়া যায়।”
নীলুফা হাসল। কড়াইয়ে খুন্তি নেড়ে বললেন,
–“ভালো করেছ। আসবে, তুমি আসলে খুব ভালো লাগবে আমার। কী খাবে বলো? দুপুরে আমাদের সাথে ভাত খাবে কেমন?”
প্রণয়া চোখ বড়ো করে বলল,
–“আরে না, না আন্টি। আমি খেয়েই এসেছি। আর কিছু খাব না।”
–“এ আবার কেমন কথা? এসেছ, আর বলছ খাবে না?”
নীলুফা জোরাজুরি করতে লাগল। আর প্রণয়া বেকায়দায় পড়ে যায়৷ তবুও নীলুফাকে কিছু একটা বুঝ দিয়ে রাজি করায়।
প্রণয়া মিনমিন গলায় বলল,
–“নির্মল ভাইয়া কী দুপুরে বাসায় আসে?”
“ভাইয়া” সম্বোধন করা প্রণয়ার জন্য কিছুটা কষ্টসাধ্য। কিন্তু তবুও, নির্মল তার থেকে বয়সে অনেকটা বড়ো। চাইলেও তাকে নাম ধরে ডাকাটা ভালো দেখাবে না। এজন্য বুকে পাথর চেপেই এই শব্দটা উচ্চারণ করতে হয়েছে তাকে।
নীলুফা বললেন,
–“হ্যাঁ, তবে মাঝেমধ্যে আসতে পারে না। নুহাশ ভাইয়ের সাথেই থেকে যায়।”
প্রণয়া উত্তরে “ওহ” বলল। সে আরও কিছুক্ষণ সময় কাটালো নীলুফার সাথে। নীলুফা মানুষটার সাথে বেশ সহজেই মিশে গেছে প্রণয়া। প্রণয়া মোটেও মিশুক নয়। একা থাকার দরুন প্রথম প্রথম কারো সাথেই সে মিশতে পারে না। তার কিছুটা সময়ের প্রয়োজন হয়। নীলুফারা এসেছে প্রায় মাস দুয়েক হয়ে গিয়েছে। তাই মেশাটা কঠিনও ছিল না।
বিকালে প্রণয়া যখন উঠোনে পায়চারী করছিল তখনই নির্মল আসে। প্রণয়া ঘাড় বাঁকিয়ে নির্মলের দিকে তাকালো। আজ নির্মল দুপুরে খেতে আসেনি। এটা সে নজরে রেখেছিল বলেই বুঝতে পেরেছে। নির্মল স্মিত হেসে বলল,
–“সবসময় কী আকাশ এবং চায়ের সঙ্গেই আলাপন করেন? আর কোনো এক্টিভিটিস নেই?”
প্রণয়া অবাক হলো নির্মলের কথায়। একই সাথে মনে করারও চেষ্টা করল, আর কোনো এক্টিভিটিস তার আছে কিনা? কিন্তু এই মুহূর্তে বলার মতো কিছুই খুঁজে পেল না। তাই মুখ ছোটো করে প্রণয়া বলল,
–“না।”
নির্মল শুনলো নীরবে। তাদের কথার মাঝেই কিছু পর্যটক এলো। মজিব আশেপাশে নেই। কাজে কোথাও গিয়েছে হয়তো। এবারে প্রায় সাত থেকে আটজন ভার্সিটির ছেলে-মেয়ে এসেছে এখানে ছবি তুলতে, চা বিলাস একটু ঘুরে বেড়াতে। পর্যটকরা বাড়ি দেখে প্রতিবারের মতোই প্রশংসা করলো এবং ছবি তুলল। তবে এবার ঘটনা ভিন্ন হলো।
একজন মেয়ে আসল নির্মলের সাথে ছবি তোলার পারমিশন চাইতে। তা দেখে প্রণয়ার মনে হলো কেউ যেন যত্নের সাথে তার গা জুড়ে সুঁচ বিঁধিয়ে দিচ্ছে। প্রণয়া নাক-মুখ ঘুচে গম্ভীর হয়ে মেয়েটাকে দেখে চলেছে। মেয়েটা দেখতে সুন্দর-ই বলা যায়। পরেছে রঙিন কূর্তি এবং ডেনিম জিন্স। রিবন্ডিং করা চুলগুলো পিঠময় ছড়িয়ে আছে, আবার চুলে গুঁজে রেখেছে রঙিন সানগ্লাস।
এরকম একটা মেয়ে নির্মলের সান্নিধ্যে এসেছে কোন সাহসে প্রণয়া সেটাই ভেবে পাচ্ছে না। অবশ্য নির্মল হাসি-মুখেই ছবি তুলতে বারণ করে দিলো। মেয়েটাকে এতে নিরাশ হতে দেখা যায়, আর প্রণয়াকে খুশি। মেয়েটার বন্ধুমহল থেকে একটা ছেলে চা বিলাস সম্পর্কে জানতে চাইলো। নির্মল যতটুকু জানে তা স্পষ্ট ভাষায় বর্ণনা করল। এভাবে কিছুটা ভাব হয়ে যায় তাদের সাথে নির্মলের। প্রণয়া মুখ বাঁকিয়ে মিনমিন করে বলল,
–“আবারও কথার জাদু প্রয়োগ করছে মানুষের উপর।”
নির্মল এবার তাকাল প্রণয়ার দিকে। প্রণয়ার অস্পষ্ট কথা শুনতে পায়নি বলেই তাকিয়েছে। প্রণয়াও কিছুটা চমকে ওঠে নির্মলের তাকানো দেখে, ভুলবশত কিছু শুনে ফেলেনি তো? নির্মল বলল,
–“কিছু বললেন?”
প্রণয়া ঘনঘন মাথা নাড়ায়। অর্থাৎ কিছু বলেনি।
নির্মল ওদের সাথে কথায় ব্যস্ত থাকা অবস্থায় কীভাবে প্রণয়াকেও খেয়াল করল ভাবতেই প্রণয়ার অবাক লাগছে। নির্মলের পাশের মেয়েকে যেন এতক্ষণে খেয়াল করল সবাই। প্রণয়া পেছন দিক ফিরে নিজেকে প্রায় আপাদমস্তক শাল দিয়ে আবৃত করে রেখেছে। তাই বোঝার সাধ্য নেই যে সে অল্প বয়সী মেয়ে। প্রণয়াকে লক্ষ্য করে একজন ছেলে নির্মলের উদ্দেশে বলল,
–“ভাই কী এখানে দাঁড়িয়ে প্রেম করছিলেন নাকি? মনে হচ্ছে ভুল সময়ে এসে পড়লাম।”
এ কথা শুনে তাদের মধ্যে একজন মেয়ে মুগ্ধ গলায় বলল,
–“হায়, চা বিলাসে প্রেম। ব্যাপারটা কত সুন্দর।”
নির্মল হেসে তাদের ভুল ভাঙাতে বলল,
–“তেমন কিছু নয়। আমাদের মধ্যে প্রেমের কোনো সম্পর্ক নেই।”
প্রণয়া ওদের কথা শুনে ভালো লাগায় এক মুহূর্তের জন্যে আকাশে উড়ে বেড়াচ্ছিল। পরমুহূর্তেই আবার নির্মলের কথা শুনে ধপ করে জমিনে এসে পড়ল। মুখটা মলিন করে চা বাগানের দিকে মুখ করে দাঁড়িয়ে রইলো। শুধু শুধুই স্বপ্নে ভাসছিল সে। তবুও, কিছু স্বপ্ন স্বস্তির, ভালো লাগার। ভালো লাগার স্বপ্নে কে না ভাসতে চাইবে?
ওরা বেশিক্ষণ দাঁড়ায়নি। যাওয়ার আগে সেই ছবি তুলতে চাওয়া মেয়েটা নির্মলের কাছে ফেসবুক আইডি বা মোবাইল নম্বর চেয়ে বসলো। প্রণয়া তখন নাক কুঁচকে তাকায় নির্লজ্জ মেয়েটার দিকে। কী পরিমাণের নির্লজ্জ হলে অল্প সময়ের পরিচিত ছেলের থেকে এভাবে নাম্বার চায়?
বিরক্তি ধরে রাখতে না পেয়ে প্রণয়া এতক্ষণে মুখ খুলল,
–“আমরা সাধা-সিধে পাহাড়ি মানুষজন। আমাদের এখানে কোনো মেয়ের, ছেলেদের থেকে নাম্বার চাওয়াটা ভালো চোখে দেখে না। তাই আপনার এই নাম্বার চাওয়াটাও আমি ভালো চোখে দেখছি না। চা বিলাস ঘুরেছেন, ছবি তুলেছেন, এবার আসতে পারেন!”
ছেলে-মেয়েগুলো একে অপরের দিকে চাওয়া-চাওয়ি করল। নির্মলও নির্বাক হয়ে চেয়ে রইলো প্রণয়ার দিকে। প্রণয়া প্রত্যেকের নজর অবজ্ঞা করে অন্যদিকে ফিরে তাকালো। সেই মেয়েটা কিছুটা লজ্জিত হলো বোধ হয়। নির্মলকে “দুঃখিত” প্রকাশ করে বন্ধুমহল মিলে চা বিলাস প্রস্থান করলো। নির্মল তাদের থেকে নজর ঘুরিয়ে প্রণয়ার দিকে তাকালো।
ফিচেল হেসে বলল,
–“প্লাবন বলেছিল আপনার মধ্যে চাপা রাগ এবং বিরক্তি ছাড়া অন্য কোনো রূপ সে দেখেনি। প্রথমে বিশ্বাস করতে চাইতাম না, আজ নিজ চোখে দেখে বিশ্বাস হলো।”
–“কেন? বিরক্ত প্রকাশ করা পাপ নাকি?”
–“একদম না। নিজের ভালো-মন্দ অনুভূতিদের চেপে না রেখে প্রকাশ করা ভালো। নয়তো বুকের মধ্যে খসড়া কথার পাহাড় জমে যায়। তখন দমবন্ধকর, জটিল অবস্থা তৈরি হয়।”
প্রণয়ার বিরক্তি কেটে গেল। ফোঁস করে নিঃশ্বাস ফেলে বলল,
–“মেয়েটা অহেতুক বাড়াবাড়ি পর্যায়ে চলে গেছিল, আমার এই ধরণের গায়ে পড়া মেয়ে পছন্দ নয়।”
–“যার প্রকৃতির সাথে মধুর সম্পর্ক, তার কাছে এই ব্যাপারগুলো ভালো লাগবে না, স্বাভাবিক।”
প্রণয়া আহত অনুভব করলো নির্মলের কথায়। এর মানে কী প্রণয়া ওভাবে না বললে নির্মল সত্যি সত্যি তাকে নাম্বার দিয়ে দিত? বুক পোড়া অনুভূতির সাথে অভিমানী গলায় বলল,
–“আমি কী আপনাদের মধ্যে কাঁটা হয়ে গেলাম নাকি? আমি কিছু না বললে বুঝি নাম্বার দিয়ে দিতেন?”
প্রণয়ার কথায় নির্মল হেসে ফেলল। হাসি কোনো রকমে থামিয়ে বলল,
–“আমি এটা বুঝাইনি, প্রণয়া। সত্যি বলব?”
–“বলুন।”
–“আমারও এই ধাচের মেয়ে একদম পছন্দ নয়। থাকুন, আমি বাসায় যাই। একটু পর তো দেখা হচ্ছেই।”
প্রণয়া যেন প্রাণ ফিরে পেল। নির্মল চলে গেলেও অজস্র ভালো লাগায় প্রণয়া বুদ হয়ে রইলো। মোহ যেন কাটছেই না তার।
———————–
কিছুদিন পর নির্মল হুট করে এক বাদামী প্যাকেট ধরিয়ে দেয় প্রণয়ার হাতে। প্রণয়া প্যাকেট ধরেই বুঝল দারুণ ভারী সেটা। কৌতুহলী গলায় বলল,
–“কী আছে এতে?”
নির্মল মুচকি হেসে বলল,
–“কিছু উপন্যাসের বই। যার প্রকৃতির সাথে মিশে যাওয়ার ক্ষমতা আছে সে অনায়াসেই বইয়ের পাতায় মিশে যেতে পারবে।”
প্রণয়া লাজুক হেসে চটজলদি প্যাকেট খুলতে শুরু করে দেয়, উপন্যাসের বই তাও কি না নির্মলের দেওয়া উপহার? প্রণয়া শত আনন্দের ভীড়ে নির্মলকে ধন্যবাদ দিতে ভুলে যায়। নির্মল আবার বলল,
–“অবসর সময়গুলো বই পড়ে কাটাবেন নাহয়, একঘেয়েমি লাগবে না।”
নির্মল চলে আসতে নিলে প্রণয়া তাকে পিছুডাক দিলো। নির্মল পিছে ফিরে তাকাতেই প্রণয়া হেসে বলল,
–“ধন্যবাদ।”
নির্মল উত্তরে মুচকি হেসে চলে গেল। প্রণয়া বইয়ে চোখ বুলিয়ে আপনমনে বলল,
–“ধন্যবাদ, জাদুকর সাহেব। আপনাকে দেওয়া জাদুকর সাহেব নামটা ভুল দেইনি, আপনি আসলেই আমার মন ভালো করে দেওয়ার প্রেম জাদুকর।”
চলবে—