আকাশ তীরে আপন সুর পর্ব-০৬

0
456

#আকাশ_তীরে_আপন_সুর
|পর্ব ০৬|
লাবিবা ওয়াহিদ

দাওয়াতের দিনটা বেশ ভালো কাটছে নুহাশ সাহেবের। নীলুফার হাতের রান্নার পুরানো স্বাদ বহুদিন পর পেল। পোলাও, ঝাল ঝাল মুরগি ভুনা, সাতকড়া দিয়ে গরুর মাংস, এক পদের মাছ, চা, শুঁটকি, শিদল ভর্তা.. সব মিলিয়ে দুর্দান্ত আয়োজন। নুহাশ সাহেব বেশ ভোজন রসিক মানুষ৷ তিনি আঙুল চেটে খেলেন। খাওয়ার সময় রসিক স্বরে স্ত্রীকে বলছেন নীলুফার থেকে এটা ওটা শিখে নিতে৷ ফাহিমাও তাতে অভিমানী স্বরে উত্তর দিচ্ছে। ফাহিমার অভিমানী গলা শুনলে সবাই হেসে উঠছে।

এই হাসি-মজার মধ্যে শুধু দম আটকে যাওয়া পরিস্থিতি প্রণয়ার। নির্মলকে কোণা চোখে, আড়চোখে প্রায়ই লক্ষ করেছে। নির্মল যখনই প্রণয়ার কাছেপিঠে থাকছে, প্রণয়ার চেপে রাখা ভালো লাগার অনুভূতি সর্বাঙ্গ জড়িয়ে যাচ্ছে। সেই অনুভূতি নিয়ন্ত্রণহীন হলো নির্মল যখন নিজ উদ্যোগে তার পাতে পোলাও দিতে চেয়ে বলল,
–“পোলাও আরও দিব? ঝোল লাগবে?”

প্রণয়া তখন অপ্রস্তুত হয়ে যায়। ঘনঘন মাথা নাড়িয়ে বলল, “না, নিব না কিছু।”

নির্মল তাও এক চামচ পোলাও দিল, সঙ্গে ঝোল মাংস। প্রণয়ার মনে হলো নির্মল যেন ভালোবেসেই প্রণয়াকে এগুলো দিল। তার নিজ থেকে ভালোবাসা ফিরিয়ে দেওয়ার সাধ্যি প্রণয়ার নেই। বরং নির্মল সেই যত্ন, ভালোবাসা দিয়ে প্রণয়াকে নির্মল ঋনি করে দিলো নিজের অজান্তেই।

সেদিন দাওয়াতের পর্ব শেষ হলো আছরের আযানের সময়। নুহাশ সাহেব নির্মলের কাঁধ চাপড়ে ওদের বিদায় জানিয়ে নিজের বাড়িতে চলে আসেন। প্রণয়া তো বাড়ি ফিরেই নিজের রুমে চলে যায়। তার আগে হাত-মুখ ধুয়ে সোজা ঘুমিয়ে যায়। ঘুম ভাঙে তার খসখসে শব্দ শুনে। ভ্রু কুচকে পিটপিট করে চোখ মেলতেই দেখল প্লাবন চেয়ারে বসে আপেল কামড়ে খাচ্ছে। ঘরের লাইট জ্বালানো, আর নজর প্রণয়ার পানেই। প্রণয়া শোয়া ছেড়ে উঠে বসল। চোখ কচলাতে কচলাতে নিচু গলায় বলল,
–“লাইট জ্বালিয়ে কী করছিস এখানে?”

প্লাবন আপেল চিবুতে চিবুতে বলল,
–“মা বলল তোমাকে ডেকে তুলতে। কিন্তু তোমাকে দেখে ডাকতে ইচ্ছা হলো না, তাই বসে আছি।”

প্রণয়া আড়মোড়া ভেঙে প্লাবনের দিকে তাকাল। আগের মতোই গলা নামিয়ে বলল, “উদ্ধার করে দিছেন।”
প্লাবন দাঁত কেলালো।

কেটে যায় বেশ কিছুদিন। এর মাঝে প্রণয়ার সাথে অকল্পনীয় এক ব্যাপার ঘটে। সেদিন কলেজের জন্য প্রণয়া তৈরি হয়ে নাস্তা করতে বসেছিল। নুহাশ সাহেব খেতে খেতে হঠাৎ নীরবতা ভাঙলেন। বললেন,
–“আজ প্রণয়া নির্মলের সাথে কলেজ যাবে। আমার কিছু কাজ থাকায় তোমাকে এগিয়ে দিতে পারব না।”

এরকম একটা কথা শুনে প্রণয়ার গলা দিয়ে খাবার নামতে চাইলো না যেন। বহু কষ্টে খাবারটা গিলে বলল,
–“আমি তো প্রতিবারই একা যাই বাবা। তুমি যেতে না পারলে তো সমস্যা নেই। আর..”

প্রণয়ার কথার মাঝে ফোড়ন কাটলেন নুহাশ সাহেব। ভারী গলায় বললেন,
–“আমার কথাই শেষ। আগেরটা আগের হিসেব। এখন আমি না গেলেও তুমি নির্মলের সঙ্গেই যাওয়া আসা করবে। আজ কলেজ ছুটি হবে কখন, আমাকে জানিয়ে দিয়ো। আমি নির্মলকে পাঠিয়ে দিব।”

প্রণয়া বাকশক্তি হারিয়ে ফেলল। তটস্থ হয়ে ভাবতে লাগল সমস্ত ব্যাপারটা। এক মুহূর্তের জন্য ইচ্ছে করল আজ কলেজ যাবে না। কিন্তু তৈরি হওয়ার পর কলেজ না গেলে ব্যাপারটা কেমন দেখাবে না? উলটো নির্মলকেই উলোট পালোট সন্দেহ করতে পারে। মনের দোটানায় ফেঁসে একপ্রকার বাধ্য হয়েই রাজি হলো প্রণয়া।

নাস্তা সেরে বেরিয়ে আসতেই দেখল উঠোনের এক পাশে দাঁড়িয়ে আছে নির্মল। এক হাতে কাঠের বেড়ার একাংশ চেপে সে চেয়ে আছে চায়ের সাম্রাজ্যে। পিঠমুখী নির্মলকে দেখে প্রণয়া নিজের ভেতরে প্রজাপতির ডানা ঝাপটানোর শব্দ পাচ্ছে যেন। সিঁড়ির দুই ধাপ পার করে কিছুটা এগিয়ে প্রণয়া হালকা গলা খাঁকারি দিল, নিজের উপস্থিতি জানান দিতে। নির্মল পিছ ফিরে তাকাল। নেভি ব্লু শার্টে নির্মলকে দেখে প্রণয়া নজর সরিয়ে ফেলল। প্রণয়া মিনমিন করে বলল,
–“বাইরে দাঁড়িয়ে আছেন কেন? ভেতরে গিয়ে বসতে পারতেন। শুধু শুধু অপেক্ষা করালাম।”

নির্মল আলতো হেসে বলল,
–“তেমন কিছু না, আমি এখানেই ঠিক ছিলাম।”

নির্মল থামল। প্রণয়া কোণা চোখে আরেকবার দেখল নির্মলকে। নির্মল প্রণয়ার দিকে তাকাতেই প্রণয়া দ্রুত চোখ নামিয়ে ফেলল। নির্মল বুঝতেই পারল না প্রণয়া চেয়েছিল তার পানে। নির্মল বলল,
–“চলুন যাওয়া যাক।”

চা বাগানের আঁকাবাঁকা পথ মাড়িয়ে অবশেষে দুজন সরু, ইটের রাস্তায় এসে পৌঁছালো। ক্ষণিক সময় পরপর শা শা শব্দে কিংবা হর্ন বাজিয়ে যাচ্ছে কিছু অটো রিকশা বা অন্যান্য গাড়ি। প্রণয়া মেইন রাস্তায় আসতেই দেখল তাদের জন্য একটি অটো দাঁড়িয়ে আছে। তবে এটা দুই সিটের অটো রিকশা। নিশ্চয়ই নুহাশ সাহেব ঠিক করেছেন। প্রণয়া ত্রস্ত পায়ে অটোতে উঠে বসতেই দেখল নির্মল চালকের পাশে বসতে চাচ্ছে। তা দেখে প্রণয়া থামালো। মৃদু গলায় বলল,
–“পিছে সিট আছে। আমার পাশে বসতে পারেন।”

নিজের কথায় নিজেই চমকালো প্রণয়া। সে কী বলে ফেলল নির্মলকে? মুহূর্তেই গলা শুকিয়ে এলো তার। নির্মল হাসল। বলল,
–“আপনি-ই বসুন পিছে। আমি ঠিক আছি, প্রণয়া।”

নির্মলের গলায় নিজের নাম শুনে প্রণয়া মোমের মতো গলতে শুরু করল। তবুও নির্মলকে যেহেতু একবার বলেই ফেলেছে, জোর করা প্রয়োজন। প্রণয়া আবারও বলল,
–“প্লিজ। সামনে ভাঙা রাস্তা আছে, আপনার সমস্যা হবে। আসুন।”

নির্মল স্থির নজর রাখল প্রণয়ার পানে। যদিও প্রণয়া অন্যদিকে ফিরে বলেছে, তবুও ঢের অনুভব করতে পারল সেই দৃষ্টি। নির্মল মিনিট এক সময় নিয়ে প্রণয়ার পাশে গিয়ে বসল। সঙ্গে সঙ্গে দম যেন গলায় আটকে গেল৷ বুকে যেন কেউ হাতুড়ি পেটাচ্ছে। নির্মল উঠে বসতেই অটো চলতে লাগল আর প্রণয়া শক্তি হয়ে বসে রইলো। ফিরেও তাকাল না নির্মলের দিকে। নির্মলও চুপ। বেশ কিছুটা পথ পেরোতেই নির্মল জিজ্ঞেস করল,
–“আমি বসায় কোনো সমস্যা হচ্ছে না তো প্রণয়া?”

একরাশ ভালো লাগা, অস্বস্তিতে মোহিত হয়ে প্রণয়া বলল,
–“আমি ঠিক আছি, আপনি ব্যস্ত হবেন না।”

প্রণয়ার কথা ফলে যায়। বেশ অনেকটা পথ এগিয়ে পেরোতেই ভাঙা রাস্তার সম্মুখীন হলো। সে কী ভয়াবহ ঝাকুনি। এই পর্যায়ে দুজনই বেশ সতর্ক থেকেছে। তবে সবসময় সতর্কতা বজায় থাকলেও কিছু অসতর্কতার কাণ্ড ঘটে যায় অচিরেই। এই যেমন নির্মলের বাহুর সঙ্গে প্রণয়ার বাহু স্পর্শ করেছে কয়েকবার। এই অসহ্য অনুভূতি প্রণয়া কাকে বোঝাবে? সে নিজেকে বোঝাতেই যে অক্ষম।

স্বপ্নের মতো কেটে যায় পুরো দিন। ফেরার সময় প্রণয়া একজন রাখাইন মেয়ের সাথে আসছিল। মেয়েটার সাথে তার গাঢ় বন্ধুত্ব নেই, তবে ক্লাসমেট। তবে প্রণয়া জানে, এই মেয়েটা প্রেম করে। প্রায়ই একটি ছেলের সাথে ভার্সিটির আশেপাশে দেখা যায় তাকে। যেহেতু সে প্রেম করে, সেহেতু ইনিয়ে বিনিয়েও প্রণয়া নিজের কিছু প্রশ্নের উত্তর জেনে নিতে পারবে চিন্তা করল। এজন্য প্রণয়া সেই মেয়েটা অর্থাৎ পিয়াসাকে জিজ্ঞেস করল,
–“আচ্ছা, যদি কোনো ছেলেকে দেখলে নিজের মধ্যে অস্বাভাবিক অনুভূতি নাড়া দেয় তাকে কী ধরা হয়?”

পিয়াসা হাসল। প্রণয়ার দিকে অদ্ভুত চোখে চেয়ে মিটিমিটি হেসে বলল,
–“শুধু একজনের জন্য এরকম অনুভূতি আসলে তাকে ভালোবাসা বলে। কেন, কাউকে মনে ধরেছে নাকি?”

প্রণয়া থমকায়, চোখ কপালে তুলে ঘনঘন মাথা নেড়ে তুখোড় অস্বীকার করে বলল,
–“একদম না। কীসব যে বলছ না তুমি!”

পিয়াসা তবুও হাসতে লাগল। প্রণয়া এতে অস্বস্তিতে পড়ে যায়। শেষমেষ কি না সে প্রেমে পড়ল, ভালোবেসে ফেলল নির্মলকে? কিন্তু কয়েকদিনের দেখা-সাক্ষাৎ এ এটা কী করে সম্ভব? পিয়াসা শুধু শুধুই ভয় দেখাচ্ছে তাকে।

নির্মল বলেছিল ছুটি হয়ে গেলে একা একা না ফিরতে। নির্মলই এসে তাকে নিয়ে যাবে। যদি সময়মতো পৌঁছাতে নাও পারে তবে অপেক্ষা করতে বলেছে। প্রণয়া নির্মলের কথার নড়চড় হয়নি। সে বাধ্য মেয়ের মতো ভার্সিটির গেটের বাইরে একপাশে দাঁড়িয়ে অপেক্ষা করছে নির্মলের। আশেপাশে পথে নজর বুলিয়ে নির্মলকে খুঁজছে। প্রেমে পড়লে নাকি অপেক্ষাও মধুর হয়। সেই মধুর অপেক্ষা যেন প্রণয়া উপলব্ধি করলেও সঙ্গে সঙ্গে মাথা থেকে ঝেড়ে ফেলল। বিরক্তিতে তার কপাল কুঁচকে যায়। পিয়াসাও না, প্রণয়ার কানে একদম বিষপোকা ঢুকিয়ে দিয়ে গেছে। এই বিষপোকার আরেক নাম প্রেম পোকা৷ এই মুহূর্তে বিষকেই তার মধুর লাগতে শুরু করেছে, কী বাজে অবস্থা!

ভার্সিটির সামনের রাস্তা অনেকটা বাজারের মতো। এখানে মুদি দোকান, পোশাকের, বিভিন্ন অলংকারের, খাবারের এবং খাতা-পত্রের দোকানে ঠাসা। মূলত ভার্সিটি বলেই এখানটা বেশ জাকজমক। অবশ্য দুই একটা টঙের দোকানও আছে। সেখানে প্রায় সব বয়সী পুরুষদের দেখা যায়। কেউ চায়ের কাপে আড্ডার আসর বসায় আবার পাহাড়ি বখাটে ছেলেরা মেয়ে দেখতে এদিক সেদিক ঘুরে বেড়ায়।

প্রণয়ার সামনে হঠাৎ এক ত্রিশের উর্ধ্বে বয়সী লোক এসে দাঁড়ায়। পানের প্রভাবে দাঁত লাল করে ফেলেছে একদম। সেই দাঁত বের করে হেসে বলল,

–“প্রথম দেখাতেই মনটা কাইড়া নিছিলা, এহন সামনা-সামনি দেইখা মাথা নাড়াচাড়া দিয়ে উঠছে। আছ কিমুন ময়না?”

প্রণয়ার গা ঘিনঘিন করে উঠল এই লোকের অসৎ চাহনি দেখে। অসৎ চিন্তা-ভাবনার সাথে বাজে মন্তব্যও। প্রণয়ার ভয়ে মুখ ছোটো হয়ে গেল। কোনোরকমে পা চালিয়ে লোকটার দৃষ্টি সীমানার বাইরে যাওয়ার চেষ্টা করল। লোকটা প্রণয়ার পিছু নেয়নি, একই জায়গায় দাঁড়িয়ে দাঁত কপাট বের করে প্রণয়ার যাওয়ার পানেই চেয়ে আছে সেই লোক।

প্রণয়া কিছুটা পথ এগিয়ে গেল। আশেপাশে নির্মলকে খুঁজতে খুঁজতে হাঁটতে লাগল। এই পথ ধরেই নির্মল আসবে। তাই নির্মল আসলে তাকে অবশ্যই সে দেখতে পাবে। হলোও তাই। মিনিট দুয়েকের মাঝে নির্মল অটো নিয়েই আসছিল। পথে প্রণয়াকে দেখে সে অটো নিয়েই থামল। অটো থেকে নেমে প্রণয়ার সামনে গিয়ে দাঁড়াল সে। চিন্তিত গলায় প্রশ্ন করল,
–“এ কী প্রণয়া? আপনাকে না বললাম কলেজের বাইরে দাঁড়িয়ে আমার জন্য অপেক্ষা করতে? হেঁটে আসলেন কেন এই অবধি?”

প্রণয়া শুকনো হাসি দিল। নির্মলের চোখ জোড়া প্রণয়ার সুরক্ষা জানান দিচ্ছে। পুরুষে, পুরুষে কতটা ভিন্নতা। কেউ নারীকে দেখে কামনার চোখে আর কেউ নারীকে দেখে সম্মানের চোখে। নির্মলের চোখে উজাড় করা সুরক্ষা, ভরসা দেখে প্রণয়া কিছুক্ষণ আগের ঘটনা ভুলে গেল। সত্য চেপে মিনমিন করে বলল,
–“শরীর ভালো লাগছিল না। তাই কিছু পথ এগিয়ে এসেছি।”

নির্মল আর কথা বাড়ায় না। গলা খাদে নামিয়ে প্রণয়াকে রিকশায় উঠতে বলল। প্রণয়াও কথা না বড়িয়ে উঠে বসে। এবার নির্মল পাঁচ সিটের অটো এনেছে। তাই দুজনে প্রায় মুখোমুখি-ই বসে বাড়ির পথে রওনা হলো।

চলবে—

একটি উত্তর ত্যাগ

আপনার মন্তব্য লিখুন দয়া করে!
এখানে আপনার নাম লিখুন দয়া করে