‘আকাশ তীরে আপন সুর’
|পর্ব ০৫|
লাবিবা ওয়াহিদ
সেদিনের পর থেকে ফাহিমা যেন অঘষিত এক দায়িত্ব দিয়ে দিল প্রণয়াকে। সেটা হচ্ছে, নির্মল আসলেই তাকে নাশতা দিয়ে আসবে প্রণয়া। হলোও তাই। প্রণয়া দাঁতে দাঁত চেপে মায়ের আদেশ মেনে নিল, আর ফাহিমা তখন টিভির শব্দ কমিয়ে নিজের মতো করে সিরিয়াল দেখতে বসেন।
প্রণয়া অবশ্য একটা ব্যাপার লক্ষ্য করেছে। সে প্রায় যে-বারই নাস্তা নিয়ে গিয়েছে প্লাবন সেবারই মুখস্থ পড়া দিচ্ছে। যার ফলস্বরূপ প্রণয়া তার পড়ায় ব্যঘাত না ঘটিয়ে অপেক্ষা করত তার পড়া শেষ করার। অপেক্ষা করতে গিয়ে সে নির্মলের দিকে আনমনে চেয়ে থাকে৷ প্লাবনের পড়া শেষ হতে হতে চা ঠান্ডা হয়ে যায়, আর প্রণয়া প্রতিবারের মতো ছুটে গিয়ে ঠান্ডা চা গরম করে আনে। এতে প্রণয়া বিরক্ত হয়। এজন্য দুইদিন সে চায়ের বদলে ট্যাঙের সরবত দিয়েছে। আর চা নিয়ে গেছে নির্মল আসার পরপরই। তবে প্রণয়া একটা বিষয় লক্ষ্য করেছে। তার চোখ জোড়া বারবার নির্মলের দিকে চলে যায়। চোখ জোড়াও বুঝি আজকাল কথা না শোনার পণ করেছে? প্রণয়া খিঁচে চোখ বুজে চোখ জোড়াকে শাসায়,
“এত অবাধ্য কেন তোরা?”
চোখ জোড়া তবুও অবাধ্যপণা ছাড়েনি। এজন্য নির্মল আসলেই প্রণয়া নিজের ঘরে গিয়ে বসে থাকত। তাতেও কাজ হত না। তখন বুকের ভেতরটা কেমন জৈষ্ঠ্যের তপ্ত দুপুরের ন্যায় খাঁ খাঁ করতে লাগে। বুকজুড়ে হাহাকার, ব্যাকুলতা আর চোখ জোড়ার অঢেল তৃষ্ণা। এই লক্ষণগুলো আজকাল ভীষণ অস্বস্তিতে ফেলছে প্রণয়াকে। অনুভূতিগুলো প্রণয়ার জন্যে সম্পূর্ণ নতুন এবং অদ্ভুত। এজন্য সে অনুভূতিগুলোর ঘাড় ধরে তাদের নাম জানতে পারছে না।
আশেপাশে এমন কেউ-ও নেই যার সাথে ভেতরে চেপে রাখা কথাগুলো প্রকাশ করতে পারবে। কারো সাথে বললে হয়তো এর সমাধান হতো? অস্থিরচিত্তে ঘুরে বেড়ানো প্রণয়ার হঠাৎ শুক্রবারে দাওয়াত পড়ল নির্মলদের বাসায়। অবশ্য প্রণয়া একা নয়, তার পুরো পরিবারের। নুহাশ সাহেবও সেই দাওয়াত হাসিমুখে গ্রহণ করলেন।
আজ জুম্মার দিন, তাইতো নুহাশ সাহেব সকাল সকাল মজিবকে পাঠালেন তাদের স্থানীয় বাজারে, ভালো দেখে ফল-মূল এবং মিষ্টি দই আনার জন্য। নুহাশ সাহেব সবসময়ই দু’হাত উজাড় করে উপহার দিতে পছন্দ করেন। কারো বাসায় দাওয়াত পড়লে তো কোনো কথাই নেই। হাত ভরে উপহার নিয়ে তবেই দাওয়াতে যান। ব্যাপারটা অনেকের কাছে যেমন দৃষ্টিকটু, তেমনই অবাকের।
অবশ্য একদিক দিয়ে চা বিলাসের সদস্যরা ভাগ্যবান কিংবা ভাগ্যবতী। আশেপাশে পিঠ-পিছে সমালোচনা করার মতো কোনো প্রতিবেশি নেই। দূর দূরান্ত অবধি বাড়ি-ঘরও দেখা যায় না। যতদূর চোখ যায় শুধু সবুজে রাঙানো চা বাগান। আবার অন্য দিক দিয়ে নুহাশ সাহেবের একটাই আফসোস, প্রতিবেশি কিংবা সেরকম আত্নীয় আশেপাশে না থাকায় তিনি দু’হাত ভরে বাজার করতে পারেন না। এবার অবশ্য ভাগ্য সহায় হলো তাঁর। নিজের মতো আপ্যায়ন করার মতো নীলুফাকে এবং নির্মলকে পেয়েছেন।
দুপুরের দিকে গোসল সেরে ভেজা চুল পিঠময় ছড়িয়ে প্রণয়া বসে ছিল ঝুল বারান্দায়। মূলত রোদ পোহানোর উদ্দেশ্যেই সে বারান্দায় এসে বসেছে। একটু আগেই গামছা দিয়ে চুলের পানি ছাড়িয়েছে। এখন ভেজা চুল নরম বাতাসে মৃদু উড়ছে। কিন্তু এসবে প্রণয়ার ধ্যান নেই। সে এক নজরে চেয়ে আছে অদূরে। এক জোড়া পাখি অদূরে চায়ের পাতার মাঝে খুনশুঁটিতে মেতেছে। দৃশ্যটা চমৎকার লাগল তার চোখে। পরপরই মস্তিষ্কে হানা দিল নির্মলের চশমা পরা কিংবা চশমা ছাড়া স্নিগ্ধ মুখ। যার ফলস্বরূপ প্রণয়ার কপালে ভাঁজ পড়ল। সেই ভাঁজে বিচরণ করছে বিরক্তি।
এখন জুম্মার সময়। বাড়িতে মা, মেয়ে ব্যতীত আর কেউ নেই। বাকিরা সবাই নামাজের জন্য মসজিদে গিয়েছে। নিচ থেকে ভেসে আসছে ফাহিমার ডাক। ফাহিমা উঁচু গলায় প্রণয়াকে বারবার তৈরি হতে বলছেন। প্রণয়া তৈরি না হলেও মায়ের ডাকে নিচে গিয়ে সোফায় বসে থাকল। তা দেখে ফাহিমা বিরক্ত হয়ে রান্নাঘরে চলে গেলেন। সময় কেটে যেতে লাগল। এর মাঝে হাজির হলো নুহাশ সাহেব এবং প্লাবন। তাদের পেছন পেছন এসেছে মজিব। নুহাশ সাহেব এসেই তাড়া দিয়ে বললেন,
–“দ্রুত চলো। আপা হয়তো অপেক্ষা করছেন।”
ফাহিমা মেয়ের নামে নালিশ করতে চেয়েও করলেন না। প্রণয়াও সেই সুযোগ না দিয়ে বলল,
–“তোমরা আগে আগে যাও। আমি পিছেই আছি।”
ফাহিমা প্রণয়ার হাতে তালা দিয়ে বললেন,
–“প্লাবন। বোনের সাথে আসবে।”
প্লাবনের কপাল কুচকে গেল মায়ের কথা শুনে। নুহাশ সাহেবও সম্মতি জানিয়ে বললেন,
–“হ্যাঁ, তাই ভালো। মেয়েকে তো একা রেখে যেতে পারি না। ফাহিমা, মজিব চলো। আমরা বরং আগেই যাই। পথে আবার নির্মলকেও দেখলাম না৷ আগে আগে চলে আসল নাকি?”
নুহাশ সাহেব প্লাবনকে প্রণয়ার কাছে রেখে বাকিদের সাথে নিয়ে চলে গেলেন। মজিবের মুখে আজ তৃপ্তির হাসি। ভালো-মন্দ খাবারের ডাক পড়লে কোন মানুষ অখুশি থাকবে?
প্লাবন প্রণয়ার সামনে এসে দাঁড়াল। নিজের পেটের দিকে তর্জনী দেখিয়ে বলল,
–“আমার পেটটা কতটা গুড়গুড় শব্দ করছে তা কী জানো আপু? ভেজা কাপড়ের মতো মুঁচড়াচ্ছে খুদায় আর তুমি এখানে এখনো বসে আছ? কেন? বসে থাকার ইচ্ছে হলে একাই বসে থাকতে, আমাকে সঙ্গে নিয়ে কেন বসতে হবে? তোমার পেট না থাকলেও আমার আছে।”
প্লাবনের এলোমেলো কথায় চোখ রাঙায় প্রণয়া। কিন্তু প্লাবনের খুদার দম বেশি। প্রণয়ার চোখ রাঙানোতেও কাজ হলো না। কিছুক্ষণ অতিবাহিত হতেই প্রণয়া ফোঁস করে নিঃশ্বাস ফেলে বলল,
–“বাইরে যা। আমি আসছি!”
প্লাবন খুশিতে গদগদ হয়ে দ্রুত চলে গেল বাইরে। কিছু সময় পরপর আবার ডাকছে প্রণয়াকে।
–“ও আপু, হয়েছে তোমার? আর কতক্ষণ? যাবা নাকি আমি একা চলে যাব?”
প্রণয়া মূলত বসেছিল চুল শুকানোর জন্য কারণ ভেজা চুল বাঁধা সম্ভব না। আবার চুল না বাঁধলেও ওড়নার নিচে দিয়ে চুল বেরিয়ে থাকবে যা প্রণয়ার ভীষণ অপছন্দের। এখন প্লাবনের তাড়াতে প্রণয়ার এই অপছন্দের কাজটাই করতে হচ্ছে। যথাসম্ভব চেষ্টা করল ভেজা চুল ওড়নার আড়ালে রেখে বেরিয়ে গেল। প্রণয়ার সদর দরজায় তালা লাগানোর সময় প্লাবন নিজেই চলে গেল। এখান থেকে এখানে মাত্র এক মিনিটের পথ, এটুকু নিশ্চয়ই প্রণয়ার সঙ্গে আসতে হবে না। প্রণয়া তালার দিকে চেয়েই বলল,
–“প্লাবন, নড়বি না কিন্তু। একসাথে যাব।”
কিন্তু পেছন থেকে কোনো সাড়া এলো না। আসবে কী করে যদি না সাড়া দেওয়ার কেউ না থাকে? প্রণয়া তালা লাগিয়ে পিছে ফিরতেই দেখল প্লাবন নেই। প্রণয়ার কিছুটা রাগ হলেও সে নিজেকে সামলে নেয়। সিঁড়ির এক ধাপ পার হতেই নির্মলকে দেখল সবে সে চা বিলাসে প্রবেশ করছে। হাতে তার কিছু ফলের প্যাকেট।
প্রণয়াকে দেখামাত্রই নির্মল স্মিত হাসল। নির্মল সাদা পাঞ্জাবি এবং কালো এক টুপি পড়েছে। কেন জানি না নির্মলকে চোখের সামনে দেখেই প্রণয়ার বুকের বা পাশটা অস্বাভাবিক ঢিপঢিপ শব্দ তুলছে। এতে সে অপ্রস্তুতবোধ করল। নির্মল এগিয়ে আসতে আসতে বলল,
–“এখন যাচ্ছেন নাকি? তবে একা কেন?”
প্রণয়া এবার নড়াচড়ার শক্তি পেল। সে নির্মলদের বাসার দিকে পা বাড়িয়ে বলল,
–“আমি একটু পরেই বের হলাম।”
প্রণয়া জানত নির্মল ফিরেনি। কিন্তু নির্মলের ফেরাটা যে প্রণয়ার বের হওয়ার সঙ্গে সঙ্গেই হবে কে জানত? নির্মল বলল,
–“আচ্ছা ঠিক আছে। এখন আমার সঙ্গে আসুন।”
দুজন পাশাপাশি, পায়ে পায়ে ধাপ মিলিয়ে হাঁটছে। প্রণয়া এতে কেন যেন স্বস্তি, অস্বস্তির মিশ্র অনুভূতিতে জড়িয়ে গেল। নির্মলকে নিয়ে এক নিষিদ্ধ অনুভূতিও অনুভব করল সে।
প্রণয়া হঠাৎ প্রশ্ন করতে চাইল, “আপনি কেন আমায় ‘আপনি’ সম্বোধন করেন? প্রথমদিন ছোটো নই বলায়?”
কিন্তু আফসোস প্রণয়া উচ্চারণ অবধিও করতে পারল না সেসব। তবুও অন্যকিছু জিজ্ঞেস করল,
–“ফিরতে দেরী হলো যে?”
–“মসজিদ থেকে বেরিয়ে একটু বাজারে গিয়েছিলাম। এজন্যই ফিরতে একটু দেরী হলো। তবে আপনাকে দরজার মুখে দেখে মনে হলো না আহামরি দেরী করেছি।”
শেষ কথাটা বলে নির্মল শব্দহীন হাসল। আর প্রণয়ার কান তখন অকারণে গরম হয়ে রয়। অথচ প্রণয়ার কান জোড়া ভেজা চুলে লেপ্টে ছিল। যার ফলস্বরূপ সে চুপসে গেল। নির্মল একপলক তাকাল প্রণয়ার দিকে। প্রণয়ার ভেজা চুল মুখের দু’ধারে অল্প বিস্তর বেরিয়ে আছে। মুখ জুড়েও তার স্নিগ্ধতার রেশ। নির্মল চোখ ফিরিয়ে নিল। চলে এসেছে তারা।
~ চলবে