“আকাশী” পর্ব ২৪.

0
1268

“আকাশী” পর্ব ২৪.
ছাদের আশেপাশের গাছপালাকে দেখে মনে হচ্ছে, এইমাত্র তারা অন্ধকারের কোল থেকে উঠে এসেছে। এখন প্রস্তুতি নেবে সূর্যের দেওয়া রোদ গায়ে মাখার। এই পরিবেশে ছাদের এককোণে বসে ড্রয়িং করলে মন্দ হয় না। পরিবেশ, শব্দটা কতদিন পরই না মাথায় এসেছে। এতদিন জীবনের কিছু বিভীষিকার চাপে যেন মনের অতলে এর ছোঁয়া ডুবেই ছিল। জীবনের কিছু শিক্ষা পাওয়ায় আর ওই তালগাছের পাশের পুকুরে যাওয়া হয় না। রাত-বেরাত ক্ষেতের পাশের নির্জন জায়গায় ঘুরা হয় না। এসবই ছিল তার মনের একমাত্র খোরাক। আজ এতো এতো মাস এসবের কাছ থেকে দূরে থেকেও মন কেন যেন একবারও এদের কথা মনে করার অবকাশ পায়নি।
অনার্সে ভর্তি হওয়ার আগের ঝড়ঝাপটাই অধিকাংশ দায়ী। কিন্তু এর পরে যেন তার নতুন জন্ম হয়েছে। আগের মতোই তার জীবনে হস্তক্ষেপ করার কেউ নেই। তার জীবনের আবহ পাল্টানোর কেউই নেই। এই তো চায় সে। সবকিছু স্বাভাবিক হওয়ার পরও সে ওই নির্জন রাস্তা বা দাগহীন আকাশ কিংবা খামারের সামনের পুকুরের পাড় কারো সাথেই কথা বলতে যায় না। তাদের সাথে স্ব আত্মীয়তার বন্ধন ছিন্ন করেছে। অথচ তাদের কোনো দোষই ছিল না। প্রকৃতির পরিবেশ তো তার কোনো ক্ষতি করেনি। কেবল কিছু মানুষের কাজের জন্যে আজ পর্যন্ত পরিবেশকেই দোষারোপ করে এসেছে।
বন্ধুত্ব স্বেচ্ছায় ভেঙে কেউ কোন মুখে পুনরায় বন্ধুত্ব ভিক্ষা চাইতে যায়! সেও পরিবেশকে নিজের মুখ দেখাতে পারছে না। সে ভুলেই গিয়েছে, একসময় সবধরনের দুঃখ সে তাদের সাথে শেয়ার করতে গিয়েছিল। এরপর একদিন অপূর্ব ঘনিষ্ঠ হতে চাওয়ায় সে ওই পরিবেশের কর্তৃত্বকেই ভুলে গেছে। নিজ ভুল বুঝতে পেরে পরিবেশের কাছে ফিরে যেতে চাইলে তার জীবনে নেমে আসে ঘন কালচে মেঘের দুটো খণ্ড। একটা রহিম, আরেকটা এরশাদ। দু’জনই আকাশীকে সম্পূর্ণ পাল্টিয়ে দিয়েছে। বিমুখতা সৃষ্টি করেছে প্রকৃতির প্রতি। আজ তার জীবনে কোনো মেঘ নেই। তবু প্রকৃতির পরিবেশের কাছে ফিরে যাওয়ার সাহস হচ্ছে না। তারা কি আর তাকে গ্রহণ করে নেবে? কেন নেবে? সে সবসময় কেবল নিজের স্বার্থের জন্যে তাদের দ্বারে গিয়েছে। কোনো দোষ না থাকলেও সে তাদের দোষী সাব্যস্ত করে দূরে ঠেলে দিয়েছে। তারা কোন উদারতায় তাকে আপন করে নেবে! কিন্তু মনটাও অনেক বড় স্বার্থপর। বারবারই সেই প্রকৃতির কাছে ফিরে যাওয়ার চেষ্টা করছে, যার জন্য সে যোগ্য নয়।
নিজেকে আকাশী দূরে রাখছে। কিন্তু তা বড়ই কষ্টদায়ক। ভর্তির শুরুর সময় হওয়ায় এখন পড়ার চাপ তেমন একটা নেই। মনের ভেতর শূন্য শূন্য একটা আমেজ তাকে বিরক্ত করে তুলছে। কিছু করার জন্য মন সর্বদা ছটফট করে। এই কয়েকদিন বিগত জীবনের সবকিছুই ডায়েরিতে লিখেছে। তাও যেন হাতে অনেক অবসর পড়ে রয়েছে। সে পাড়া বেড়িয়েছে। তাতেও শান্তি নেই। কেননা তা পরিবেশের সাথে কথা বলা ব্যতীত অপূর্ণ। সে রোজ সকালে এদিক-ওদিক ঘুরতে থাকে।

এখনই জয়েন করুন আমাদের গল্প পোকা ফেসবুক গ্রুপে।
আর নিজের লেখা গল্প- কবিতা -পোস্ট করে অথবা অন্যের লেখা পড়ে গঠনমূলক সমালোচনা করে প্রতি মাসে জিতে নিন নগদ টাকা এবং বই সামগ্রী উপহার।
শুধুমাত্র আপনার লেখা মানসম্মত গল্প/কবিতাগুলোই আমাদের ওয়েবসাইটে প্রকাশিত হবে। এবং সেই সাথে আপনাদের জন্য থাকছে আকর্ষণীয় পুরষ্কার।

গল্পপোকার এবারের আয়োজন
ধারাবাহিক গল্প প্রতিযোগিতা

◆লেখক ৬ জন পাবে ৫০০ টাকা করে মোট ৩০০০ টাকা
◆পাঠক ২ জন পাবে ৫০০ টাকা করে ১০০০ টাকা।

আমাদের গল্প পোকা ফেসবুক গ্রুপে জয়েন করার জন্য এই লিংকে ক্লিক করুন: https://www.facebook.com/groups/golpopoka/?ref=share

অন্ধকার নেমে গিয়ে সূর্য দূর গগনে উঠতে শুরু করলে সকাল এক সদ্য জন্মা শিশুর মতো নিষ্পাপ দেখায়। বাংলায় নাতিশীতোষ্ণের মতোই একটি শব্দ থাকা উচিত ছিল, নাতিভোরাত। ভোরও নয়, রাতও নয়। এমন একটি সময়ে সে আজকাল মনকে শান্তি রাখতে বেরুয়। সেখানেও যেন লুকিয়ে রয়েছে প্রকৃতির সাথে কথা বলার প্রবণতা। দু’একদিন এভাবে চলতেই সে তার দুর্বলতা অনুভব করল। পরক্ষণে নিজেকেই বলল, এ থেকে দূরে থাকতে হবে। কিন্তু তা হয়ে উঠছে না। ঠিক ওই সময়ই ঘুমটা ভেঙে যায়। কী করবে ভেবে না পেয়ে সে নিজেকে ব্যস্ত রাখার কথা ভাবল। ভাবল সে সময় ড্রয়িং নিয়ে বসলে মন্দ হয় না। প্রতিবারই সে ড্রয়িং করতে বসলে মনটা আনচান করে, না, ঘরের ভেতর আঁকতে ভালো লাগছে না। বাইরে যাওয়া উচিত। বাইরের টানে ছাদে আসা। ছাদে আসার মাধ্যমে আবারও প্রকৃতির সাথে কথা বলতে চাওয়া। কি অসহনীয়! তাহলে প্রকৃতি সম্ভবত তাকে কাছে ডাকছে। তাদের তো আর স্বার্থ থাকে না। তাদের অভিমান থাকে না। পীড়িতকে তারা সাগ্রহে আপন করে নিতে পারে। আবার সে ফল ভোগ করেও শোকর না করলে তারা গায়ে মাখে না। এখন আকাশের এক জায়গায় সূর্যকে দেখা যাচ্ছে। সবে সে তার মিষ্টি রোদ ছড়াতে শুরু করেছে। বহুদূরের আকাশে দুটো চিল বৃত্তাকার ভাবে উড়ছে। এইতো, সে আবারও প্রকৃতির রূপের দিকে ঝুঁকে পড়েছে। না, আর দূরত্ব রাখা ঠিক না।
আকাশী অর্ধেক আঁকা ছবি ফেলে নতুন পাতায় প্রকৃতির রূপ আঁকতে শুরু করল। এটাই সর্বোৎকৃষ্ট পন্থা প্রকৃতির কাছে পুনরায় বন্ধুত্বের আবেদন করার। আঁকতে আঁকতে রোদ প্রখর হলো। কিছু একটা ঝাপ্টানোর আওয়াজ পেলে সে পেছনে ফিরে দেখল, তাদের সামনের ছাদে সালমা কাপড় শুকাতে দিচ্ছে। সে হয়তো ফিরে তাকাবে না। কিন্তু তাকে অবাক করে দিয়ে সালমা তার দিকে তাকিয়ে হাসি বিনিময় করল। সালমা পাল্টে গেছে নাকি? তার ভাব আজ কোথায়? আকাশী দীর্ঘশ্বাস ফেলে। সবাই ক্ষণে ক্ষণে পাল্টাতেই পারে। এতে দোষের কিছু নেই। ‘আকাশী…’ এবার সালমার ডাক শোনে সে ঝট করে পেছনে ফিরল। সে তাকে ইশারায় ছাদের অপরপ্রান্তে ডাকছে। ওই জায়গা থেকে সালমাদের ছাদের দূরত্ব খুবই কম। ভদ্রতার খাতিরে আকাশী খাতা রেখে ছাদের সামনের প্রান্তে গেল।
‘কেমন আছ?’
‘এইতো আছি। এখন কিসে পড়ছ তুমি?’
‘ভুলে গেলে নাকি? আমি তোমারই সমবয়সী সালমা।’
‘ওহ্, মাইন্ডে ছিল না। আমি সোশিয়লজিতেই পড়ছি। গ্রামে এলে তোমার কথা অনেক শুনি। যথেষ্ট ফেমাস তুমি।’
‘ওরকম কিছু না। আমাকে লজ্জিত করছ।’
‘তা কী করছিলে?’
‘ড্রয়িং।’
‘তোমার মেধা দেখি কম নয়।
আসলে ডিসেম্বর হিসেবে বেড়াতে এসেছি। মা আরও কিছুদিন থাকার জন্য জোর করছেন। একা একা দম ঘুটে আসছে। তারপর তোমার কথা মাথায় এলো। তুমি তো পাড়া বেড়াও। যদি আমাকে সঙ্গী করো, তবে আমার একাকীত্ব গুছবে।’
‘আচ্ছা, দেখি।’
আকাশী মনে মনে অস্বস্তি বোধ করে। সে সবসময় একাই বেড়াতে পছন্দ করে। বন্ধু তার তেমন পছন্দের না। আবার কারো মুখের ওপর না বলে দেওয়াও তার স্বভাবে নেই। তবে সালমা তো বেশিদিন থাকছে না। কাজেই সঙ্গী করা যেতে পারে।
কথাবার্তা শেষে সে নিচে ফিরে এলো। নাস্তা করে সে রান্নাবান্না করতে যায়। রোকসানা সমস্বরে কোরআন তেলাওয়াত করছেন। মাঝের ঘর থেকে তিনি আকাশীকে ডাকলেন। সে এসে বলল, ‘মা ডেকেছেন?’
‘হ্যাঁ। রান্না আরও দুজনের জন্য কর। তোর মামা নানুকে নিয়ে আসছে।’
‘নানু? হঠাৎ?’
রোকসানা কোরআন শরীফ অর্ধেক বন্ধ করলেন, ‘তুই কি তোর মামির বাসায় থেকে পড়াশোনা করতে পারবি? ওখান থেকে কিন্তু তোর কলেজ খুব কাছে। তাছাড়া শাহানা যে বিল্ডিং-এ থাকে, সেখানের নানা স্টুডেন্টকে পড়াতে পারবি।’
প্রস্তাবটা শোনে তার মন লাফিয়ে উঠে। এতদিন একটা সমস্যাই তাকে তাড়া করছিল। এখান থেকে এতো দূরে কলেজে গিয়ে পড়াশোনা খুবই কষ্টকর। স্কুলে থাকতে মৃত্যুঞ্জয় স্যার বলতেন, জ্ঞান সমৃদ্ধির জন্য পড়াশোনার পাশাপাশি টিউশনি করা উচিত। কিন্তু বাড়িতে পড়ানোর মতো কাউকে পায়নি। যদি শহরে যায়, তবে দুটো মেইন প্রবলেমই সলভ হয়ে যাবে। তাছাড়া এই গ্রামে থাকতে থাকতে কেমন এক একঘেয়েমি ভাব চলে এসেছে। নতুন জায়গায় যাওয়ার প্রবণতা তার মনের কোনো এক কোণে উহ্য ছিল। আজ মায়ের প্রস্তাব শোনে, সে তার প্রয়োজন বোধ করছে। সে ঝটপট হ্যাঁ করে দেয়। একটু পর মামা নানুকে নিয়ে আসবেন। বিকেলের দিকে মামা চলে যাবেন।
রোকসানা বললেন, ‘তুই যাই ইচ্ছা হয় তাই কর। তোর টাকায় আমার কিছুই ভালো লাগে না। মা এখানে চলে এলে ভাইয়া তাঁর ওষুধসহ খরচার পাশাপাশি আমার জন্যও টাকা দেবে। সে টাকায় দু’জনের চলে যাবে। কিন্তু ভাইয়া বললেন, তোর মামাতো বোনকে বাসায় থেকে পড়াতে। এতে সবারই লাভ হবে। তুই না গেলে ভাইয়া আমার জন্য টাকা দিতে চাইবেন না। মনে করবেন, মেয়ের টিউটর হিসেবে তোকে চাইছে, আর আমি কিনা তার প্রয়োজন মেটাতে পারিনি। তাই তুই যথাশীঘ্র চলে যা ওখানে।’
‘আচ্ছা।’
তার প্রতি মায়ের মনে এখনও অপ্রকাশিত একটা ক্ষোভ আছে দেখে খারাপ অবশ্য লেগেছে। কিন্তু মায়ের অবহেলা তার জন্য নতুন কিছু নয়। নানু তাকে পছন্দ করেন না। তার ভবঘুরে হওয়ার কথা তাঁর কানে পৌঁছাতে দেরি লাগেনি। সেই এগারো বছর বয়সে তাঁকে দেখেছিল। এরপর তিনি শহরে থাকতে শুরু করেন। মা তাঁকে দেখতে গেলেও আকাশীকে যেতে নিষেধ করে দিতেন। তিনি এখনও সেই পুরনো প্রথা মান্যকারী লোক। ওর পড়াশোনাও তাঁর পছন্দ নয়। স্পষ্টতই তাঁকে মামা নিয়ে এলে তাঁর সাথে চলে যাওয়ার কথা মা অস্পষ্ট ভাবে বলছেন। তার নিজেরও এতে আপত্তি নেই। যে-লোক ভাবে, সমাজকে সংযত হতে না বলে নিজেকেই গুটিয়ে রাখা একান্ত কর্তব্য, তার পরশ সে সহ্য করতে পারবে না। তাছাড়া সে সবসময় নিজের মনের কথা শোনে এসেছে। আরেকজনের চিন্তার হস্তক্ষেপ তার মোটেই পছন্দের নয়। তার কাছে মনে পড়ে যায় স্কুলের দিনের কথা। বাবার যেদিন অ্যাক্সিডেন্ট হয়েছিল, সেদিন মন বলছিল কিছু একটা পরিবর্তিত হতে চলেছে। সেদিন হয়তো আজকের দিনের ইঙ্গিতই সে পেয়েছিল।
এখন তাকে অন্য কোনো জায়গার পরিবেশ ডাকছে, বন্ধুত্ব করার জন্য। এই জায়গার পরিবেশের বন্ধুত্ব সে কখনই ভুলবে না। ভুলবে না এখানের নিস্তব্ধ পরিবেশের মনোরম জায়গাগুলো। তাকে এগুলো ছেড়ে যেতে হবেই। অনেকদিন থেকেছে এদের সাথে। এরাও তাকে ভুলবে না। কিন্তু তাকে সবার কাছ থেকে বিদায় নিতে হবে।
অল্পক্ষণ পর নানুরা এসে যায়। দুপুরের দিকে খাওয়া-দাওয়া সেরে সে তার স্যুটকেস গুছিয়ে রেখে বেরিয়ে পড়ে। প্রথমে যাবে অনিকের মায়ের কাছে। আবার মনে পড়ল, সালমা তাকে সঙ্গী করতে বলেছিল। যাক, দুই কাজ একসাথে করা যাবে। সে অনিকের মায়ের কাছে বিদায় নিয়ে সালমাকে নিয়ে বেরিয়ে পড়ে। সে সত্যিই অনেক পাল্টে গেছে। আগে যে একগুঁয়ে ভাব তার মাঝে থাকত, তা এখন আর নেই। মন খুলে কথা বলছে সে। দুপুর গড়ানোর আগে আকাশী বাড়ির যাবতীয় লোকের কাছ থেকে বিদায় নেয়। তারপর সালমাকে নিয়ে বাড়ির পাশের ক্ষেতের মাঝখানের রাস্তা ধরে।
‘আমরা এখন কোথায় যাচ্ছি?’
‘আমার কিছু বন্ধুর সাথে দেখা করতে হবে। কথা বলতে হবে।’
‘বাপরে! তোমার কতগুলো বন্ধু আছে বলো তো! আমি তো বাড়িতে অতটা ঘরও চিনি না, যতটা না তুমি ঘরগুলোর মানুষের সাথে আত্মীয়তা রেখেছ।’
‘জীবনের প্রতি ধাপে দেখে এসেছি, পরেরাই অনেক আপন। তাদের সাথে রক্তের সম্পর্ক না থাকলেও একটা ভিন্ন ভালোবাসার বন্ধন তৈরি করা যায়। নিজেকে ঠিক রাখলে সে বন্ধন আজীবন অটল থাকে।’
আকাশীরা পুকুরের পাড়ে চলে এলো।
‘কোথায় তোমার বন্ধু?’
‘এই জায়গার প্রতিটি জিনিস আমার বন্ধু। তার উপরের আকাশটা আরও অন্তরঙ্গ।’
‘অদ্ভুত! আমি এই জায়গার প্রতি তোমার ভক্তিত্বের কথা শুনেছিলাম।’
‘কার কাছে?’ আকাশী অবাক হয়।
‘অপূর্ব ভাইয়ার কাছে।’
আকাশী এবার নিস্তব্ধ হয়ে গেল। তার জীবনের শুরুর পরিবর্তন এই লোকটির হাত ধরেই হয়েছে। যৌবনের স্পর্শকাতর একটা মুহূর্তেরও লোকটি সাক্ষী। তার দোষ কিছুটা থাকলেও জীবনের নানা উথাল-পাতাল আকাশীকে তার ভাবনা থেকে দূরে রেখেছিল। আজ সালমাই দূরত্ব কমানোর ভূমিকা রাখছে। সেদিন তার দোষ থাকুক কী না থাকুক তার হাত পুড়ে দেওয়া উচিত হয়নি। মনের দেয়ালে একে একে হওয়া এতদিনের দুঃখের শেওলার নিচে অপূর্বের জন্য জন্মানো বিদ্বেষটা চাপাই পড়ে গেছে। এখন শেওলা উঠার সাথে সাথে সেই বিদ্বেষটা উঠে যাওয়ার কথা সে টের পায়নি। পরিবর্তে কিছুটা মায়া জাগল তার জন্য। ইচ্ছে করছে, অপূর্বের কথা জিজ্ঞেস করে। কিন্তু সালমা কী ভাববে। পরক্ষণে সে নিজের বিবেককে বুঝায়, স্বাভাবিক ভাবে কথা বলতে তো কোনো বাধা নেই। একসময় অপূর্ব যখন তার জীবনে ছিল না, তখন যেভাবে প্রশ্ন করত, ঠিক সেভাবেই এখন করল, ‘উনি কেমন আছেন?’
সালমার চোখে কৌতুক, ‘তোমার সাথে কি উনার যোগাযোগ নেই?’
‘না। উনি এখানে থাকলেই তো দেখা হয়। উনার সঙ্গে বেশ কয়েকবার এই জায়গায় দেখা হয়েছে। তোমার সঙ্গে যোগাযোগ আছে?’
‘আমরা দুজনই সগন্ধায় থাকি।’ বলার সময় সালমার মুখ উজ্জ্বল দেখাল।
‘বলো কি! তবে তো রোজ দেখা হয়।’
‘তা বটে।’
‘কাকতালীয় ভাবে আমার মামার বাসাও ওখানে।’
সালমার মুখ মুহূর্তেই চুপসে গেল। কিছুটা ঈর্ষাও জন্মাচ্ছে। কেন যে বলতে গেল সুগন্ধায় থাকে! আবার আকাশীকে সন্দেহও হচ্ছে। ও মিথ্যে বলছে না তো! অপূর্বের মুখ ফসকে প্রায়ই আকাশীর নাম বেরিয়ে আসে। যদি যোগাযোগ না থাকে তবে কীভাবে সম্ভব? নিশ্চয় যোগাযোগ রেখেছে, ওদের মাঝে সম্পর্ক আছে। কিন্তু অপূর্ব লুকায় কেন? না, আন্দাজের ভিত্তিতে কিছুই বলা যায় না। পরীক্ষা করে দেখা যাক।
‘জানো, অপূর্ব ভাইকে রাতের বেলায় একবার বলেছিলাম আমার সঙ্গে ঘুরতে যেতে। তিনি পরিষ্কার না করে দিলেন। বললাম, রাতের বেলার আবহাওয়া খুবই ভালো। তিনি ধমকের সুরে কী বললেন জানো? বললেন, আকাশী, তুমি আর এই রাতের বেলার পরিবেশ আমার মোটেই পছন্দের না।’
সালমা যদিও একটি ঘটনার পরিপ্রেক্ষিতে এই ঘটনা বানিয়ে বলেছে। কিন্তু এটি আকাশীর কাছে সত্যই বোধ হয়েছে। সেদিনের রাতের ঘটনার পর তাকে অপছন্দ করারই কথা। সালমা ভাবল, যদি যোগাযোগ থাকে, তবে আকাশী ধরে ফেলতে পারবে তার আর অপূর্বের মাঝে রাগের কোনো সম্পর্ক যেহেতু নেই, অপূর্ব এমন রিয়েক্ট করেনি। আকাশীকে চিন্তা করতে দেখে সালমা নিশ্চিত হলো, সত্যিই তাদের মাঝে কোনো যোগাযোগ নেই। তবে তাদের মাঝে একটা দেয়াল উঠেছে। এজন্যই আকাশী বানানো ঘটনাটা শোনে কোনো প্রশ্ন করছে না। আর অপূর্বের কাছে আকাশীর নাম তুললেও সে ক্ষেপে উঠে। নিশ্চয় তাদের মাঝে গতবার মেলার সময় ঝগড়া-ফেসাদ কিছু হয়েছে। যাক, যা হয়েছে ভালোই হয়েছে।
(চলবে…)
লেখা: ফারিয়া কাউছার